সাধ‌্যের সবকুটু দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে গেল আয়ারল‌্যান্ড। টপ ও মিডল অর্ডারে যা কমতি ছিল, লোয়ার অর্ডারের ব‌্যাটসম‌্যানরা তা পুষিয়ে দিল চোখের পলকে, চমকে দিয়ে। জয়ের জন‌্য ৪ উইকেটের অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ। ৫৯.৩ ওভার ব‌্যাটিং করে স্বাগতিক শিবিরে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল আয়ারল‌্যান্ড।

চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, দৃঢ়চেতা মনোবল, বুক চিতিয়ে লড়াই ও হার না মানা মাসকিতায় বাংলাদেশকে কঠিন সময় দিল তারা। মিরপুরের রেকর্ড বুক এলোমেলো করলো মাটি কামড়ে পড়ে থাকা ব‌্যাটিংয়ে। ২২ গজে তাদের রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক ব‌্যাটিংয়ে তরতাজা হয়ে উঠল ম‌্যাচের প্রাণ। তাতে শের-ই-বাংলায় চতুর্থ দিনে দৃষ্টিনন্দন ব‌্যাটিংয়ে ম‌্যাচ একঘেয়ে হলো না। সমানে সমান লড়াইয়ে শেষ হাসিটা বাংলাদেশ হারলেও আয়ারল‌্যান্ড নিশ্চিতভাবেই মন জয় করে নিয়েছে ক্রিকেটপ্রেমিদের।

আরো পড়ুন:

২১৭ রানের জয়ে আয়ারল্যান্ড হোয়াইটওয়াশ

জয়ের সুবাতাস পাচ্ছে বাংলাদেশ, তিন বছর পর মিরপুর টেস্ট পঞ্চম দিনে

২১৭ রানের বিশাল জয়ে বাংলাদেশ সিলেটের পর ঢাকা টেস্টও জিতে নিল। ৫০৯ রানের বিশাল লক্ষ‌্য তাড়া করতে নেমে চতুর্থ ইনিংসে আয়ারল‌্যান্ড অলআউট ২৯১ রানে। ৭১ রানের অপরাজিত থেকে কার্টিস ক‌্যাম্পার যখন সাজঘরে ফেরেন দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানান সমর্থকরা। মাঠেই এগিয়ে গিয়ে তাকে স্বান্তনা দেন শততম টেস্ট খেলা মুশফিকুর রহিম। কথা বলতে দেখা যায় বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তকেও।

জয় এমনিতেই বাংলাদেশের নাগালে ছিল। কিন্তু সেই জয়কে বিলম্বিত করলো আয়ারল‌্যান্ডের লেজের ব‌্যাটসম‌্যানরা। ২০২২ সালের পর মিরপুর টেস্ট পঞ্চম দিনে গড়ানোয় উইকেটের আচরণ কেমন হবে তা ছিল দেখার। স্পিনাররা সাহায‌্য পাবে বোঝা যাচ্ছিল। তবে বল বাড়তি কোনো টার্ণ বা উচুঁ-নিচু হয়নি। মিরপুরের উইকেট নিয়ে আগে যে ‘অভিযোগ’ ছিল তা ছিল না। স্বাগতিক দল বাড়তি সুবিধা তো পায়নি বরং স্পোর্টিং উইকেটে দুই দল লড়াই করেছে ভালোভাবেই। খানিকটা ঘাস এবং উইকেট না ভাঙায় লড়াইটা জমেছে বেশ। ক্রিকইনফোর ভাষ‌্যমতে, বল ৪.

