প্রশ্নটি আমার নয়। তবে বোধ হয় অনেকেরই। সাম্প্রতিক আর্থিক খাতের এক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে স্বয়ং অর্থ উপদেষ্টা সরাসরি না হলেও অনেকটা ইঙ্গিতে এ ধরনের চ্যালেঞ্জের কথাই বললেন। বিদেশিরা, বিশেষ করে বিনিয়োগকারীরা বরং নির্বাচনকেন্দ্রিক কিংবা নির্বাচন–পরবর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে অনেক কথা বলছেন।

কেউ কেউ আবার ন্যূনতম আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বর্তমান সরকারের দুর্বলতা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাঁরা চিন্তিত এই নিয়ে যে নির্বাচন নিয়ে হাঙ্গামা আরও বেড়ে যাবে কি না। দু-একজন আবার হাঙ্গামা দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, বিমানবন্দর কিংবা সমুদ্রবন্দরে কাজকর্ম ব্যাহত হবে কি না, এটি নিয়ে চিন্তিত। চিন্তিত এ ধরনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করবে কি না, এ নিয়ে।

আমদানি দায় নিষ্পত্তি করা যাবে কি না, এ নিয়ে। নির্বাচনকালীন বা পরবর্তী হাঙ্গামা গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে কি না। আমি অবশ্য তাঁদের বলেই যাচ্ছি, আমি এ ধরনের পরিস্থিতির আশঙ্কা করছি না। কারণ, তাঁরাও যেটা জানেন, আমরাও দেখছি আমাদের প্রবাসী আয় বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, বৈদেশিক দায় বাড়লেও বিদেশি সাহায্য বাড়ছে, সরকারের আয় তেমন না বাড়লেও সরকার ঘোষিতভাবে কৃচ্ছ্রতা বজায় রাখার কথা বলছে। আমদানিকে কমিয়ে, বাজার থেকে ডলার কিনে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

আরও পড়ুনবাংলাদেশে ‘মাফিয়া অর্থনীতি’ দমন কতটা সম্ভব হচ্ছে০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তবে আশঙ্কা যেন থেকেই যাচ্ছে। আশঙ্কিত সবাই নৈরাশ্যবাদী কি না, আমি অবশ্য জানি না। বিশ্বব্যাংক, এডিবি নৈরাশ্যবাদী কি না, তা–ও আমি জানি না। তবে গত অর্থবছরের শুরুতে ছাত্র-তরুণ নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ সুদের হার ও লাগামহীন মূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। সার্বিক প্রবৃদ্ধি গত বছরের ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর। মূল্যস্ফীতিতে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, সুদের হার বৃদ্ধি, ঋণসংকট, ব্যাংক খাতের অনিশ্চয়তা ও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের অনীহা অর্থনীতির গতি শ্লথ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ প্রতিবেদনেও অনেকটা এ চিত্র উঠে এসেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই ধীরগতি শুধু প্রবৃদ্ধিকেই নয়, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনাকেও গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

বিশ্বব্যাংকের উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যায়, যা নতুন শিল্প ও উৎপাদন প্রকল্পে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত। উচ্চ সুদের হার, ব্যয়বহুল কাঁচামাল ও অনিশ্চিত মুদ্রানীতি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহ করেছে। ফলে বিনিয়োগ স্থবিরতা সার্বিক প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ বাস্তবায়ন, জরুরি তারল্য সহায়তা (ইএলএ) চালু এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। অভিজ্ঞদের মতে, এখন প্রয়োজন নীতিগত স্থিতিশীলতা ও বাস্তবসম্মত সংস্কার, যাতে বিনিয়োগ আস্থা ফিরিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়।

তবে একই সময়ে রপ্তানি খাত কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্য খাতের সাফল্যে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাসী আয়ও ইতিহাসের অন্যতম উচ্চপর্যায়ে উঠে এসেছে ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে। বলা হচ্ছে, এই দুটি খাতের ইতিবাচক প্রভাবেই অর্থনীতি পুরোপুরি সংকটে না পড়ে স্থিতিশীল থাকার চেষ্টা করেছে।

কৃষি খাত বছরের শেষ ভাগে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও শিল্প ও নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে ছিল। সেবা খাতেও মন্দাভাব বিরাজ করেছে, বিশেষ করে বাণিজ্য, পরিবহন ও আবাসন খাতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। শ্রমবাজারে সংকট আরও প্রকট; ২০২৪ সালে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় মোট কর্মসংস্থান অনুপাত ২ দশমিক ১ শতাংশ কমে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে বেকারত্বের হার বেড়ে ৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে।

আরও পড়ুনব্যাংক সংস্কার: রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত কেন প্রয়োজন০৩ জানুয়ারি ২০২৫

অন্যদিকে ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতা অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হিসাব করলে মার্চ ২০২৫ নাগাদ ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ১ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তিন গুণের বেশি। মূলধনঝুঁকি অনুপাত কমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে এসেছে, যা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রক মান ১০ শতাংশের নিচে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং নতুন ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ জারি করেছে।

বহিঃখাতে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে আট বছর পর দেশটি প্রথমবারের মতো চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে এসেছে ১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আমদানি কার্যক্রমের মধ্যেও বৈপরীত্য বিদ্যমান। খাদ্য ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বেড়েছে, কিন্তু যন্ত্রপাতি ও মূলধনি পণ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও উৎপাদন সম্প্রসারণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

আরও পড়ুনবেকারত্ব: প্রবহমান সমস্যাটির সমাধান কী০৬ জুন ২০২৫

রাজস্ব খাতের অবস্থা বেশ করুণ। কর আদায় জিডিপির অনুপাতে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়ে বর্তমান ব্যয় জিডিপির ৯ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছেছে, আর উন্নয়ন ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব সংস্কারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন কর নীতি ও প্রশাসনের পৃথক্‌করণ, কর অব্যাহতির ব্যবস্থাপনা সংস্কার এবং বাধ্যতামূলক অনলাইন রিটার্ন দাখিল। তবু সরকারি ঋণ জিডিপির অনুপাতে আরও ভারী হয়েছে, যার প্রায় ৩৭ শতাংশ এখন দেশীয় ব্যাংকব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।

বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমবে এবং ভোগব্যয় বাড়লে চাহিদা পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, সংস্কার বিলম্ব ও জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতি আগামী বছরেও বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের পথে বড় বাধা হিসেবে থেকে যাবে।

আরও পড়ুনপুঁজিক্ষুধার্ত বাংলাদেশে কীভাবে বিনিয়োগ আসবে০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

তাঁদের মতে, রপ্তানি বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প আগামী বছরও প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হবে। তবে আমদানি স্বাভাবিক হলে চলতি হিসাব আবার ঘাটতিতে যেতে পারে। রাজস্ব ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা নিচ্ছে, যদিও কৃষি ও জ্বালানি খাতে ব্যয় এখনো বেশি থাকবে। সরকারি ঋণও বাড়ছে—২০২৭ সালের মধ্যে তা জিডিপির ৪১ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ বাস্তবায়ন, জরুরি তারল্য সহায়তা (ইএলএ) চালু এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। অভিজ্ঞদের মতে, এখন প্রয়োজন নীতিগত স্থিতিশীলতা ও বাস্তবসম্মত সংস্কার, যাতে বিনিয়োগ আস্থা ফিরিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়।

বিশ্বব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা যেমন সুশাসন আর সরকারের দক্ষতার ওপর জোর দিয়েছেন, তেমনি প্রশাসনের সক্ষমতা, গুণগত ব্যয় ব্যবস্থাপনা আর মানবসম্পদের উন্নয়নের কথাও বলেছেন। আমাদের মতো তাঁদের অনেকেই তাকিয়ে আছেন নির্বাচনের পর নতুন সরকার কীভাবে দেশ চালায়, শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে আর ব্যক্তি খাতকে প্রণোদিত করে।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক

মতামত লেখকের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক প রব দ ধ ব শ বব য ব শ ষ কর ৪ দশম ক সরক র র অন প ত দ র মত দ র বল অন শ চ আরও প আমদ ন আশঙ ক বছর র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ১২২ দেশে এগিয়ে বাংলাদেশ, পিছিয়ে ১০৪ দেশে

বিশ্বের ২২৬ দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করে বাংলাদেশ; কিন্তু এ বাণিজ্য সব মহাদেশে সমান নয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় রপ্তানিতে সাফল্যের ওপর ভর করে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে এগিয়ে থাকলেও এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাংলাদেশ এখনো বাণিজ্যঘাটতির দেশ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ১২২ দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। তবে এ সাফল্য ঢাকা পড়ে গেছে ১০৪ দেশের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতিতে। কারণ, ঘাটতি এত বেশি যে ১২২ দেশে এগিয়ে থেকেও বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যঘাটতি বেশি।

এনবিআরের হিসাবে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্বের ২০১ দেশে ৪ হাজার ৬৫৭ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে বিশ্বের ২০৬ দেশ থেকে আমদানি করেছে ৬ হাজার ৭৪৪ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৭ কোটি ডলারের। আমদানি–রপ্তানি মিলিয়ে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ হাজার ৪০২ কোটি ডলার।

সবচেয়ে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে
বিশ্বের বৃহৎ ভোক্তার বাজার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। গত অর্থবছরে দেশটিতে ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। তার বিপরীতে আমদানি করেছে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। সেই হিসাবে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত বাণিজ্য ৬২৬ কোটি ডলারে, যা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি।

