‘দরদ’ সিনেমার শুটিং শুরুর সময় নির্মাতা অনন্য মামুন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে একই দিনে হিন্দি, তেলুগুসহ পাঁচটি ভাষায় ভারতে মুক্তি পাবে ‘দরদ’। ফলে সিনেমাটিকে প্যান ইন্ডিয়ান ছবি দাবী করেছিলেন তিনি। সিনেমাটিতে নায়ক ছিলেন শাকিব খান। প্যান ইন্ডিয়ান দাবিতে নায়কেরও মৌন সম্মতি ছিল,সন্তুষ্টি চিত্তে মেনেও নিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু বাস্তবে প্যান ইন্ডিয়ান কেবল পরিচালকের দাবি করার মধ্যেই আটকে থেকেছে। বাস্তবে কোনো রুপ পায়নি। মুক্তির সময় কথা ও কাজের মিল দেখা যায়নি। গত বছরের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশে মুক্তি পেলেও ভারতে উপেক্ষিতই  ‘দরদ’।

যদিও বাংলাদেশে মুক্তির সময়  সাংবাদিকদের কাছে ভারতে মুক্তি এ প্রসঙ্গ নির্মাতা বলেছিলেন, বাংলাদেশে মুক্তির দুই সপ্তাহ পরে দরদ ভারতে মুক্তি পাবে। এর কারণ মূলত পাইরেসি। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় বাংলা, হিন্দি ও তামিলে দরদ মুক্তি পেয়েছে। কেবল একটা দেশেই মুক্তি পায়নি এটা বড় কোনো বিষয় নয়।

সেই দুই সপ্তাহ গিয়েছে কবেই ভারতে আর মুক্তি পায়নি। ফলে দরদের দরদের বেলায় প্যান ইন্ডিয়ান মুভি হয়ে ওঠা আর সম্ভব হয়নি!

প্যান ইন্ডিয়ান অর্থ:

‘প্যান-ইন্ডিয়ান ফিল্ম’ শব্দটি এমন একটি চলচ্চিত্রের জন্য ব্যবহৃত হয় যা একই সাথে সারা ভারত জুড়ে একাধিক ভাষায় বাজারজাত করা হয় এবং মুক্তি পায় - তেলেগু , হিন্দি , তামিল , কন্নড় এবং মালায়ালাম । এই ধরনের চলচ্চিত্র ভাষাগত, সামাজিক, আঞ্চলিক এবং সাংস্কৃতিক বাধা অতিক্রম করে ভারতের সব প্রদেশের সকল দর্শকদের কাছে পৌছানের চেষ্টা করে। 

দরদ কি প্যান ইন্ডিয়ান?

যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, কানাডাসহ প্রায় ২০ দেশে দরদ মুক্তি পেলেও ভারতে এখনো মুক্তি পায়নি দরদ। এবার জানা গেল, ভারতে মুক্তির আগেই ওটিটিতে দেখা যাবে সিনেমাটি। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিন তাদের ফেসবুক পেজে সিনেমার পোস্টার শেয়ার করে দরদ মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তার মানে  আদৌ দরদ ভারতে মুক্তি পাবে কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়। পাকিস্তানেও দরদ মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেখানকার একটি পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা দরদের প্রিভিউ কপি দেখার পর সিনেমাটি পাকিস্তানে মুক্তির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন বলেও জানা গেছে।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

আশ্চর্য মানুষের শেষযাত্রা

‘তিনি আসলে আশ্চর্য মানুষ।’ পাশে দাঁড়ানো এক প্রবীণ সাংবাদিক বলছিলেন, ‘আজব! সারা জনম নিজেকে শুধু আড়ালে-আবডালেই রাখলেন।’

