হবিগঞ্জের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী চাঁন মিয়া প্রতিদিন গ্রাহকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন
Published: 17th, November 2025 GMT
হবিগঞ্জের চাঁন মিয়া (৫৮) চোখে দেখতে পান না। এ প্রতিবন্ধিতা নিয়েই তিনি প্রতিদিন প্রায় ২০০ গ্রাহকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেন। পত্রিকা বিলির কাজটি ২৪ বছর ধরে করছেন তিনি।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বারাপইল গ্রামের বাসিন্দা চাঁন মিয়া। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় ছোটবেলা থেকে সমাজে অবহেলিত ছিলেন। গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করা চাঁন মিয়ে তরুণ বয়স থেকেই কাজের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু চোখে দেখেন না বলে কেউ কাজ দিতেন না। আবার কাজ দিলেও পারিশ্রমিক কম দিতেন।
চাঁন মিয়া নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, একদিন স্থানীয় এক ব্যক্তির পরামর্শে তিনি পত্রিকা বিক্রিতে সম্মত হন। ১৯৯৮ সালে দৈনিক এক্সপ্রেস নামের স্থানীয় একটি পত্রিকা বিক্রির সুযোগ পান। প্রথম দিন ৪০টি পত্রিকা বিক্রি করে ৪০ টাকা পেয়েই মহাখুশি তিনি। সেই থেকে এ পেশায় আছেন। বর্তমানে তাঁর কাছ থেকে পত্রিকা নেন প্রায় ২০০ গ্রাহক।
চোখে না দেখলেও কীভাবে গ্রাহকের কাছে পত্রিকা বিলি করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে চাঁন মিয়া বলেন, ‘আমি চোখে না দেখলে কী হবে, মনের আলোয় সব দেখতে পাই।’ সময় বোঝেন সূর্যের তাপের ওঠা-নামা অনুভব করে। পেশাগত কারণে হবিগঞ্জ শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়ানোর ফলে শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতের অবস্থান তাঁর আয়ত্তে।
চাঁন মিয়া বলেন, প্রতিদিন সকাল সাতটায় পত্রিকা নিয়ে বের হয়ে সহকর্মীদের কাছে জেনে নেন সেদিনের পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের শিরোনাম। জোরে জোরে বলতে থাকেন সেসব শিরোনাম আর বিক্রি করেন পত্রিকা। বড় কাপড়ের ব্যাগে পত্রিকাগুলো ভাগ ভাগ করে সাজিয়ে রাখেন, যাতে গ্রাহক চাইলে সহজে বের করে দিতে পারেন।
তবে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বলে দাবি করলেন চাঁন মিয়া। তিনি বলেন, কেউ কেউ পাঁচ টাকার নোট দিয়ে বলেন ১০ টাকা। আবার অনেকে জাল ও ছেঁড়াফাটা নোট দিয়ে ঠকান। তবে এ থেকে বাঁচতে তিনি তাঁর পাঞ্জাবিতে চারটি পকেট রেখেছেন। একটি পকেটে ২ টাকা, একটিতে ১০ টাকা, অপরটিতে ২০ টাকা এবং সর্বশেষ পকেটে রাখেন বড় অঙ্কের নোটগুলো। এতে সহজ হয় তাঁর লেনদেন। এভাবে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় বা কনকনে শীত উপেক্ষা করে পাঠকের দ্বারে পত্রিকা পৌঁছে দেন তিনি।
চাঁন মিয়া বলেন, ‘আমার যাঁরা গ্রাহক, তাঁরা আমাকে ভালোবেসে পত্রিকা কেনেন। অনেক সময় পত্রিকা পৌঁছাতে দেরি হলেও কেউ বিরক্ত হন না।’ তবে চোখে দেখেন না বলে নানা দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়েছে বহুবার। একবার একটি নর্দমায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায়। তিন-চারবার রিকশার নিচে পড়ে আহত হয়েছেন।
চাঁন মিয়ার দুই সন্তান। মেয়ে ফারহানা আক্তার এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ছেলে বায়েজিদ রাহিন হবিগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করেছেন। কয়েক বছর আগেও পত্রিকা বিক্রি করে সংসার ভালোই চলত তাঁর। কিন্তু এখন মানুষ অনলাইনমুখী হওয়ায় পত্রিকা বিক্রি কমে গেছে। এর প্রভাব তাঁর জীবনেও পড়েছে।
হবিগঞ্জ শহরের সংবাদপত্র এজেন্ট লায়েছ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, চাঁন মিয়া প্রতিদিন হেঁটে শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে পত্রিকা বিলি করেন। কখনো ভুলে এক গ্রাহকের পছন্দের পত্রিকা অন্য গ্রাহককে দেননি।
হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রভাকর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সহিবুর রহমান বলেন, চোখে দেখেন না বলে দমে যাননি তিনি। প্রতিদিন গ্রাহকের কাছে পত্রিকা পৌঁছাতে তাঁর কোনো অলসতা নেই।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র হক র ক
এছাড়াও পড়ুন:
আজ মাওলানা ভাসানীর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী
মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী সোমবার (১৭ নভেম্বর)। এ উপলক্ষে টাঙ্গাইলের সন্তোষে মরহুমের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে ভোর থেকে ঢল নেমেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের। প্রয়াত এই নেতার মাজারে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তার পরিবার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছে।
ইতোমধ্যে সন্তোষে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মাজার প্রাঙ্গণে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসেছে। বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা, সেমিনার চলছে। মাজার প্রাঙ্গণে ভক্ত, অনুসারী ও মুরিদরা ‘যুগ যুগ জিও তুমি, মওলানা ভাসানী’ স্লোগানে ক্ষণে ক্ষণে স্লোগান দিচ্ছেন।
এদিকে, সংরক্ষণের অভাবে এবং অযত্ম-অবহেলায় থাকা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্মৃতিচিহ্ন গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তার চিন্তা ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে। নতুন সরকারের কাছে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে যথাযথ সম্মান জানানোর দাবি তাদের।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, বিগত দিনে যারাই সরকার ছিলেন, তাদের দায়বদ্ধতার ঘাটতি ছিল বলেই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাতে গড়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যমুনা সেতু ও টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ ভাসানীর নামে করার দাবি তাদের।
জাতীয় নেতার মর্যাদার পাশাপাশি, মাওলানা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি সচেতন মহলের। দেশের মানুষের স্বার্থে তাকে নিয়ে আরো গবেষণা করা প্রয়োজন বলে মনে করে ভাসানী ফাউন্ডেশন।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর হাতে লেখা চিঠি
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের এই দিনে ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। পরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাকে সমাহিত করা হয়।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল চেগা মিয়া। তবে, তিনি লাল মওলানা হিসেবেও সমধিক পরিচিত। মক্তবে শিক্ষকতার সুবাদে ১৯০৯ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে চলে আসেন। সিরাজগঞ্জে জন্ম হলেও তার জীবনের সিংহভাগই টাঙ্গাইলের সন্তোষে কাটিয়েছেন। সন্তোষের মাটিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কৈশোর-যৌবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি তৎকালীন বাংলা-আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। লাইন-প্রথা উচ্ছেদ, জমিদারদের নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনসহ সারাজীবনই তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। তার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে কাগমারীতে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সর্বদলীয় ওয়ার কাউন্সিলের উপদেষ্টা ছিলেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পাক জান্তাদের ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম’ বলে বিদায় জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তার সর্বশেষ কীর্তি ছিল- ফারাক্কা লং মার্চ।
১৯৬৭ সালে চীনের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে উপহার পাওয়া ট্রাক্টর, ওভার কোর্ট, তার ব্যবহৃত টাইপিং মেশিন, লাঠি, ট্রানজিস্টারসহ বিভিন্ন আলোকচিত্রসহ অনেক স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মওলানা ভাসানী রিসার্চ সেন্টারের উদ্যোগে জাদুঘরে এগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করা হলেও তার ওপরে ধুলা বালুর আস্তর পড়েছে।
আক্তারুজ্জামান সাজু নামে এক শিক্ষার্থী জানান, ভারত, এশিয়া, আফ্রিকা, লেটিনসহ নানা দেশে ভাসানীকে নিয়ে চর্চা ও গবেষণা করা হয়। তার চিন্তা ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে। নতুন সরকারের কাছে ভাসানীকে যথাযথ সম্মান দিতে এবং তার চেতনাকে বাস্তবায়ন করার দাবি জানান তিনি।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাতি হাসরত খান ভাসানী ও আজাদ খান ভাসানী জানান, তাদের নানা দেশ ও জাতির জন্য জীবনকে উৎসর্গ করলেও ইতিপূর্বে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কেউ জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মৃত্যুর পর তার শেষ স্বপ্ন ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় মুখ থুবড়ে পড়ে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাসানীর হাতে গড়া অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেন, “ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাসানী সম্পর্কে জানাতে ভাসানী স্টাডিজ পাঠ্য বই পড়ানো হয়। সংগ্রামী মজলুম মানুষের পক্ষে কাজ করা ভাসানীর ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। আলোচনা সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। ভাসানীর উপহার পাওয়া ট্রাক্টর, বিভিন্ন আলোকচিত্রীগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। তার হাতের স্মৃতি বিজরিত জিনিসপত্র রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিজ্ঞান মনস্ক ভাসানী স্বপ্ন দেখতে এদেশে কেরোসিন ও লবণ ছাড়া সব কিছুই তৈরি হবে। সততা, ন্যায় ও সংগ্রামী চেতনা নিয়ে নতুন প্রজন্ম এমন এক দেশ উপহার দিবে যা মাওলানা ভাসানী স্বপ্ন দেখতেন।”
ঢাকা/কাওছার/মাসুদ