ইসরায়েলি ড্রোন ও যুদ্ধবিমানের ক্রমাগত শব্দের নিচে জিহাদ আবু মানদিল গাজার দির আল-বালাহ্‌ শরণার্থীশিবিরে তাদের ছোট্ট অস্থায়ী তাঁবুতে তাঁর পাঁচ সন্তানকে খেলনা পশু নিয়ে খেলতে দেখছিলেন। অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে ইসরায়েলের চলমান গণহত্যার মধ্যে এটি ছিল শৈশবের ক্ষণিকের এক ঝলক।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারস এই জাতিগত নিধনকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে, ইসরায়েল গাজায় জীবনের প্রায় প্রতিটি উৎস ধ্বংস করে দিয়েছে। হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরো পাড়া গুঁড়িয়ে দিয়ে ৯০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করেছে তারা।

ইসরায়েল নির্বিচার হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ৬৭ হাজার ১৬০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তাদের হামলায় আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার। হাজার হাজার মরদেহ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে, যাঁদের সংখ্যা অজানা। এই ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিত ও মৃত মানুষের আশা ও স্বপ্নও কবরস্থ হয়েছে।

৪১ বছর বয়সী আবু মানদিল তাঁর চার ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটিকে কোলে নিয়ে আল–জাজিরাকে বলেন, ‘এই রক্তপাত বন্ধ হোক, আমি শুধু এটাই চাই।’

হামাস ও ইসরায়েল গতকাল বুধবার রাতে গাজায় যুদ্ধ বন্ধে সম্মত হয়েছে। ফলে আনন্দ–স্বস্তি ছুঁয়ে গেছে গাজার বাসিন্দাদের।

ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন

গাজার বেসামরিক নাগরিকেরা এই আশায় বুক বাঁধছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে মিসরে আলোচনা শেষে হামাস ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এখন স্থায়ী যুদ্ধবিরতি অনেকটাই হাতের নাগালে চলে এসেছে।

গত দুই বছরে ইসরায়েল অসংখ্য মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে গাজায় একটি টেকসই যুদ্ধবিরতি অর্জিত হলেও গাজার ফিলিস্তিনিদের স্বদেশ এবং বাড়িঘর ও মহল্লা পুনর্গঠনের মতো এক দুরূহ কাজের মুখোমুখি হতে হবে।

জাতিসংঘের অনুমান, গাজার পুনর্গঠনের জন্য পাঁচ হাজার কোটি ডলারের বেশি প্রয়োজন হবে। এই উপত্যকাকে আবার বাসযোগ্য করে তুলতে কমপক্ষে ১৫ বছর সময় লাগতে পারে।

ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ২০১৭ সালের একটি নীতিপত্র অনুসারে, এ অনুমান এই শর্তে করা হয়েছে যে ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ পুনর্গঠনে বড় বাধা সৃষ্টি করবে না। গাজায় আগেও চালানো সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পরও দেখা গেছে।

বর্তমানে দোহায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সঙ্গে কর্মরত গাজার বিশেষজ্ঞ আজমি কেশাওয়ি ব্যাখ্যা করে বলেন, যুদ্ধপরবর্তী যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্মাণসামগ্রী প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের ওপর আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োজন।

কেশাওয়ি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা তাদের জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে সক্ষম। কিন্তু পুনর্গঠনের ইচ্ছা থাকাই যথেষ্ট নয়.

..এটি শুধু তাঁদের ওপর নির্ভর করে না।’

অপরাধী গোষ্ঠী ও দলাদলি

গাজার ভবিষ্যতের জন্য পুনর্গঠন অপরিহার্য হলেও এমন আশঙ্কাও রয়েছে, হামাস ক্ষমতা ছেড়ে দিলে এই ভূখণ্ড সংঘাগ ও অরাজকতায় ডুবে যাবে, যা ট্রাম্পের পরিকল্পনার একটি শর্ত।

গাজা থেকে এখনো প্রতিবেদন পাঠানো সাংবাদিক ইয়াসির আল-বান্না ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘গাজায় হামাসের শাসনের একটি সুবিধা হলো তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।’

এ গণহত্যার সময় ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার নিরাপত্তা বাহিনীকে হত্যা করেছে এবং কুখ্যাত অপরাধী গোষ্ঠীগুলোকে মদদ দিয়েছে, যারা গাজায় আসা সামান্য ত্রাণ চুরি করে সর্বোচ্চ লাভে বিক্রি করেছে।

কেশাওয়ি মনে করেন, এসব গোষ্ঠী এখন সমস্যা হলেও ইসরায়েল গাজা ছেড়ে চলে গেলে তারা টিকতে পারবে না। তাঁর বিশ্বাস, ফিলিস্তিনি সমাজ এই বিশ্বাসঘাতকদের একঘরে করে দেবে।

তবে কেশাওয়ি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গোষ্ঠীগত সংঘাত, বিশেষ করে ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে সংঘাত বড় এক সমস্যা হতে পারে।

ফাতাহ পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অন্যদিকে হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াইয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও গাজার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে।

২০০৬ সালে পিএর প্রধান হওয়ার নির্বাচনে হামাস জয়ী হওয়ার পরপরই ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। এই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তিচুক্তির মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল।

এই নির্বাচনী ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোকে হতবাক করে দিয়েছিল। কারণ, তারা হামাসকে একটি ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কারণ, হামাস ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে বা এ দেশের দখলদারত্বের অবসানে সশস্ত্র প্রতিরোধ থেকে সরে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছিল।

এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ফাতাহকে সমর্থন দেয়। এর ফলে সংক্ষিপ্ত একটি গৃহযুদ্ধ হয়। ২০০৭ সালের জুনের মধ্যে হামাস গাজা থেকে ফাতাহকে বিতাড়িত করে, যা ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিভেদকে আরও পাকা করে তোলে।

কেশাওয়ি বলেন, আঞ্চলিক রাষ্ট্র এবং সম্ভবত ইসরায়েলের সমর্থনে নির্বাসিত কিছু ফাতাহ কর্মকর্তার প্রত্যাবর্তন হামাস ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ডকে উসকে দিতে পারে।

কেশাওয়ি আল–জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েল এসব লোককে গাজায় ফিরে আসতে দিলে তারা হামাসকে সমর্থনকারী মানুষের পেছনে লাগতে পারে।

দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা

গাজায় থাকতে যাঁরা বাধ্য হবেন, তাঁদের ভয়াবহ এক জাতিগত নিধনের স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াবে। তাঁদের মানসিক ট্রমার সঙ্গে লড়াই করতে হবে। ইসরায়েলের অবিরাম আক্রমণে তাঁরা পরিবার, বন্ধু, ঘরবাড়ি এবং ভবিষ্যৎ—অনেক কিছু হারিয়েছেন। এসব নিয়ে ভাবার বা শোক করার মুহূর্ত খুব কম মানুষই পেয়েছেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার শুরুর আগে ২০২২ সালে সেভदদ্য চিলড্রেনের পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, গাজার প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে চারটিই হতাশা, ভয় ও শোক নিয়ে জীবন যাপন করছিল।

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) মতে, এই জাতিগত নিধনের কারণে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর যে সম্মিলিত মানসিক আঘাত এসেছে, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গবেষণা বা দেখা কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনীয় নয়।

গত বছর এমএসএফের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আহমদ মাহমুদ আল-সালেম জর্ডানের আম্মানের একটি ক্লিনিকে গাজার শিশুদের চিকিৎসা করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, বেশির ভাগ শিশুই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন, হতাশা ও অনিদ্রায় ভুগছিল।

লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রির অনারারি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ডেরেক সামারফিল্ড আল–জাজিরাকে বলেন, গাজার শিশুরা এখন যা অনুভব করছে, তা অকল্পনীয়।

সামারফিল্ড উল্লেখ করেন, গাজায় অভিভাবকহীন কমপক্ষে ১৭ হাজার শিশু রয়েছে। তারা কখনো নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ পাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

এই জ্যেষ্ঠ প্রভাষক বলেন, এসব শিশুর ভবিষ্যৎ তাদের ট্রমা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে না। কারণ, তাদের ট্রমা এখনো শেষ হয়নি।’

সামারফিল্ড বলেন, এটি নির্ভর করে তাদের চারপাশের সমাজের কী হবে তার ওপর। কিন্তু তাদের পুরো সমাজই তো ধ্বংস হয়ে গেছে। আর এ কারণেই এটি একটি জাতিগত নিধন।’

গাজার সব মা–বাবার মতো আবু মানদিলও কেবল তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যতের সামান্য নিশ্চয়তা চান।

জাতিগত নিধনের কারণে আবু মানদিলের স্কুলগামী শিশুরা ইতিমধ্যে দুই বছরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কিন্তু এই ভূগোল শিক্ষিকা বলছেন, তিনি তাদের কিছু প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যাতে তারা খুব বেশি পিছিয়ে না পড়ে।

মানদিল বলেন, ‘আমি শুধু চাই, তাদের ভবিষ্যৎ আমাদের চেয়ে ভালো হোক। এই অবিরাম হত্যাকাণ্ড আমার সন্তানদের নিয়ে আমাকে খুব ভীত করে তোলে।’

আবু মানদিল আল–জাজিরাকে বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমি আশা করি এক দিন আমি আমার সন্তানদের গাজা থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারব।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আল জ জ র ক র জন য ম নদ ল র একট র ওপর ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১৮

গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ১৮ জন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। শনিবার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী এবং চিকিৎসকরা জানিয়েছেন,  প্রথম হামলাটি ঘনবসতিপূর্ণ রিমাল পাড়ায় একটি গাড়িতে আঘাত করা হয়েছিল। এর ফলে গাড়িতে আগুন ধরে যায়। নিহত পাঁচজন গাড়ির যাত্রী নাকি পথচারীদের মধ্যে ছিলেন তা তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট নয়। আগুন নেভাতে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার করতে কয়েক ডজন মানুষ ছুটে আসে।

গাড়িতে হামলার কিছুক্ষণ পরেই ইসরায়েলি বিমান বাহিনী মধ্য গাজা উপত্যকার দেইর আল-বালাহ শহর এবং নুসাইরাত ক্যাম্পে দুটি বাড়িতে দুটি পৃথক বিমান হামলা চালায়। এর ফলে কমপক্ষে পাঁচজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

শনিবার পশ্চিম গাজা শহরের একটি বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে চার ফিলিস্তিনি নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ১৮ তে পৌঁছেছে।

১০ অক্টোবর মার্কিন মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। তবে সেই ঘোষণাকে পাশ কাটিয়ে প্রতিদিনই গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মিশরে হামাসের প্রতিনিধি দল
  • ৪৪ দিনে ৫০০ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল
  • ইউনিলিভারে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবেদন শেষ ২৪ নভেম্বর
  • গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১৮