ভদ্রলোককে বিলক্ষণ চিনি, কিন্তু শোকার্ত সময় বলেই হয়তো তিনি আমায় চিনতে পারছেন না। তবু তাঁর মন্তব্যের উদ্দিষ্ট শ্রোতা এই মুহূর্তে কে হতে পারে, নিশ্চিত হতে যখন চারপাশে তাকাচ্ছি, তখন আরও তিনজনকে দেখা গেল। এরা অপেক্ষাকৃত তরুণ। সম্ভবত স্থানীয় সাংবাদিক। এদেরই একজন কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরাসমেত মাথা দুলিয়ে সায় জানাল ওই প্রবীণকে, ‘এক্কেরে ঠিক কইছোন।’

হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা এখন নেই। টানা দুরাত একফোঁটা ঘুমোতে পারিনি। শরীরজুড়ে ৩০০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার অসহনীয় ক্লান্তি। এত দীর্ঘ শবযাত্রার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। শুরু হয়েছিল ১ নভেম্বর রাতে আর এখন ৩ নভেম্বর, সকাল ১০টা। কার্তিকের হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুরো সিলেট শহর। তখনো জানি না, এই যাত্রা শেষ হবে কখন! দাফন যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই নাকি মঙ্গল। অথচ দ্রুত কিছু হওয়ার লক্ষণ নেই। নানা জায়গায় বিতিকিচ্ছি ভেজাল লেগে গেছে। সংকটের সুরাহা কীভাবে হবে, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না।

১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর রাতে টিভি ও রেডিওতে তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচারের পর সিলেট শহরের কিছু লোক তৎপর হয়ে ওঠে। দরগাহসংলগ্ন পায়রা নামের মহল্লায় থাকেন সদ্য মৃতের দুই ভাগনে। তাঁরা প্রভাবশালী ও সরকারি দলের মানুষ; দরগাহ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ইতিমধ্যে কবরের জায়গাও ঠিক করে ফেলেছেন। পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার অপেক্ষা করেননি। তবে আমার এক বোনের নাকি এতে সম্মতি আছে। এটা নিয়ে আজ সংবাদও ছেপেছে একটি জাতীয় দৈনিক: ‘আজরফের লাশের দাফন নিয়ে পরিবারে মতানৈক্য’। যে দৈনিক জাতীয় অধ্যাপকের মৃত্যুসংবাদ ছেপেছিল ভেতরের পৃষ্ঠায়, ছোট হরফে; সেই পত্রিকাই মতানৈক্যের খবর ছেপেছে শেষ পৃষ্ঠায় বড় হরফে, ফলাও করে। এতে খুশি হয়েছে পায়রাবাসী, তাদের দাবি জোরদার হয়েছে আরও। এই দাবির পেছনে অবশ্য যুক্তি একটাই, ‘তাইন আমরার মানুষ।’ মানে তিনি আমাদের মানুষ।

এত দীর্ঘ শবযাত্রার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। শুরু হয়েছিল ১ নভেম্বর রাতে আর এখন ৩ নভেম্বর, সকাল ১০টা। কার্তিকের হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা পুরো সিলেট শহর। তখনো জানি না, এই যাত্রা শেষ হবে কখন! দাফন যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই নাকি মঙ্গল। অথচ দ্রুত কিছু হওয়ার লক্ষণ নেই।

রবি ঠাকুর তো ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক’ কবিতাটি লিখেছিলেন শিলাইদহে বসে, কিন্তু শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় কলকাতায়। কে না চায় সবার প্রিয় মানুষ হতে! তবে এদের বক্তব্য কঠোর ও একদেশদর্শী, ‘আমরার মানুষ আমরার কাছে ফিরছোইন।... মামুর কবর ইখানেই অইবো।’পরিবারের অন্য সদস্যদের মতামত তাহলে কিছুই না? জীবনের প্রায় পাঁচটি দশক কাটিয়েছি তাঁর সঙ্গে। আঠারো হাজারের বেশি দিন আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম, কিংবা তিনি আমার সঙ্গে, একই ছাদের তলায়। অথচ কেউ আমার সঙ্গে আলাপ করার ন্যূনতম আগ্রহও দেখাচ্ছে না; তিনি হয়ে গেছেন সবার বাবা! হ্যাঁ, সবারই তো; সাত পুত্র, দুই কন্যা এবং তাদের পঁচিশজন ওয়ারিশ। আর অগণিত ছাত্র কিংবা ভক্তসমাজ তো আছেই। মুহূর্তের জন্য মনে প্রশ্ন জাগে; তিনি আসলে কাদের? শুধু ধার্মিক ও ধর্মবেত্তাদের, নাকি সবার? সিলেটের, না সারা দেশের? কারও কারও ধারণায়, তিনি ইসলামি চিন্তাবিদ। কেউ বলেন দার্শনিক। কারও মতে, তিনি ধর্মবিশেষজ্ঞ। বহির্বিশ্বে অবশ্য তাঁর পরিচিতি ধর্মবিশেষজ্ঞ হিসেবে। এ প্রসঙ্গে তাঁর কয়েকটি সফরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

১৯৬১ সালে ভারতের দিল্লিতে ইন্দো-পাক কালচারাল কনফারেন্সে, ১৯৬৩ সালে ইরাকের বাগদাদে প্রথম মুসলিম দার্শনিক আল–কিন্দির মৃত্যু-সহস্রবার্ষিকী অনুষ্ঠানে, ১৯৮১ সালে বিশ্বভারতীতে, ১৯৮৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ধর্ম ও দর্শন সম্মেলনে, ১৯৮৫ সালে ইতালির রোমে ধর্ম সম্মেলনে, ১৯৮৬ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত ধর্ম ও দর্শন সম্মেলনে তাঁকে ‘রিলিজিয়ন স্পেশালিস্ট’ বলেই আখ্যায়িত করা হয়। রোমের সম্মেলনে তাঁর পঠিত প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘হোলিনেস অব ইসলাম অ্যান্ড ক্রিশ্চিনিয়াটি’। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন খ্রিষ্টধর্মীয় নেতা দ্বিতীয় জন পল। খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের শতাধিক বুদ্ধিজীবীর কাছে তাঁর পঠিত প্রবন্ধ ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। জন পোপ পল এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যে ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে ঘড়ি ও ক্রুশ উপহার দেন। প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে, তেহরানের সম্মেলনে; তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ একাধিক মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও বিদ্বৎসমাজের সদস্যরা তাঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন ফারসি ও ইংরেজিতে।

তবে বাংলাদেশের কথা আলাদা। এখানে ধর্ম–অজ্ঞ ধর্মগুরুর সংখ্যা যেমন বেশি, অসংবেদনশীল ‘প্রগতিশীল’ মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মোল্লারা মনে করেন, তিনি ইসলামি চিন্তাবিদ; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, টানা এক মাস রোজা রাখেন। কথিত ‘প্রগতিশীলেরা’ ভাবেন, লোকটা নামাজ ও রোজায় সমর্পিত, উপরন্তু মাথায় টুপি পরেন, ‘মৌলবাদী’ শিরোপাই তাঁর জন্য যথার্থ।

এটা নিয়ে আজ সংবাদও ছেপেছে একটি জাতীয় দৈনিক: ‘আজরফের লাশের দাফন নিয়ে পরিবারে মতানৈক্য’। যে দৈনিক জাতীয় অধ্যাপকের মৃত্যুসংবাদ ছেপেছিল ভেতরের পৃষ্ঠায়, ছোট হরফে; সেই পত্রিকাই মতানৈক্যের খবর ছেপেছে শেষ পৃষ্ঠায় বড় হরফে, ফলাও করে।

