হাজারীবাগের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সেলিম। সাতসকাল থেকে ব্যবসার কাজে আড়তে ঢোকেন। সেখান থেকে বের হতে হতে রাত ১২টা। অনেক দিনের ইচ্ছা তিনি পাসপোর্ট করবেন। কিন্তু হাজারীবাগ থেকে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট করার সময় কোথায় তাঁর। তাঁকে দেখা গেল ঢাকার নীলক্ষেতের নাগরিক সেবা কেন্দ্রে। পত্রিকায় সংবাদ দেখে এসেছেন পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে। তিনি বলেন, ‘আমার সময় কম। সারা দিন অনেক কাজ। এরই মধ্যে আবার পাসপোর্টের ফরম পূরণ বা পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার জন্য সুযোগ নেই। পত্রিকায় নাগরিক সেবা কেন্দ্রের খবর দেখে এসেছি পাসপোর্ট করাতে। মাত্র ২০ মিনিটে পাসপোর্টের সব তথ্য পূরণ করতে পারছি এখান থেকে। এখানে এসে জেনেছি, এখন পাসপোর্টসহ ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) সংক্রান্ত সেবা মিলবে এখানে।’

মোহাম্মদ সেলিমের পাসপোর্টের কাগজপত্র পূরণে সহায়তা করছিলেন নাগরিক সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তা মো.

জাহিদ হাসান। ২০২৫ সালে স্থাপত্য ডিপ্লোমা করেন এই তরুণ। তিনি নীলক্ষেত নাগরিক সেবা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছেন।

জাহিদ বলেন, ‘আমার এই কেন্দ্র থেকে ১০-১৫ জন নানা ধরনের নাগরিক সেবা নিতে আসেন। বেশির ভাগ মানুষই জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) সংক্রান্ত তথ্য হালনাগাদ করতে আসেন। এখান থেকে মাত্র ১০০-২০০ টাকার মধ্যে সব সেবা নেওয়া যাচ্ছে।

সব মিলবে এক কেন্দ্রে

সরকারি বিভিন্ন সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে অনলাইনে ‘এক ঠিকানায় সকল নাগরিক সেবা’ স্লোগানে চালু হয় নাগরিক সেবা বাংলাদেশ। গত মে মাসে এই কার্যক্রমের পাইলট প্রকল্প উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রশিক্ষিত নাগরিক সেবা উদ‍্যোক্তারা এই সেবাগুলো নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে সাধারণ নাগরিকদের প্রদান করছেন। পাইলট প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর গুলশান, উত্তরা ও নীলক্ষেত এলাকায় নাগরিক সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তান, বনশ্রী ও মোহাম্মদপুরে আরও তিনটি নাগরিক সেবা কেন্দ্র চালু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উদ্যোগে এবং সরকারের আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে চলছে এই সেবা। এই সেবার আওতায় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য নিয়মিতভাবে সেবার হালনাগাদ ও সমন্বয়ের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এই ওয়েবসাইট (https://www.nagoriksheba.gov.bd/) থেকে দেখা যায়, জনপ্রিয় সেবার মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র, ই-রিটার্ন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ই-মিউটেশন, ভূমি কর, ই-পরচা, অনলাইন জিডি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যয়ন, সার্টিফিকেট সত্যয়ন ও ই-পাসপোর্ট সেবা।

যেসব সেবা মিলছে

নীলক্ষেত সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্ত জাহিদ হাসান বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র আবেদন থেকে শুরু করে ইউটিলিটি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এখানে। প্রতিটি কেন্দ্রে আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে নাগরিকদের জন্য। নাগরিক সেবা কেন্দ্র সাধারণ মানুষের দীর্ঘ ভ্রমণ বা লাইনের প্রয়োজন দূর করছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ই-মিউটেশন, ই-পরচা, ভূমি কর; রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুনিবন্ধন; বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নতুন ভোটার নিবন্ধন, কার্ড পরিবর্তন; বাংলাদেশ পুলিশের অনলাইন জিডিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কাপড় বিক্রয়ের লাইসেন্স প্রাপ্তির আবেদন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষানবিশির জন্য আবেদন, ময়ূর ক্রয়ের জন্য আবেদন, নার্সারি থেকে অনলাইনে চারা ক্রয়ের জন্য আবেদনের মতো বিভিন্ন বিষয়ে আবেদন করা যাচ্ছে এসব কেন্দ্র থেকে।

