পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু ব্যবহারযোগ্য পানি পাওয়া এখন বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ। অক্সফাম পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষ এখনও ব্যবহারযোগ্য ও নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশে এখনও ৪১ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। কাজের কারণে আমাকে বরাবরই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যেতে হয়। বাংলাদেশের এ অঞ্চলের উপকূল, যেগুলো এক সময় প্রকৃতির দানে পরিপূর্ণ ছিল; সেই সঙ্গে ছিল যথেষ্ট পরিমাণে সুপেয় পানির আধার, সেখানে এখন সুপেয় পানির সংকট। এক সময় যেই পানি ছিল ওই অঞ্চলের মানুষের প্রধান সম্বল; সংকট ছিল স্বল্পস্থায়ী; কালের ধারাবাহিকতায় এখন তা নিয়মিত এবং তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ সমস্যার কারণে দুর্যোগপ্রবণ মোট ১৯টি জেলার কোটি মানুষের জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে।
সুস্থভাবে জীবন যাপনে একজন মানুষের প্রতিদিন ৩-৪ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। বর্তমান পরিস্থিতিতে শহরাঞ্চলের মানুষের কাছে দৈনিক ৩-৪ লিটার পানি পাওয়া তেমন বিষয় নয়। একটি কল ঘুরিয়ে বা পরিশোধিত পানির বোতল খুললেই তাদের প্রয়োজন মিটে যায়। কিন্তু উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য এই পানি সংগ্রহ করতে গড়ে ১-২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজন হয় আর্থিক বিনিয়োগের। 

এই সংকটের একক কারণ হিসেবে অনেকে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করলেও নানা স্থানীয় কারণও এর সঙ্গে যুক্ত, চিড়িং চাষের আধিপত্য যার অন্যতম। চিংড়ি চাষ একদিকে জমির উর্বরতা নষ্ট করছে, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত কোনো নেতৃত্ব না থাকায় পানীয় জলের সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃসীমান্ত নদী গঙ্গা (পদ্মা) থেকে পানির প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। এর শাখা নদী গড়াই থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের নদীগুলোতে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। ফলে বঙ্গোপসাগর থেকে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

সুপেয় পানির এই সংকট সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে নারীদের ওপর। উপকূলীয় অঞ্চলে নারীরাই সাধারণত পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে পানি সংগ্রহের জন্য পথ পাড়ি দেওয়া তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। অনেক সময় নিরাপদ পানির অভাবে নারীরা প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান করতে পারছেন না, যা তাদের স্বাস্থ্য বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
এ সমস্যার সমাধান কী?

এটা বলার আগে আমি এ অঞ্চলের খাবার পানির উৎসগুলোকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করতে চাই। ভূগর্ভস্থ পানি, ভূপৃষ্ঠের পানি এবং বৃষ্টির পানি। তবে উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভূপৃষ্ঠের পানির প্রধান উৎস হিসেবে পুকুরের পানিকেই ধরা হয়। সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে এই পুকুর। পুকুরের পানিকে এক বিশেষ পরিশোধন ব্যবস্থায় (পিএসএফ) পরিশোধিত করে দৈনন্দিন খাবার ও রান্নার পানি হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এ ছাড়া যেসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের পরিমাণ কম সেসব এলাকায় বাড়িভিত্তিক বায়োস্যান্ড ফিল্টার (বিএসএফ) ব্যবহার করেও উপকূলীয় অঞ্চলের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ পানির আওতায় আনা সম্ভব। 

নম্বই দশকের শেষের দিকে এ অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করে রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং (আরডব্লিউএইচ), যেখানে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সঞ্চয় করা হয়। এখানকার অনেক বাসাবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়ে এই প্রক্রিয়ায় পানি সংগ্রহ করা হয়, যা শুষ্ক মৌসুমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খাবার পানির 
চাহিদা অনেকাংশেই মেটাতে সক্ষম। এ ছাড়া বর্তমানে পানীয় জল পরিশোধনে আধুনিক কিন্তু ব্যয়বহুল রিভার্স অসমোসিস ব্যবস্থার প্রচলন উল্লেখযোগ্য হারে দেখা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, পানীয় জল বিশুদ্ধকরণে ব্যবহারের এই পদ্ধতিটি পানি বিশুদ্ধকরণে কার্যকরী হলেও পরিশোধনকালে এর থেকে উৎপাদিত ময়লা পানি (গ্রে ওয়াটার) নিয়ে বিভিন্ন মহলে আপত্তি রয়েছে।  
উপকূলীয় এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সংকটে সরকার, দাতা সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। তবে সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবে মৌলিক এই সমাধানের স্থায়ী পথ এখনও অধরা থেকে গেছে। এই মুহূর্তে সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনোভাবেই সুপেয় পানির এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে পানি ব্যবস্থাপনায় নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য টেকসই সমাধান বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।

দেবরাজ দে: উন্নয়নকর্মী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপক ল ন র পদ প ন ব যবস থ উপক ল য় ব যবহ র জনগ ষ ঠ সমন ব ত র জন য পর শ ধ ক সময় সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও

রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।

গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।

পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়। 

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো। 

ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।” 

তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।” 

আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”

রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”

গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।

গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।” 

উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।

ঢাকা/আমিরুল/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি ট্রাম্পের
  • মেসি বনাম ইয়ামাল: ফিনালিসিমার সময়-সূচি ঘোষণা
  • গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও