জুলাই সনদ: বাস্তবায়নের উপায় দেখে সিদ্ধান্ত নেবে দলগুলো
Published: 10th, October 2025 GMT
১৫ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
তবে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এখন পর্যন্ত সুপারিশ চূড়ান্ত করেনি কমিশন। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে।
এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত সব দল সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কমিশনের সুপারিশে বাস্তবায়নের উপায় বিশেষ করে গণভোটের সময় ও ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে কী থাকছে—এগুলো আগে দেখতে চায় দলগুলো। এসবের ওপর সনদে সই করা না করার বিষয়টি নির্ভর করছে বলে দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে মতামত দিয়েছে, সেটা ভিত্তি ধরছে কমিশন। প্রয়োজনে এটি আরও সুনির্দিষ্ট ও কিছুটা বিস্তারিত করা হবে।জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলছে। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দলগ ল
এছাড়াও পড়ুন:
যাঁরা গণভোট দেবেন তাঁরা গণভোট নিয়ে কতটা জানেন
দেশজুড়ে কয়েক দিন ধরে আলোচনার পারদ চড়ছে ‘গণভোট’ নিয়ে। পত্রপত্রিকায় গণভোট কবে হবে, রাজনৈতিক দলগুলো কে কীভাবে দেখছে, তা নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু যাঁরা এই গণভোট দেবেন, সেই বাংলাদেশের মালিকেরা কি জানেন ‘গণভোটের বিষয়বস্তু’ কী?
বিষয়টি বোঝার জন্য মঙ্গলবার দেশে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। জেলা শহরের বাইরে থাকা মফস্সলের একজন সাংবাদিক, একজন শিক্ষক, একজন ভ্যানচালক আর একজন কলেজশিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করলাম, ‘সরকারের ঐকমত্য কমিশন ভবিষ্যতে “গণভোট” আয়োজন করতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে আপনারা কিছু জানেন?’ উত্তরে স্থানীয় সাংবাদিক বললেন, ‘জুলাই সনদকে সাংবিধানিক রূপ দেওয়ার জন্য এই ভোট।’
আমি তখন পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘জুলাই সনদে তো অনেক বিষয়বস্তু আছে, ঠিক কোন বিষয়গুলো আপনি জানেন, যার জন্য এই গণভোট?’ এরপর তিনি বললেন, ‘আমি ঠিক সেইভাবে ডিটেলস জানি না।’
স্কুলশিক্ষক বললেন, ‘টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, গণভোট হবে। কিন্তু কী বিষয়ের ওপর হবে, তা আমি এখনো জানি না।’ ভ্যানচালকের কাছে একই প্রশ্ন তোলার পর তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘এটা আবার কিসের ভোট? আমরা তো জানি, সরকারকে আনতে হলে ভোট দিতে হবে ধানের শীষে, নয়তো নৌকায়। এবার তো নৌকা ভোট করতে পারবে না শুনছি। কিন্তু গণভোট কী জিনিস।’
স্থানীয় একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী একই প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘ভাইয়া “গণভোট” হচ্ছে গত বছরের জুলাই-আগস্টে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের সাংবিধানিকভাবে শহীদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং যাঁরা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন, তাঁদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার পক্ষে মতামত প্রদান করার জন্য সরকার “গণভোট” আয়োজন করতে যাচ্ছে।’
বিষয়গুলো জানার পর আমি সত্যি একধরনের অস্বস্তিতে পড়লাম। সরকারের ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র মেরামতের সংস্কার কার্যক্রমের অংশগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চালিয়ে আসছে, টেলিভিশনগুলোয় সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে, এরপরও মানুষ জানে না ‘গণভোট’ আসলে কিসের জন্য হচ্ছে, তাঁদের ভোট দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কোন বিষয়ে পরবর্তী সরকার পরিবর্তন আনবে, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখছে না।
অথচ রাজনৈতিক দলগুলো এই গণভোট আয়োজনের পক্ষে, এরই মধ্যে ‘হ্যাঁ’ সূচক বার্তা দিয়েছে। কিন্তু যাঁদের জন্য জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জনগণ ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ ভোটের রায় দেবেন, তাঁদের ইলমে আনার দায়িত্ব কে নেবে?
