সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) সীমানা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাতীয় পরিবেশ কমিটির বৈঠকে সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের ভেতরে শিল্পের অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও পরিবেশবাদীরা বলছিলেন, শিল্পকারখানা সুন্দরবনকে সংকটে ফেলবে।

২০১৭ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় পরিবেশ কমিটির চতুর্থ সভায় ইসিএ এলাকার সীমানা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ওই কমিটির সভাপতি শেখ হাসিনা। বৈঠকের কার্যবিবরণীতেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এখন সেটি সামনে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, ওই সভার পর অবৈধভাবে গড়ে ওঠা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি নতুন করে এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) প্ল্যান্ট, সিমেন্ট কারখানা ও সিকদার গ্রুপের পাওয়ার প্যাক ইকোনমিক জোনের অনুমোদন দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।

জীববৈচিত্র্যের অসামান্য সম্ভার সুন্দরবনের পরিবেশগত ও বাস্তুতান্ত্রিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯৭ সালে একে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। তবে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠা, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নৌযান চলাচলসহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ জানিয়েছে সংস্থাটি।

সুন্দরবনকে রক্ষায় ১৯৯৯ সালে বনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বা ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্বাসমূলীয় এই বনের ইসিএর মধ্যকার মাটি, পানি ও বায়ুর বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়, এমন কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।

অবশ্য ইসিএর মধ্যে কোন কোন এলাকা পড়েছে, তা নিয়ে সংশোধিত ও চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয় ১৯ বছর পর—২০১৭ সালের জুন মাসে। সে অনুযায়ী সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার ১০ উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার ২৯৮ মৌজা ইসিএর অন্তর্ভুক্ত।

আগের সরকার সুন্দরবনকে রক্ষার বদলে শিল্প রক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল। দুর্নীতিপ্রবণ মানসিকতা থেকেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। শরীফ জামিল, সদস্যসচিব, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা 

দেখা যায়, তত দিনে সুন্দরবনের ইসিএ এলাকার মধ্যে বিভিন্ন শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে এবং ওঠার পর্যায়ে রয়েছে। বেশির ভাগ শিল্পকারখানার মালিক প্রভাবশালী। সরকারও সেখানে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে।

ইসিএ নিয়ে প্রশ্ন তুলে শিল্প অনুমোদনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ-প্রকৃতি সুরক্ষার যে সাংবিধানিক, আইনি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার আছে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সেগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে এ ধরনের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়েছে, কিন্তু কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়নি, অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলোর অনুমোদন বাতিল করে পরিবেশ সুরক্ষায় উদাহরণ তৈরি করতে পারে।’

কী হয়েছিল সভায়

জাতীয় পরিবেশ কমিটির মোট সদস্য ২৯ জন। এর মধ্যে অর্থ, কৃষি, স্থানীয় সরকার, পানিসম্পদ, পরিবেশ ও বন, ভূমি, খাদ্যসহ মোট ১০টি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা থাকেন সদস্য হিসেবে। এ ছাড়া ১৭টি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও তিনজন বাইরের মনোনীত প্রতিনিধি থাকেন কমিটিতে। সভায় বলা হয়, সুন্দরবন অঞ্চলে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এমন চাহিদার প্রেক্ষাপটে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবগুলো (শিল্পকারখানার ছাড়পত্র) অনুমোদন করা যেতে পারে বলে শেখ হাসিনাকে অভিহিত করা হয়।

সভার কার্যবিবরণীতে শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে বলেন, সুন্দরবনের ইসিএ এলাকার সীমানা ও মৌজা নির্ধারণ করে ২০১৫ ও ২০১৭ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি কিসের ভিত্তিতে করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। ইসিএ ঘোষণার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের যে পরিমাপ নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটির ভিত্তিও স্পষ্ট নয়। জারিকৃত মৌজার তালিকাটি নিয়ে তিনি (শেখ হাসিনা) অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ইসিএ তালিকাটি পুনরায় পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে জানান তিনি।’

সভায় লাল শ্রেণিভুক্ত (বেশি ক্ষতিকর) ট্যানারি, ডাইং, ওয়াশিং, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ও টায়ার পাইরোলাইসিস ছাড়া মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) এলাকায় নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।

জাতীয় কমিটির ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছউল আলম মণ্ডল। তিনি এখন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যেকোনো সভা প্রচলিত আইনের বাইরে যেতে পারে না। ওই সময় ‘এনভায়রনমেন্টাল কমপ্লায়েন্স’ (পরিবেশগত আইনকানুন) মেনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দূষণ রোধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, জানতে চাইলে রইছউল আলম বলেন, সব কটি বিষয় তাঁর মনে পড়ছে না। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইসিএ এলাকার পর্যালোচনা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কোনো কিছু জানাতে পারেননি তিনি।

তবে, পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, এরপর ইসিএর আর কোনো পুনর্বিবেচনা হয়নি। এতে বোঝা যায়, প্রভাবশালীদের অবৈধ শিল্পের অনুমতি দিতেই ইসিএ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ইসিএতে কোনো আপত্তির দিক থাকলে সরকার সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা পর্যালোচনা করত।

জাতীয় পরিবেশ কমিটির বৈঠকে ইউনেসকোর শর্ত মেনে সুন্দরবন এলাকার জন্য ‘কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের মে মাসে এসইএ সম্পন্ন হয়। যদিও সেটাকে সুন্দরবনবান্ধব না করার বদলে শিল্পবান্ধব করা হয়েছে উল্লেখ করে পরিবেশকর্মীরা জাতিসংঘের কাছে চিঠি দেন। 

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’র (ধরা) সদস্যসচিব শরীফ জামিল প্রথম আলোকে বলেন, আগের সরকার সুন্দরবনকে রক্ষার বদলে শিল্পরক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল। তারা পরিবেশ, জনজীবন, বাস্তুতন্ত্র রক্ষার মৌলিক সব শর্ত পাস কাটিয়ে সব মেগা প্রজেক্ট (বড় প্রকল্প) বাস্তবায়ন করেছিল। দুর্নীতিপ্রবণ মানসিকতা থেকেই এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। দুঃখজনকভাবে এখনো পরিবেশ-প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আদালতে গিয়েও লাভ হয়নি

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ‘সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন সুন্দরবনের ইসিএর মধ্যে গড়ে ওঠা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্ছেদ করা ও ছাড়পত্র না দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তালিকা করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্ছেদ করা এবং নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র না দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। এর পরের বছর পরিবেশ অধিদপ্তর একটি তালিকা আদালতে জমা দেয়। ওই তালিকায় ছিল ১৯০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে ২৪টি লাল শ্রেণির।

পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩-এ দূষণের মাত্রা অনুযায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘লাল শ্রেণি’র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করা বাধ্যতামূলক। ইআইএর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারণে পরিবেশের ওপর কী কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে, তা চিহ্নিত করা যায়। সম্ভাব্য সেসব ক্ষতি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিককে। অন্য তিন শ্রেণি হলো ‘সবুজ’, ‘হলুদ’ ও ‘কমলা’।

ইসিএর মধ্যে থাকা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ছাড়পত্র না দেওয়ার আদেশের পর আদালতে যায় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী। জাতীয় পরিবেশ কমিটির সভার সিদ্ধান্তের আলোকে সেসব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সিকদার গ্রুপের পাওয়ার প্যাক ইকোনমিক জোনকে ছাড়পত্র দেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে পরিবেশ অধিদপ্তর। লিভ টু আপিল নিষ্পন্ন হওয়ার আগেই ২০২০ সালে অবস্থানগত ছাড়পত্র পায় পাওয়ার প্যাক ইকোনমিক জোন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র) মাসুদ ইকবাল মো.

শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় বেশ কটি কোম্পানি আদালতে রিট করে। রিটের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। পাওয়ার প্যাক ইকোনমিক জোনের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা অনুসারে অবস্থানগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে সুন্দরবনের ইসিএর মধ্যে লাল শ্রেণির মোট কতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য অধিদপ্তর দিতে পারেনি। পরিচালক মাসুদ ইকবাল এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ের যোগাযোগের পরামর্শ দেন। ১৬ এপ্রিল প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সেখানে যোগাযোগ করেও পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তর বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের এলাকায় ও মোংলা ইপিজেডে (রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা) প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কারখানা চালু আছে। উভয় এলাকা ইসিএর মধ্যে পড়েছে।

শিল্পকারখানা: সরেজমিন

১৬ এপ্রিল সরেজমিনে দেখা যায়, সুন্দরবনের ইসিএর মধ্যে ২০৫ একরের মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভূমি উন্নয়ন, সড়ক, বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া জায়গায় ২৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের পাশেই ইপিজেড। সেখানকার ৩০২টি প্লটেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে ইপিজেডের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়নি।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান সিকদার গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্যাক ইকোনমিক জোনকে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। বলা হয়েছিল, সেখানে ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।

পাওয়ার প্যাক ইকোনমিক জোনে কোনো স্থাপনা দেখা যায়নি। এর উত্তর-পূর্ব পাশে তিনটি নিরাপত্তাচৌকি রয়েছে। দুজন নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে ৩০ একর জমি নিয়েছে একটি শিল্পগোষ্ঠী। সিমেন্টের ব্যাগ তৈরির প্ল্যান্ট করার কথা। চার বছর আগে কাজও শুরু হয়েছিল। তবে দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।

এদিকে গত সোমবার সচিবালয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে জাতীয় পরিবেশ কমিটির ১৬তম সভায় সুন্দরবনের ইসিএ এলাকায় নতুন করে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্র বলছে, পুরোনো শিল্পের বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে এবং তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

এর আগে ১৬ এপ্রিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকগুলো লাল শ্রেণিভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সবুজ শ্রেণিতে নিয়ে আসা হয়েছে। সেগুলোর তথ্য নিচ্ছি। আর সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান না করতে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, সেটারও একটা তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছি।’এসব তথ্য ও প্রতিবেদন হাতে আসার পর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

সুন্দরবনের কী ক্ষতি হচ্ছে 

২০২২ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিন থেকে করা ‘ইমপ্যাক্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট অন দ্য ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা অ্যান্ড ইকোসিস্টেম অব দ্য সুন্দরবন অ্যান্ড সারাউন্ডিং এরিয়াজ’ শীর্ষক এক গবেষণায় সুন্দরবনের চারপাশে গড়ে ওঠা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা বর্জ্য ও গ্যাস আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের উত্তপ্ত পানি সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করছে বলে বলা হয়।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্টাডিতে দেখেছি সুন্দরবনের চারপাশের গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা–সংলগ্ন এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারার সংখ্যা কমে এসেছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, রামপাল ও মোংলার সুন্দরবন এলাকায় প্রতি বর্গমিটারে চারার সংখ্যা ২ থেকে ৩টি। অন্যদিকে যেসব এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই, সেখানে চারার সংখ্যা প্রতি বর্গমিটারে ১০ থেকে ১৪টি।

প্রতিটি বীজে ভ্রূণ থাকে। দূষণের কারণে অধিকাংশ বীজের ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তাদের অঙ্কুরোদ্‌গম হয় না। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণ জোয়ারের টানে বনের ভেতর চলে আসে। ফলে বনের মাটির গুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় উদ্ভিদের বৈচিত্র্য কমে আসবে। সুন্দরবনের বন্য প্রাণী, পাখিসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে সুন্দরবনের কোথাও কোথাও এ ধরনের ক্ষতি দৃশ্যমান হচ্ছে।

শিল্পের কাছে গুরুত্ব পায়নি প্রাণ–প্রকৃতি

এশিয়ান হাতি ও বেঙ্গল টাইগার—এ দুটি বন্য প্রাণীকে বাংলাদেশের প্রাণ–প্রকৃতির প্রতিনিধিত্বকারী প্রাণী (ফ্ল্যাগশিপ স্পেসিস) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের সুপারিশ পাশ কাটিয়ে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের তিনটি রক্ষিত বনের লক্ষাধিক গাছ, ২৬টি পাহাড় কেটে ও হাতি চলাচলের ১৪টি ক্রসিং পয়েন্টের ওপর দিয়ে নির্মাণ করা হয় দোহাজারি–কক্সবাজার রেললাইন। ১৫ হাজার একর ম্যানগ্রোভ বন কেটে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলে তৈরি করা হয় দেশের সবচেয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময় দেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীতে ১০ হাজার একর রক্ষিত বন ও ইসিএ ঘোষিত সোনাদিয়া অধিগ্রহণ করা হয় পর্যটনের নামে।

