উচ্চ আয়ের মার্কিনদেরও বিমানভ্রমণ কমছে
Published: 19th, November 2025 GMT
সচ্ছল মার্কিন নাগরিকেরা চলতি বছর ছুটি কাটাতে তেমন একটা ব্যয় করছেন না। ফলে এই শ্রেণির ক্রেতাদের ওপর ভর করে যেসব বিমান সংস্থা ব্যবসা চালাচ্ছিল, তাদের জন্য এটি অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে উচ্চ আয়ের মার্কিনদের ব্যয়ের পরিমাণ আরও কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অনেক বিমান পরিবহন সংস্থাই এত দিন বেশি দামি টিকিট বিক্রির ওপর নির্ভর করেছে। কিন্তু বিভিন্ন সূচকে দেখা যাচ্ছে, এই শ্রেণির গ্রাহকেরা ভ্রমণ বাবদ ব্যয় কমাচ্ছেন।
গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের তথ্যে দেখা যায়, বার্ষিক ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার বা তার চেয়ে বেশি আয়ের গোষ্ঠী বাদে বাকি সব আয় গোষ্ঠীর বিমান টিকিট আগাম সংরক্ষণের হার বেড়েছে। ভোক্তা ব্যয়সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কনজিউমার এজের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ইনসাইটস মাইকেল গুন্থার ই–মেইলের মাধ্যমে ফোর্বসকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত বৈশ্বিক পরিষেবা নেটওয়ার্ক ডেলয়েটের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ১ লাখ ডলার বা তার বেশি আয় করা মানুষের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে চারজনই এ বছর ছুটিতে ভ্রমণ পরিকল্পনা কাটছাঁট করতে চান।
কনজিউমার এজের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ আয়ের ভোক্তারা, অর্থাৎ যাঁদের বার্ষিক আয় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বেশি, তাঁদের ক্রেডিট কার্ডে বিমানভ্রমণের খরচ মে মাস থেকেই কমতে শুরু করেছে।
***এবার যাঁরা ভ্রমণে যাচ্ছেন, তাঁদের ৪৭% বিমানে চড়বেন। গত বছর এই হার ছিল ৫৫%। *** যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ আয়ের যাত্রীরাও আর্থিক চাপে পড়তে শুরু করেছেন। *** উচ্চ আয়শ্রেণির যাত্রীদের বিমানে ভ্রমণের আগ্রহ ৬৩% থেকে কমে ৫৩%–এ নেমেছে। *** ছুটিতে যাঁরা ভ্রমণে যাবেন, তাঁদের গড় বাজেট ১৮% কমেছে।গত এক দশকে বড় বড় বিমান সংস্থাগুলো বিমানে প্রিমিয়াম ইকোনমি বা উন্নত সাধারণ মানের আসন বাড়াতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। সে জন্য তারা পুরোনো উড়োজাহাজে নতুন আসন যুক্ত করেছে। আবার নতুন বিমান কেনার সময় বলে দিয়েছে, উন্নত মানের সাধারণ আসন বেশি থাকবে।
উদাহরণ হিসেবে ডেল্টা এয়ারলাইনসের কথা বলা হয়েছে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের আয় প্রকাশ অনুষ্ঠানে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট গ্লেন হাউয়েনস্টাইন বলেন, পুনর্গঠিত (রেট্রোফিটেড) উড়োজাহাজে বর্তমানে উন্নত মানের আসন আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। সেই সঙ্গে নতুন যে বিমানগুলো কারখানা থেকে বের হচ্ছে, সেখানে উন্নত মানের আসনের সংখ্যা রাখা হয়েছে আরও বেশি।
বিনিয়োগের এই সিদ্ধান্ত মূলত মহামারির পর বিলাসবহুল অবকাশ–ভ্রমণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়েছিল—যে চাহিদা ২০২৩, ২০২৪ এমনকি চলতি ২০২৫ সালের একটা সময় পর্যন্ত ভালোই ছিল। বড় মার্কিন বিমান সংস্থাগুলো বলেছে, অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘মেইন কেবিন’ বা সাধারণ শ্রেণির টিকিটের চাহিদা অনেকটা কমে গেলেও উন্নত মানের আসনের চাহিদা ভালোই ছিল।
গত মাসে ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময় কোম্পানির প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু নোসেলা বিনিয়োগকারীদের জানান, উন্নত মানের আসন থেকে আয় এক বছরে ৬ শতাংশ বেড়েছে।
চাহিদা কমছেকিন্তু ডিলয়েট ও কনজিউমার এজসহ বিভিন্ন সূত্রের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, উন্নত মানের আসনের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। প্রিমিয়াম ইকোনমি, যাকে কখনো কখনো ‘গোল্ডিলকস’ ক্যাটাগরিও বলা হয়; এই টিকিটের দাম সাধারণ ইকোনমি শ্রেণির প্রায় দ্বিগুণ। এতে বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া গেলেও দাম বিজনেস ক্লাসের (উন্নত শ্রেণি) চেয়ে অনেক কম। এই শ্রেণির টিকিটের প্রতি ধনী ও ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ বাড়ছে। এরই মধ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, উচ্চ আয়ের যাত্রীরাও আর্থিক চাপে পড়তে শুরু করেছেন।