চার দশক আগে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে কোটাসুবিধা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি এগিয়েছে দেশটিতে। শুধু এগিয়ে নয়, একক বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। পাল্টা শুল্ক আরোপের পরও এখনো দেশটিতে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও উত্তর আমেরিকার কানাডা, মেক্সিকো, পানামার মতো দেশগুলোয় বাংলাদেশের আমদানির তুলনায় রপ্তানি বেশি। গত অর্থবছরে এই মহাদেশের ২৫টি দেশ ও অঞ্চলে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১ হাজার ৬৭ কোটি ডলারের পণ্য। এর বিপরীতে আমদানি করেছে ৩৪৮ কোটি ডলারের পণ্য। সেই হিসাবে ৭১৯ কোটি ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাংলাদেশের।

পোশাকে ভর করে এগিয়ে ইউরোপেও
ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যেও ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এসব দেশ থেকে বাংলাদেশের মোট আমদানি কম, রপ্তানি বেশি। বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার ইউরোপের দেশগুলো। মূলত এই একটি পণ্য দিয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

গত অর্থবছর ইউরোপ মহাদেশের ৫১টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বাংলাদেশ দ২ হাজার ৬৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে এসব দেশ থেকে আমদানি হয়েছে ৫১০ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে এই মহাদেশের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যে বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত রয়েছে ২ হাজার ১৬৬ কোটি ডলার।

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির সঙ্গে বাণিজ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছর দেশটিতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫৩২ কোটি ডলারের পণ্য। আর আমদানি হয়েছে ৮২ কোটি ডলারের। দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৪৫০ কোটি ডলার। জার্মানি ছাড়াও যুক্তরাজ্য, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, পোলান্ড, ইতালি, ডেনমার্ক, সুইডেন, বেলজিয়ামের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

বড় ঘাটতি চীন–ভারতে
এশিয়া মহাদেশে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের বড় ঘাটতি চীনের সঙ্গে। দেশটি থেকে গত অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৬১ কোটি ডলারের। এর বিপরীতে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৭৪ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতি ১ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলারের।

চীনের পরেই বড় ঘাটতি ভারতের সঙ্গে। যদিও প্রতিবেশী দেশটিতে রপ্তানি বাড়তে থাকায় ঘাটতি কমছে। এরপরও গত অর্থবছরে দেশটি থেকে আমদানি হয়েছে ৯৬৮ কোটি ডলার পণ্য। রপ্তানি হয়েছে ১৮২ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে বছর শেষে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতি ৭৮৬ কোটি ডলারের।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চীন–ভারত থেকে আমদানি বেশি হলেও তা আবার ইউরোপ–আমেরিকায় রপ্তানিতে ভূমিকা রাখছে। কারণ, এই দুই দেশ থেকে বাংলাদেশ রপ্তানির কাঁচামাল আমদানি করে বেশি, যা দিয়ে ইউরোপ–আমেরিকার দেশগুলোতে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের ৫৪ শতাংশই ছিল রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল। বাকি ৪৬ শতাংশ ছিল বাণিজিক পণ্য। একইভাবে ভারত থেকে গত অর্থবছরে আমদানি হওয়া পণ্যের ৩১ শতাংশই ছিল রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল। বাংলাদেশের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের বড় উৎস এই দেশ দুটি। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে কম সময়ে ও কম খরচে পণ্য আমদানি করা যায়। আবার রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ছাড়াও বাণিজ্যিক পণ্য, ইলেকট্রনিক পণ্যের বড় উৎস চীন। দুই দেশ থেকে কম খরচে পণ্য আমদানি করা যায় বলে দেশের ভোক্তারাও সুফল পাচ্ছেন।

চীন–ভারতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেও আমাদের আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। সবমিলিয়ে এশিয়া মহাদেশের ৫১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য রয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ হয়েছে এই মহাদেশের দেশগুলোর সঙ্গে।

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোনো দেশের সঙ্গে ঘাটতি থাকবে, কোনো দেশের সঙ্গে উদ্বৃত্ত থাকবে। তবে মোট বৈদেশিক বাণিজ্য যাতে উদ্বৃত্ত থাকে, সেই চেষ্টা থাকতে হবে। মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি

ক্ষুদ্র বাজার, তবু ঘাটতি
দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বেশ পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে থেকে বাংলাদেশের আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। এই তিন দেশ থেকে মূলত সয়াবিন তেল, সয়াবিন বীজ, গমসহ কৃষিপণ্য আমদানি করা হয়। গত অর্থবছরে এই মহাদেশের দেশগুলো থেকে ৩৮৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, রপ্তানি হয়েছে ৬০ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে অর্থবছর শেষে ঘাটতি দাঁড়ায় ৩২৯ কোটি ডলারে।

আফ্রিকার দেশগুলোতেও বাংলাদেশের রপ্তানি কম, আমদানি বেশি। গত অর্থবছরে এই মহাদেশের দেশগুলো থেকে ২৮১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, রপ্তানি হয়েছে ৪৪ কোটি ডলার। তাতে অর্থবছর শেষে ঘাটতি দাঁড়ায় ২৩৭ কোটি ডলারে।

একইভাবে ওশেনিয়া মহাদেশের দেশগুলোতে গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ১০৩ কোটি ডলারের পণ্য, আমদানি হয়েছে ১৮৫ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে বাণিজ্যঘাটতি ৮৩ কোটি ডলারের।

 নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস–বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেল শিল্প গড়ে উঠবে। রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ঘটবে। তাতে রপ্তানি বাড়িয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি কমানো সম্ভব।
আমিরুল হক, এমডি, সিকম গ্রুপ

আমদানি কেন বেশি, রপ্তানি কেন কম
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্পের কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত পণ্যে বাংলাদেশের আমদানিনির্ভরতা বেশি। আমদানি প্রতিস্থাপক কারখানা গুটিকয় পণ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে আমদানিনির্ভরতাও কমছে না। আবার রপ্তানির ঝুড়িতে পণ্যের সংখ্যাও কম। প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য রপ্তানিতে অগ্রগতি নেই। যেমন গত অর্থবছরে রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই বা ৩ হাজার ৯৪৭ কোটি ডলার ছিল তৈরি পোশাক। দ্বিতীয় স্থানে থাকা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের হিস্যা মোট রপ্তানির ২ শতাংশের কাছাকাছি বা ১১৩ কোটি ডলারের। আর কোনো খাতের রপ্তানি আয় বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেনি।

আমদানি বেশি হওয়ায় বাংলাদেশমুখী পণ্যে পরিবহনভাড়া তুলনামূলক বেশি, যা মূলত পরিশোধ করে আমদানিকারকেরা। কিন্তু রপ্তানি কম থাকায় রপ্তানিতে পরিবহনভাড়া কম, যা মূলত পরিশোধ করেন বিদেশি ক্রেতারা।

ঘাটতি কমাতে যা দরকার
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোনো দেশের সঙ্গে ঘাটতি থাকবে, কোনো দেশের সঙ্গে উদ্বৃত্ত থাকবে। তবে মোট বৈদেশিক বাণিজ্য যাতে উদ্বৃত্ত থাকে, সেই চেষ্টা থাকতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও যোগাযোগ—এই তিনের সংশ্লেষ ঘটিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাতে রপ্তানি বাড়তে পারে। মানবতন্তু দিয়ে তৈরি পোশাকের বৈচিত্র যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বহুমুখী পণ্যের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ দরকার।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও আসিয়ানের দেশগুলো থেকে আমাদের আমদানি ৬০ শতাংশের বেশি। কিন্তু রপ্তানি ১২ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এসব দেশ বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে। তাই দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়াতে নজর দিতে হবে। তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্যে আমরা উদ্বৃত্ত অবস্থায় থাকব।’

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতির বিষয়ে জানতে চাইলে সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্যঘাটতি কমাতে দুটি বিষয় জরুরি। এক, সরকারি বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বাণিজ্যে সমঝোতার দক্ষতা। যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের আমদানি বেশি তাদের বলতে হবে, তুমি কী কিনবে? যেমন ভারতের সঙ্গে আমাদের শুল্ক–অশুল্ক বাধা অনেক। ভিসাও পাওয়া যায় না। তাহলে রপ্তানি বাড়বে কীভাবে? দুই, সহায়তা নয়, একজন উদ্যোক্তার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। যেমন নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস–বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেল শিল্প গড়ে উঠবে। রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ঘটবে। তাতে রপ্তানি বাড়িয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ঘাটতি কমানো সম্ভব।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নানা আয়োজনে মোংলা বন্দরের প্লাটিনাম জয়ন্তী উদ্‌যাপন
  • ব্যবসা-বাণিজ্যে কমলেও ভোক্তাঋণে বড় প্রবৃদ্ধি কেন
  • নভেম্বরের ২৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৩২ হাজার কোটি টাকা
  • ভারত, চীন, রাশিয়া ও জাপান চার মাসে ঋণের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি
  • চিত্রা নদী দখল করে পৌরসভার ভবন, এবার নির্মাণ হচ্ছে সীমানাপ্রাচীর
  • দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ১২২ দেশে এগিয়ে বাংলাদেশ, পিছিয়ে ১০৪ দেশে