কেন গুরুত্বপূর্ণ ইসিএ

মানুষের নানাবিধ কর্মকাণ্ড কোনো একটি নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্রের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকলে সেটিকে প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা বা ইংরেজিতে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মূলত নির্দিষ্ট বন, জলাশয়, হাওর ও সৈকতের মাটি, পানি, বায়ুসহ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে ইসিএ ঘোষণা করা হয়। সুন্দরবনসহ নানা সময়ে বাংলাদেশে ইসিএ ঘোষণা করা হয়েছে ১৩টি এলাকাকে। ইসিএ ঘোষণা করার পর এসব সংবেদনশীল এলাকায় ৯ ধরনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা, শিকার ও বন্য প্রাণী হত্যা, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থলের ক্ষতি হয় এমন কর্মকাণ্ড; মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি হয় এমন কর্মকাণ্ড এবং মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণ তৈরি করে এমন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়। 

১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান দেয় ইউনেসকো। কিন্তু তাতে শর্ত ছিল এই বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয় এমন কোনো তৎপরতা চালানো যাবে না। শর্ত লঙ্ঘনের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হলে তার বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান চলে যাবে। এরপর ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের সম্ভার রক্ষায় সরকার সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল ও ইসিএর মধ্যে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা—এই তিন তৎপরতা সুন্দরবনকে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করতে পারে বলে তৎকালীন সরকারকে সতর্ক করে ইউনেসকো। সতর্ক করার পরও তৎকালীন সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন করে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ১০ ক ল ম ট র স ন দরবন র চ প রথম আল ক র স ন দরবন ২০১৭ স ল সরক র স মন ত র ন এল ক অন য য় এল ক য় র অন ম হয় ছ ল র চ লক কর ত প র জন য ধরন র র ওপর এমন ক সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয় থেকে অজগর উদ্ধার

বাগেরহাটে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয় থেকে একটি অজগর সাপ উদ্ধার করেছে ওয়াইল্ডটিম ও ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম (ভিটিআরটি)। মঙ্গলবার (২৪ জুন) দুপুরে শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ তাফালবাড়ি গ্রাম থেকে সাপটি উদ্ধার করা হয়। 

ওয়াইল্ডটিমের মাঠ কর্মকর্তা আলম হাওলাদার জানান, স্থানীয় বাসিন্দা সুদেব বাইনের সবজি ক্ষেত ঘিরে রাখা জালে আটকে পড়ে অজগরটি। খবর পেয়ে ওয়াইল্ডটিম ও ভিটিআরটির সদস্যরা স্থানীয়দের সহায়তায় সাপটি উদ্ধার করে। অজগরটি পুরোপুরি সুস্থ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, খাবারের সন্ধানে বা উপযুক্ত পরিবেশের খোঁজে সাপটি বনাঞ্চল ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেব জানান, উদ্ধার হওয়া অজগরটি লম্বায় ৮ ফুট এবং ওজন প্রায় ১০ কেজি। এটি সুন্দরবনের ধাবড়ি খাল এলাকায় বিকেলে অবমুক্ত করা হয়েছে।
 

আরো পড়ুন:

‘সুন্দরবন রক্ষায় কনক্রিট অ্যাকশন প্ল্যান করা হবে’

খুলনায় উদ্ধারকৃত অজগর সুন্দরবনে অবমুক্ত

ঢাকা/শহিদুল/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয় থেকে অজগর উদ্ধার
  • সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেসের রাত্রিকালীন যাত্রাবিরতির দাবিতে ট্রেন থামিয়ে বিক্ষোভ
  • সুন্দরবনে হরিণের দৌড় থামায় শিকারি, ২০ দিনেই জব্দ ২ সহস্রাধিক ফাঁদ
  • অস্ত্রসহ বনদস্যু করিম শরীফ বাহিনীর সদস্য আটক
  • নদী রক্ষায় সব মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করতে হবে