ডেলয়েটের সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ বছর থ্যাংকসগিভিং ডে (নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার) থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত আমেরিকানদের ৫৪ শতাংশ ভ্রমণে যেতে চান— গত বছরের তুলনায় যা ৫ শতাংশ বেশি। কিন্তু তাঁরা আগের মতো খরচ করবেন না। অনেকেই হোটেলে থাকার বদলে বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়দের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সঙ্গে তাঁরা উড়োজাহাজে না গিয়ে গাড়িতে যাতায়াত করবেন। যাঁরা ভ্রমণে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরও কম (৪৭ শতাংশ) ছুটির সময় বিমানে চড়ার পরিকল্পনা করেছেন—গত বছর এই হার ছিল ৫৫ শতাংশ। উচ্চ আয়শ্রেণির যাত্রীদের মধ্যে দেশের ভেতরে বিমানে ভ্রমণের আগ্রহ ৬৩ শতাংশ থেকে কমে ৫৩ শতাংশে নেমে গেছে, অর্থাৎ এক বছরে ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে।
ডেলয়েটের তথ্যানুসারে, ছুটিতে যাঁরা বিমানে ভ্রমণ করবেন, তাঁদের গড় ভ্রমণ বাজেট বছরে ১৮ শতাংশ কমে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৪ ডলার।
মাইকেল গুন্থার ফোর্বসকে বলেন, উচ্চ আয়শ্রেণির যাত্রীরা এখনো মধ্যম ও নিম্ন আয়ের তুলনায় ২-৩ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি হারে বিমান টিকিট কিনছেন। তারপরও দেখা যাচ্ছে, এই গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে।
গুন্থার আরও বলেন, বিমান সংস্থার খরচ সাধারণত আগাম সংরক্ষণের সময়ই ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের বিবরণীতে দেখা যায়। তাই হোটেল খরচের তথ্যের তুলনায় বিমানভ্রমণের খরচের তথ্য অনেক আগে থেকেই বোঝা যায়। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মানুষ নিজেদের আর্থিক অবস্থা কীভাবে দেখছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ রমণ র আর থ ক র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আপিলের রায় হলে কী হতে পারে
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রায় তিন দশক আগে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এরপর তিনটি নির্বাচন হয়েছিল নির্দলীয় এই সরকারের অধীন। এক যুগ আগে সর্বোচ্চ আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। এরপর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে বাদ পড়ে নির্বাচনকালীন এই সরকারব্যবস্থা। এরপর যে তিনটি নির্বাচন হয়, তার সব কটিই পড়ে বিতর্কে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপই দেশে রাজনৈতিক সংকট নিয়ে এসেছে।
আরও পড়ুনতত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে কি না, জানা যাবে ২০ নভেম্বর১১ নভেম্বর ২০২৫২০২৪ সালে জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সর্বোচ্চ আদালতে আবার উঠেছে বিষয়টি। ২০ নভেম্বর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন আপিল বিভাগ। রাজনৈতিক সংকটের এ সময়ে ওই রায় কোনো পথ দেখাবে কি না, রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে এলে আগামী নির্বাচনেই কি তা কার্যকর হবে? আর কী কী প্রভাব পড়তে পারে, চলুন খুঁজি তার উত্তর।
আপিল বিভাগে কী নিয়ে রায় হতে যাচ্ছেতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা–সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন বাতিল করে ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছিলেন। এই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত আপিল ও এ-সংক্রান্ত আবেদনের ওপর ২০ নভেম্বর রায় দিতে যাচ্ছেন সর্বোচ্চ আদালত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের আপিল বিভাগের রায় বহাল থাকবে কি না, তা জানা যাবে সেই রায়ে।
ত্রয়োদশ সংশোধনীতে কী ছিলনির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ। সে জন্য সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইনের ২ ও ৩ ধারার মাধ্যমে সংবিধানে ৫৮ক, ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ ও ৫৮ঙ অনুচ্ছেদ নতুন সন্নিবেশিত করার পাশাপাশি কয়েকটি অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন ও সংশোধন আনা হয়।
আইনের ২ ধারার মাধ্যমে নতুন ৫৮ক অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়; আর ৩ ধারার মাধ্যমে নতুন ২ক পরিচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়। এই পরিচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্ববাধায়ক সরকার সম্পর্কে বলা ছিল। এ–সংক্রান্ত ৫৮ক অনুচ্ছেদে পরিচ্ছেদের প্রয়োগ; ৫৮খ অনুচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার; ৫৮গ অনুচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, উপদেষ্টাদের নিয়োগ ইত্যাদি; ৫৮ঘ অনুচ্ছেদে নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকারের কার্যাবলি এবং ৫৮ঙ অনুচ্ছেদে সংবিধানের কতিপয় বিধানের অকার্যকারিতা সম্পর্কে বলা ছিল।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল হলো কীভাবেত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৯ সালে রিট আবেদন করেন। হাইকোর্টের তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। তাতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে আপিল করা হয়।
