এমএসএফের মানবাধিকার প্রতিবেদন: ধর্ষণ-গণপিটুনিতে হত্যা বেড়েছে জুনে, কমছে না অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা
Published: 30th, June 2025 GMT
চলতি জুনে দেশে ধর্ষণ ও গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়েছে। দলবদ্ধ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি নির্যাতনও কমেনি এ মাসে। শারীরিক নির্যাতন, নিগ্রহ বেড়েছে। গত মে মাস থেকে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। জুন মাসে তার সংখ্যা সামান্যই কমেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যাও কমেনি। মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) দেওয়া জুন মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। আজ সোমবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এমএসএফ।
দেশের শীর্ষ ২০টির বেশি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকের প্রতিবেদন এবং নিজেদের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করেছে এমএসএফ।
এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী এ মাসে ৩৬৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। যা গত মাসের তুলনায় ৫টি কম। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৬৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। গত মে মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৫৯টি।
চলতি মাসে ধর্ষণের শিকার ৬৩ জনের মধ্যে ১৯ শিশু ও ২৩ কিশোরী রয়েছে। অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ শিশু, ৭ জন কিশোরী ও ৮ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ১ জন কিশোরী ও ৩ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা ২৭টি, যৌন হয়রানি ৩৯টি, শারীরিক নির্যাতনের ৫১টি ঘটনা ঘটেছে।
গণপিটুনি বেড়েছেএমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুন মাসে অন্তত ৪১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১০ জন নিহত ও ৪৭ জন গুরুতর আহত হয়েছে। গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ২ জনকে ডাকাতির অভিযোগে, ৩ জনকে সন্দেহজনক চুরির অভিযোগে, ১ জনকে খুনের অভিযোগে, ২ জনকে চুরির অভিযোগে এবং আরও দুজনকে শিশু নির্যাতন ও নারী ধর্ষণের অভিযোগে হত্যা করা হয়। অপরদিকে হত্যার অভিযোগে ১ জন, ৫ জনকে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, ৩ জনকে যৌন হয়রানির অভিযোগে, ৪ জনকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে, ১৭ জনকে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হওয়ার অভিযোগে, ৪ জনকে ডাকাতির অভিযোগে এবং চুরি, চাঁদাবাজি, কটূক্তি, প্রতারণা, অপহরণ এ ধরনের অপরাধজনিত বিষয়ে সন্দেহজনককেভাবে ১৫ জনকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মব সৃষ্টি করে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। এতে মানুষও হত্যা করা হচ্ছে। এসব ঘটনা আসলে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার ফল। সরকারের ভেতরে নানা মতের মানুষ রয়েছেন। তাঁদের মতের পার্থক্যের জন্যই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
গত মে মাসে গণপিটুনির ৩৪টি ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছিল বলে এমএসএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই তুলনা এ মাসে গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়েছে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মব সৃষ্টির পেছনে আসলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলে আমাদের মনে হয়। মব সৃষ্টি করা বেআইনি ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু এই বিষয় থেকে নিবৃত্ত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কিছু বলা হয় না। প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী কেউ কিছু বলেন না এ বিষয়ে। বরং সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিবকে আমরা বলতে শুনি যে এগুলো মব নয় প্রেশার গ্রুপ। এভাবে তো অন্যায়কে উসকে দেওয়া হয়।’
এমএসএফ মনে করে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং পরিচয় জানার বিষয়টি জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা যত ক্ষমতাবানই হোক, এসব অপরাধীর চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
অজ্ঞাতনামা লাশ, নতুন ভীতিএমএসএফ বলছে, জুন মাসে ৪৯টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এমএসএফ বলছে, এটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ। অল্পসংখ্যক ঘটনা ছাড়া সব কটি লাশের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে। মে মাসে এর সংখ্যা ছিল ৫৫ জন। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলা কাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ভীতিকর বলেই মনে করেন শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, এমন ঘটনা ঘটতে পারে যে হয়তো হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সম্পর্কে থানাগুলো তথ্য নিচ্ছে না বা আত্মীয়স্বজনেরা তথ্য দিতেও পারছে না। তবে এভাবে লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি আসলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকেই তুলে ধরে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এমএসএফ র গণপ ট ন ত সরক র র হত য র র হয় ছ র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
ধর্ষণ ও গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে সেপ্টেম্বরে: এমএসএফ
দেশে সেপ্টেম্বরে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণের সংখ্যাও বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন।
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রকাশিত সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও নিজেদের অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ এই মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আজ মঙ্গলবার এমএসএফ এ প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে।
প্রতিবেদনে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, গণপিটুনি ও মব সহিংসতার মতো আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে নিহত ও আহতের সংখ্যা বেড়ে নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা এ বিষয়ে নাগরিকদের জীবনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলেছে।
এমএসএফের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মব সন্ত্রাসের বিপরীতে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা চরমে পৌঁছেছে। কিছু ক্ষেত্রে মব সন্ত্রাসে সরকারের উসকানিও আছে বলে মনে হয়েছে।
প্রতিবেদনটি দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র তুলে ধরেছে। এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা সামান্য বেড়ে আগস্টের ২৩ জন থেকে সেপ্টেম্বরে ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। ‘আইন হাতে তুলে নেওয়ার’ এই লাগামহীন প্রবণতা সমাজে বিচারহীনতা ও মানবিক মূল্যবোধের পতনের গভীর সংকটকে স্পষ্ট করে তুলেছে বলে মনে করে এমএসএফ।
প্রতিবেদনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে চুরির সন্দেহে স্থানীয় লোকজনের মারধরের শিকার হয়ে চার দিন পুলিশ হেফাজতে থাকার পর হাসপাতালে এক যুবকের মৃত্যু হয়। এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে, সহিংসতা শুরু হয় গণপিটুনি দিয়ে, আর এর জের চলে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে গিয়েও। গণপিটুনির এই সংস্কৃতি রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তার মৌলিক অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতন
প্রতিবেদনে নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ব্যাপকতাও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আগস্টে ৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বরে ৫৩টি হয়েছে। এর মধ্যে দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনা ১৩টি এবং ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে তিনটি। অন্যদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাও বেড়েছে। চলতি মাসে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে ২৯টি, যা আগস্টে ছিল শূন্য।
পাশাপাশি মাজার বা আখড়ায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ১৬টি ঘটনা ঘটেছে। জাতিগত সংখ্যালঘুদের ১২টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভরত তিনজন জাতিগত সংখ্যালঘু যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির দুরবস্থা নির্দেশ করে।
এমএসএফ মনে করে, গণপিটুনির মতো জঘন্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি রুখতে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। একই সঙ্গে হেফাজতে মৃত্যু, ধর্ষণ ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।