আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে সবকিছুই দ্রুতগতির। নতুন ফোন, ফ্যাশনেবল জুতা বা ব্যাগ—ইচ্ছা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেতে চাই। ‘ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন’ বা তাৎক্ষণিক তৃপ্তির এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। অ্যামাজন প্রাইমের এক ক্লিকে পণ্য বাড়িতে চলে আসে, নাইকির স্লোগান ‘জাস্ট ডু ইট’ নিয়ত তাড়া দিতে থাকে। তাড়াহুড়োয় ভুলে যাই ধৈর্য ও সংযমের গুরুত্ব। অথচ মুসলিম হিসেবে এই দুটি গুণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নফস শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘আত্মা’ বা ‘সত্তা’। একে ‘প্রবৃত্তি’ও বলা যায়। নফস আমাদের মন্দ কাজের দিকে প্ররোচিত করে। কোরআনে নবী ইউসুফের (আ.
নফসকে তার ইচ্ছানুযায়ী চলতে দেওয়া বিপজ্জনক, কারণ এটি তাকে আরও শক্তিশালী করে এবং আমাদের সংযমের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ইসলামে নফসকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা রয়েছে। ইমাম ইবনে কাইয়্যিম (রা.) নফস নিয়ন্ত্রণের পাঁচটি ব্যবহারিক পদ্ধতির কথা বলেছেন। এ ছাড়া ইসলামবেত্তাগণ আরো নানামুখী উপদেশ দিয়েছেন, যা আমাদের জীবনে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে।
১. অতিরিক্ত সামাজিকতা নিয়ন্ত্রণসামাজিক মেলামেশা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, তবে তা মধ্যপন্থায় হওয়া উচিত। উপকারী সঙ্গী ছাড়া অন্যদের সঙ্গে মেলামেশায় সতর্ক থাকা উচিত। ইমাম ইবনে কাইয়্যিম বলেন, ‘অতিরিক্ত সামাজিকতা হৃদয়কে দূষিত করে।’ (মাদারিজ আস-সালিকিন, খণ্ড ১, পৃ. ৪৪৩-৪৪৯, দারুল কুতুব, কায়রো: ১৯৯৬)
অতিরিক্ত মেলামেশা আমাদের ইবাদত ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের সময় কমিয়ে দেয়। কখন বুঝবেন যে আপনি অধিক সামাজিকতায় লিপ্ত হচ্ছেন? যখন কথোপকথন অর্থহীন হয়ে যায় বা গীবত, অপ্রয়োজনীয় কৌতুক বা অকেজো আলোচনায় রূপ নেয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকে, তাকে জান্নাতের উচ্চস্থান দেওয়া হবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৩১২)
আরও পড়ুনপার্থিব জাঁকজমক যেন আধ্যাত্মিকতার বাধা না হয়০৭ মে ২০২৫২. অবাস্তব কল্পনা পরিহারইবনে কাইয়্যিম (রহ.) অবাস্তব কল্পনাকে হৃদয়ের জন্য ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে কল্পনায় ডুবে থাকা নাফসকে দুর্বল করে। কোরআন আমাদের বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি রাখতে বলে: ‘তারা কি এই কোরআন নিয়ে চিন্তা করে না, নাকি তাদের হৃদয়ে তালা লাগানো?’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত: ২৪)
ধরুন, কেউ তার জীবনের পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করে এবং কল্পনা করে যে সবকিছু ভিন্ন হলে ভালো হতো। এই কল্পনা তার ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতাবোধকে নষ্ট করে। তাকে সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর পরিকল্পনার ভাবতে হবে। বরং প্রতিদিন আল্লাহর শোকর আদায় করুন, যে-অবস্থাতেই থাকুন না কেন। এতে অবাস্তব ইচ্ছা কমে আসবে।
৩. আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি আসক্তি ত্যাগআল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি (যেমন অর্থ, চাকরি বা মানুষ) থাকলে মনোবল দুর্বল হয়ে যায়। কোরআন বলে, ‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে প্রশান্তি লাভ করে।’ (সুরা রা‘দ, আয়াত: ২৮)
আসক্তি আল্লাহর ইবাদতের সময় ও শক্তি কেড়ে নেয়।
নামাজে মনোযোগ বাড়ান, নিয়মিত যিকির করুন এবং কোরআন পড়ার সময় নির্ধারণ করুন। দৈনিক সকালে অন্ততঃ ১০ মিনিট কোরআন তিলাওয়াত করুন। এতে নফসের অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছা কমে আসবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত থাকে, তার জন্য দুনিয়ার সবকিছু যথেষ্ট হয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২,৬৮৫)
৪. অতিরিক্ত খাওয়া নিয়ন্ত্রণঅতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষতিকর। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের পেটের চেয়ে খারাপ কোনো পাত্র নেই। তার পিঠ সোজা রাখতে কয়েক মুঠো খাবারই যথেষ্ট। যদি অবশ্যই পূর্ণ করতে হয়, তবে এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ বাতাসের জন্য রাখবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩,৩৪৯)
অতিরিক্ত খাওয়া নফসের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেয় এবং শরীরে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। পরিমিত খান, ধীরে ধীরে খান এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন। খাওয়ার সময় সুন্নাহ মেনে বসুন, ডান হাতে খান এবং খাওয়ার আগে ও পরে দোয়া পড়ুন। এতে নফসকে নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং স্বাস্থ্য রক্ষা হবে।
৫. অতিরিক্ত ঘুম এড়ানোখাওয়ার মতো বেশি ঘুমও শরীরে জন্য ক্ষতিকর। এতে সৃজনশীলতাও কমে যায়। ইবনে কাইয়্যিম বলেন, ‘অতিরিক্ত ঘুম হৃদয়কে দুর্বল করে।’ (মাদারিজ আস-সালিকিন, খণ্ড ১, পৃ. ৪৪৩-৪৪৯, দারুল কুতুব, কায়রো, ১৯৯৬)
বেশি ঘুম ফজর নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মিস করিয়ে দেয়। তাই রাতে ইশার নামাজের পর তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করুন এবং ফজরের জন্য অ্যালার্ম সেট করুন। ফোনের পরিবর্তে ঘড়ির অ্যালার্ম ব্যবহার করুন, যাতে সামাজিক মাধ্যমে সময় নষ্ট না হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের জন্য বরকত সকালের সময়ে নির্ধারিত হয়েছে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ১,৩০৪)
সকালে উঠে দিন শুরু করুন ইবাদত ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে।
৬. নিয়ত নবায়ন করুননফস নিয়ন্ত্রণে সফলতা আল্লাহর অনুমতির ওপর নির্ভর করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
প্রতিটি কাজের আগে নিয়ত যাচাই করুন যে এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। খাওয়ার আগে বলুন, ‘আমি খাচ্ছি যেন আমার শরীর সুস্থ থাকে এবং ইবাদতের শক্তি পাই।’ এভাবে হলে নিয়ত নফসকে আল্লাহর পথে রাখবে।
আরও পড়ুনভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ০১ আগস্ট ২০২৫৭. আত্মপর্যালোচনা ও দোয়ানফস নিয়ন্ত্রণে আত্মপর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘নিজের অন্তরের হিসাব নাও, কারণ এটি তোমাকে তোমার ত্রুটি দেখিয়ে দেবে।’ (ইহয়া উলুমিদ্দিন, খণ্ড ৪, পৃ. ৩৮১, দারুল কুতুব, কায়রো, ১৯৯৮)
প্রতিদিন রাতে ১০ মিনিট সময় নিয়ে নিজের কাজ পর্যালোচনা করুন এবং ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করুন।
নফস নিয়ন্ত্রণে দোয়া অপরিহার্য। কোরআনের একটি শক্তিশালী দোয়া হলো: ‘রব্বিশ-রাহলী, সদরী, ওয়া-ইয়াস্সিরলী, আম্রী (হে আমার রব, আমার অন্তরকে প্রশস্ত করুন, আমার কাজকে সহজ করুন এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করুন)।’ (সুরা তা-হা, আয়াত: ২৫-২৮)।
এই দোয়া নিয়মিত পড়ুন, যাতে আল্লাহ আপনার নফস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করেন।
৮. সময় ব্যবস্থাপনানফসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সময় ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করা হলে নফসের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। প্রতিদিনের জন্য একটি সময়সূচি তৈরি করুন, যেখানে ইবাদত, কাজ, বিশ্রাম ও সামাজিকতার জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুটি নিয়ামত এমন যে, মানুষ এর মূল্য বোঝে না: স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪১২)
সময়ের সঠিক ব্যবহার নফসকে শৃঙ্খলায় রাখবে।
৯. সুন্নাহ মেনে চলানফস নিয়ন্ত্রণে সুন্নাহ অনুযায়ী কাজকর্ম করা খুবই কার্যকর একটি উপায়। নবীজি (সা.)-এর জীবনধারা আমাদের শৃঙ্খলার পথ দেখাবে। সুন্নাহ মেনে খাওয়া, ঘুমানো, সাজসজ্জা এবং যিকির করা হলে নফস আল্লাহর পথে থাকবে। নিয়মিত সুন্নত নামাজ, দোয়া এবং যিকির নাফসের অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছা কমিয়ে দেবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে আমার সুন্নাহকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৬৭৮)
১০. সঙ্গী নির্বাচনআপনার সঙ্গী আপনার নফসের উপর প্রভাব ফেলে। সৎ ও আল্লাহভীরু সঙ্গী নফসকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার সঙ্গীর ধর্মের উপর থাকে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৩৩)
সৎ সঙ্গী আপনাকে ইবাদত, সংযম ও কৃতজ্ঞতার পথে উৎসাহ যোগাবে। তাই এমন বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান যারা আল্লাহর স্মরণ ও সৎ কাজে উৎসাহ দেয়।
মোটকথা
নফস নিয়ন্ত্রণ করা একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, যা কেবল আল্লাহর সাহায্যে জয় করা সম্ভব। ইমাম ইবনে কাইয়্যিমের উপদেশ এবং নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা মেনে চললে আমরা সফল হব। অতিরিক্ত সামাজিকতা, অবাস্তব কল্পনা, আসক্তি, অতিরিক্ত খাওয়া ও ঘুম এড়িয়ে এবং নিয়ত নবায়ন করা, আত্মপর্যালোচনা, দোয়া, সময় ব্যবস্থাপনা, সুন্নাহ পালন ও সৎ সঙ্গ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা নফসকে শৃঙ্খলায় রাখতে পারি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর জন্য সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদের পথ দেখাব।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৯)
আরও পড়ুনরাগ নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে২৫ মার্চ ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ম জ কত আল ল হ আম দ র বল ছ ন র জন য র সময ইসল ম ক রআন আসক ত
এছাড়াও পড়ুন:
নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন কীভাবে
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে সবকিছুই দ্রুতগতির। নতুন ফোন, ফ্যাশনেবল জুতা বা ব্যাগ—ইচ্ছা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেতে চাই। ‘ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন’ বা তাৎক্ষণিক তৃপ্তির এই সংস্কৃতি আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। অ্যামাজন প্রাইমের এক ক্লিকে পণ্য বাড়িতে চলে আসে, নাইকির স্লোগান ‘জাস্ট ডু ইট’ নিয়ত তাড়া দিতে থাকে। তাড়াহুড়োয় ভুলে যাই ধৈর্য ও সংযমের গুরুত্ব। অথচ মুসলিম হিসেবে এই দুটি গুণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নফস শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘আত্মা’ বা ‘সত্তা’। একে ‘প্রবৃত্তি’ও বলা যায়। নফস আমাদের মন্দ কাজের দিকে প্ররোচিত করে। কোরআনে নবী ইউসুফের (আ.) বক্তব্য রয়েছে, ‘আমি আমার নফসকে পবিত্র মনে করি না, নিশ্চয়ই নাফস মন্দ কাজ প্রবণ।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)
নফসকে তার ইচ্ছানুযায়ী চলতে দেওয়া বিপজ্জনক, কারণ এটি তাকে আরও শক্তিশালী করে এবং আমাদের সংযমের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ইসলামে নফসকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষা রয়েছে। ইমাম ইবনে কাইয়্যিম (রা.) নফস নিয়ন্ত্রণের পাঁচটি ব্যবহারিক পদ্ধতির কথা বলেছেন। এ ছাড়া ইসলামবেত্তাগণ আরো নানামুখী উপদেশ দিয়েছেন, যা আমাদের জীবনে ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে।
১. অতিরিক্ত সামাজিকতা নিয়ন্ত্রণসামাজিক মেলামেশা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়, তবে তা মধ্যপন্থায় হওয়া উচিত। উপকারী সঙ্গী ছাড়া অন্যদের সঙ্গে মেলামেশায় সতর্ক থাকা উচিত। ইমাম ইবনে কাইয়্যিম বলেন, ‘অতিরিক্ত সামাজিকতা হৃদয়কে দূষিত করে।’ (মাদারিজ আস-সালিকিন, খণ্ড ১, পৃ. ৪৪৩-৪৪৯, দারুল কুতুব, কায়রো: ১৯৯৬)