১৯৬৮ সালে একবার বাঞ্ছারামপুরে এক জলসায় দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি সে দাওয়াত কবুল করতে পারেননি; এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ডাকযোগে একটি দু লাইনের ছড়া পাঠানো হয় তাঁর ঠিকানায়। লেখক অজ্ঞাত। ঠিকানা অবশ্য আছে, বাঞ্ছারামপুর, বি-বাড়িয়া। লাইন দুটি এ রকম, ‘তাকে যায় না করা মাফ/ সে একটা আস্ত জিরাফ।’ ছড়াটি পড়ে মন খারাপের বদলে তিনি আনন্দিত; বললেন, ‘যে এই লাইন দুটি লিখেছে, সে আসলে খোঁজখবর রাখে। এই নাম আমাকে দিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।’

বিদ্রোহী কবি ছাড়াও ‘জিরাফ’ নামে ডাকতেন আরও দুজন। একজন তাঁর শ্রদ্ধেয় ‘স্যার’ কাজী মোতাহার হোসেন, অপরজন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক সাইদুর রহমান। তাঁর অপর বন্ধু জিসি দেব নামটি শুনলে ক্ষিপ্ত হতেন।

বৃহত্তর সিলেটে তাঁর একাধিক পরিচয়। তিনি জমিদারপুত্র ও জমিদার, রাজনীতিক, ভাষাসংগ্রামী ও শিক্ষাবিদ। জমিদার হয়েও তিনি নানকার আন্দোলনের সমর্থক; অকাতরে জমিজমা বিলিয়ে দেন নানকারদের মধ্যে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও ব্রিটিশদের কৃপালাভের চেষ্টা না করে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ধার্মিক পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি সময় কাটান স্বামী বিবেকানন্দের আশ্রমে। ‘জন্মেছ যখন, দাগ রেখে যাও,’ স্বামীজির এই কথায় তিনি অনুপ্রাণিত হন। তবে সাধারণ্যে তিনি গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। নির্বাচিত হন আসাম উচ্চ পরিষদের সদস্য হিসেবে। আজ যে সিলেট ভারতের না হয়ে বাংলাদেশের হয়েছে, তা এক কঠিন আন্দোলনেরই ফসল; গণভোটের আগে তাই তাঁকে দেখতে পাই মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে। সিলেটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন মানুষের সমর্থন আদায়ের জন্য। লোকে হয়তো সে কারণেই বলে, তিনি ইতিহাসের পাতায় উচ্চারিত এক নাম। মাওলানা ভাসানীর ডাকে ১৯৪৭ সালের মে মাসে, আসাম সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। এ অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। তাঁর স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। কারাগার থেকে তিনি চিঠি পাঠান বাড়িতে, ‘যদি মেয়ে হয়, নাম রেখো মুক্তি, ছেলে হলে আজাদ।’

লেখা বাহুল্য, নতুন রাষ্ট্র ‘সাধের পাকিস্তান’ও তাঁকে স্বস্তি বা শান্তি দেয়নি। ‘আজাদি আন্দোলনের সৈনিক’ পুরস্কৃত হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো নানা হয়রানি ও নিগ্রহের শিকার হন। স্বামী বিবেকানন্দের আশ্রমে সময়যাপনের অতীত কাহিনি সামনে এনে রাষ্ট্রযন্ত্র সন্দেহ করে যে তিনি আসলে মুসলিম ছদ্মাবরণে কমিউনিস্ট। সম্ভবত সে কারণেই সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোনো সরকারি চাকরি তাঁর বরাতে জোটেনি।

অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে, তেহরানের সম্মেলনে; তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ একাধিক মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা ও বিদ্বৎসমাজের সদস্যরা তাঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন ফারসি ও ইংরেজিতে।২.

