দেশকে এগিয়ে নিতে সবাইকে সুসংগঠিত থাকতে হবে : এ্যাড. মাহফুজ
Published: 15th, February 2025 GMT
দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে সুসংগঠিত থাকতে হবে। আর তারেক রহমানের নির্দেশনাকে বাস্তবায়ন করতে হলে বিএনপির নেতাকর্মীদের মানুষের ধারে ধারে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাড. মাহফুজুর রহমান হূমায়ুন।
শনিবার বিকেলে উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়ন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের উদ্যোগে জিন্দা পার্ক এলাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আয়োজিত সাংগঠনিক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সভায় দাউদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি এ্যাড.
উৎস: Narayanganj Times
কীওয়ার্ড: র পগঞ জ ব এনপ ন র য়ণগঞ জ ব এনপ র
এছাড়াও পড়ুন:
বদরুদ্দীন উমর: প্রত্যাখ্যানের প্রজ্ঞা ও সাহস
আমাদের একজন বদরুদ্দীন উমর ছিলেন, যিনি জীবনভর উজানপানে তরী বেয়ে সদ্য নিয়েছেন বিদায়। যে দেশে, যে সমাজে প্রশ্ন করাকে নিরুৎসাহিত করা হয় নানাভাবে; শির উঁচু করে কথা বলাকে মনে করা হয় ঔদ্ধত্য; মেরুদণ্ড সোজা থাকলে দাগিয়ে দেওয়া হয় ‘বেয়াদব’ ট্যাগে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রে তিনি ছিলেন ‘চির উন্নত মম শির’র বিরল ব্যতিক্রমী উদাহরণ।
বদরুদ্দীন উমর সারাজীবন প্রত্যাখ্যান করেছেন সকল প্রলোভন, পদ, পদক ও পুরস্কার। সবাই যখন চলতি হাওয়ার পথে হাঁটতে অতিমাত্রায় উৎসাহী তখনও তিনি হননি বিচ্যুত। অথচ এ দেশে বুদ্ধিজীবীমাত্রই দু’একজন ব্যতিক্রম বাদে, সকলেই শেয়ালের হুক্কা হুয়া রবে আহুত, কৃপা প্রার্থনায় আভূমি শায়িত। সেই দেশে সেই কালে জন্ম নিয়ে বদরুদ্দীন উমর প্রত্যাখ্যানের প্রজ্ঞা ও সাহসকে করে গেলেন উচ্চকিত ও মহিমান্বিত।
সকলেই জানেন পুরস্কারের আড়ালে লুকিয়ে থাকে স্বার্থের চিন্তা এবং এ সংক্রান্ত কার্যকারণ। যে কোনো প্রতিষ্ঠান; তা সরকারী, বেসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, কিংবা ব্যক্তিমালাকানাধীন সকলেই সন্দেহাতীতভাবে এই উদ্দেশ্যতাড়িত। পুরস্কার বা সম্মাননা দেওয়া হয়, বিশেষ উদ্দেশ্যকে ভরকেন্দ্রে রেখে। তারপরও সকলেই মুখিয়ে থাকেন সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির লক্ষ্যে। কেবলই কি মুখিয়ে থাকেন? পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য যত রকম অসাধুতা করা প্রয়োজন, সেসব করতে মত্ত হন যুদ্ধংদেহী আচরণে। এ দেশে পুরস্কার ঘিরে বদ খাসলতের নজির একেবারে কম নয়। পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য এখানে প্রকাশ্যে বা আড়ালে যা কিছু হয় তা রোগ-ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে কবি-লেখকদের মাঝে। এবং এই রোগকে তুলনা করা যায় কেবল জলাতঙ্ক রোগীর সঙ্গে। এসব জানার পরও কবি-লেখকরা এই রোগকে ভালোবাসতে, এর প্রেমে দিওয়ানা হতে উদগ্রিব হয়, গৌরববোধ করে। বদরুদ্দীন উমরের এই রোগ ছিল না। আক্রান্ত হননি তিনি জীবনের শুল্কপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষের কোনো ফেরেই।
আবুল মনসুর আহমদ মনে করতেন, রাষ্ট্র যখন কাউকে পুরস্কার দেয়, তখন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ করে নেওয়ার লক্ষ্যেই দেন। যদিও তিনি নিজেই পুরস্কার নিয়েছেন। বাংলা একাডেমি, স্বাধীনতা পদকের কথা স্মরণ করা যেতে পারে এই মুহূর্তে। এ কথা কেবল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির তরফে যেসব পুরস্কার দেয়া হয়, সেসবের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এ কথা যুৎসই ও যুক্তিযুক্ত।
কবি-লেখকমাত্রই এ দেশে যখন বইয়ের ফ্ল্যাপে নিজের পরিচিতি সাটান, বইয়ের সংখ্যা ও পুরস্কারের ফিরিস্তি দেন বাজারমূল্য বাড়াতে। যুক্ত করেন কোন কোন প্রতিষ্ঠানের সদস্য তার হলফনামা; যেমন জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলা একাডেমি ইত্যাদি। এই বালখিল্যতা ও নাবালকত্বের দেশে একজন বদরুদ্দীন উমরকে পেয়েছিলাম আমরা, এটাই আমাদের মহত্তম এক অর্জন।
বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান কবি-লেখকরা জানেন না, পুরস্কার গৌরব বা প্রতিভার স্বীকৃতি নয়। পুরস্কার আসলে পদানত করারই কৌশল বিশেষ। বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের নামান্তর মাত্র। বড়শির মাথায় খাবার দেখে বোকা মাছ ভাবতেই পারে এই খাবার বুঝি তাকে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু আদতে যে তাকে ধরার কৌশল এবং ফ্রাই করার নিমিত্তে বৈ অন্যকিছু না; পুরস্কারও ঠিক তাই। এ কারণে পুরস্কার নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি যা কিছু হয় তার অনেকটাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। যেখানে দারিদ্র্য ও দীনপনার কারণে কবি-লেখকদের পুরস্কারের উপঢৌকন ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের মোসাহেবে পরিণত করা যায়। এবং সেই মোসাহেবিকে কবি লেখকরা অলঙ্করণ জ্ঞান করে বইয়ের ফ্ল্যাপে হর্ন বাজিয়ে ফিরিস্তি দেন। বিকিকিনি করেন নিজের কূপমুণ্ডকতার ওপর ধবধবে এক চাদর বিছিয়ে।
আমাদের কবি-লেখকদের আবার রয়েছে পানীয় গ্রহণের অনিরাময়যোগ্য এক ব্যাধি। যেদিন বৃষ্টি হয় আর যেদিন বৃষ্টি হয় না এই দু’দিনই উনাদের এসব না হলে চলেই না। এ কারণে আমাদের কবি-লেখকদের পুরস্কার ও পানীয়র হ্যান্ডশেকে গোত্রভূক্ত করা যায় সহজেই। এই হ্যান্ডশেকের ধারে কাছে ছিলেন না বদরুদ্দীন উমর। চাইলেও গোত্রভূক্ত করতে পারেননি কেউ। বাংলাভাষায়, বাংলাদেশে আমরা এরকম একজন লেখক-গবেষক-ঐতিহাসিকের দেখা পাব, তা কেবল অভূতপূর্ব নয়, অভাবিত ঘটনাও বৈকি।
এই গল্প তো আমাদের এখানে চাউর রয়েছে বেশ জোরেশোরেই। গল্পটা এই রকম আর শওকত ওসমান হচ্ছেন এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। তখন পাকিস্তান আমল। ক্ষমতায় সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান। ১৯৬২ তে তিনি লিখলেন ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস। যার মূল বার্তা মালিক চাইলেই ক্রীতদাসকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করাতে পারেন। কারণ অর্থ দিয়ে তিনি ক্রীতদাস কিনেছেন। মালিকের খায়েশ বা ইচ্ছাপূরণই ক্রীতদাসের একমাত্র কাজ। শওকত ওসমান এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন, মালিক চাইলে হয়তো সবই করাতে পারেন, কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি কেনা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্রীতদাস আর যাই-ই হোক অর্থের বিনিময়ে হাসি বেচে দিতে বাধ্য নয়।
‘ক্রীতদাসের হাসি’ যখন লেখা হচ্ছে তখন বিশ শতকের ছয়ের দশক। আজকের বাংলাদেশ ছিল সেদিন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পাকিস্তানের একটা প্রদেশ। এই ভূখণ্ডজুড়ে তখন নবজাগরণের কাল। বাংলাদেশের নবজাগরণ বিকশিত হচ্ছে নানামাত্রায়। আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে ফুঁসছে পূর্বপাকিস্তানের ছাত্র জনতা। এর মাঝে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যোগ করলো বাড়তি এক মাত্রা। কারণ এখানে আইয়ুবশাহীর স্বৈরশাসনকে নিন্দনীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রতীকায়িত করে।
১৯৬৬ সালে শওকত ওসমানকে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের জন্য দেওয়া হলো আদমজী পুরস্কার। তিনি এই পুরস্কার গ্রহণ করলেন। পুরস্কার তুলে দিলেন সেই সময়ের পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বৈরশাসক-সামরিক জান্তা আইয়ুব খান। শওকত ওসমান হাসি মুখে গ্রহণ করলেন সেই পুরস্কার। পরদিনের একটা জাতীয় দৈনিকে সেই ছবি ছাপিয়ে লেখকের সেই হাসিকেই বলা হলো ‘ক্রীতদাসের হাসি’। আমাদের কবি-লেখকমাত্রই (হয়তো কেউ কেউ এর বাইরে রয়েছেন, যা খুব বেশি দৃশ্যমান নয়) সেই ‘ক্রীতদাসের হাসি’র উত্তরাধিকার। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল বদরুদ্দীন উমর। সকলের নিশ্চয় স্মরণে আছে, বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক দিয়েছিলেন। বরাবরের মতোই তিনি সেটা গ্রহণ করেননি। গ্রহণ করলে কী কী আবিষ্কার করা যেত, তা বুঝতে নিশ্চয় খুব বেশি বেগ পাওয়ার কথা নয়। বদরুদ্দীন উমর আমাদেরকে শওকত ওসমানের পুনরাবৃত্তি দেখা থেকে রক্ষা করেছেন।
কেবল পুরস্কার কিংবা পদক নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রত্যাখানের প্রজ্ঞা ও সাহসকে উচ্চকিত করে গেছেন বদরুদ্দীন উমর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ এসেছে। তিনি চাকরি ছেড়ে দিলে উপাচার্য রক্ষে পান গভর্নরের কাছে বিব্রত হওয়া থেকে। তিনি তাই করেছেন। কোনো প্রকার অনুরোধ করেননি, মোসাহেবি করার পথে পা বাড়াননি। সেই পাকিস্তান আমল থেকে বাংলাদেশের বিগত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই তাকে আপন মনে করেনি। আমরা মনে করি, বদরুদ্দীন উমরের সৌন্দর্য এখানেই। এই সৌন্দর্যকে ধারণ করে তিনি বুদ্ধিজীবীর ধর্মকে উচ্চকিত করেছেন, মহিমান্বিত করেছেন; আমাদেরকে গর্ব ও গৌরব দান করেছেন।
আমাদের দেশে, সমাজ ও সংস্কৃতিতে, পরিবারের চারদেয়ালে, বিদ্যায়তনিক পরিসরে সর্বত্রই জারি রয়েছে প্রশ্নকে দাবিয়ে রাখার শিক্ষা ও বাস্তবতা। এখানে ‘হ্যাঁ’ বলাকে মনে করা হয় শিষ্টাচার ও সভ্য হওয়ার প্রধান শর্ত। যৌক্তিকতাকে পদদলিত বা উপেক্ষা করে ‘হ্যাঁ’ বললেই এখানে সব কিছুই রক্ষে হয়, কল্কে পায়। তা না হলে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় সব- অ থেকে চন্দ্রবিন্দু অবধি। ‘না’ নয় ‘হ্যাঁ’ এর অন্ধ বৃত্তে এখানে ঘুরপাক খাচ্ছে ইহজাগতিকতার দিনপঞ্জি। অথচ ‘না’ বলাটা যে কতোটা জরুরি, প্রয়োজনীয়, গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যবাহী সেটা আমলে নেওয়া হয়নি আজও। বদরুদ্দীন উমরের প্রত্যাখ্যানের সাহস দেখেও আমরা দীক্ষা নেয়নি ‘না’ বলার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনিয়তাকে। অথচ কে না জানে, যে সমাজ ‘না’ বলতে জানে না, সে সামনে এগোতে পারে না। ‘প্রশ্ন’ করার শক্তি এবং ‘না’ বলতে পারার যুক্তি ও চর্চা সমাজকে যেমন আলোকিত করে, রাষ্ট্রকে তেমনি কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিগণিত করে; দেশকে করে তোলে সকলের দেশ। আপনার মাঝে আপনাদের একীভূত করে একক শক্তিরূপে হাজির করে। বদরুদ্দীন উমর সেই ‘না’ এর শক্তিকে চিনেছিলেন সম্যকভাবে।