অতিরিক্ত মেলামেশা আমাদের ইবাদত ও আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের সময় কমিয়ে দেয়। কখন বুঝবেন যে আপনি অধিক সামাজিকতায় লিপ্ত হচ্ছেন? যখন কথোপকথন অর্থহীন হয়ে যায় বা গীবত, অপ্রয়োজনীয় কৌতুক বা অকেজো আলোচনায় রূপ নেয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহেতুক কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকে, তাকে জান্নাতের উচ্চস্থান দেওয়া হবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৩১২)
আরও পড়ুনপার্থিব জাঁকজমক যেন আধ্যাত্মিকতার বাধা না হয়০৭ মে ২০২৫২. অবাস্তব কল্পনা পরিহারইবনে কাইয়্যিম (রহ.) অবাস্তব কল্পনাকে হৃদয়ের জন্য ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে কল্পনায় ডুবে থাকা নাফসকে দুর্বল করে। কোরআন আমাদের বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি রাখতে বলে: ‘তারা কি এই কোরআন নিয়ে চিন্তা করে না, নাকি তাদের হৃদয়ে তালা লাগানো?’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত: ২৪)
ধরুন, কেউ তার জীবনের পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করে এবং কল্পনা করে যে সবকিছু ভিন্ন হলে ভালো হতো। এই কল্পনা তার ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতাবোধকে নষ্ট করে। তাকে সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর পরিকল্পনার ভাবতে হবে। বরং প্রতিদিন আল্লাহর শোকর আদায় করুন, যে-অবস্থাতেই থাকুন না কেন। এতে অবাস্তব ইচ্ছা কমে আসবে।
৩. আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি আসক্তি ত্যাগআল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি (যেমন অর্থ, চাকরি বা মানুষ) থাকলে মনোবল দুর্বল হয়ে যায়। কোরআন বলে, ‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে প্রশান্তি লাভ করে।’ (সুরা রা‘দ, আয়াত: ২৮)
আসক্তি আল্লাহর ইবাদতের সময় ও শক্তি কেড়ে নেয়।
নামাজে মনোযোগ বাড়ান, নিয়মিত যিকির করুন এবং কোরআন পড়ার সময় নির্ধারণ করুন। দৈনিক সকালে অন্ততঃ ১০ মিনিট কোরআন তিলাওয়াত করুন। এতে নফসের অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছা কমে আসবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত থাকে, তার জন্য দুনিয়ার সবকিছু যথেষ্ট হয়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২,৬৮৫)
৪. অতিরিক্ত খাওয়া নিয়ন্ত্রণঅতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়া শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষতিকর। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের পেটের চেয়ে খারাপ কোনো পাত্র নেই। তার পিঠ সোজা রাখতে কয়েক মুঠো খাবারই যথেষ্ট। যদি অবশ্যই পূর্ণ করতে হয়, তবে এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ বাতাসের জন্য রাখবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩,৩৪৯)
অতিরিক্ত খাওয়া নফসের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেয় এবং শরীরে অস্বস্তি সৃষ্টি করে। পরিমিত খান, ধীরে ধীরে খান এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন। খাওয়ার সময় সুন্নাহ মেনে বসুন, ডান হাতে খান এবং খাওয়ার আগে ও পরে দোয়া পড়ুন। এতে নফসকে নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং স্বাস্থ্য রক্ষা হবে।
৫. অতিরিক্ত ঘুম এড়ানোখাওয়ার মতো বেশি ঘুমও শরীরে জন্য ক্ষতিকর। এতে সৃজনশীলতাও কমে যায়। ইবনে কাইয়্যিম বলেন, ‘অতিরিক্ত ঘুম হৃদয়কে দুর্বল করে।’ (মাদারিজ আস-সালিকিন, খণ্ড ১, পৃ. ৪৪৩-৪৪৯, দারুল কুতুব, কায়রো, ১৯৯৬)
বেশি ঘুম ফজর নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মিস করিয়ে দেয়। তাই রাতে ইশার নামাজের পর তাড়াতাড়ি ঘুমানোর চেষ্টা করুন এবং ফজরের জন্য অ্যালার্ম সেট করুন। ফোনের পরিবর্তে ঘড়ির অ্যালার্ম ব্যবহার করুন, যাতে সামাজিক মাধ্যমে সময় নষ্ট না হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের জন্য বরকত সকালের সময়ে নির্ধারিত হয়েছে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ১,৩০৪)
সকালে উঠে দিন শুরু করুন ইবাদত ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে।