এই সব সাতপাঁচ সুদূরচারণায় যখন মনটা দারুণ বিক্ষিপ্ত, তখন একজন ‘হুজুর’কে সামনে দেখা গেল। তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করে পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন এবং জানালেন, ‘জাতীয় মসজিদের খতিব সাহেব দরগাহে এসেছেন, আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।’ বুঝলাম, দাফনসম্পর্কিত জটিলতা সম্ভবত আরও জট পাকিয়েছে।

হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর দরগাহে পায়রা ও ফকিরের অভাব নেই; পায়রা অবশ্য মানুষকে বিরক্ত করে না, ফকিরেরা টাকাপয়সা পাওয়ার জন্য অনেক সময় আগন্তুকের জামা পর্যন্ত খামচে ধরে। আমাদেরও পিছু লেগে গেল এক দঙ্গল। ‘হুজুর’ আচমকা এমন জোরে চিৎকার করে ওঠেন যে একঝাঁক জালালি-পায়রা আকাশে উড়াল দিল। তারপর তিনি খানিক স্থিতধী হলেন এবং আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি উপহার দিলেন; বিড়বিড়িয়ে বললেন, ‘সব তাঁর ইচ্ছা।’ ভদ্রতার খাতিরে মাথা ঝাঁকালাম। তাঁর পদচারণ খুবই ধীর; কিছু যেন বলতে চান তিনি।

আমার ধারণাই ঠিক। তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আচ্ছা, একটা কথা জিগাই আপনারে? কিছু মনে করোইন না যে?’ কোনো জবাব না দিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম।

তিনি নিজের পরিচয়টা দিলেন কোনো প্রশ্ন না করে। স্থানীয় সরকারি দলের ওলামা সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি। জানালেন, স্বাধীনতার চেতনায় দৃঢ় বিশ্বাসী।

এবারও কোনো কথা না বলে মাথা ঝাঁকালাম। ভালো কথা।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘নেত্রী কেন তাঁর মৃত্যুর পর শোকবাণী দিলেন না? তাইন কি রাজাকার আছলা?’

বললাম, ‘আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, পঁচিশে মার্চের পর তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর কলেজের প্রিয় ছাত্র ফারুক ইকবাল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ, যার জানাজা পড়িয়েছিলেন তিনি।’তিনি মাথা ঝাঁকালেন। ‘জানি। তাইনের দুই পুয়াও তো মুক্তিযোদ্ধা। একজন আবার দোয়ারাবাজার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ঠিক কি না?’

আমি বললাম, ‘জি।’

বিষণ্ন বদনে তিনি এবার মুখে আফসোসধ্বনি উচ্চারণ করলেন। বললেন, ‘কামটা ঠিক অইছে না।’

কোন কাজের কথা তিনি বললেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না। তাঁকে অনুসরণ করে খতিব সাহেবের সামনে উপস্থিত হলাম।

জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক সজ্জন মানুষ। সালামটা তিনিই আগে দিলেন। ইশারায় উপবেশনের স্থান দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন। আজরফ সাহেব কি কোনো অসিয়ত করে গেছিলেন?’

আমি বললাম, জি।

তিনি নিজের পরিচয়টা দিলেন কোনো প্রশ্ন না করে। স্থানীয় সরকারি দলের ওলামা সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি। জানালেন, স্বাধীনতার চেতনায় দৃঢ় বিশ্বাসী। এবারও কোনো কথা না বলে মাথা ঝাঁকালাম। ভালো কথা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘নেত্রী কেন তাঁর মৃত্যুর পর শোকবাণী দিলেন না? তাইন কি রাজাকার আছলা?’

‘কী বলেছিলেন, আপনার মনে আছে?’

‘জি। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মা–বাবার পাশেই যেন তাঁকে দাফন করা হয়।’

‘আপনার দাদা-দাদির কবর কোথায়?’

বললাম, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি দুহালিয়ায়।’

খতিব সাহেব উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা শুনলেন তো, মরহুমের ছেলের কথা, এরপর আর কী কথা থাকে? তার বড় বোনও একই কথা বলেছেন।’

ইত্যবসরে যে আমার বড় বোন মুকুলের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে, এ তথ্য আমার জানা ছিল না। খতিব সাহেব এবার তাঁর সিদ্ধান্ত দিলেন, ‘জানাজার পর মরহুমের লাশ দুহালিয়ায় নিয়ে যাবেন। এখানে তাঁর দাফন হবে না।’

