সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরীগাছ পরগাছার আক্রমণে বিপন্ন
Published: 19th, October 2025 GMT
সুন্দরবনসংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার গোবরা গ্রামের বনজীবী জাহিদুল ইসলাম। ৩০ বছর ধরে সুন্দরবন ঘিরে জীবিকা তাঁর। সম্প্রতি সুন্দরবনের একটি পরিবর্তন তাঁর চোখে পড়েছে। সেটি হলো—পাঁচ-ছয় বছর আগেও যেখানে সুন্দরীগাছের ঘন জঙ্গল ছিল, এখন সেসব জায়গা প্রায় ফাঁকা। বহু সুন্দরীগাছ শুকিয়ে গেছে।
সুন্দরীগাছ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পেল পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো.
বনজীবী ও বন কর্মকর্তার কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সুন্দরবনে সুন্দরীগাছ বিপদে পড়েছে। এই বিপদের নাম ‘পরগাছা’। এই নীরব পরজীবী সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরীগাছকে ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ করছে। আগে শাখা-প্রশাখায় সীমাবদ্ধ থাকা পরগাছা এখন মূল অংশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। গাছ দুর্বল হয়ে একসময় শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। তবে এই পরগাছা নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। ফলে কীভাবে এর মোকাবিলা করে সুন্দরীগাছ বাঁচানো যাবে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
গহিন বনে একের পর এক রোগাক্রান্ত গাছবিষয়টি সরেজমিনে দেখতে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে যান সুন্দরবনের শিবসা নদীসংলগ্ন কালাবগী এলাকার গহিন অরণ্যে। যত ভেতরে যাচ্ছিলেন, চোখে পড়ছিল একের পর এক রোগাক্রান্ত গাছ। কিছু শুকিয়ে মরা, কিছু আগা মরায় কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ সুন্দরীগাছের গায়ে দেখা গেল ধূসর-বিবর্ণ কিংবা গাঢ় সবুজ রঙের নানা ধরনের পরগাছা। কারও গায়ে যেন শেওলার চাদর, কারও ডালে ঘন লতাপাতার আস্তরণ।
গত বছরও একই জায়গায় গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। তখন এমন পরগাছার ছড়াছড়ি ছিল না। সফরসঙ্গীদের মধ্যে যাঁরা বহুবার সুন্দরবনের এই অঞ্চলে গেছেন, তাঁরাও বললেন, কয়েক বছর আগেও এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি। কয়রায় ফিরে তিনি কথা বলেন প্রবীণ-নবীন মিলে ১০ জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালের সঙ্গে। প্রত্যেকেই বললেন, এখন সুন্দরবনের গাছে পরগাছা অনেক বেড়েছে। আগে এতটা দেখা যেত না। বয়স্ক ও সুন্দরী প্রজাতির গাছই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।
সুন্দরবনের কোনো কোনো গাছে যেন শেওলার চাদর। সুন্দরবনের কালাবগী এলাকায়উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন র স ন দর গ ছ
এছাড়াও পড়ুন:
লোনাপানির সুন্দরবনের নিচে লুকিয়ে আছে মিঠাপানির ভান্ডার
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে পানি মানেই একরাশ তিক্ততার গল্প। নোনাজল, আর্সেনিক দূষণ, নদীর লবণাক্ততার বিস্তার—সব মিলিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বছরের বেশির ভাগ সময়ই নিরাপদ পানির সংকটে ভোগেন। খুলনা, সাতক্ষীরা আর বাগেরহাটজুড়ে চিংড়িঘের, ভাঙন, খরা ও লবণাক্ত নদীর পানি যেন জীবনের স্থায়ী সঙ্গী।
এই বাস্তবতার মধ্যে আন্তর্জাতিক একদল গবেষকের নতুন দাবি যেন উপকূলের বুকেই এক অচেনা আশার ঝরনা বইয়ে দিয়েছে। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, মাটির বহু গভীরে লুকিয়ে আছে দুটি বিশাল মিঠাপানির ভান্ডার। হাজার বছর আগের সেই পানি আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে।
গবেষণাটি গত শুক্রবার খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনসে প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মেক্সিকো ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা খুলনা শহর থেকে সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে আধুনিক ভূ-তড়িৎ-চৌম্বকীয় প্রযুক্তি, ম্যাগনেটোটেলুরিক ব্যবহার করে ভূগর্ভের অভ্যন্তরীণ গঠন পরীক্ষা করেন।
সুন্দরবনে প্যালিও ওয়াটারের দুটি উৎস পাওয়া গেছে। প্যালিও ওয়াটার হলো প্রাচীন ভূগর্ভস্থ জল, যা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকে। এটি প্রাচীন সুন্দরবনের বয়স ও গঠনের ধারণাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ইসমে আজম, সুন্দরবনবিষয়ক লেখক ও গবেষকগবেষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খুলনার উত্তরের অংশে প্রায় ২০০ থেকে ৮০০ মিটার গভীরে বিস্তৃত আছে বিশাল এক মিঠাপানির স্তর। এটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং পানির লবণাক্ততা এত কম যে সরাসরি মিঠাপানি হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পানি তৈরি হয়েছিল শেষ বরফযুগে, যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ আজকের তুলনায় প্রায় ১২০ মিটার নিচে ছিল। তখন নদীগুলো গভীর উপত্যকা তৈরি করে সমুদ্রের দিকে ছুটে যেত এবং সেই বালুমিশ্রিত নদীপথে প্রবেশ করা বৃষ্টির পানি হাজার বছর ধরে ভূগর্ভে সঞ্চিত থাকত।
সুন্দরবনের ভেতরে পাওয়া গেছে দ্বিতীয় আরেকটি মিঠাপানির ভান্ডার। এটি আকারে তুলনামূলক ছোট এবং গভীরতাও কম, কিন্তু লবণাক্ততার মাত্রা এতটাই নিচে যে এ অঞ্চলেও নিরাপদ পানির আরেকটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এই দুটি ভান্ডারের মাঝখানে আছে একটি প্রশস্ত লবণাক্ত পানির স্তর, যা গঙ্গার প্রাচীন নদীখাত ভরাট হয়ে তৈরি হয়েছে। বরফযুগের পর সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়তে শুরু করলে এই এলাকাগুলো লবণাক্ত কাদা-মাটিতে ঢেকে যায় এবং এখন তা স্থায়ী লবণাক্ত স্তর হিসেবে ভূগর্ভে রয়ে গেছে।
গুগল স্যাটেলাইট মানচিত্রে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