গাজায় একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির মেয়াদ দ্বিতীয় দফা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনার জন্য গতকাল সোমবার কাতারের রাজধানী দোহায় একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে ইসরায়েল। এর মধ্যেই হামাসের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলের সরকার। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বন্দি বাকি জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসকে বাধ্য করার জন্যই এ নির্দেশ দিয়েছে দেশটি। এদিকে হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য ইসরায়েলের এ সিদ্ধান্তকে ‘সস্তা ও অগ্রহণযোগ্য ব্ল্যাকমেইল’ বলে উল্লেখ করেছে ফিলিস্তিনি সংগঠনটি। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হামাস।
রোববার ইসরায়েলের জ্বালানিমন্ত্রী এলি কোহেন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার ঘোষণা দেন। এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। গাজায় ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন। এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে এবং যুদ্ধ শেষে গাজায় আর এক দিনও যেন হামাসের অস্তিত্ব না থাকে, তা নিশ্চিত করতে আমাদের হাতে যা কিছু আছে, তার সবই আমরা ব্যবহার করব। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হলে শুরুতেই গাজায় পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থায় প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাজার বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক বিবৃতিতে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য ইজ্জাত আল-রিশক বলেছেন, গাজাকে খাদ্য, ওষুধ ও পানি থেকে বঞ্চিত করার পর এখন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাই আমরা। এটি আমাদের জনগণ এবং তাদের প্রতিরোধ আন্দোলনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার এক হতাশাজনক প্রচেষ্টা এবং সস্তা ও অগ্রহণযোগ্য ব্ল্যাকমেইল কৌশল।
এদিকে বিশ্বব্যাপী ১২টির বেশি মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় ‘অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত অনাহার’ নীতি ফের চালু করার অভিযোগ এনেছেন। তারা ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টা ব্যাহত করা এবং গাজার জন্য মানবিক সহায়তা বন্ধ করার কঠোর সমালোচনা করেছেন।
সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ও শান্তির সব সম্ভাবনাকে স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, আমরা ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, তারা আবারও গাজায় যাবতীয় পণ্য ও সরবরাহ, এমনকি জীবনরক্ষাকারী মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের দায়িত্ব হচ্ছে গাজার জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিন্তু ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে এই সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে আবারও সাহায্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি হামলায় পাঁচ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও বহু ফিলিস্তিনি। যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিনই গাজায় হামলা চালাচ্ছে এবং এতে ঘটছে হতাহতের ঘটনাও।
এদিকে সর্বশেষ প্রাণহানির ঘটনায় অবরুদ্ধ এই উপত্যকাটিতে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার ৪৬০ জনে পৌঁছেছে। খবর আলজাজিরা, বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ানের।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব দ য ৎ সরবর হ ইসর য় ল ইসর য় ল র র জন য চ ত কর
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানের ভুলে আজারবাইজান যেভাবে ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ল
ইরানের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমি রাফসানজানি তাঁর স্মৃতিকথায় ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে প্রথম নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেইদার আলিয়েভের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেছেন। রাফসানজানির মতে, আর্মেনিয়ার সঙ্গে সংঘাতে ইরানের সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন আলিয়েভ।
রাফসানজানি লিখেছেন, ‘বারবার করে বলা তাঁর (আলিয়েভ) একটি মন্তব্য ছিল যে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ইরানের উচিত আজারবাইজানে তার উপস্থিতি বাড়ানো। মাঝেমধ্যে তিনি এ–ও বলতেন, আজারবাইজান একসময় ইরানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমাদের (ইরান) সেখানে এসে এটিকে (আজারবাইজান) রক্ষা করতে ও নিয়ন্ত্রণ নিতে অনুরোধ করতেন।’ তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে ইরান যদি আজারবাইজানকে তার প্রভাববলয়ে নিয়ে আসে, তবে তা পুরো ককেশাসে রাশিয়ার আধিপত্যকে নাড়িয়ে দেবে।
৩২ বছর পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আজারবাইজানের কর্মকর্তারা এখন আর বাকুর বিষয়ে তেহরানের সম্পৃক্ততা চান না।
এখন ইরানের রাজনৈতিক নেতারাও এই ছোট প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেবে তা নিয়ে অনিশ্চিত। আজারবাইজান ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু গোলস্তান (১৮১৩) এবং তুর্কমেনচায় (১৮২৮) চুক্তির মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের কাছে হস্তান্তরের আগে এটি একসময় ইরানের অংশ ছিল।
গত দশকে দুটি দেশের (ইরান ও আজারবাইজান) মধ্যে ক্ষমতার গতিশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আজারবাইজানের অনেকে ও দেশটির গণমাধ্যম এখন ইরানেরই কিছু অংশকে আজারবাইজানের সঙ্গে সংযুক্ত করার দাবি তুলছে।
এদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধ তেহরান ও বাকুর রাজনৈতিক বিভেদকে আরও গভীরতার দিকে নিয়ে গেছে। তেহরানে আজারবাইজানের ইসরায়েলের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সামরিক ও গোয়েন্দা সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
ইসরায়েলি ড্রোন কোথা থেকে এল?ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই ইরানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কাছে বসবাসকারীরা আজারবাইজানের দিক থেকে ইসরায়েলি ড্রোন প্রবেশের খবর দেন। পরবর্তী সময়ে ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমও এই খবর নিশ্চিত করে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে যে তেহরান, তাবরিজ, উরমিয়াসহ বিভিন্ন শহরে ইসরায়েলের হামলায় ব্যবহৃত ড্রোনগুলো আজারবাইজান থেকে ইরানে প্রবেশ করেছিল।
বিষয়টি তখন এতটাই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে যে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় যে তারা বিষয়টি দেখছে। তবে কয়েক দিন পর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন যে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে ইসরায়েল আজারবাইজানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে হামলা চালায়নি।
যদিও এটি ইরানের অনেককে আশ্বস্ত করতে পারেনি। সংবাদমাধ্যম বা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের কেউই আজারবাইজানের এ বক্তব্যকে গ্রহণ করেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেহরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন অধ্যাপক বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রেসিডেন্ট উভয়ই এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন তার মানে ইরান এটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।
ওই বিশেষজ্ঞের মতে, ইরান যদি আজারবাইজান সীমান্ত থেকে ইসরায়েলের যুক্ত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত না হতো, বিষয়টি এতটা উচ্চপর্যায়ে গুরুত্বসহকারে নেওয়া হতো না।
তিনি আরও যুক্তি দেন যে আলিয়েভের আশ্বাস সম্পর্কে পেজেশকিয়ানের মন্তব্য ককেশাস অঞ্চলে ইরানের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা তুলে ধরে। অধ্যাপক বলেন, ‘পেজেশকিয়ান যা বলেছেন, তা কেবল কূটনৈতিক ভাষা। বাস্তবে শেষ কারাবাখ যুদ্ধের পর থেকে ইরান আজারবাইজানের সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করবে তা জানে না। এর পর থেকে আজারবাইজান একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বা অন্তত নিরপেক্ষ দেশ থেকে বরং একটি শান্ত কিন্তু গুরুতর হুমকির দেশে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বাকু ও তেল আবিবের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আরও প্রমাণ হিসেবে আজারবাইজানীয় ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজান ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে এবং দেশটি উন্নত মানের ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা সরঞ্জাম আমদানি করছে। কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইসরায়েল আজারবাইজানের সামরিক অস্ত্রের প্রায় ৭০ শতাংশ সরবরাহ করেছে।ইরানের দোরগোড়ায় ইসরায়েলসোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর আজারবাইজান প্রথমে ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কের কাছাকাছি আসে। পরবর্তী সময়ে দেশটি ইসরায়েলের সঙ্গেও তার সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আজারবাইজান ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে এবং দেশটি উন্নত মানের ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা সরঞ্জাম আমদানি করছে। কিছু প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ইসরায়েল আজারবাইজানের সামরিক অস্ত্রের প্রায় ৭০ শতাংশ সরবরাহ করেছে।
এখন আজারবাইজান নতুন সিরীয় সরকারের সঙ্গেও কাজ করছে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সিরীয় সরকার ইরান থেকে সরে এসেছে।
ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ককেশাস অঞ্চলে কোনো স্পষ্ট কৌশল না থাকায় ইরান এখন দেখছে যে তেল আবিব তার সীমান্তের দিকে আরও কাছাকাছি আসছে।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ইসরায়েল, সিরিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি নতুন আঞ্চলিক জোট দ্রুতই তুরস্কের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ইরানের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে পারে। একমাত্র বাধা হলো আর্মেনিয়া ও ইরানের মধ্যকার ৪৩ কিলোমিটার স্থলপথ, যার মাধ্যমে আজারবাইজান তার ছিটমহল এলাকা নাখচিভানের সঙ্গে যুক্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিবাদে ইরানে বিক্ষোভ। তেহরান, ইরান, ২২ জুন ২০২৫