পায়রা (পুরোনো নাম দরগাহ মহল্লা) তখনো উত্তপ্ত। কয়েকজন তরুণ জানিয়ে দিয়েছে, খতিবের সিদ্ধান্ত তারা মানবে না। এতে আমার কয়েকজন রাগী ভাতিজার সঙ্গে তাদের হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম।

খতিবের এই সিদ্ধান্তের পর পরিবারের তরুণ প্রজন্মে স্বস্তির হাওয়া বইলেও আরেকটি সমস্যা দেখা গেল। মরহুমের প্রিয় পিতৃভূমির বেশ কিছু মানুষ চলে এসেছে শহর সিলেটে। তারা ক্ষুব্ধ, কেননা গ্রামে বসে তারা নাকি শুনতে পেয়েছে, কে বা কারা তাদের প্রিয় ‘ঢাকার সাবের’ লাশ আটকে দিয়েছে, জোর করে দাফন করতে চাইছে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর দরগাহ প্রাঙ্গণে। সুতরাং তারা একহাত দেখে নিতে চায়। দুহালিয়ায় ‘ঢাকার সাবের’ কবর ইতিমধ্যে প্রস্তুত। গ্রামের লোকেরাই স্বেচ্ছায় মরহুম দেওয়ান আসফ রাজা চৌধুরী ও মরহুমা রওশন হুসেইন বানুর কবরের পাশে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের শেষ শয্যা রচনা করেছে। ‘কবরটা খুউব সোন্দর অইছে, দেওয়ান,’ আমায় একজন জানালেন। এই ক্ষুব্ধ মানুষের নাম ফুরুদ্দি, পেশায় কৃষক। তাঁর পিতৃপুরুষকে দেওয়ান আজরফ নানকার আন্দোলনের সময় জমি ও বসতভিটা দান করেছিলেন।

ঠিক সময়ে সাংবাদিকেরা এসে উপস্থিত। তাঁদের বোঝালাম, বিষয়টা একেবারেই পারিবারিক। একজন আমায় চিনতে পারলেন; কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘আজরফ সাহেবের ওপর একটি লেখা লিখব। কিছু তথ্য জানার ইচ্ছা ছিল।’

‘কী জানতে চান, বলুন।’

‘তাঁর জন্ম, লেখালেখি...।’

ততক্ষণে আমি দুঃখহীন এক রোবটে পরিণত হয়েছি; মাথার ভেতরকার তথ্যভান্ডার থেকে গড়গড় করে যা মনে আসে, বলতে লাগলাম। ১৯০৬ সালের ২৫ অক্টোবরে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জন্মগ্রহণ করেন তাঁর নানা মরমি কবি দেওয়ান হাসন রাজার বাড়িতে। জায়গাটির নাম লক্ষ্মণশ্রী, মৌজা তেঘরিয়া। তাঁর বাবা দেওয়ান আসফ রাজা চৌধুরী, মা রওশন হুসেইন বানু। বাবা দেওয়ান আসফ রাজা ছিলেন জমিদার এবং আসাম-বেঙ্গল খিলাফত আন্দোলনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। একই সঙ্গে কংগ্রেসের সহসভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দেওয়ান আজরফ তাঁর তৃতীয় সন্তান। লেখাপড়া শুরু দুহালিয়া মাইনর ইশকুলে, পরবর্তী সময়ে তিনি পড়েছেন সুনামগঞ্জ জুবিলি হাইস্কুল, এমসি কলেজ, কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শনশাস্ত্রে এমএ। ফারসিতে লেটার মার্কস পেয়েছিলেন। জানতেন সংস্কৃত, আরবি ও ইংরেজি। তাঁর লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই, তবে প্রথম বই ছিল গল্পের। নাম নতুন সূর্য। পরে গল্প না লিখলেও উপন্যাস লিখেছেন একাধিক (আত্মজৈবনিকসহ)। জাগ্রত অতীত, নয়া জিন্দেগি ও সোনাঝরা দিনগুলি তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃত্য। তবে দর্শন ও ধর্মবিষয়ক বই–ই লিখেছেন বেশি। শতাধিক হবে সংখ্যায়; জীবদ্দশায় অবশ্য প্রকাশিত হয়েছে ৫৪টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দর্শনের নানা প্রবন্ধ, ইসলাম ও মানবতাবাদ, আবুজর গিফারী (ইংরেজিতে লেখা), সিলেটে ইসলাম, কবির দর্শন, ধর্ম ও দর্শন, মরমি কবি হাসন রাজা, তমদ্দুনের বিকাশ, কান্ট, হেগেল ও রয়েল, জিয়োরদানো ব্রুনোর শাস্তি, দর্শনের কথা, বিজ্ঞান, ধর্ম ও দর্শন।

