লন্ডনের ডোরচেস্টার হোটেলে দীর্ঘ সময় ধরে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক নিয়ে দেশ-বিদেশে কৌতূহলের কমতি ছিল না । বৈঠকে কিছু সময় দুই পক্ষের প্রতিনিধি দল অংশ নিলেও এক ঘণ্টার বেশি সময় দুই নেতা একান্তে আলোচনা করেছেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন সরকার এবং বিএনপির প্রতিনিধিরা। একটি সংক্ষিপ্ত যৌথ বিবৃতিও পড়ে শোনানো হয়েছে। সেখানে দুই পক্ষই তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। সেই সূত্র ধরে অনেক সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার এক সপ্তাহ আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লন্ডনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোনো কোনো সংবাদপত্র আগ বাড়িয়ে দিন-তারিখও বলে দিয়েছে।

বাস্তবে যৌথ বিবৃতিতে কি তা বলা হয়েছে? সেখানে আছে– যদি প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সংস্কার ও বিচারকার্যে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়, তাহলে নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হতে পারে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে– এ কথা পরিষ্কার করে সিদ্ধান্তের মতোই ঘোষণা দিয়েছিলেন। যৌথ বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলা হলেও তা হবে শর্ত পূরণসাপেক্ষে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে উল্লিখিত সময় আর লন্ডনের বিবৃতির সময় একভাবে বলা হয়নি– এটি বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এদিকে দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক বিশেষ করে যৌথ বিবৃতি নিয়ে জামায়াত, এনসিপি এবং আরও দু-একটি দল নাখোশ। তারা বলছে, কেন বিদেশে বসে অন‍্যান‍্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হলো? সময়সীমা কি আসলেই নির্ধারিত হয়ে গেছে? সময়সীমা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা কি দেওয়া হয়েছে? তা হয়নি। জামায়াতের বিরাগ হওয়ার কারণ বোধগম্য নয়। এ দলের আমির ডা.

শফিকুর রহমান কিছুদিন আগে প্রেসের সামনে রোজার আগের সময়কেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য উপযুক্ত বলেছিলেন। তবে কি জামায়াত চেয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট বিএনপির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্ব নিরসন না হয়ে বরং তা জিইয়ে থাকুক?

প্রধান উপদেষ্টা কোরবানির ঈদের আগে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার আগে কি সব দলের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? জামায়াত-এনসিপিসহ দু-তিনটি পার্টি তখন ত্বরিত ঘোষিত সময়সূচিকে স্বাগত জানিয়েছিল। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কেউ কি তখন বলেছিল, জামায়াত-এনসিপির সঙ্গে পরামর্শ করেই সরকার ওই ঘোষণা দিয়েছে?

জামায়াত নির্বাচন নিয়ে কোনো জাতীয় বিবেচনা নয়, বরং সংকীর্ণ দলীয় বিবেচনা থেকে আগাগোড়াই একেক সময় একেক কথা বলেছে। অথচ তা নীতি-নৈতিকতার বিচারে সমর্থনযোগ‍্য নয়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সবাইকে দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াই জরুরি।
নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপিও হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে, লন্ডন বৈঠকে বিচার ও সংস্কার যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। অথচ যৌথ বিবৃতিতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে– বিচার এবং সংস্কারে যথেষ্ট অগ্রগতি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেই কেবল ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। তাহলে এনসিপির মন খারাপ করার কোনো কারণ তো দেখছি না। এনসিপি সরকারের ভেতরে-বাইরে থেকে সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচন প্রলম্বিত করার কৌশলে এগোচ্ছে দল গুছিয়ে তোলার জন্য– এ কথা কে না বোঝে!

লন্ডন বৈঠকের ফলাফলে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেও হয়তো জামায়াত-এনসিপি মন খারাপ করেছে। কিন্তু বিএনপি ও তার মিত্রদের উচ্ছ্বসিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বৈ কি। লন্ডন বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে সরকারের উদ্যোগে। খেয়াল করা দরকার, একটি অসাধারণ, প্রাণোচ্ছল পরিবেশে বৈঠকটি শুরু ও শেষ হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান হাস‍্যোজ্জ্বল মুখে হাত নেড়ে বৈঠকের শুরুতে এবং বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে হোটেলের সামনে সমবেত নেতাকর্মীর অভিবাদন গ্রহণ করেছেন। উপরন্তু দীর্ঘ সময় ধরে দুই নেতার বৈঠক। ধরেই নেওয়া যায়, দেশের বর্তমান নানা রাজনৈতিক ইস্যু, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে দুই নেতার মধ্যে নিবিড় আলোচনা হয়েছে। হয়তো কোথাও কোথাও ঐকমত্যও তৈরি হয়েছে। ফলে বিএনপি এবং সমমনাদের সমর্থকরা বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হবেন– এটা ধরেই নেওয়া যায়। এতে যে সামগ্রিক রাজনীতিতেও একটা স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটাও কি অস্বীকার করা যায়?