১ ডিগ্রি টার্ন করেছে যা এই পাঁচ দিনে ছিল সর্বোচ্চ।

তাইজুলের হাত ধরে বাংলাদেশ প্রথম সাফল‌্য পায় দিনের ১৪তম ওভারে। দ্বিতীয় বলে তাইজুলের আর্ম বল সোজা আঘাত করে ম‌্যাকব্রাইনের প‌্যাডে। ফিল্ডারদের জোরালো আবেদনে আম্পায়ার আঙুল তোলেন মুহূর্তেই। ৫৩ বলে ২১ রান করা ম‌্যাকব্রাইন রিভিউ নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টায় ব‌্যর্থ হলে ফিরতে হয় ড্রেসিংরুমে।

উইকেটে এসে জর্ডান নেইল প্রতি আক্রমণে গিয়ে রান তোলা শুরু করেন। তার খেলা দ্বিতীয় বলেই পেয়ে যান বাউন্ডারি। পরের পাঁচ ওভারে তার ব‌্যাট থেকে আসে তিন চার ও এক ছক্কা। নেইল আক্রমণ ধরে রাখেন পরবর্তীতেও। তার সঙ্গে যোগ দেন ক‌্যাম্পারও। দুজন ৮৫ বলে ৪৮ রান যোগ করে বাংলাদেশ শিবিরে ভয় দেখান।

নতুন বল নেওয়ার পর বাংলাদেশের ভাগ‌্য ফেরে। প্রথম ওভারে তাইজুল এক বাউন্ডারি হজম করে ৫ রান দেন। দ্বিতীয় ওভারে মিরাজ উইকেট উপচে ফেলেন নেইলের। মিরাজের জোরের ওপরের বল ডিফেন্স করতে গিয়ে মিস করে বোল্ড হন ৫ চার ও ১ ছক্কায় ৩০ রান করা নেইল। 

শেষ ২ উইকেট হাতে রেখেও আয়ারল‌্যান্ড চমক দেখায়। দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে ক‌্যাম্পার ও হোয়ে দ্বিতীয় সেশনে ম‌্যাচ টেনে নেন। সকালের সেশনের সময় আরো ২০ মিনিট বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আম্পায়াররা। তাতেও কাজ হয়নি। মধ‌্যাহ্ন বিরতির পরও দুই আইরিশ ব‌্যাটসম‌্যান লড়াই চালিয়ে যান। ৯০ মিনিটের ব‌্যাটিংয়ে প্রবল চাপে পড়ে যান বোলাররা।

সেখানে হাসান মুরাদ দলকে উদ্ধার করেন। পরপর দুই বলে তিনি ফেরান হোয়ে ও হামফ্রিজকে। তাতে ম‌্যাচটা শেষ হয়ে যায় মুহূর্তেই। ২৫৯ বলে ৭১ রান করে ক‌্যাম্পার অপরাজিত থাকেন উইকেটের আরেক প্রান্তে। ৪টি চার ও ২ ছক্কা তার দুর্দান্ত ব‌্যাটিংয়ে।

ম‌্যাচ বাঁচাতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া আয়ারল‌্যান্ড বেশ কিছু রেকর্ডও গড়েছে। মিরপুরে চতুর্থ ইনিংসে অতিথি দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি রান করেছে আয়ারল‌্যান্ড। এর আগে অস্ট্রেলিয়া ২০১৭ সালে ২৪৪ রান করেছিল। আয়ারল‌্যান্ডের আজকের রান ২৯১। সবচেয়ে বেশি ওভার খেলাতেও আয়ারল‌্যান্ড এগিয়ে। আয়ারল‌্যান্ড চতুর্থ ইনিংসে ব‌্যাটিং করেছে ১১৩.৩ ওভার। এর আগে জিম্বাবুয়ে ব‌্যাটিং করেছিল ৮৩.১ ওভার।

