জাতীয় ঐকমত্য সমঝোতা স্মারকে যা থাকতে পারে
Published: 11th, March 2025 GMT
আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট গভীর, তা সমাধানের জন্য ঐকমত্যভিত্তিক সংস্কারপ্রক্রিয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আয়োজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ এই ঐকমত্য গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা বা কঠোর ‘প্রথমে সংস্কার, পরে নির্বাচন’ বা ‘আমার পথই একমাত্র পথ’ ধরনের অনমনীয় মনোভাব সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। এর পরিবর্তে দরকার ‘ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির একটি নকশা’।
সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটি মৌলনীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমে, রাজনৈতিক নেতারা জরুরি সংস্কার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক করে সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির ইস্যুগুলো নির্ধারণ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এজেন্ডাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ইস্যুভিত্তিক প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন। সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না। আলাপ-আলোচনা চালিয়ে সর্বসম্মত ন্যূনতম ঐকমত্য খুঁজে বের করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা যায়। এর দুটি ধাপ থাকতে পারে। নির্বাচনের আগে এবং পরের ধাপের সংস্কার কার্যক্রম চিহ্নিত করা যায়।
জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতায় আন্তরিক থাকলে এই পদ্ধতিতে ‘সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি’ সমঝোতা স্মারকে পৌঁছানো সম্ভব। সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি সর্বরোগের ওষুধ নয়। এটি স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিতকরণ এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রথম পদক্ষেপ। এর কেন্দ্রে তিনটি মূল বিষয় থাকতে পারে। ক.
জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান প্রচলিত ব্যবস্থাকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। সমতা, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দাবি এখন জাজ্বল্যমান। সংবিধান, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা ও পুলিশি কার্যক্রম নিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো ঐকমত্য গঠনের জন্য ভিত্তি হতে পারে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কীভাবে সংলাপে সম্পৃক্ত হতে পারে, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়া হলো।
শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর: একদলীয় আধিপত্যের চক্র ভাঙাক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের অভাব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। জনগণের আস্থা চুরমার করেছে। নির্বাচন তদারকির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন দেশীয় কায়দায় তৈরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ক্ষমতার অদলবদল ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া এবং হস্তান্তরকালে সহিংসতা বা বাধাবিঘ্ন থেকে বিরত থাকার জন্য একটি বাধ্যতামূলক অঙ্গীকারেও সম্মত হতে পারে। এই পদক্ষেপগুলোতে সার্বিক সম্মতি থাকলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সমতাভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন দল ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার ও সংসদের ভারসাম্য, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও মেয়াদসীমা নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য দৃশ্যমান। বিশেষভাবে নারীদের সংসদে অংশগ্রহণ বাড়ানোর ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব সীমিত এবং প্রচারাভিযান তহবিলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘প্রচারাভিযান তহবিল প্রবিধান’–এর বিষয়ে সম্মত হতে পারে। তদুপরি ছোট দলসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও হতে পারে সংলাপের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন: ভোটারের আস্থা পুনঃস্থাপনবর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে বায়োমেট্রিক ভোটার যাচাইকরণ ব্যবস্থা চালু, ভুতুড়ে ভোটার দূর ও ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা নিশ্চিতি অন্তর্ভুক্ত। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে পুনর্গঠন বিষয়ে জনগণের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে।
কমিশনারদের একটি স্বচ্ছ, বহুদলীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ‘রাতে ভোট’, ‘ভোটের আগেই প্রার্থী নির্বাচিত’ এবং ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হওয়ার রোগ সারাতে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্বাচন কমিশনের আওতায় আনার পরিষ্কার আইনি কাঠামো দরকার। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাষ্ট্র ও বেসরকারি মিডিয়ায় সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতি এবং নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করতে খ্যাতিমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর সংবিধির প্রয়োজন।
প্রতিনিধিত্বশীল শাসনকাঠামো: গণতন্ত্র ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা একধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতি, স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং বিচারকদের নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণের বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠছে। এ ধরনের সংস্কার জন–আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। একইভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা, স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি মামলার স্বাধীন তদন্তের জন্য দুদককে পর্যাপ্ত সম্পদ ও কর্তৃত্ব প্রদান জরুরি।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করাও নাগরিকতন্ত্র গঠনের জন্য জরুরি। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনকাঠামোর জন্য তা অপরিহার্য। পুলিশ বিভাগকে রাজনীতিমুক্ত করা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদি নাগরিক সেবার জন্য আবশ্যিক শর্ত।
পুলিশের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ এবং তাদেরকে কমিউনিটির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাও একটি সম্ভাব্য সংস্কার পদক্ষেপ হতে পারে। এই সংস্কারগুলো আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নির্বাহী ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আদালতের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বিচারাধীন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভাব্য ঐকমত্যের আরেকটি ক্ষেত্র।
এখনই সময় কথাকে কাজে পরিণত করারঅন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আহ্বানে অনুষ্ঠিত সংলাপ বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। রাজনৈতিক নেতারা যখন জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন তাঁদের সে অনুযায়ী কাজও করতে হবে।
সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য নিখুঁত সংস্কার নয়; বরং সম্ভবপর সংস্কার বাস্তবায়ন করা। বর্ণিত ম্যাক্স-মিন পদ্ধতি (Max-min principle), তথা সর্বাধিক দলের ন্যূনতম জরুরি সংস্কারে একমত হওয়া একটি বাস্তবসম্মত পথ তৈরি করতে পারে। আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও স্থিতিশীলতা ও বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় মূল সংস্কারে ঐকমত্য সম্ভব।
এই সংলাপকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিবেদিত রাখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঐকান্তিক, ধৈর্যশীল, কার্যকর ভূমিকা পালন জরুরি। জনস্বার্থে সংস্কারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়বদ্ধ করতে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও বিদ্বৎসমাজেরও বিশাল ভূমিকা আছে।
সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি শেষ লক্ষ্য নয়। এটি বরং একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত মূল সংস্কার নিঃসন্দেহে জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত তৈরি করবে।
এরপর একটি নির্বাচিত সরকার জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী আরও ব্যাপক সংস্কার কার্যকর করতে পারবে। এর চেয়ে কম কিছু বাংলাদেশের জনগণ প্রাপ্য নয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতির জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
● ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ন শ চ ত কর ন র জন য র র জন য ব যবস থ ঐকমত য জনগণ র ত র জন ত কর র ক র জন র একট সরক র গঠন র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
সুপারিশ নিয়ে বিতর্ক, কতটা যৌক্তিক
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের যে সুপারিশ করেছে, তার কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমতের উল্লেখ না থাকা, বিকল্প একটি সুপারিশ অনুযায়ী একপর্যায়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তাবগুলো সংবিধানে যুক্ত হবে—এমন বিষয়ে আপত্তি ও প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি কিছু মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে ভিন্নমত দিয়েছে। দলটির ভিন্নমত অনুসারে সংস্কার বাস্তবায়ন করা হলে খুব বেশি মৌলিক পরিবর্তন আসবে না। অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংস্কার প্রস্তাব সংবিধানে যুক্ত করার সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়।
গত মঙ্গলবার জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিকল্প দুটি সুপারিশ জমা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর পর থেকে এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা হচ্ছে।
শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কয়েকটি দলের দাবি ছিল, ভিন্নমত অনুসারে নয়, ঐকমত্য কমিশন যেভাবে প্রস্তাব দিয়েছে বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।ভিন্নমত নিয়ে বিতর্কজুলাই জাতীয় সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে অন্তত ৩৬টিতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। ১৭ অক্টোবর যে জুলাই জাতীয় সনদ সই হয়েছে, সেখানে কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘অবশ্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সেইমতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।’
কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ার তফসিলে সংস্কার প্রস্তাবগুলোই শুধু উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ভিন্নমতের উল্লেখ নেই। আদেশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ‘আদেশের তফসিল-১-এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ’ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে। এর আগে গণভোটও হবে সনদের তফসিলে থাকা প্রস্তাবগুলোর অনুমোদন প্রশ্নে। অর্থাৎ সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে না।
কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যই চূড়ান্ত নয়। এখানে জনগণের মতও প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতের সুরক্ষা থাকে।মূল সনদে ভিন্নমত থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে এটা না রাখাকে প্রতারণা হিসেবে উল্লেখ করেছে বিএনপি। অন্যদিকে শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশ কয়েকটি দলের দাবি ছিল, ভিন্নমত অনুসারে নয়, ঐকমত্য কমিশন যেভাবে প্রস্তাব দিয়েছে বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেভাবেই এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
জুলাই সনদে ভিন্নমতের কথা উল্লেখ আছে, বাস্তবায়নের সুপারিশে তা না রাখা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন সংসদ বিষয়ে গবেষক নিজাম উদ্দিন আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন যেকোনো দল বলতে পারে, এটা উল্লেখ না থাকলে তারা জুলাই সনদে সই করত না। ভিন্নমতের উল্লেখ ছিল বলেই তারা সই করেছে। এখন তারা সুপারিশ না মানলে হয়তো কিছু করার থাকবে না।
ভিন্নমত বাদ কেনঐকমত্য কমিশন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের সমন্বয়ে কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণ করেছে। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের মতামত ছিল ভিন্নমত রেখে সনদ বাস্তবায়ন করা হলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। কমিশনও সেটাই মনে করে। তা ছাড়া নোট অব ডিসেন্ট হলো একটি সিদ্ধান্তে কারও ভিন্নমতের উল্লেখ। এতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় না।
সংবিধান সংস্কারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো কিছু মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন আনা। যেমন ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি কঠিন করা, যাতে কোনো দল ইচ্ছেমতো তা পরিবর্তন করতে না পারে। এ জন্য বেশ কিছু সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার একটি হলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন। এ পদ্ধতিতে সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। নিম্নকক্ষে (সংসদ) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধান সংশোধনী বিল অনুমোদিত হওয়ার পর উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এটি পাস হতে হবে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ হলে একক দলের ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধন কঠিন হবে।
বিএনপি চায় নিম্নকক্ষে পাওয়া আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন। কিন্তু এভাবে উচ্চকক্ষ গঠন করা হলে সেটি হবে নিম্নকক্ষের অনুলিপি। এতে উচ্চকক্ষ গঠনের মূল লক্ষ্য পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এতে শুধু সংসদ সদস্যের সংখ্যা এবং রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনাতেও বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছিল।
অনেকে মনে করেন, বেশির ভাগ দল ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় তাদের দলীয় অবস্থান ও আদর্শ বিবেচনায় প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সংবিধান শুধু কোনো দলের চিন্তার বিষয় নয়। সংবিধান হলো জনগণের অভিপ্রায়। তাই এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিতে প্রস্তাবগুলো ভিন্নমত ছাড়া গণভোটে দেওয়ার সুপারিশ যৌক্তিক।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ৪৮টি প্রস্তাবের ৩০টির মধ্যে দলগুলোর একধরনের ঐকমত্য আছে। বাকিগুলোতে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। কিন্তু কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যই চূড়ান্ত নয়। এখানে জনগণের মতও প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতের সুরক্ষা থাকে।