৬. নিয়ত নবায়ন করুননফস নিয়ন্ত্রণে সফলতা আল্লাহর অনুমতির ওপর নির্ভর করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
প্রতিটি কাজের আগে নিয়ত যাচাই করুন যে এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। খাওয়ার আগে বলুন, ‘আমি খাচ্ছি যেন আমার শরীর সুস্থ থাকে এবং ইবাদতের শক্তি পাই।’ এভাবে হলে নিয়ত নফসকে আল্লাহর পথে রাখবে।
আরও পড়ুনভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ০১ আগস্ট ২০২৫৭. আত্মপর্যালোচনা ও দোয়ানফস নিয়ন্ত্রণে আত্মপর্যালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘নিজের অন্তরের হিসাব নাও, কারণ এটি তোমাকে তোমার ত্রুটি দেখিয়ে দেবে।’ (ইহয়া উলুমিদ্দিন, খণ্ড ৪, পৃ. ৩৮১, দারুল কুতুব, কায়রো, ১৯৯৮)
প্রতিদিন রাতে ১০ মিনিট সময় নিয়ে নিজের কাজ পর্যালোচনা করুন এবং ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) করুন।
নফস নিয়ন্ত্রণে দোয়া অপরিহার্য। কোরআনের একটি শক্তিশালী দোয়া হলো: ‘রব্বিশ-রাহলী, সদরী, ওয়া-ইয়াস্সিরলী, আম্রী (হে আমার রব, আমার অন্তরকে প্রশস্ত করুন, আমার কাজকে সহজ করুন এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করুন)।’ (সুরা তা-হা, আয়াত: ২৫-২৮)।
এই দোয়া নিয়মিত পড়ুন, যাতে আল্লাহ আপনার নফস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করেন।
৮. সময় ব্যবস্থাপনানফসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সময় ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ। অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় নষ্ট করা হলে নফসের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। প্রতিদিনের জন্য একটি সময়সূচি তৈরি করুন, যেখানে ইবাদত, কাজ, বিশ্রাম ও সামাজিকতার জন্য নির্দিষ্ট সময় থাকবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুটি নিয়ামত এমন যে, মানুষ এর মূল্য বোঝে না: স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪১২)
সময়ের সঠিক ব্যবহার নফসকে শৃঙ্খলায় রাখবে।
৯. সুন্নাহ মেনে চলানফস নিয়ন্ত্রণে সুন্নাহ অনুযায়ী কাজকর্ম করা খুবই কার্যকর একটি উপায়। নবীজি (সা.)-এর জীবনধারা আমাদের শৃঙ্খলার পথ দেখাবে। সুন্নাহ মেনে খাওয়া, ঘুমানো, সাজসজ্জা এবং যিকির করা হলে নফস আল্লাহর পথে থাকবে। নিয়মিত সুন্নত নামাজ, দোয়া এবং যিকির নাফসের অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছা কমিয়ে দেবে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে আমার সুন্নাহকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৬৭৮)
১০. সঙ্গী নির্বাচনআপনার সঙ্গী আপনার নফসের উপর প্রভাব ফেলে। সৎ ও আল্লাহভীরু সঙ্গী নফসকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার সঙ্গীর ধর্মের উপর থাকে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৩৩)
সৎ সঙ্গী আপনাকে ইবাদত, সংযম ও কৃতজ্ঞতার পথে উৎসাহ যোগাবে। তাই এমন বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান যারা আল্লাহর স্মরণ ও সৎ কাজে উৎসাহ দেয়।
মোটকথা
নফস নিয়ন্ত্রণ করা একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, যা কেবল আল্লাহর সাহায্যে জয় করা সম্ভব। ইমাম ইবনে কাইয়্যিমের উপদেশ এবং নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা মেনে চললে আমরা সফল হব। অতিরিক্ত সামাজিকতা, অবাস্তব কল্পনা, আসক্তি, অতিরিক্ত খাওয়া ও ঘুম এড়িয়ে এবং নিয়ত নবায়ন করা, আত্মপর্যালোচনা, দোয়া, সময় ব্যবস্থাপনা, সুন্নাহ পালন ও সৎ সঙ্গ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা নফসকে শৃঙ্খলায় রাখতে পারি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যারা আল্লাহর জন্য সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদের পথ দেখাব।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৯)
আরও পড়ুনরাগ নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে২৫ মার্চ ২০২৫