সুযোগ থাকলেও সেবা নেই

২২ অক্টোবর গুলশানের নাগরিক সেবা কেন্দ্রে নিজের জন্মনিবন্ধন করার উদ্দেশ্যে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আলিমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম অনেক সুবিধা পাব এখানে, ভেবেছিলাম এক স্থান থেকেই সেবা নিয়ে ঘরে ফিরতে পারব। কিন্তু জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে দেখি এখান থেকে কেবল আবেদন করা যাচ্ছে, যেটা নিয়ে আমাকে আবার কমিশনার কার্যালয়ে যেতে হবে, অথচ আবেদনের কাজটি আমি বাসা থেকেই করতে পারতাম কিংবা একজন সাধারণ কম্পিউটার দোকান থেকেও করা যেত।’ এ কথার উত্তরে নাগরিক সেবা উদ্যোক্তা মীর ফাতেমা বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন সার্ভারের এক্সেস না থাকায় সেবাকেন্দ্র থেকে আবেদন, ভেরিফিকেশন ও জন্মনিবন্ধন সনদ প্রিন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে পরিপূর্ণ সুবিধা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেবাকেন্দ্রে আসা আরেকজন নাগরিক জানান, গুলশানের নাগরিক সেবা কেন্দ্রটি মহাখালী বা কড়াইল বস্তিতে থাকা ভাসমান বা নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য বড় সেবা কেন্দ্র হতে পারে। অনেক মানুষের এখনো জন্মসনদ নেই। এখানে এসে জন্মসনদ করার সুযোগ আছে। তবে সম্পূর্ণ প্রসেসটি এখান থেকেই করা গেলে জনদুর্ভোগ কমত এবং ভাসমান ব্যক্তিরাও জন্মনিবন্ধনের সুযোগ পেত।

গুলশান নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, দ্রুতই এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আরও নতুন নতুন সেবা নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে নেওয়া যাবে। সেবা কেন্দ্র পরিচালনায় নারী উদ্যোক্তারা আছেন বলে অনেক নারী ও শিশু-কিশোরবান্ধব এখানকার পরিবেশ। পাইলট পর্যায় থেকে সরাসরি চালু হলে অনেক সেবার সুযোগ মিলবে।

প্রথম সিটিজেন সার্ভিস কানেকটিভিটি হাব

নাগরিক সেবা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একটি বিশেষ উদ্যোগ। তৃণমূল পর্যায়ে ডিজিটাল সরকারি সেবাগুলো আরও সহজলভ্য করে তুলছে এই কেন্দ্র। প্রশিক্ষিত উদ্যোক্তাদের পরিচালিত স্থানীয় সেবা কেন্দ্রের বর্ধমান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, নাগরিকেরা দ্রুত, পেশাদারভাবে এবং বাড়ির কাছেই প্রয়োজনীয় কাজে সহায়তা পাচ্ছেন। বর্তমানে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) সংক্রান্ত সেবাসহ বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদের মোট ৪০০টি সেবা নিয়ে নাগরিক সেবার পাইলট এবং লার্নিং প্রোগ্রাম চলছে। প্রতিটি সরকারি অফিসের সেবাকে এক জায়গায় এনে নাগরিকদের হয়রানিমুক্ত সেবাদানের লক্ষ্যে নাগরিক সেবার মাধ্যমে ‘ন্যাশনাল এপিআই কানেকটিভিটি হাব’ তৈরি করা হচ্ছে। এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন অফিসের ওয়েবসাইটে গিয়ে আলাদাভাবে সেবার আবেদন করার প্রয়োজন পড়বে না। বরং এক জায়গায় সব সেবা পাওয়ার জন্য একটি ন্যাশনাল কানেকটিভিটি হাব দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সব সেবা এক জায়গায় দিতে এটি বাংলাদেশের প্রথম সিটিজেন সার্ভিস কানেকটিভিটি হাব।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের উদ্যোগে এবং আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে নাগরিক সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের এসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) জানিয়েছে, বিভিন্ন সরকারি অফিসের সেবাকে এক ছাদের নিচে আনার জন্য নাগরিক সেবা কেন্দ্র ধারণাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে। নাগরিকেরা যেন বাড়ির আশপাশে সরাসরি বিভিন্ন নাগরিক সেবা গ্রহণ করতে পারে, তার সব সুবিধা আছে এখানে। প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বিভিন্ন সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে নাগরিক সেবা কেন্দ্র। এসব সেবা কেন্দ্র স্থানীয় উদ্যোক্তারা পরিচালনা করছেন বলে এলাকাভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের এসব নাগরিক সেবা কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