সংবিধানে কিছু কি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে পারেসংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সুপারিশ করা হয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে, প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে গণভোট। গণভোটে প্রস্তাব পাস হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। এ সময়ে সংস্কার করতে সংসদ ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। এর জন্য সংস্কার প্রস্তাবগুলো সংবিধান সংস্কার বিল (সংবিধান সংশোধনে আইনের খসড়া) আকারে আদেশের তফসিলে থাকবে। আরেকটি বিকল্প সুপারিশের কাঠামোও একই। কিন্তু সেখানে ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন না হলে কী হবে, তার উল্লেখ নেই। এখানে তফসিলে থাকবে শুধু সংস্কার প্রস্তাব।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংবিধানে কোনো কিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে পারে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। কোন প্রক্রিয়ায় এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে, সেটাও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে কোনো কিছু যুক্ত হওয়ার বিধানও বিদ্যমান সংবিধান অনুমোদন করে না। অবশ্য জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ গণভোটে পাস হলে এই বিধান গণভোটের মাধ্যমেও ভিত্তি পাবে।
তবে সুপারিশের এ অংশ বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন সংসদ বিষয়ে গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে কিছু যুক্ত হতে পারে—এমন বিধান কোথাও আছে বলে তাঁর জানা নেই। সংবিধানে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
ঐকমত্য কমিশন গিলোটিন প্রসিডিউরের ধারণা থেকে এই বিধান সুপারিশ করেছে। এটি হলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিতর্ক শেষ না হলে আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে বিল পাস করানো।
এ বিষয়ে নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, গিলোটিনের চর্চা সাধারণত অর্থবিলে হয়ে থাকে। সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ ধারণা প্রয়োগ করা ঠিক হবে না।
বিল তৈরিতে জটিলতা হতে পারেসংস্কার প্রস্তাবগুলোকে বিল আকারে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রেও জটিলতা আছে। কারণ, সনদের কয়েকটি প্রস্তাব সুনির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত নয়। যেমন বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ করা হবে। সেখানে কী কী থাকবে, তা সুনির্দিষ্ট নয়। সনদে বলা আছে, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রস্তাবগুলো ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে, যাতে রাজনৈতিক দলের নেতারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং ভবিষ্যতে জনপ্রতিনিধিরা সাংবিধানিক ব্যবস্থা ও আইনি বিধানাবলি পরিবর্তন করতে পারেন।
তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মৌলিক অধিকারের বিষয়টি কীভাবে গণভোটের বিলে যুক্ত করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। মৌলিক অধিকারে কী কী থাকবে, সেটা কে নির্ধারণ করবে, কীভাবে নির্ধারণ করবে?
প্রক্রিয়াগত জটিলতাসংসদে একটি বিল পাস হওয়ার পর তাতে সই করেন স্পিকার। এরপর সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায় সংসদ সচিবালয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর তা আইনে পরিণত হয়। এ প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার বিধান হাস্যকর।
সংবিধান সংস্কারবিষয়ক প্রস্তাবগুলো গণভোটে পাস হলে সেগুলো যাবে সংসদে (সংবিধান সংস্কার পরিষদ)। বিল সংসদে পাস হবে কি না, তা মূলত নির্ভর করবে সরকারি দল তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর। কারণ, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। সংসদের স্পিকারও হবেন সরকারি দল থেকে। রাষ্ট্রপতিও হবেন সরকারি দলের মনোনীত প্রার্থী।
সরকারি দল না চাইলে ২৭০ দিনের মধ্যে বিলটি পাস হবে না। ২৭০ দিন পর বিলটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর উদ্যোগ কে নেবে, রাষ্ট্রপতি এটিতে সই করবেন কি না, গেজেট কীভাবে প্রকাশিত হবে—এ প্রক্রিয়া পরিষ্কার নয়।
তবে নানা প্রশ্ন থাকলেও সনদ বাস্তবায়ন হবে এ নিশ্চয়তা বিধান করতেই মূলত স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হবে—এমন সুপারিশ এসেছে। কারণ, অনেকে মনে করেন এ রকম বিধান না থাকলে সংস্কারের পরিণতি হবে নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখার মতো। কয়েকটি দলও সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চেয়েছে।
এখানে আরেকটি বিকল্প আলোচনায় ছিল, সেটা হলো ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে সংসদ বিলুপ্ত হবে। কিন্তু এটি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এটি ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে, এমন বিবেচনায় সেটা রাখা হয়নি বলে কমিশন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়নে কমিশন দুটি বিকল্প দিয়েছে। এর একটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে দ্রুত সংস্কার সম্পন্ন করা যায়, সে জন্য এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আরেকটা বিকল্প পথও বলা হয়েছে। সরকার সেটাও নিতে পারে। তিনি বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় গিলোটিন প্রসিডিউরের ধারণা থেকে তাঁরা প্রথম বিকল্পের সুপারিশ করেছেন। তবে কমিশনের দৃঢ় বিশ্বাস, এত দূর যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সংসদে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সংস্কার সম্পন্ন করবে দলগুলো।