‎বাঁ প্রান্ত ধরে বল নিয়ে ছুটছেন রাকিব হোসেন। তাঁকে আটকাতে মরিয়া ভারতের তিন ফুটবলার। কিন্তু পারলেন না। বক্সের পাশ থেকে তাঁর নিখুঁত পাস, ডান দিক থেকে দৌড়ে আসা শেখ মোরছালিন বলটা জালে ঠেলে দিয়েই রাকিবকে নিয়ে উদ্‌যাপন মাতলেন। ততক্ষণে ২২ হাজার দর্শকের চিৎকারে প্রকম্পিত পুরো জাতীয় স্টেডিয়াম।

গতকাল এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে ভারতকে হারানো সেই গোলের মুহূর্তটা চাইলেও ভুলতে পারবেন না রাকিব। কারণ, এটা তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পাস।‎

২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক রাকিবের। এর পর থেকে বহু জয়ের সাক্ষী হয়েছেন। জাতীয় দলের হয়ে ৪৯ ম্যাচে করেছেন ৬ গোল। পাশাপাশি ৫ গোলে সহায়তা।

‎কিন্তু গতকাল ভারতের বিপক্ষে যে গোল বানিয়ে দিয়েছেন সেটার গুরুত্ব তাঁর কাছে অনেক, ‘এই পাসটা আমার অনেক দিন মনে থাকবে। একটা গোল করার পর যতটা না ভালো লাগে, কাল ঠিক ততটাই খুশি লেগেছে।’

গোলের পর মোরছালিনের সঙ্গে উদ্‌যাপন রাকিবের.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের কৃষিতে

বাংলাদেশের কৃষি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশের কৃষিকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। বাড়তে থাকা তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরা—এসব দুর্যোগ কৃষকের জীবন ও কৃষি উৎপাদনকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।

বিগত দশকে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে কখনো অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়ে জমি তলিয়ে যায়, আবার কখনো দীর্ঘ খরায় ফসল নষ্ট হয়। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ত পানি কৃষিজমিতে ঢুকে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। এ কারণে ধান, পাট, ডাল, সবজি—সব ধরনের ফসল উৎপাদনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। লবণাক্ততার কারণে অনেক জায়গায় ঐতিহ্যবাহী আমন বা বোরো চাষই এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে প্রথমেই বাংলাদেশের অবস্থান। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও দূরবর্তী দ্বীপগুলোর নিকটবর্তী অঞ্চলে লোনাপানি প্রবেশ করায় সেসব অঞ্চলে উন্মুক্ত জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় ১০ দশমিক ৫৬ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমি লবণাক্ততার বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে এসব অঞ্চলের বিশাল পরিমাণ আবাদি জমি পতিত থাকছে।

শুষ্ক মৌসুমে নিয়মিত সামুদ্রিক জোয়ারের সঙ্গে ভূভাগের অনেক গভীরে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে নদীর পানিকে সেচের কাজে ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলছে। গ্যাস নির্গমন বাড়ার কারণে বায়ুমণ্ডল ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে ২০৩০ সাল নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক শূন্য ডিগ্রি, ২০৫০ সালে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সালে ২ সালে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। সম্প্রতি দেশে উষ্ণতা ও শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুই-ই ক্রমেই কমে আসছে।

বেশির ভাগ রবি ফসলেরই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া শীত মৌসুমে উষ্ণপ্রবাহ দেখা দিলে বেশি সংবেদনশীল ফসল, বিশেষ করে গমের ফলন হ্রাস পাচ্ছে। ধানের ক্ষেত্রে ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার ওপরে গেলে চিটার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে, যা ধানের ফলনকে কমিয়ে দেবে। উষ্ণতা বাড়ার কারণে গাছের প্রস্বেদনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অতিরিক্ত সেচের কারণে পানির অভাব হয়। শৈত্যপ্রবাহের কারণে আমের মুকুল নষ্ট হয় ও নারকেলের ফল ধারণ ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি ক্ষেত্রে বন্যা, খরা, লবণাক্ত, জলাবদ্ধতাসহ কৃষি পরিবেশের পরিবর্তনের কারণে জমির উর্বরতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সঙ্গে ফসলের উৎপাদনশীলতাও কমে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীভাঙনের কারণে প্রচুর উৎপাদনশীল জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছরই নদীর কূল ভেঙে অনেক কৃষিজমি, বসতি, স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এতে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এবং অনিশ্চিত জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় অতিবর্ষণের সময় উঁচু এলাকার উপরিভাগের উর্বর মাটি ধুয়ে ক্ষয়ে যায়, এ কারণে প্রায়ই ভূমিধস দেখা দেয়। ফলে এসব এলাকার মাটি ক্রমান্বয়ে উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ধীরে ধীরে ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। শুধু তা–ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো মরূকরণসহ জীববৈচিত্র্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঘটছে।

জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে রক্ষা করতে হলে সমন্বিত ও টেকসই কৃষিব্যবস্থার প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা, বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং অস্বাভাবিক তাপমাত্রা কৃষির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এ অবস্থায় কৃষকদের জলবায়ুসহিষ্ণু উন্নত জাতের ফসল চাষ করতে হবে, যাতে খরা বা অতিবৃষ্টি হলেও ফসল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। পাশাপাশি ফলনের বৈচিত্র্য বজায় রাখলে একটি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্য ফসল থেকে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়।

মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে মালচিং পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। কারণ, এটি মাটিকে শুকিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে এবং লবণাক্ত পানির ঊর্ধ্বগতি কমায়। আধুনিক সেচব্যবস্থা যেমন ড্রিপ ইরিগেশন বা স্প্রিংকলার ব্যবহার করলে কম পানি ব্যয় করেও বেশি ফলন নিশ্চিত করা যায়, আর পুকুর বা জলাশয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করলে সেচের সময় পানির অভাব কমে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা যেমন বৃক্ষরোপণ জলবায়ুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নো-টিল বা বিনা চাষপদ্ধতিও একটি কার্যকর কৌশল। কৃষিকে আরও নিরাপদ করতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবহার করা জরুরি। কারণ, সঠিক সময়ে ফসল রোপণ, কর্তন বা সংরক্ষণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো যায়। এ ছাড়া গবেষণা ও ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকের কাছে দ্রুত সঠিক তথ্য পৌঁছে দিলে তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আরও প্রস্তুত থাকতে পারেন।

এভাবে উন্নত প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি একত্রে কৃষিকে জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখার কার্যকর উপায় হতে পারে।

তানিয়া খান

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