আরও পড়ুনতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার তত্ত্বতালাশ০৫ এপ্রিল ২০২৫আপিলের শুনানি শেষে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে (৪: ৩) ২০১১ সালের ১০ মে রায় দেন। সেই রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন, ১৯৯৬ (আইন-১: ১৯৯৬) বাতিল ও সংবিধানপরিপন্থী ঘোষণা করা হয়।
২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তবে তা প্রকাশের আগেই ২০১১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে।
আরও পড়ুনআপিল মঞ্জুর করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল চাইলেন জামায়াতের সেক্রেটারির আইনজীবী২৮ অক্টোবর ২০২৫সেই রায়ের পর কারা আবেদন করলেনজুলাই অভ্যুত্থানের পর ১৪ বছর আগের ওই রায়ের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে গত বছর আবেদন করেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। এরপর রিভিউ আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আরেকটি রিভিউ আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া মো. গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন রায় নিয়ে আরেকটি আবেদন করেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠনও রিভিউ আবেদন করে। এ ছাড়া সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে এ মামলায় যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের শুনানির পর গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির এবং বিএনপি মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে গত ২১ অক্টোবর থেকে শুনানি শুরু হয়। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত দশম দিনে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ২০ নভেম্বর রায়ের জন্য দিন রাখেন।
শুনানিতে কী আরজি জানানো হয়েছেআগের রায়টি পুনর্বিবেচনা ও রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর করে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনর্বহালের আরজি জানিয়েছেন আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবীরা। শুনানিতে তাঁরা দলীয় সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত তিনটি (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সাল) নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী নয়; বরং মৌলিক কাঠামোর অংশ এবং ব্যবস্থাটি সাংবিধানিক রীতি হিসেবে গণ্য হয়েছে। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিলের প্রক্রিয়া, ২০১১ সালের ১০ মে দেওয়া সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে প্রায় ১৬ মাস পর প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের অসংগতির কথা তুলে ধরা হয় শুনানিতে। ওই রায়ে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা প্রয়োগে ভুল এবং রায়টি বিচারিক ক্ষমতাবহির্ভূত বলেও দাবি করেন কোনো কোনো আইনজীবী।
আরও পড়ুনতত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়০২ নভেম্বর ২০২৫আবেদন নাকচ হলে কী হবেএই আবেদন নাকচ হলে ১৪ বছর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা–সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছিলেন, তা বহাল থাকতে পারে।
আবেদনকারীপক্ষে রায় হলে আগামী নির্বাচনেই কি তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা ফিরবে
জুলাই অভ্যুত্থানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। আইনজীবীদের অভিমত, রায়ে যা–ই হোক, আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তার কোনো প্রভাব পড়বে না।
আপিল বিভাগের আগের রায় বাতিল হলে অষ্টম সংশোধনী ও ষোড়শ সংশোধনীর মামলার রায়ের নজির অনুসারে আগের বিধান (তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা) ফিরে আসতে পারে।
তবে পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির আইনজীবী ড. শরীফ ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সংক্রান্ত ৫৮গ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ ভেঙে দেওয়ার বা ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা নিযুক্ত হবেন উল্লেখ ছিল। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে।
কাজেই ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পুনর্বহাল হলেও এখনই তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এর আলোকে এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ নেই। কেননা, এক বছর আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পুনরুজ্জীবিত হলে চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ হবে। ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন পুনর্বহাল হলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ গঠিত হবে, তা ভেঙে দেওয়ার পর সংশোধনীর আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যাবে।
ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বৈধতা এসেছিল কীভাবেসংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদকাল ছিল ৯০ দিন বা ৩ মাস। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার দুই বছর ছিল। তা বৈধতা পেয়েছিল আপিল বিভাগের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সারমর্ম হিসেবে ১৬টি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর ১৬ দফায় বলা হয়, ২০০৭ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিন মেয়াদ–পরবর্তী অতিরিক্ত প্রায় দুই বছর সময়কাল প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় ওই অস্বাভাবিক সময়কালের কার্যাবলি মার্জনা করা হলো।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এখানে কীভাবে প্রাসঙ্গিকআদালতের রায় সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধন নিয়ে হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন। কারণ, পঞ্চদশ সংশোধনেই শাসনতন্ত্র থেকে বাদ পড়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূইয়া প্রথম আলোকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দুইভাবে বাতিল হয়েছিল। ১৪ বছর আগে দেওয়া সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বিধান দিয়ে। তাই এ ক্ষেত্রে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রাসঙ্গিক। যে কারণে ১৪ বছর আগের রায়ের পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করা হয় এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেও রিট আবেদন করা হয়।
আপিল বিভাগের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন এনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ওই সংশোধনীতে সংবিধানে ৫৪টি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছিল।
আরও পড়ুনপঞ্চদশ সংশোধনী: তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ‘যথাযথভাবে পুনর্বহাল হয়নি’, লিভ টু আপিল মঞ্জুরের আরজি১২ নভেম্বর ২০২৫জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়েও দুটি রিট আবেদন করা হয়। সুজন সম্পাদকসহ পাঁচ ব্যক্তি একটি এবং নওগাঁর বাসিন্দা মো. মোফাজ্জল হোসেন আরেকটি রিট আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় দেন। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। এই দুটিসহ পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।
আরও পড়ুনতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যেভাবে বাতিল হয়েছিল০৯ আগস্ট ২০২৫ড. শরীফ ভূইয়া বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর অংশবিশেষ অসাংবিধানিক ঘোষণা করে তা বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। পুরো সংশোধনীর বাতিল চাওয়া হয়েছিল; কিন্তু পুরোটা বাতিল করেননি। তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা–সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা বাতিল করা হয়েছে। ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার; তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, উপদেষ্টাদের নিয়োগ ইত্যাদি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাধায়ক সরকারের কার্যাবলি—এই বিধানগুলো ফিরেছে।
তবে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা আগের মতো ফিরিয়ে আনতে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের আরও কিছু ধারা বাতিল হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. শরীফ ভূইয়া। তিনি বলেন, হাইকোর্টে রায়ে ওই সব ধারা বাতিল করা হয়নি।
পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে শুনানি এখন কোন পর্যায়েতত্ত্বাবধায়ক সরকার ও গণভোট ফিরিয়ে এনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী–সংক্রান্ত যে রায় হাইকোর্ট দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেন বদিউল আলম মজুমদারসহ চারজন। নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন আরেকটি লিভ টু আপিল করেছেন। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার একটি লিভ টু আপিল করেন।
এ-সংক্রান্ত লিভ টু আপিলগুলো একসঙ্গে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। ১৩ নভেম্বর লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ।
আইনজীবী শরীফ ভূইয়া বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে আপিল শুনানি ও নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা যথাযথভাবে ফিরে আসতে পারে।