বিভিন্ন সেবা কেন্দ্রের ঠিকানা:

১. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, গুলিস্তান

ঠিকানা: রমনা টেলিফোন ভবন, গুলিস্তান (নগর ভবনের পাশে)। গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/cAet4WzmPEBeJTXG9) । ফোন: ০১৭৪৪৯৮৭৬০৬

২. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, বনশ্রী

ঠিকানা: হাউস নম্বর ১/এ, রোড ০২, ব্লক ডি, বিটিসিএল, বনশ্রী, ঢাকা-১২১৯১ গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/LifX6NDRcU22dazD7)। ফোন: ০১৮১১২৫৬৩৪১

৩. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, মোহাম্মদপুর

ঠিকানা: প্লট-৪৭, আসাদ অ্যাভিনিউ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭। গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/DHqACmu21nys38nh9)। ফোন: ০১৭১৮৮৬৩৩৭১

৪. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, গুলশান

প্লট নম্বর-২৫, রোড-১৬, গুলশান-১, ঢাকা, গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/9btSKptu5nsR92VaA)

ফোন: ০১৯১১৩১০৩৫৭

৫. নাগরিক সেবা কেন্দ্র, উত্তরা

ঠিকানা: ৩ এবং ৫, শাহজালাল অ্যাভিনিউ, সেক্টর-৬, উত্তরা, ঢাকা, গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://maps.app.goo.gl/N93mhjMjK294wmAG6)। ফোন: ০১৯১৩৭৩৭৩৪৭

৬ নাগরিক সেবা কেন্দ্র, নীলক্ষেত

ঠিকানা: নীলক্ষেত টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, ১, বাবুপুরা রোড, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫, গুগল ম্যাপে এই অবস্থান (https://g.co/kgs/tNihsqQ)

ফোন: ০১৪০৯৫৬২৩৯৩

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন ম ও ম ত য এই অবস থ ন গ গল ম য প ন লক ষ ত উদ য ক ত পর চ ল সব স ব র জন য র উদ য প ইলট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই নাফাখুম ঝরনায় যান ১৭ পর্যটক, গোসলে নেমে একজন নিখোঁজ

বান্দরবানের থানচি উপজেলার নাফাখুম ঝরনায় গোসলে নেমে এক পর্যটক নিখোঁজ রয়েছেন। ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পর্যটকদের একটি দলের সঙ্গে ঢাকা থেকে নাফাখুমে গিয়েছিলেন ওই তরুণ পর্যটক। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি নিখোঁজ হন। আজ শনিবার বেলা একটা পর্যন্ত ওই পর্যটকের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

নিখোঁজ ওই পর্যটকের নাম ইকবাল হোসেন (২৫)। পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর বাড়ি ঢাকার ডেমরার রসুলনগরে। তাঁর বাবার নাম মফিজুল ইসলাম ও মায়ের নাম রাশিদা বেগম।

উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, গতকাল সকালে আলীকদম ও তিন্দু হয়ে ইকবালসহ ১৭ জন নাফাখুমে গিয়েছিলেন। সারা দিন থাকার পর বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁরা সবাই ঝরনায় গোসলে নামেন। একপর্যায়ে ইকবাল ঝরনার পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ হন। তাঁকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা চলছে।

জানতে চাইলে থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছির উদ্দিন মজুমদার বলেন, ১৭ জন পর্যটকের অন্য ১৬ জন উপজেলা সদরে ফিরে এসেছেন। ইকবাল হোসেনের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি তাঁর পরিবারকে জানানো হয়েছে।

ইকবাল হোসেনের জাতীয় পরিচয়পত্র

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই নাফাখুম ঝরনায় যান ১৭ পর্যটক, গোসলে নেমে একজন নিখোঁজ