নারায়ণগঞ্জের কদম রসুল সেতু হবে আশীর্বাদ না অভিশাপ?
Published: 6th, May 2025 GMT
অনেক দেশেই একটা কথার প্রচলন আছে, প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়ালে যেখানে নদী বা খাল নেই, সেখানেও তিনি একটা সেতু বানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। এ রকমটি আমাদের দেশে হরহামেশা হয়ে থাকে। একবার প্রথম আলোতে এই সেতু নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তুঘলকি কাণ্ডের একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
দুই পাতার বিশেষ ক্রোড়পত্র। খালের ওপর সেতু তৈরি হয়েছে, তাতে ওঠা বা নামার ব্যবস্থা নেই। ফসলের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেতু, আশপাশে কোনো খাল-বিল নদী কিছু নেই। আবার কোথাও সেতু তৈরি হয়েছে, তাতে ওঠা বা নামার পথ নেই, কিন্তু স্থানীয় জনতা বাঁশ দিয়ে নিজেরাই র্যাম্প বানিয়ে নিয়েছেন। এ রকম চিত্র আমাদের কষ্ট করে খুঁজতে হয় না, চলতে-ফিরতেই চোখে পড়ে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেখেছি, ব্যক্তি বিশেষের অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে কীভাবে প্রকল্প-মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্পের উদ্ভাবন করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছে প্রকল্প।
এসব প্রকল্পের অধিকাংশের যথাযথ সমীক্ষা ছিল না। অপরিকল্পিত এসব প্রকল্পে ছিল টাকার শ্রাদ্ধ। বিভিন্ন বাহানায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা। মেয়াদ বৃদ্ধি মানে বাজেট বৃদ্ধি। এই সবকিছুকে উন্নয়ন বলে চালানো হয়েছে। এর অধিকাংশই জনগণের কোনো কাজে আসেনি।
বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে। এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ এবং এর পরবর্তী বাস্তবতা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর একটি হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিতব্য কদম রসুল সেতু।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় এই সেতুর অবস্থান। নগরাঞ্চলে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব ও পশ্চিম পাড়কে যুক্ত করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু। এই সেতুকে নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্নও বলা চলে। কিন্তু এই সেতুর নকশা তৈরিতে বড় ধরনের ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এই ত্রুটি এখনই যে তৈরি হয়েছে, তা নয়। এই ত্রুটিপূর্ণ নকশা নিয়েই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন পার করেছে। এখন জনসমক্ষে প্রকল্পটি উন্মুক্ত হওয়ায় ত্রুটিটি জনগণের নজরে এসেছে। জনগণ যেহেতু এসব প্রকল্পের অংশীজন, তাই এমন প্রকল্প গ্রহণের শুরুতে তাঁদের মতামত নেওয়া গেলে বা বিষয়টি অবগত করে তাঁদের তাতে যুক্ত করা গেলে শুরুতেই ত্রুটি চিহ্নিত করা যেত।
পশ্চিম পাড়ের মুখটি পরিবর্তন করে দ্রুত সেতুর কাজ শুরু করাটা জরুরি। এই পরিবর্তন করতে গিয়ে প্রকল্প যাতে বিঘ্নিত বা বিলম্বিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এমনিতেই ভুল নকশা নিয়ে বহু সময় পার করা হয়েছে। এখনই এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছি।এ সেতুটি নির্মাণের দায়িত্বে যৌথভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ৭৩৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদিত হয়। কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালে। এর মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেতুটির পূর্ব পাড়ের র্যাম্প-স্পট (নামার মুখ) বন্দর উপজেলার সিএসডি অঞ্চল এবং পশ্চিমাংশের র্যাম্প শহরের নারায়ণগঞ্জ কলেজের সামনে। নারায়ণগঞ্জ কলেজটি শহরের অত্যন্ত ব্যস্ততম সড়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কে অবস্থিত।
এর উত্তর পাশে শহরের বৃহত্তর স্কুল নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল এবং কলেজ ঘেঁষে শহরের সবচেয়ে বড় বাজার দিগুবাবুর বাজারে প্রবেশমুখ। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরে রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনাল একই জায়গায় অবস্থিত। এবং সেখানে যাওয়ার এটিই যেমন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, আবার দেশের বৃহত্তর রং ও সুতার বাজার টানবাজারে যাওয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এখানেই রয়েছে রেলক্রসিং। যার ফলে বিভিন্ন সময় এখানে দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে এ সড়কটিতে লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াত। ১ নম্বর রেলগেট থেকে পুরো সিরাজউদ্দৌলা সড়কটিতে প্রতিনিয়ত প্রচণ্ড ট্রাফিক থাকে।
নারায়ণগঞ্জে অপরিকল্পিত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে এখানে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত পরিবহনব্যবস্থা। ১৮৮৫ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেলব্যবস্থা চালু হলে যাতায়াতের সুব্যবস্থার কারণে নারায়ণগঞ্জ সে সময় পূর্ববঙ্গের সিংহদ্বারে পরিণত হয়েছিল। গোয়ালন্দ থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে রেল বা সড়কপথে ঢাকা বা অন্যান্য জায়গায় যাওয়া যেত। কিন্তু আজকে ১৪০ বছর পর এই যোগাযোগব্যবস্থা জনদুর্ভোগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর এ জন্যই কদম রসুল সেতুর নকশা প্রণয়নে এলাকার বাস্তবতা, ট্রাফিক প্রভাব নিরূপণে যথাযথ সমীক্ষা তৈরির ক্ষেত্রে ত্রুটি রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সেতু দিয়ে ঘণ্টায় কত যান চলাচল করবে এবং তার ধারণ সক্ষমতা এই সড়কের কতটুকু রয়েছে, তা এই প্রকল্পের নকশা তৈরির ক্ষেত্রে সঠিকভাবে গুরুত্ব পায়নি। বর্তমান অবস্থায় সেতু থেকে সড়কে গাড়ি নামার কোনো বাস্তবতা নেই।
