কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে পাথরবোঝাই ট্রাকের ভারে সোনাহাট সেতুর পাটাতন ভেঙে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
সোনাহাট স্থলবন্দর থেকে পাথরবোঝাই একটি ট্রাক সেতুর মাঝামাঝি এসে স্টিলের অংশে পাটাতন ভেঙে আটকে যায়। এতে সেতুতে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ অফিসগামী লোকজন ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন। সেতুর দুই পাশে যানবাহনের লম্বা সারি দেখা গেছে। জরুরি প্রয়োজনে লোকজনকে নৌকায় পারাপার হতে দেখা গেছে।
১৮৮৭ সালে লালমনিরহাট থেকে ভারতের গৌহাটি পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়। তারই অংশ হিসেবে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দুধকুমার নদের ওপর ১ হাজার ২০০ ফুট দীর্ঘ সোনাহাট রেলসেতুটি নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রবেশ ঠেকাতে সেতুটির একটি অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর এরশাদ সরকারের আমলে সেতুটি মেরামত করে ভূরুঙ্গামারী দক্ষিণের তিন ইউনিয়ন ও কচাকাটা ও মাদারগঞ্জের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সচল করা হয়। এর পর আর সংস্কার করা হয়নি।
সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, দীর্ঘদিনের পুরোনো সেতুর পাটাতন ভেঙে গেছে। বিভিন্ন স্থানে লোহার পাত খুলে পড়েছে। বেশকিছু অংশে বড় বড় গর্ত। জরাজীর্ণ সেতুটি সংস্কার না করায় দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকি নিয়েই যানবাহন ও পথচারীরা চলাচল করছিলেন। গতকাল সেতুটির পাটাতন ভেঙে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী, এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ স্থানীয় বাসিন্দারা।
এইচএসসি পরীক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, পরীক্ষার হলে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে পৌঁছতে হবে। রিজার্ভ অটোরিকশা নিয়ে এসে দেখি, সেতু বন্ধ। বাধ্য হয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে।
অটোচালক জয়নাল মিয়া বলেন, চর ভূরুঙ্গামারীর নতুন হাট থেকে ৮ জন যাত্রী রিজার্ভ নিয়ে কুড়িগ্রামের উদ্দেশে রওনা করেছিলাম। এসে দেখি, সেতুতে ট্রাক আটকা পড়েছে। কোনো যানবাহন চলছে না। যাত্রীরা নেমে গেছেন। আজ আর গাড়ি চালিয়ে কোনো আয় হবে না। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
কুড়িগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম সমকাল প্রতিবেদককে বলেন, অতিরিক্ত পাথরবোঝাই একটি ট্রাকের কারণে সেতুর পাটাতন ভেঙে গেছে। মেরামতের কাজ চলছে। খুব দ্রুত যান চলাচল স্বাভাবিক হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ক ষ র
এছাড়াও পড়ুন:
দ্বীপকন্যার ‘ডলার ধরা’র গল্প
স্বামী মোজাহেদ হাসান পুলিশ পরিদর্শক। কাজের ফাঁকে গান লিখেন, গান করেন। স্বামীর লেখা গানের একটি লাইন বেশ মনে ধরেছিল আসমাউল হোসনার– ‘ডলার বাতাসে উড়ে/যার যোগ্যতা আছে, সেই ধরতে পারে।’ হোসনা মনে মনে ঠিক করলেন, তিনি ডলার ধরবেন। যেই ভাবা সেই কাজ, গত বছরের শুরুর দিকে ফেসবুকে ‘কিছু করতে চাই’ নামের একটি গ্রুপে যুক্ত হন তিনি। সেই গ্রুপে ‘নারীদের সফলতার গল্প’ পড়েন আর নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখেন যৌথ পরিবারের বউ হোসনা। তবে সংসারের কাজের ফাঁকে ভিন্ন ট্র্যাকের কিছু করা নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্নও ছিলেন দুই সন্তানের এই জননী।
এই সময় আসমাউল হোসনা একদিন এনটিভিতে ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর প্রতিষ্ঠান লিডিং লাইটের কর্ণধার সিনথিয়া আকতার লিজার সাক্ষাৎকার দেখেন। লিজা ফ্রিল্যান্সিং মাসে আয় করেন ৪ লাখ টাকা। হোসনা চোখ বন্ধ করে ভর্তি হয়ে যান লিডিং লাইটে। গত বছরের মার্চে শুরু হয় ফ্রিল্যান্সিং শেখার কোর্স। কোর্স চলাকালীন আগস্টে প্রথম নেদারল্যান্ডসের একজন ক্লায়েন্টের কাজ পান তিনি। কাজটা সফলভাবে সম্পন্ন করেন। গত বছরের আগস্টে দেশ ছিল টালমাটাল, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রেশ তখনও চলছে দেশে। ২৩ আগস্ট আসমাউল হোসনা যখন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায়, তখনই আসে প্রথম ৪৫ ডলারের পেমেন্ট। হোসনার ডলার ধরার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেল।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি গৃহবধূ আসমাউল হোসনাকে। এখন তিনি ইউক্রেন,
জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী চারজন বায়ার এবং তিনটি গ্লোবাল সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির ম্যানেজার। ফ্রিল্যান্সিং করে এখন তার মাসিক আয় ১২০০–১৫০০ ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় দেড় লাখ টাকা। গত ঈদে নিয়মিত আয়ের পাশাপাশি পেয়েছেন বোনাস ডলার।
বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট ম্যানেজমেন্ট, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম ক্যাম্পেইন রানের পাশাপাশি ওয়েবসাইট তৈরি করেন আসমাউল হোসনা। ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট স্ট্র্যাটেজি, অর্গানিক গ্রোথ টেকনিক এবং এনালিটিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন তিনি।
প্রথম ডলার পাওয়ার অনুভূতি বললেন আসমাউল হোসনা–‘আমি তখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জ্বরে কাবু, বিছানায় পড়ে আছি। এই সময়ে এলো সুখবর, আমার একাউন্টে জমা হলো ৪৫ ডলার। তখন আমার মনে হলো কখনও কখনও দুঃসময়ও মানুষকে সেরা মুহূর্ত উপহার দেয়।’
কক্সবাজারের সাগরকন্যা খ্যাত কুতুবদিয়ার লেমশীখালীর মেয়ে আসমাউল হোসনা। সাগরের গর্জন আর ঝাউবনের গান শুনে বড় হয়েছেন তিনি। সেখান থেকে ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তোলা যেন এক ‘রূপকথার গল্প’। ২০১৫ সালে লেমশীখালী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন হোসনা। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করা ছিল তার জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই পারিবারিক সিদ্ধান্তে পুলিশ কর্মকর্তা মোজাহেদ হাসানের সঙ্গে বিয়ে হয় হোসনার। পরে চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিনি।
স্বামীর কর্মস্থল কখনো শহরে, কখনো মফস্বলে, কখনো পাহাড়ে–কখনো সমতলে। শুরু দিকে এই নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতে তাঁকে মানসিকভাবে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু দ্বীপকন্যা ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া, তাই সবসময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। আসমাউল হোসনা বলেন, ‘আমার স্বামী বাংলাদেশ পুলিশের একজন সদস্য, তিনিই আমার স্বপ্নের সারথী, আমার সাফল্যের চালিকা শক্তি। স্বামীর সহৃদয় সহায়তায় আমি নতুন দিনের আলো দেখেছি।’
স্বামী, সন্তান, সংসার দেখভাল করার পর ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য সময় বের করেন কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আসমাউল হোসনা বলেন, ‘এই পেশায় আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল টাইম ম্যানেজমেন্ট। আমাদের যৌথ পরিবার। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সংসার সামলানোর পাশাপাশি পড়াশোনাও সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস–ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব।’
‘ডলার তো ধরছেন, এখন আপনার পরিকল্পনা কী?’–এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হলো, ডিজিটাল সেক্টরে গ্রামের মেয়েদের দক্ষ করে তোলা। আমি চাই এমন একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে, যেখানে প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা ঘরে বসেই আয়ের পথ তৈরি করতে পারবেন। আমার বিশ্বাস, শিক্ষা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব এবং নারীদের দক্ষ করে তোলার মধ্যে দিয়েই দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আরও শক্তিশালী করা যাবে।’
নতুন যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী? ‘মহান আল্লাহর দেওয়া অফুরন্ত শক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে সঠিকভাবে চেষ্টা করে গেল সাফল্য আসবেই। শেখার কোনো শেষ নেই। প্রথম দিকে সবকিছুই একটু কঠিন লাগে, সময়ের সঙ্গে সহজ হয়ে যায়। আমি মনে করি, গৃহিণীদের জন্য ফ্রিল্যান্সিংয়ে দারুণ সুযোগ রয়েছে। আমরা রান্না, খাওয়া ও ঘুমানোর ফাঁকে একটু সময় পেলেই স্মার্ট ফোনে ঢু মারি। আমার পরামর্শ থাকবে ফেসবুক, ইউটিউবে অযথা সময় নষ্ট না করে গৃহবধু, তরুণ–তরুণীরা যে ফ্রিল্যান্সিং শিখে, আয়ের পথ খুঁজেন।’–বলেন আসমাউল হোসনা।