তবে লন্ডন বৈঠকের রেশ কাটতে না কাটতেই কতগুলো প্রশ্ন ঘুরেফিরে সামনে আসছে। লন্ডনে সাংবাদিকদের সামনে সরকারের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে। অথচ নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা এখন পর্যন্ত কোনো সিগন্যাল পায়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এরই মধ‍্যে এ দাবি তুলেছেন। 
এখন লন্ডন বৈঠকের যুক্ত বিবৃতিতে উল্লিখিত পর্যাপ্ত সংস্কার ও বিচারের অগ্রগতি এবং সব প্রস্তুতি সম্পন্ন বলতে সরকারপক্ষ কী বোঝাতে চাইছে, তা কিন্তু খোলাসা করেনি। তবে কি আবারও কম সংস্কার অথবা বেশি সংস্কারের মারপ্যাঁচের মধ‍্যে আমরা পড়ে গেলাম? আমরা তা মনে করতে চাই না। বিশ্বাস করতে চাই, দুই নেতা দীর্ঘ সময় ধরে একান্তে আলোচনায় এসব নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছেন ।
দু-একটি দল মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও এই হাইভোল্টেজ বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে স্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করেছে, তাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। দেশ-বিদেশের কোনো চক্রান্ত যেন এই স্বস্তির পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে। 

সবাইকে পাহারা দিয়ে দেশকে নির্বাচনের ট্রেনে তুলে দিতে হবে, যাতে রোজার আগেই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতি একটি নির্বাচিত সরকার পায়।

মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল: নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ সরক র র ব এনপ র এনস প

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় নাগরিক পার্টির গঠনতন্ত্র অনুমোদন

প্রতিষ্ঠার চার মাসের মাথায় গঠনতন্ত্র তৈরি করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।  শুক্রবার রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের ষষ্ঠ সাধারণ সভায় গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরে এর বিভিন্ন দিক সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

আখতার হোসেন বলেন, কিছু সংশোধনীসহ সভায় এনসিপির ‘খসড়া গঠনতন্ত্র’ অনুমোদিত হয়েছে। আগামী কাউন্সিলের আগে প্রয়োজন সাপেক্ষে বর্তমান প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটি এতে সংশোধনী আনতে পারবে।

গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে আখতার বলেন, এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সারা দেশের কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। একজন সদস্য জীবনে সর্বোচ্চ দুইবার সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং সর্বোচ্চ দুইবার সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দলের রাজনৈতিক পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।

এনসিপির রাজনৈতিক পরিষদ ন্যাশনাল কাউন্সিলের (জাতীয় পরিষদ) সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবে। ‘রাজনৈতিক পরিষদ’ সর্বনিম্ন ১১ জন থেকে সর্বোচ্চ ১৫ জন সদস্যের হবে। ১১ জন সদস্য ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। তার মধ্যে ন্যূনতম তিনজন নারী সদস্য থাকতে হবে। পদাধিকারবলে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক রাজনৈতিক পরিষদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই পরিষদের বাকি দুজন সদস্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বারা মনোনীত হবেন।

এনসিপির একটি ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল’ থাকবে। এই ফোরাম ‘রাজনৈতিক পরিষদ’ নির্বাচন, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন এবং জরুরি সময়ে কিছু কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার দায়িত্ব পালন করবে। কেন্দ্রীয় কমিটি, অঙ্গসংগঠনের নির্বাহী কমিটি, জেলা পদমর্যাদার কমিটি থেকে পাঁচজন এবং উপজেলা পদমর্যাদার কমিটি থেকে দুজন সদস্যের সমন্বয়ে ন্যাশনাল কাউন্সিল গঠিত হবে।

এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটি দলের সভাপতি, সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদকমণ্ডলী, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাধারণ সদস্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে জেলা সভাপতিদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ হবে তিন বছর। মেয়াদের শেষ ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে।

এনসিপির এই গঠনতন্ত্র দলীয় ফোরামে অনুমোদিত হলো নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের আবেদন সময়সীমা শেষ হওয়া সামনে রেখে। আগামী রোববার এই সময়সীমা শেষ হচ্ছে।

এনসিপির নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন দাখিলের বিষয়ে সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান আখতার হোসেন। তিনি বলেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সামগ্রিক যোগাযোগের জন্য মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ ও যুগ্ম সদস্যসচিব জহিরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ, যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন, যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাতীয় নাগরিক পার্টির গঠনতন্ত্র অনুমোদন