চার-পাঁচ হাতবদল হওয়াসহ পণ্যের দাম বৃদ্ধির যত কারণ
Published: 21st, May 2025 GMT
পণ্যের দাম বাড়ার প্রাথমিক কারণ সরবরাহের ঘাটতি। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের অতি মুনাফার কারণেও পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। কৃষকের মাঠ থেকে উৎপাদিত প্রতিটি পণ্য চার–পাঁচ হাত ঘুরে ক্রেতার হাতে পৌঁছায়। যদিও পণ্যের দামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন কৃষক বা উৎপাদকেরা। অর্থাৎ লাভ কিংবা লোকসান—দুটিরই বড় হিস্যা যায় কৃষকের ঘাড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশের ১৪টি জেলায় অত্যাবশ্যকীয় পাঁচটি কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করতে জরিপটি করেছে। যে পাঁচটি পণ্যের ওপর জরিপ করা হয় সেগুলো হচ্ছে—চাল, আলু, পেঁয়াজ, ডিম ও ব্রয়লার মুরগি।
জরিপে উঠে আসে বছরের যে সময়ে ধান, আলু ও পেঁয়াজের মতো পণ্যের উৎপাদন মৌসুম থাকে না, ওই মাসগুলোতে এসব পণ্যের দাম বেশি বাড়ে। এ জন্য মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে এসব পণ্য আমদানি উৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোরও সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যের পেছনে যে খরচ হয়, তার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ যায় চাল কিনতে। উৎপাদন পর্যায় (কৃষক) থেকে অন্তত পাঁচ–ছয় হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে চাল বিক্রি হয়। এ কারণে একজন ক্রেতাকে উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণ বা তার বেশি দামে চাল কিনতে হয়। জরিপে বলা হয়েছে, এক কেজি মোটা চালের (ধান) উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৩৪ টাকা; সেই চাল খুচরায় ক্রেতারা কেনেন ৬২–৬৩ টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, গত বছর দেশে বন্যা ও অতিরিক্ত পোকার আক্রমণে আমন ধানের উৎপাদন কম হয়েছিল। এতে বাজারে চালের ঘাটতি দেখা দেয়। এ ছাড়া ডলার–সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় চাল আমদানিও সম্ভব হয়নি। এ কারণে চালের দাম বাড়তি ছিল। এ ছাড়া ধান চাষের কৃষিজমি কমে যাওয়া; বিদ্যুৎ, সার, ডিজেল, শ্রমিকের মজুরি ও সুদহার বৃদ্ধি—প্রভৃতি কারণও চালের মূল্যবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
চার পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে গত অর্থবছরে ১ কোটি ৬ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছিল। আর দেশে আলুর চাহিদা বছরে আনুমানিক ৯০ লাখ টন। তারপরও গত বছরের নভেম্বরে আলুর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল। কারণ, চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্যে বেশ গরমিল ছিল। এ সুযোগে আলুর সরবরাহব্যবস্থায় থাকা মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। গত বছর প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় হয় ১৭ টাকা, যা তাঁরা ১৮ থেকে ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করেন। সেই আলু বাজার থেকে খুচরায় ক্রেতারা কিনেছেন ৪০ থেকে ৯০ টাকা দরে। চালের মতো আলুও চার–পাঁচ হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছায়। এর মধ্যে হিমাগার থেকে আলু ছাড়ের সময় দামে বড় পার্থক্য তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দাম স্থিতিশীল রাখতে আলুর সঠিক চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্য জানা জরুরি। সে আলোকে হিমাগার থেকে ধাপে ধাপে আলু ছাড়ের ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। হিমাগার থেকে আলু ছাড়ের ক্ষেত্রে বাজার পরিস্থিতি অনুসারে প্রতি মাসে দামের সীমা নির্ধারণেরও প্রস্তাব করা হয় প্রতিবেদনে।
জরিপে উঠে আসে, কয়েক বছর ধরেই দেশে পেঁয়াজের দাম উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় উঠেছিল। গত বছর কয়েক দফা অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে বহু পেঁয়াজ নষ্ট হয়। এসব কারণে মূলত সরবরাহ সংকট থেকে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের মজুতের কারণেও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। কৃষকের মাঠে উৎপাদনের পরে অন্তত পাঁচ হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছায় পেঁয়াজ। অবশ্য গত বছরের তুলনায় এ বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজের দাম অনেক কম। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন কৃষকেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, চলতি বছর প্রতি কেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যয় ছিল ৫৪ টাকা। গত জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি মাসে সেই পেঁয়াজ কৃষক বিক্রি করেছেন ৩৫–৪৮ টাকায়। গত বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজে কৃষকেরা ১৭৪ শতাংশ মুনাফা করেছিলেন। সেখানে এ বছর ২৪ শতাংশ লোকসান হয়েছে তাঁদের। লোকসানের কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর অতিরিক্ত মুনাফা করায় এ বছর বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। পাশাপাশি পেঁয়াজ বীজ, জমি ইজারা, শ্রমের মজুরিও বেড়েছে।