এ কারণে তিনি কেবল চাকরির নামে রাষ্ট্রের দাসত্বকে ‘না’ জানাননি, পদ-পুরস্কার-পদকের মতো রাংতা মোড়ানো উপঢৌকনকেও ‘না’ বলেছেন। ঐতিহাসিক অনেক ঘটনার বয়ানকেও ‘না’ বলে দ্বিমত করেছেন। অনেকের লব্ধ গবেষণার সিদ্ধান্তকেও দ্বিধাহীন চিত্তে ‘না’ বলেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেও নিঃসংকোচে ‘না’ জানিয়েছেন। এই যে ‘না’ বলার ক্ষমতা, এই ক্ষমতায় বদরুদ্দীন উমরকে পরিগণিত করেছে আমাদের অনিবার্য এক বাতিঘর। উনার এই ‘না’ নিয়ে মত-দ্বিমত থাকতেই পারে। পাল্টা বয়ান, পাল্টা সিদ্ধান্ত হাজির-নাজিল করা যেতেই পারে। কিন্তু সেটাও করতে হবে উনার ‘না’-কে আমলে নিয়েই, খারিজ বা উপেক্ষা করে নয়।
আমরা যারা উমরের কালে বেঁচে ছিলাম, সকলের জন্য লজ্জা ও বেদনার বিষয় হলো, আমরা উমরের এই প্রত্যাখ্যানের প্রজ্ঞা ও সাহসকে সেই অর্থে মূল্যায়ন করতে পারিনি। সেই অর্থেইবা কেন কোনো ভাবেই মূল্যায়ন করা হয়নি, করার চেষ্টাও দেখা যায়নি কোনো তরফেই। আবার আমরা যারা সাংবাদিকতা বা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, তা যে পর্যায়েই হোক না কেন, উমরকে মূল্যায়ন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এটা আমাদের জন্য যে কত বড় ব্যর্থতা, তা এখন হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না। কিন্তু ভবিষ্যৎ আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। মহাকাল যখন সময়ের কষ্টিপাথরে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করবেন সব কিছু, তখন উমরকে বরণ করে নিতে না পারার সম্মিলিত ব্যর্থতাকেও মূল্যায়ন করতে কসুর করবে না, সংশয়িত হবে না।
উমর পুরস্কার নেননি, ঠিক আছে। এই রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত-আধা সরকারি কিংবা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান কি পারত না তাকে সংবর্ধনা দিতে? তিনি বেঁচে ছিলেন ৯৪ বছর। রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে কিংবা তাদের সাংস্কৃতিক উইংসের পক্ষে কী সম্ভব ছিল না একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা? এমনকি সেই অনুষ্ঠানে উমর যদি সশরীরের হাজির নাও হতেন, তাও কি আমাদের দায় ছিল না সেইরকম একটা অনুষ্ঠান করার? এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রয়োজন তো ছিল আমাদের স্বার্থেই, নতুন প্রজন্মের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘রাজা প্রজারে দেন মান,/ সে মান আপনি ফিরে পান’।
উমর টিরোসিয়াসের মতো ঠিক ত্রিকালদর্শী ছিলেন না। তবে দক্ষিণ এশিয়ার, বিশেষ করে আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণ অভ্যুত্থান, ২০২৪-এর গণ অভ্যুত্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়েছে তার সম্মুখেই। এসব ঘটনা তিনি বুঝতে চেয়েছেন নিজের মতো করে, কারও দ্বারা প্রভাবিত কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের বয়ান থেকে নয়। এসবে বিতর্ক উস্কে উঠেছে। কিন্তু উমর নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেননি। প্রতিষ্ঠিত মতকেও তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত মত মানেই তা সবসময় সত্য হয় না।