১ নম্বর রেলগেটের কাছেই রয়েছে বন্দর খেয়াঘাট। প্রতিদিন এই বন্দর খেয়াঘাট দিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ লোক যাতায়াত করে। এই সংখ্যার ৬০ শতাংশ যদি সেতু ব্যবহার করে, তা হলে সেতু ও সড়কে তার প্রভাব কতটা পড়বে, যথাযথ সমীক্ষা করে তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।
এই শহরে আজ সাড়ে ৯ লাখ মানুষের বসতি। যদি বর্তমান হাড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তা হলে আগামী ১০০ বছরে এই সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটির বেশি। এ ধরনের প্রকল্প অন্তত ১০০ বছর সামনে রেখে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনীতি ও আত্মস্বার্থ যখন গুরুত্বপূর্ণ হয়, তখন আর কোনো কিছু বিবেচনায় থাকে না। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।
বিষয়টিতে মনে হচ্ছে যেনতেনভাবে একটা সেতু বানিয়ে দিলেই কাজ সারা হয়ে গেল। এটি জনগণের কাজে লাগুক আর না লাগুক, কিচ্ছু যায় আসে না। বর্তমান নকশায় এই সেতুর মুখ যেভাবে আছে, সেভাবে বাস্তবায়িত হলে এটি উপকার তো নয়ই, বরং স্থায়ীভাবে নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য বড় ধরনের দুর্ভোগের কারণ হয়ে উঠবে। সেতুটি নারায়ণগঞ্জের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।
পশ্চিম পাড়ের মুখটি পরিবর্তন করে দ্রুত সেতুর কাজ শুরু করাটা জরুরি। এই পরিবর্তন করতে গিয়ে প্রকল্প যাতে বিঘ্নিত বা বিলম্বিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এমনিতেই ভুল নকশা নিয়ে বহু সময় পার করা হয়েছে। এখনই এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছি।
রফিউর রাব্বি আহ্বায়ক, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক আন্দোলন
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এসব প রকল প র ন র য়ণগঞ জ ব যবস থ র জন য এই স ত শহর র গ রহণ অবস থ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৩৫৬ কোটি টাকা কি পানিতে গেল
দেশের ১৪টি জেলায় ডাকব্যবস্থাকে আধুনিক ও গতিশীল করার লক্ষ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার (এমপিসি) নির্মাণ করেছিল। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এই সেন্টারগুলো কার্যত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, শতকোটি টাকার সরঞ্জাম পরিণত হয়েছে ‘ভাগাড়ে’। এভাবে জনগণের অর্থ অপচয়ের প্রকল্প খুবই হতাশাজনক। এ প্রকল্প কেন ব্যর্থ হলো, কারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২৮৯ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৩ ধরনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মতো প্রধান সেন্টারগুলোতেও অনেক সরঞ্জাম এখনো বাক্সবন্দী বা অযত্নে পড়ে আছে। মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে গেট, ট্রলি, এক্স-রে গুডস—সবকিছুই অব্যবহৃত। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও একই চিত্র। ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম—সবখানেই কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অলস পড়ে আছে, অনেকগুলো আবার নষ্ট, যা পচনশীল পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ একটি সরঞ্জাম চিলার চেম্বার, সেটিরও কোনো ব্যবহার নেই।
সার্ভিস সেন্টারগুলো চালু না হওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সফটওয়্যারের অভাব এবং দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন (এসপিএস) চালুর জন্য সফটওয়্যার না দেওয়ায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ৪২০ সেট হার্ডওয়্যারও অব্যবহৃত। এমনকি এই এসপিএস প্যাকেজ এমপিসি প্রকল্পের অধীনে কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কারণ এটি মূলত ডাকঘরের পার্সেল ও ই-কমার্স সেবার জন্য কেনা হয়েছিল। এটি কি কেবলই ভুল পরিকল্পনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে? সম্ভাব্যতা যাচাই ও চাহিদার মূল্যায়ন না করায় এ প্রকল্পটির এমন বেহাল পরিণতি হলো। এখানে সরঞ্জাম কেনার পেছনে বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ, যার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি।
ডাক বিভাগের ওয়েবসাইটে এমপিসি সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকা এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট জবাব না পাওয়ার বিষয়টিতে স্পষ্ট হয়, এখানে জবাবদিহির চরম অভাব ছিল। প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁরাই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কাছে অবশ্যই জানতে চাওয়া হোক কেন বিপুল ব্যয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করার পর এর বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হলো না? কেন অদরকারি সরঞ্জাম কেনা হলো?
জনগণের টাকার এমন অপচয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে এই এমপিসি প্রকল্পের একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। কারা এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী, কেন শতকোটি টাকার সরঞ্জাম অকেজো হয়ে পড়ে আছে এবং কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব, তা খুঁজে বের করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।