ডিম ও ব্রয়লার মুরগির বাজারেও ২–৩ ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে। তবে এই দুই পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার দাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিম উৎপাদনের ৭৪ শতাংশ ও ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আর বাচ্চা কিনতে ১৪–২০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়। পোলট্রি খাদ্যের প্রায় ৭০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। গত তিন–চার বছরে বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যের কাঁচামালের দাম বেশি থাকায় দেশেও পোলট্রি খাদ্যের দাম বেশি ছিল। এদিকে বাড়তি ব্যয় সামলাতে না পেরে অনেক ছোট খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পোলট্রি খাদ্য ও বাচ্চার দাম কমানো এবং ছোট ও মাঝারি আকারের খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গত বছর আমদ ন উৎপ দ বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অপেক্ষায় আছেন উদ্যোক্তারা: জিইডির প্রতিবেদন
নতুন ব্যবসা চালু করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অপেক্ষায় আছেন বহু উদ্যোক্তা। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সর্বশেষ মাসিক অর্থনৈতিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
জিইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আসন্ন নির্বাচন যদি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক গতিপথ ঠিক করে এবং নতুন সরকার এসে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা, আর্থিক ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা, জ্বালানি নিশ্চয়তাসহ বিভিন্ন সংস্কারের উদ্যোগ অব্যাহত রাখে, তাহলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ফিরে পাবে।
জিইডির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় অর্থনীতি নিয়ে সতর্ক আশাবাদ দেখিয়েছে জিইডি। জিইডি বলছে, একদিকে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে স্থায়ী মূল্যস্ফীতি, ব্যবসায়িক আত্মবিশ্বাস ও দুর্বল ব্যাংকিং খাত স্থানীয় চাহিদা ও বেসরকারি বিনিয়োগকে সীমিত করতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভালো অবস্থায়
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান আগের তুলনায় ভালো হয়েছে বলে মনে করছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। এ ছাড়া প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক প্রবাহ বেড়েছে, যা দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অবস্থান ভালো হওয়ার বড় কারণ।
জিইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে চলতি বছরে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বা বহির্বাণিজ্যের সূচকে অস্থিরতা ছিল। রপ্তানি আয়ের সূচকও ওঠানামা করেছে। বিশেষ করে ২০২৫ সালের এপ্রিল ও জুনে রপ্তানি আয়ে পতন দেখা যায়। তবে অক্টোবরে এই সূচকের অবস্থানে উন্নতি দেখা যায়। তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানির সূচকে বছরের অর্ধেক সময় পর্যন্ত ধীরগতি দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে উন্নতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের নভেম্বরে মোট রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৫ সালের অক্টোবরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে। এর কারণ খাদ্যের দাম স্থিতিশীল হচ্ছে ও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ সরবরাহের শৃঙ্খলে স্থিতিশীলতা ও আমদানি করা পণ্যের চাপ কম থাকায় চলতি বছরের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমার বড় কারণ হচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে, যা ২০২৪ সালের অক্টোবরের ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবরে ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান ৪৭ শতাংশ
খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে চাল। জিইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান ছিল ৪৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরের তুলনায় সামান্য কম। আর মাছ ও মাংসের ভূমিকা ছিল যথাক্রমে ৩৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তবে পর্যাপ্ত মৌসুমি সরবরাহ ভালো থাকায় সবজির দাম কম ছিল। তাই সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে সবজি।