অনেক দেশেই একটা কথার প্রচলন আছে, প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়ালে যেখানে নদী বা খাল নেই, সেখানেও তিনি একটা সেতু বানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এ রকমটি আমাদের দেশে হরহামেশা হয়ে থাকে। একবার প্রথম আলোতে এই সেতু নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তুঘলকি কাণ্ডের একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

দুই পাতার বিশেষ ক্রোড়পত্র। খালের ওপর সেতু তৈরি হয়েছে, তাতে ওঠা বা নামার ব্যবস্থা নেই। ফসলের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেতু, আশপাশে কোনো খাল-বিল নদী কিছু নেই। আবার কোথাও সেতু তৈরি হয়েছে, তাতে ওঠা বা নামার পথ নেই, কিন্তু স্থানীয় জনতা বাঁশ দিয়ে নিজেরাই র‌্যাম্প বানিয়ে নিয়েছেন। এ রকম চিত্র আমাদের কষ্ট করে খুঁজতে হয় না, চলতে-ফিরতেই চোখে পড়ে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেখেছি, ব্যক্তি বিশেষের অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে কীভাবে প্রকল্প-মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্পের উদ্ভাবন করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছে প্রকল্প।

এসব প্রকল্পের অধিকাংশের যথাযথ সমীক্ষা ছিল না। অপরিকল্পিত এসব প্রকল্পে ছিল টাকার শ্রাদ্ধ। বিভিন্ন বাহানায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা। মেয়াদ বৃদ্ধি মানে বাজেট বৃদ্ধি। এই সবকিছুকে উন্নয়ন বলে চালানো হয়েছে। এর অধিকাংশই জনগণের কোনো কাজে আসেনি।

বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে। এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এবং এর পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর একটি হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিতব্য কদম রসুল সেতু।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় এই সেতুর অবস্থান। নগরাঞ্চলে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়কে যুক্ত করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। এই সেতুকে নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নও বলা চলে। কিন্তু এই সেতুর নকশা তৈরিতে বড় ধরনের ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

এই ত্রুটি এখনই যে তৈরি হয়েছে, তা নয়। এই ত্রুটিপূর্ণ নকশা নিয়েই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন পার করেছে। এখন জনসমক্ষে প্রকল্পটি উন্মুক্ত হওয়ায় ত্রুটিটি জনগণের নজরে এসেছে। জনগণ যেহেতু এসব প্রকল্পের অংশীজন, তাই এমন প্রকল্প গ্রহণের শুরুতে তাঁদের মতামত নেওয়া গেলে বা বিষয়টি অবগত করে তাঁদের তাতে যুক্ত করা গেলে শুরুতেই ত্রুটি চিহ্নিত করা যেত।

পশ্চিম পাড়ের মুখটি পরিবর্তন করে দ্রুত সেতুর কাজ শুরু করাটা জরুরি। এই পরিবর্তন করতে গিয়ে প্রকল্প যাতে বিঘ্নিত বা বিলম্বিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এমনিতেই ভুল নকশা নিয়ে বহু সময় পার করা হয়েছে। এখনই এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছি।

এ সেতুটি নির্মাণের দায়িত্বে যৌথভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ৭৩৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদিত হয়। কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালে। এর মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেতুটির পূর্ব পাড়ের র‌্যাম্প-স্পট (নামার মুখ) বন্দর উপজেলার সিএসডি অঞ্চল এবং পশ্চিমাংশের র‌্যাম্প শহরের নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনে। নারায়ণগঞ্জ কলেজটি শহরের অত্যন্ত ব্যস্ততম সড়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কে অবস্থিত।

এর উত্তর পাশে শহরের বৃহত্তর স্কুল নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল এবং কলেজ ঘেঁষে শহরের সবচেয়ে বড় বাজার দিগুবাবুর বাজারে প্রবেশমুখ। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল একই জায়গায় অবস্থিত। এবং সেখানে যাওয়ার এটিই যেমন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, আবার দেশের বৃহত্তর রং ও সুতার বাজার টানবাজারে যাওয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এখানেই রয়েছে রেলক্রসিং। যার ফলে বিভিন্ন সময় এখানে দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে এ সড়কটিতে লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াত। ১ নম্বর রেলগেট থেকে পুরো সিরাজউদ্দৌলা সড়কটিতে প্রতিনিয়ত প্রচণ্ড ট্রাফিক থাকে।

নারায়ণগঞ্জে অপরিকল্পিত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে এখানে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত পরিবহনব্যবস্থা। ১৮৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেলব্যবস্থা চালু হলে যাতায়াতের সুব্যবস্থার কারণে নারায়ণগঞ্জ সে সময় পূর্ববঙ্গের সিংহদ্বারে পরিণত হয়েছিল। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে রেল বা সড়কপথে ঢাকা বা অন্যান্য জায়গায় যাওয়া যেত। কিন্তু আজকে ১৪০ বছর পর এই যোগাযোগব্যবস্থা জনদুর্ভোগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর এ জন্যই কদম রসুল সেতুর নকশা প্রণয়নে এলাকার বাস্তবতা, ট্রাফিক প্রভাব নিরূপণে যথাযথ সমীক্ষা তৈরির ক্ষেত্রে ত্রুটি রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সেতু দিয়ে ঘণ্টায় কত যান চলাচল করবে এবং তার ধারণ সক্ষমতা এই সড়কের কতটুকু রয়েছে, তা এই প্রকল্পের নকশা তৈরির ক্ষেত্রে সঠিকভাবে গুরুত্ব পায়নি। বর্তমান অবস্থায় সেতু থেকে সড়কে গাড়ি নামার কোনো বাস্তবতা নেই।

১ নম্বর রেলগেটের কাছেই রয়েছে বন্দর খেয়াঘাট। প্রতিদিন এই বন্দর খেয়াঘাট দিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ লোক যাতায়াত করে। এই সংখ্যার ৬০ শতাংশ যদি সেতু ব্যবহার করে, তা হলে সেতু ও সড়কে তার প্রভাব কতটা পড়বে, যথাযথ সমীক্ষা করে তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।

এই শহরে আজ সাড়ে ৯ লাখ মানুষের বসতি। যদি বর্তমান হাড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তা হলে আগামী ১০০ বছরে এই সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটির বেশি। এ ধরনের প্রকল্প অন্তত ১০০ বছর সামনে রেখে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনীতি ও আত্মস্বার্থ যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়, তখন আর কোনো কিছু বিবেচনায় থাকে না। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।

বিষয়টিতে মনে হচ্ছে যেনতেনভাবে একটা সেতু বানিয়ে দিলেই কাজ সারা হয়ে গেল। এটি জনগণের কাজে লাগুক আর না লাগুক, কিচ্ছু যায় আসে না। বর্তমান নকশায় এই সেতুর মুখ যেভাবে আছে, সেভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি উপকার তো নয়ই, বরং স্থায়ীভাবে নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য বড় ধরনের দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠবে। সেতুটি নারায়ণগঞ্জের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।

পশ্চিম পাড়ের মুখটি পরিবর্তন করে দ্রুত সেতুর কাজ শুরু করাটা জরুরি। এই পরিবর্তন করতে গিয়ে প্রকল্প যাতে বিঘ্নিত বা বিলম্বিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এমনিতেই ভুল নকশা নিয়ে বহু সময় পার করা হয়েছে। এখনই এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছি।

রফিউর রাব্বি আহ্বায়ক, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আন্দোলন

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এসব প রকল প র ন র য়ণগঞ জ ব যবস থ র জন য এই স ত শহর র গ রহণ অবস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

খালেদা জিয়াকে মামুন মাহমুদের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির অভ্যর্থনা 

দীর্ঘদিন লন্ডনে চিকিৎসা শেষে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন।

বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবনে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক মামুন মাহমুদের নেতৃত্বে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। 

মঙ্গলবার (৬ মে ) সকাল থেকেই জেলা বিএনপি'র বিভিন্ন ইউনিট বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা জাতীয় ও দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে ব্যানার ফেস্টুনে সুসজ্জিত কুড়িল বিশ্বরোডের সামনে সমবেত হয়।

পরে দুপুর দিকে বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আসলে তাকে অভ্যর্থনা জানান মামুন মাহমুদের নেতৃত্বে জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। 

এসময়ে উপস্থিত ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু, যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজিব, যুগ্ম আহ্বায়ক শরীফ আহমেদ টুটুল, জেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রিয়াদ মোহাম্মদ চৌধুরী, জুয়েল আহমেদ, শহীদুল ইসলাম টিটু, মোশারফ হোসেন, এড. মাহফুজুর রহমান হুমায়ূন, রহিমা শরীফ মায়া, জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান সাদেক, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক খায়রুল ইসলাম সজিব,জেলা শ্রমিকদলের সভাপতি মন্টু মেম্বার, সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমানসহ জেলা বিএনপি'র আওতাধীন বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃবৃন্দ ।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাংবাদিক মিলনের মায়ের মৃত্যুতে নারায়ণগঞ্জ নিউজ পেপার ওনার্স এসোসিয়েশনের শোক
  • ফতুল্লায় স্টেডিয়ামের শোভাবর্ধণের স্বার্থে ট্রাকস্ট্যান্ড অন্যত্র নির্মাণের দাবি  
  • ‘দ্য হিন্দু’র সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবেদন ভিত্তিহীন: প্রেস উইং
  • খালেদা জিয়াকে মামুন মাহমুদের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির অভ্যর্থনা 
  • অস্ট্রেলিয়ায় লেবার পার্টি কেন বড় জয় পেল
  • সরকার যুদ্ধংদেহী হলেও পাকিস্তানের মানুষ কেন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চান না
  • গণমাধ্যমে দলীয়করণ ও ফ্যাসিবাদী প্রভাব কমাতে সংস্কার রূপরেখা চান নাহিদ ইসলাম
  • সরকার নির্বাচন চায় না, মুলা ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছে: রিজভী
  • নারী সংস্কার কমিশনের ‘বিতর্কিত’ বিষয় পর্যালোচনায় কমিটি চেয়ে রিট