ব‌্যক্তিগত রেকর্ডে উজ্জ্বল ক‌্যাম্পার। ৭১ রানের ইনিংসটি খেলতে ক‌্যাম্পার সবচেয়ে বেশি ২৫৯ বল খেলেছেন। এর আগে সাকিব আল হাসান ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২১২ বল খেলেছিলেন। উইকেটে টিকে থাকার রেকর্ডও ভেঙেছেন এই আইরিশ ব‌্যাটসম‌্যান। ৩৬১ মিনিট ক্রিজে ছিলেন তিনি। সাকিব আল হাসান ২৮৭ মিনিট ক্রিজে কাটিয়ে এতো দিন রেকর্ডটি নিজের কাছে রেখেছিলেন।

মুশফিকুর রহিমের শততম টেস্টে জয় উপহার দিয়েছেন সতীর্থরা। মুশফিকুর সেঞ্চুরি (১০৬ ও ৫৩*) করে পেয়েছেন ম‌্যাচসেরার পুরস্কার। যা মুশফিকের অষ্টম ম‌্যান অব দ‌্য ম‌্যাচ। ১৩ উইকেট নিয়ে সিরিজ সেরা তাইজুল ইসলাম। যা তার তৃতীয় সিরিজ সেরার পুরস্কার।

ঢাকা/ইয়াসিন/আমিনুল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র কর ড র ন কর ত ইজ ল উইক ট য টসম

এছাড়াও পড়ুন:

ক্যাম্ফারের ‘যন্ত্রণা’ পাশ কাটিয়ে স্বস্তির হাসি বাংলাদেশের

হাসান মুরাদের বলে বোল্ড হলেন ম্যাথু হ্যামফ্রিস। সঙ্গে সঙ্গেই জয়ের উচ্ছ্বাসে ভাসতে শুরু করল পুরো বাংলাদেশ দল। এর মধ্যেই কার্টিস ক্যাম্ফারের কাছে গিয়ে পিঠ চাপড়ে দিলেন লিটন দাস, সামনে এগিয়ে কথা বললেন মুশফিকুর রহিমও। কী বলেছেন, সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। ধৈর্য ও দক্ষতার যে অপূর্ব মেলবন্ধন দেখিয়েছেন, সেটির জন্য সাধুবাদ যে তাঁর প্রাপ্যই।

গত পাঁচ দিনের বেশির ভাগজুড়ে ম্যাচের ফল যে দিকে হাঁটছিল, শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তাই। আয়ারল্যান্ডকে ২১৭ রানে হারিয়ে ম্যাচের সঙ্গে সিরিজও জিতেছে বাংলাদেশ। তবে হ্যামফ্রিসের বোল্ডের মধ্য দিয়ে আসা এই জয়ের আগে বাংলাদেশকে অনেকটা সময় অস্বস্তিতে ভুগিয়ে গেছেন ওই ক্যাম্ফারই।

হাতে শেষ ৪ উইকেট নিয়েও আজ পঞ্চম দিনে ৫৯.৩ ওভার ব্যাট করেছে আয়ারল্যান্ড। এক ক্যাম্ফারই খেলেছেন ১৬৬ বল। শেষ পর্যন্ত থেকেছেন অপরাজিতও।

লেজের সারির ব্যাটসম্যানদের নিয়ে আয়ারল্যান্ড কতটা লড়াই করেছে, সেটা বুঝতে সাহায্য করতে পারে এই পরিসংখ্যানটা— মিরপুরে চতুর্থ ইনিংসে সফরকারী দল হিসেবে সর্বোচ্চ রান আর বল খেলার দুটি রেকর্ডই গড়েছে তারা। সব মিলিয়েও তাঁদের দ্বিতীয় ইনিংসে ১১৩.৩ ওভারে করা ২৯১ রান দ্বিতীয়। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশই শুধু এর চেয়ে বেশি (৪১৩ রান) করতে পেরেছিল।

এমন কীর্তি গড়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন আয়ারল্যান্ডের দুই ব্যাটসম্যান কার্টিস ক্যাম্ফার ও গ্যাভিন হোয়ে। ৬ উইকেটে ১৭৬ রান নিয়ে আজ শেষদিনে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল আয়ারল্যান্ড। ৯৩ বল খেলে ৩৪ রান করা ক্যাম্ফারের সঙ্গী তখন ১৩ বলে ১১ রান করা অ্যান্ডি ম্যাকব্রাইন।

কত দ্রুত তাঁদের ফিরিয়ে বাংলাদেশ জয়টা নিশ্চিত করতে পারবে, দিনের সেটাই ছিল কৌতূহল। ২১ রানে ম্যাকব্রাইনকে এলবিডব্লিউ করে সেই পথের ভালো শুরু এনে দেন তাইজুল ইসলাম। গতকাল টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ডে সাকিব আল হাসানকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই স্পিনারের এটি ২৫০তম উইকেট।

সপ্তম উইকেটের পতনের ক্যাম্ফারের সঙ্গী হন জর্ডান নেইল। তাঁদের জুটিও জমে গিয়েছিল, তবে তা ভাঙতে খুব বেশি সময় লাগেনি বাংলাদেশের। মেহেদী হাসান মিরাজের বলে বোল্ড হন ৩০ রান করা নেইল।

আইরিশদের আট উইকেট চলে যাওয়ার পর প্রথম সেশনেই ম্যাচটা শেষ হয়ে যাবে কি না, এমন অনুমানই তখন স্বাভাবিক। এ জন্য আম্পায়াররা প্রথম সেশনের দৈর্ঘ্য ২০ মিনিট বাড়িয়েও দেন। কিন্তু ওইটুকু সময়ে আর কোনো উইকেট হারায়নি সফরকারীরা। এমনকি লাঞ্চ বিরতির পর এসেও উইকেটে বেশ জমে যান ক্যাম্ফার-হোয়ে।

পেস, স্পিন, আক্রমণাত্মক কিংবা রক্ষণাত্মক ফিল্ডিং— কোনো কিছুতেই জুটি ভাঙা যাচ্ছিল না। নাজমুল হোসেনদের মধ্যে তখন হয়তো ড্রর শঙ্কাও উঁকি দিচ্ছিল। আর যা-ই হোক, এমন ম্যাচে ড্র মানে প্রায় হারই।

খেলতে খেলতে হোয়ে-ক্যাম্ফারের জুটি পেরিয়ে যায় দেড় শ বলের মাইলফলকও। ফিল্ডারদের শরীরী ভাষায় ফুটে ওঠে হতাশার ছাপও। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ আনন্দে মেতে ওঠার মুহূর্ত পায় ক্যাম্ফার-হোয়ে জুটির ১৯১তম বলে। বাঁহাতি স্পিনার হাসান মুরাদের বলে এলবিডব্লুর ফাঁদে পড়েন হোয়ে। ১০৪ বলের ইনিংসে ৩৪ রান করেন দশ নম্বরে নামা এই ব্যাটসম্যান।

তাঁকে ফেরানোর পর জয়ের জন্য বাংলাদেশকে তেমন অপেক্ষাই করতে হয়নি। এগারো নম্বর ব্যাটসম্যান হ্যামফ্রিস প্রথম বলেই বোল্ড। বাংলাদেশ মেতে ওঠে জয়ের উল্লাসে। একপ্রান্তে ২৫৯ বলের ইনিংসে ৭১ রানে অপরাজিত থাকেন ক্যাম্ফার। আইরিশদের ১২ টেস্টের ইতিহাসে এটিই কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ বল খেলার রেকর্ড। মিরপুরে চতুর্থ ইনিংসেও এই প্রথম কোনো ব্যাটসম্যান খেলেছেন আড়াই শর বেশি বল।

নিশ্চিত জয়ের দিকে হাঁটতে থাকা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত তা পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাঁর আগে কিছুটা রোমাঞ্চ তৈরি করে গেছেন ক্যাম্ফার। আর সে জন্যই ম্যাচশেষে তিনি পেলেন মুশফিক, লিটন দাসদের অভিনন্দন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