পেয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, আন্তর্জাতিক সংহতি পুরস্কার, অতীশ দীপংকর পুরস্কার, একুশে পদক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার। আজীবন শিক্ষকতা করে গেছেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আবুজর গিফারী কলেজ এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষাঙ্গন। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এমসি কলেজ, সুনামগঞ্জ কলেজ, নরসিংদী কলেজ, মতলব কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতা করেছেন কিছুকাল। সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল-এর সম্পাদক ছিলেন। এই সাপ্তাহিকই ভাষা আন্দোলনের সময় আলোড়ন তুলেছিল যুবসমাজে এবং তিনি সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। ধারণা করা হয়, তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কোনো দিনই তাঁকে এ কারণে ‘প্রিয়জন’ মনে করতে পারেনি। ফলে কোনোকালেই তিনি ধরনা দিয়েও সরকারি চাকরি পাননি।

গড়গড়িয়ে বলা এসব তথ্য তরুণ সাংবাদিক ক্যাসেটবন্দী করছিলেন, এ সময় জোহরের আজান শোনা গেল। নামাজের পর দরগাহ প্রাঙ্গণে হবে তাঁর চতুর্থ জানাজা; অগত্যা সাংবাদিক সাহেবকে বিদায় জানাতে হলো।

দর্শনশাস্ত্রে এমএ। ফারসিতে লেটার মার্কস পেয়েছিলেন। জানতেন সংস্কৃত, আরবি ও ইংরেজি। তাঁর লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়েই, তবে প্রথম বই ছিল গল্পের। নাম নতুন সূর্য। পরে গল্প না লিখলেও উপন্যাস লিখেছেন একাধিক (আত্মজৈবনিকসহ)। জাগ্রত অতীত, নয়া জিন্দেগি ও সোনাঝরা দিনগুলি তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃত্য।৩.

এখন রাত্রি। মাগরিবের আগেই আমরা লাশবাহী গাড়ি নিয়ে অবশেষে দুহালিয়ায় পৌঁছাতে পেরেছিলাম। অপেক্ষমাণ হাজারো মানুষ। যারা তাঁকে কখনো দেখেনি, তারা দল বেঁধে এসেছিল শেষবারের মতো দেখতে। পঞ্চম দফা জানাজার পর তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হলো মা-বাবার কবরের পাশে। বাইরে কামিনী ও ছাতিম ফুলের দেদার সুবাসে একসময় চাপা পড়ল কর্পূর ও আতর–লোবানের গন্ধ। যার যার ঘরে যথারীতি ফিরে গেল সবাই। তারপর সুনসান নীরবতা।

গোসল শেষে আমি এসে বসলাম কৈশোরের বন্ধু বাবুলের দোকানের বেঞ্চিতে। অদূরে বসেছিল গাঁয়ের সবার প্রিয় আন্ধা কানাই; দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে তখন বলছিল, ‘ঢাকার সাব গেলাগি?’ কে জানি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’

আন্ধা কানাই মাথা নাড়ল, ‘ভুল। এই সব মানুষ যাইন না, অন্তরে কবর বানাইয়া থাকোইন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