এই যে, নিজের মতে অবিচল থাকা এবং সত্য অন্বেষণে কোনো দিকে পক্ষপাত না করে ক্রমাগত নিজের অনুসন্ধান জারি রাখা- এমত উদাহরণে উমর অবিস্মরণীয়, অদ্বিতীয় এক নাম। আহমদ ছফা বলেছিলেন, আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা উমরের কালে জন্মেছিলাম। তিনি এও বলেছিলেন যে, উমর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিন খণ্ডের বই ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’র কারণেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকেরও অভিমত ছিল ঠিক একইরকম। এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে সেই সময়ের পূর্ব বাংলার মানুষ কীভাবে একাত্ম হয়েছিলেন। তিনি যে ভাষা আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থান মনে করতেন, তার কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যূথবদ্ধতা; যা বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিগণিত করেছিল।
উমর বঙ্গবিভাজনের জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে দায়ী করেছেন বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের যারা। মনে করতেন দ্বিজাতিতত্ত্ব মুসলিম লীগের হাত ধরে আসেনি, এসেছে ঊনিশ শতকে হিন্দু মেলার হাত ধরে। তার প্রশ্ন করার শক্তি আমরা দেখেছি ‘বাংলার নবজাগরণ’ প্রশ্নে। ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাঙলাদেশের কৃষক’ এবং ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালি সমাজ’ বইয়ে হাজির করেছেন কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের সীমাবদ্ধতার দিকগুলো।
উমরের ইতিহাস চর্চা দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে ওঠার প্রজ্ঞা ও সাহসের ইস্তেহারবিশেষ। ধর্মীয় স্বার্থচিন্তার বাইরে তিনি উচ্চকিত থেকেছেন নিজের মতো করে। তিনি মনে করতেন, সেই জীবনই যাপন করেছেন, যে জীবন যাপন করতে চেয়েছিলেন। জীবনের সঙ্গে এই বোঝাপড়াও উমরীয় চরিত্রের বিশেষ দিক। যা যাপন করতে লাগে প্রত্যাখ্যানের প্রজ্ঞা ও সাহস।
গণঅভ্যুত্থান ছিল উমরের গবেষণা ও ইতিহাস চর্চার বিশেষ আগ্রহের জায়গা। ২০২৪-এর আন্দোলন তখনও চূড়ান্ত পরিণতির দিক যায়নি। ছাত্রদের তরফে একদফার কথা বলা হয়নি। তখনও ঘটেনি মহাবিস্ফোরণ। সেই দোলাচাল ও উত্তুঙ্গ মুহূর্তে এই আন্দোলনকে উমর ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলে শনাক্ত ও সংজ্ঞায়িত করেন। হাঁটা পথেই হাঁটতে চায় সকলেই, কিন্তু উমর কখনোই যাননি সেই পথে, শামিল হননি ভেড়ার পালে। The Road Not Taken কবিতায় Robert Frost যেমন লিখেছিলেন:
‘Two roads diverged in a wood, and I
I took the one less traveled by,
And that has made all the difference.’
বদরুদ্দীন উমরের এই স্বাতন্ত্র্য বোঝা জরুরি। এই স্বাতন্ত্র্যর মধ্যেই উচ্চকিত হয়েছে তার স্বর-ইতিহাস নিষ্ঠতা, প্রত্যাখ্যানের প্রজ্ঞা ও সাহস। যাকে ভালবেসে-সশ্রদ্ধ সম্মানে আহমদ ছফা বলেছিলেন, তিনি গর্বিত বদরুদ্দীন উমরের কালে জন্মেছিলেন বলে।
লেখক: চিন্তক, গবেষক ও সাংবাদিক
তারা//