আরও পড়ুনগণভোট অপ্রয়োজনীয়, তবে এরপরও যদি হয়...০৮ অক্টোবর ২০২৫দেশের ক্রান্তিকালে হ্যাঁ কিংবা না ভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের বিষয়গুলোকে সাংবিধানিক ভিত্তি দেওয়ার এই প্রচেষ্টা ইতিবাচক বা নেতিবাচক হবে, তা নিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে আলোচনা কিংবা সমালোচনা চলছে।
যাঁরা ঐকমত্য কমিশনে নিয়মিত যাচ্ছেন, কথা বলছেন, সেই সব মানুষ ব্যতীত তাঁদের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা জুলাই সনদে মোটাদাগের কতটি বুলেট পয়েন্ট জানছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেমন জরুরি, তেমনি জুলাই সনদের মধ্য দিয়ে সংবিধানকে ঋত করা কতটা যাবে, তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক সমাজের বাইরে থাকা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ না করে এমন সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবসম্মত হচ্ছে, তা নিয়ে অবশ্যই কথা উঠবে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, দেশের অর্ধেক মালিক যেখানে নারী, সেই ‘নারীর সত্তা’বিবর্জিত ঐকমত্য কমিশনে আলোচকদের বেঁধে দেওয়া জুলাই সনদে নারীদের মতামতকে উপেক্ষা করে ‘সাংবিধানিক’ ভিত্তি রচনা করার প্রয়াস আমাদের পুরুষতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সামনে তুলে আনছে।
রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার জন্য ‘আইন তৈরি’ কখনোই গিনিপিগ হতে পারে না। এক সরকার ভালো লাগবে, আরেক সরকারকে ভালো লাগবে না—এমন বৈরিতায় রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য থেকে বারবার বিচ্যুতকরণ আমাদের জন্য সুখকর বার্তা দেয় না। আমরা চাই, ভবিষ্যতে আমাদের রাষ্ট্রের শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা চালু হোক, যেখানে সব শ্রেণির মানুষের মতামতকে শ্রদ্ধা জানানো হবে, গণতান্ত্রিক পদযাত্রায় কারও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ পাবে না।দেশের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা দুই নারী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সংসদে আলোচনায় আইনকানুন সংযোজন–বিয়োজন হওয়ার সুযোগ অতীতে আমরা দেখলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকমত্য কমিশন কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর থেকে কোনো নারী প্রতিনিধি না রাখার বিষয়টি আপনি উপেক্ষা করতে পারেন না।
সরকারের ঐকমত্য কমিশনের সদস্যেদের মধ্যে নারী প্রতিনিধি না থাকলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভেতর থাকা নারী নেতৃত্বের মধ্যে থেকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকার পর আমরা তাঁদের মূল্যায়ন করতে পারিনি। ফলে পুরুষদের দ্বারা পরিচালিত জুলাই সনদে নারীদের মতামতের অনুপস্থিতি কখনোই গণতান্ত্রিক মতৈক্যের সন্নিবেশ ঘটে না।
হ্যাঁ এ কথা সত্য, দেশ রাজনীতিবিদেরাই শাসন করে আসছেন। কিন্তু তাঁদের বাইরে থাকা সমাজের স্টেকহোল্ডার মতামতকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে কথাবার্তা শোনা যায়।
শুধু সমতলের মানুষ নয়, জুলাই সনদের বিষয়বস্তু নিয়ে পাহাড়ি জনপদের মানুষদের ভেতর কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে, তা জানার ও বোঝার সুযোগ আমাদের থাকতেই হবে। বিশেষ করে, গণভোটকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তগুলো কী হচ্ছে, সে বিষয়ে রাষ্ট্রের মালিকদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি গণভোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোকপাত করা জরুরি। এই কাজ যেমন সরকার করতে পারে, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে জনমত গঠন করতে পারে। কেবল চাপিয়ে দেওয়া একটি প্রশ্ন ‘জুলাই সনদের পক্ষে’ হ্যাঁ কিংবা না সূচক প্রশ্ন তুলে বাধ্যবাধকতা তৈরি করা নাগরিকের প্রকৃত মতামতকে অবমূল্যায়নের শামিল।
আরও পড়ুনসংসদ, পরিষদ না গণভোট— কোন পথে যাবে দেশ২০ আগস্ট ২০২৫আবার দেশের মোট ভোটারের কত শতাংশ ভোট পড়লে এই গণভোটের রায় বৈধ হবে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ধরুন, ১০০ জন ভোটারের মধ্যে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছেন ৩০ জন, যাঁদের মধ্যে ২৮ জনই গণভোটে ‘হ্যাঁ’ সূচকে রায় দিয়ে জুলাই সনদকে ভিত্তি দিয়েছে বলে প্রচারিত হলে প্রকৃতপক্ষে অন্যদের গণভোটে টানতে না পারার ব্যর্থতা এই সরকারকে যেমন নিতে হবে, তেমনি রাজনীতিবিদদেরও নিতে হবে।
১৯৭৭ সালের ৩১ মে নিউইয়র্ক টাইমসের ষষ্ঠ পাতায় বাংলাদেশের একটি গণভোটের শিরোনাম করেছিল ‘মার্শাল রুল ইন বাংলাদেশ অ্যাপ্রুভড ইন রেফেরেন্ডাম’, যেখানে তারা প্রশ্ন তুলেছিল, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনব্যবস্থার পক্ষে আস্থা ভোটে এক-তৃতীয়াংশ ভোটে তিনি জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু কতজন ভোট প্রদান করেছিলেন? যাঁরা ভোটে যাননি, তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। সুতরাং ভবিষ্যতে যদি ৯০ শতাংশ ভোটে জুলাই সনদ জয়যুক্ত হয়েছে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে কতজন ভোট দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে।
জুলাই সনদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান বিতরণের দায়িত্ব যেমন গণমাধ্যমগুলোর রয়েছে, তেমনি সরকারের উচিত হবে ‘গণভোটের’ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিষয়ে সমাজের সব শ্রেণি মানুষের মধ্যে তথ্য শেয়ার করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই দেশের নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়, যাঁরা পড়াশোনা জানেন না, তাঁদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।
আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকা, রাষ্ট্রপতিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া, প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত কমিটির মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগব্যবস্থা কেন প্রয়োজন, এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন। কেবল একটি দল দাবি করেছে কিংবা আরেকটি দল বিরোধিতা করেছে—এমন পটভূমিতে উঠে আসা বিষয়বস্তুর জন্য ‘গণভোটের’ প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রের মালিকদের কাছে জবাবদিহি থাকতে হবে।
অন্যদিকে নির্বাহী আদেশে নির্বাচন থেকে দূরে সরে যাওয়া রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পরবর্তী পটভূমিতে সেটি সচল কিংবা বাতিলের দাবিকে কীভাবে দেখা হবে, তা নিয়ে আলোচনা থাকা জরুরি। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্যালট পেপার ছাপানো, ভোট গ্রহণের পর কেউ ক্ষমতায় আরোহণ করে এই সনদকে অবমূল্যায়ন করার ফাঁকফোকর পাবে কি না, তা নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে।
রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার জন্য ‘আইন তৈরি’ কখনোই গিনিপিগ হতে পারে না। এক সরকার ভালো লাগবে, আরেক সরকারকে ভালো লাগবে না—এমন বৈরিতায় রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য থেকে বারবার বিচ্যুতকরণ আমাদের জন্য সুখকর বার্তা দেয় না। আমরা চাই, ভবিষ্যতে আমাদের রাষ্ট্রের শক্তিশালী শাসনব্যবস্থা চালু হোক, যেখানে সব শ্রেণির মানুষের মতামতকে শ্রদ্ধা জানানো হবে, গণতান্ত্রিক পদযাত্রায় কারও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ পাবে না।
নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব