নানা রং, নকশায় তৈরি স্কার্ফে সাধারণ পোশাকও করে তোলে অনন্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্কার্ফের ডিজাইন ও ব্যবহারে এসেছে নতুনত্ব, যা প্রতিদিনের ফ্যাশনে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। লিখেছেন আশিকা নিগার
স্কার্ফ একটি ছোট কাপড়ের টুকরো। তবে আজকের ফ্যাশন দুনিয়ায় তরুণীদের কাছে এর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। স্কার্ফ এখন শুধু প্রয়োজন নয়, একটি স্টেটমেন্টও। পুরোনো দিনের ফ্যাশনের ধারণা ভেঙে আধুনিক নারীর কাছে স্কার্ফ হয়ে উঠেছে আধুনিকতা ও বৈচিত্র্যের প্রতীক।
ঐতিহ্য থেকে ট্রেন্ডে
স্কার্ফের শুরু হয়েছিল মূলত প্রায়োগিক কারণে অর্থাৎ ধুলা, রোদ, ঠান্ডা কিংবা ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সময়ের সঙ্গে ফ্যাশনের পরিবর্তনে এটি হয়ে উঠেছে স্টাইলের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার নারীরা যেভাবে স্কার্ফ ব্যবহার করেছেন, তা একেকটি যুগে একেক রকম গল্প বলে।
গরমের স্কার্ফ ফেব্রিক
চলছে গ্রীষ্মকাল– এ সময়টায় ফেব্রিক বাছাই ফ্যাশনের মূল চাবিকাঠি। এ কারণে ফ্যাশনসচেতন নারীর জন্য ফ্যাশন ডিজাইনাররা আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে আরামদায়ক ফেব্রিক ও হালকা ডিজাইনের স্কার্ফ তৈরি করছেন, যা এ গরমেও আপনাকে স্বস্তি দেবে।
আজকালের ফ্যাশন স্টেটমেন্টে সাদামাটা পোশাকেও রঙিন বা প্যাটার্ন স্কার্ফ যোগ করলে মুহূর্তেই লুক বদলে যায়। হালকা, আরামদায়ক, শ্বাস নিতে পারে এমন কাপড়– যেমন কটন, লিনেন, মসলিনের তৈরি স্কার্ফ বেছে নেওয়া উত্তম। এ কাপড়ের স্কার্ফ ঘাম শোষণেও কার্যকরী।
তাছাড়া শিফন বা জর্জেট কাপড়ের স্কার্ফ হালকা, পাতলা ও ঝরঝরে হয়। এটি আপনাকে ট্রেন্ডি আর ফ্লোই লুক দিতে পারে। তবে খুব গরমের দিনে তা ঘামে ভিজে যেতে পারে। তাছাড়া স্কার্ফ দিয়ে হালকাভাবে চুল বাঁধলে ধুলা ও রোদের হাত থেকে চুল রক্ষা করে। পাশাপাশি এক ধরনের ক্যাজুয়াল অথচ মার্জিত লুক এনে দেয়।
ডিজাইন
স্কার্ফের ডিজাইন অনেক ধরনের হয়। প্রতিটিরই আলাদা স্টাইল আর মেজাজ আছে।
ফ্লোরাল ডিজাইন: ছোট বা বড় ফুলের নকশা সব সময়ই জনপ্রিয়। গ্রীষ্ম বা বসন্তে হালকা, রঙিন ফুলের ডিজাইন খুব মানায়।
জ্যামিতিক ডিজাইন: বৃত্ত, ত্রিভুজ, রেখার ডিজাইন স্মার্ট আর আধুনিক লুক আনে, যা অফিস বা ক্যাজুয়াল সাজে মানায়।
অ্যাবস্ট্রাক্ট ডিজাইন: এলোমেলো বা শিল্পময় নকশা, যা আপনাকে আলাদা আর স্টাইলিশ দেখাবে।
এথনিক বা ট্র্যাডিশনাল ডিজাইন: দেশি মোটিফ, ব্লক প্রিন্ট, জামদানি বা মধ্যপ্রাচ্যের নকশাগুলো ফিউশন সাজে খুব ভালো মানায়।
তাছাড়া ডিজাইন ও নকশায় ব্যবহৃত হয় এমব্রয়ডারির কাজ, লেস, জরি ও টারসেল। ডিজাইনে ভিন্নতা আনতে চুমকির কাজও রয়েছে। আবার কিছু কিছু স্কার্ফে কারচুপির কাজও করা হয়।
প্যাটার্ন
প্যাটার্ন মানে কেবল নকশা নয় বরং তার বিন্যাস। সাইজেও রকমভেদ আছে। ওড়নার মতো বড়, মাফলারের মতো চিকন, আয়তাকার, চারকোণা আকৃতির, গলার কাছে মালার মতো প্যাটার্নের স্কার্ফও দেখতে পাওয়া যায়।
ছোট প্যাটার্ন: ছোট নকশা বা ছোট মোটিফ থাকে, যা ছোট স্কার্ফ বা হালকা গলায় পরার স্কার্ফে ভালো লাগে।
বড় প্যাটার্ন: বড় ফুল, বড় নকশা বা বড় জ্যামিতিক ফর্ম, যা বড় স্কার্ফ বা শাল টাইপে সুন্দর লাগে।
বর্ডার প্যাটার্ন: শুধু স্কার্ফের চারপাশে নকশা থাকে, মাঝখানটা ফাঁকা। এটা খুব অ্যালিগ্যান্ট আর মার্জিত লুক আনে।
অলওভার প্রিন্ট: পুরো স্কার্ফে একই রকম নকশা থাকে, যা কেবল ফ্যাশনের জন্য নয়, চুল বা ব্যাগেও স্টাইল হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
সব আউটফিটেই মানানসই: দেশীয় পোশাকের পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন আউটফিটে সমানভাবে মানানসই স্কার্ফ। বেশির ভাগ স্কার্ফই তৈরি হয় জর্জেট ও সিল্কের কাপড়ে। তবে সুতি, নেট, ক্রেপ, অ্যান্ডি, উল প্রভৃতি কাপড়ের স্কার্ফও পাওয়া যাচ্ছে। ডিজাইন ও নকশায় ব্যবহার হয় চুমকি, জরি, এমব্রয়ডারি, লেস ও টারসেল। কন্ট্রাস্ট কালারের স্কার্ফ পরতে পারেন একাধিক পোশাকের সঙ্গে।
স্কার্ফের ব্যবহার
স্কার্ফের ব্যবহারেও রয়েছে বৈচিত্র্য স্টাইল। ক্ল্যাসিক নেক-নট: সবচেয়ে জনপ্রিয় আর সহজ স্টাইল। এক টুকরা রেশমি স্কার্ফ, গলায় হালকা করে পেঁচিয়ে সামনের দিকে ছোট গিঁট বেঁধে দিলেই হয়ে যায় ক্ল্যাসিক লুক। ওয়েস্টার্ন পোশাক, শার্ট বা এমনকি সাধারণ টি-শার্টেও এর ছোঁয়ায় একটা ফ্রেঞ্চ চমক এসে যায়। অফিস লুক থেকে ক্যাফে আড্ডা সবখানেই মানায়।
হেড স্কার্ফ: চুল ঢেকে বা বাঁধতে স্কার্ফের ব্যবহার যেন এক অমলিন ক্ল্যাসিক। পঞ্চাশ-ষাট দশকের হলিউড নায়িকাদের কথা মনে পড়বে। সানগ্লাস, উড়তে থাকা চুল আর মাথায় বাঁধা স্কার্ফ। আজও ভিন্টেজ লুকে কিংবা রোদ থেকে রক্ষায় এটি দারুণ চলে। প্যাস্টেল রং বা ছোট প্রিন্টের স্কার্ফ মাথায় বাঁধলে অচিরেই যোগ হয় রহস্য আর স্টাইল।
ব্যাগ-অ্যাকসেসরি: একটু ইউনিক লুক আনতে হ্যান্ডব্যাগের হাতলে বা স্লিং ব্যাগের চেইনে ছোট স্কার্ফ পেঁচিয়ে দিন। মুহূর্তেই ব্যাগের ফ্যাশন স্টেটমেন্টে বদলে যাবে।
বেল্ট হিসেবে স্কার্ফ: জিন্স বা ড্রেসের ওয়েস্টলাইন দিয়ে স্কার্ফ পেঁচিয়ে বেল্ট বানানো যায়, যা খুবই ট্রেন্ডি এবং এক্সপেরিমেন্টাল। অনেকে আবার ওভারসাইজড শার্টের ওপর দিয়ে স্কার্ফ পেঁচিয়ে পেট আটকান এক ধরনের বোহো লুক তৈরি করতে।
ব্রেসলেট বা হ্যান্ড অ্যাকসেসরি: পাতলা স্কার্ফ হাতে কয়েকবার পেঁচিয়ে নিলে হয়ে যায় অদ্ভুত সুন্দর ব্রেসলেটের বিকল্প। সাজে আসে রঙের ছোঁয়া আর মেজাজের বৈচিত্র্য।
স্কার্ফের ব্যবহার প্রসঙ্গে ‘লা রিভ’-এর ডিজাইনার মারুফা শিল্পী বলেন, ‘আজকাল মেয়েরা টিউনিক, কুর্তি বা টপসের সঙ্গে ফ্যাশনেবল স্টাইলে স্কার্ফ ব্যবহার করে, যা স্মার্ট লুক দেয়। একটা সলিড কালার টিউনিক বা কুর্তির সঙ্গে একটা প্রিন্টের স্কার্ফ কম্বিনেশন ভালো চলছে। আবার পোশাকের কালারের সঙ্গে ম্যাচ করে যে স্কার্ফ পরছে এটা দেখতেও বেশ সুন্দর লাগে।’
ফেব্রিকের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আরামদায়ক, নরম ফেব্রিকগুলো যেমন কটন, সিল্ক, হাফ সিল্কই স্কার্ফের জন্য বেশি উপযোগী। পাশাপাশি জর্জেটের স্কার্ফগুলোও অনেক ফ্যাশনেবল। সলিড কালারের স্কার্ফের পাশাপাশি প্রিন্টের বা বিভিন্ন মোটিফযুক্ত স্কার্ফগুলোও বেশ চলছে।’
রংয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মেয়েরা বেশি পছন্দ করে নুড কালারের স্কার্ফ, যা তার পোশাকটাকে পরিপূর্ণ করছে এবং সব ধরনের পোশাকের সঙ্গে সমানভাবে মানানসই। অ্যাশ, নুড পিংক, ব্ল্যাক, ব্লু কালারগুলো সবাই বেশি পছন্দ করছে ।’
কোথায় পাবেন
দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো এখনকার নারীর ফ্যাশন ও রুচির কথা মাথায় রেখে স্কার্ফে এনেছে ভিন্নতা। একরঙা ও প্রিন্ট– দুই ধরনের স্কার্ফই পাওয়া যায় বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। যে কোনো মার্কেটেও পাবেন ছোট-বড় সাইজের স্কার্ফ। তাছাড়া অনলাইন পেজগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে অনেক ধরনের স্কার্ফ। রাজধানীর নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়া, উত্তরার রাজলক্ষ্মী, মিরপুরের হোপ মার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, জাপান গার্ডেন সিটি, যমুনা ফিউচার পার্কসহ সব মার্কেটেই আপনার পছন্দের স্কার্ফ পেয়ে যাবেন।
কেমন দাম
স্কার্ফের দাম নির্ভর করে আপনি কেমন জায়গা থেকে কিনছেন– স্কার্ফের ম্যাটারিয়াল এবং ডিজাইনের ওপর। মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা যায়, ২৫০ থেকে শুরু করে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে আপনার পছন্দের স্কার্ফটি পেয়ে যাবেন। তাছাড়া স্থানীয় মার্কেটে আপনি ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যেও পেয়ে যেতে পারেন আপনার পছন্দের স্কার্ফ।
স্কার্ফের যত্নআত্তি
ফ্যাশনে স্কার্ফের ব্যবহার তো আছেই, রোদের এ সময়টায় কিন্তু ত্বক বাঁচাতে স্কার্ফ বেশ জরুরি। স্কার্ফ ভালো করে মুখে জড়িয়ে নিলে আর ধুলাবালি মুখে ঢোকার ভয় থাকে না। পাশাপাশি রোদের তেজ থেকে ত্বককে বাঁচানো যায়। তবে ঠিকমতো যত্ন না নিলে স্কার্ফ থেকে কিছু সমস্যাও হতে পারে। এ জন্য আপনার পছন্দের স্কার্ফটির নিয়মিত যত্ন নেওয়াটা জরুরি।
যারা মুখ ঢাকতে স্কার্ফ ব্যবহার করেন, পরিষ্কার না থাকলে এর ধুলাবালি কিন্তু মুখে লাগতে পারে। ধরা যাক আগের দিন যেদিকটা বাইরের দিকে ছিল, কাজে বেরোনোর ব্যস্ততায় আজ সে দিকটা ভেতরে রেখেছেন। এতে ত্বকের সমস্যা বাড়তে পারে। স্কার্ফে লেগে থাকা ধুলাবালি নাকে ঢুকে অ্যালার্জি হতে পারে। প্রতিদিন স্কার্ফ ধোয়ার সময় হয়তো সবার থাকে না। এর ফলে ধুলাবালি থেকেই যায়; যা ত্বকের ক্ষতি করে। এ জন্য স্কার্ফের কাপড়টা কেমন কিনছেন, সেটাও দেখা জরুরি। ত্বক সংবেদনশীল বা সেনসেটিভ হলে স্কার্ফ থেকে ত্বকের নানা সমস্যা হতে পারে।
স্কার্ফ ধোয়ার টিপস
প্রথমে ঠান্ডা পানিতে স্কার্ফ ভিজিয়ে রাখুন। সিল্কের স্কার্ফ হলে পানিতে হালকা ধরনের ডিটারজেন্ট দিয়ে স্কার্ফ ভেজান। কমপক্ষে পাঁচ মিনিট ভিজিয়ে রেখে ভালোভাবে হাত দিয়ে স্কার্ফটি ঘষতে থাকুন। অন্য কিছু দিয়ে না ঘষাই ভালো। হালকাভাবে স্কার্ফের সঙ্গে স্কার্ফ ঘষতে থাকুন। এরপর সাধারণ পানিতে ডুবিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন। যাতে সব ডিটারজেন্ট পরিষ্কার হয়ে যায়। বেশি দূষণযুক্ত এলাকায় স্কার্ফ ব্যবহার করলে একদিন পরপর ধোয়ার চেষ্টা করুন। অনেক সময় সোজা উল্টো বুঝতে সমস্যা হয় স্কার্ফের। সে ক্ষেত্রে মার্ক করে রাখতে পারেন।
মডেল: রিফাত জাহান;
মেকওভার: রাজিয়া’স মেকওভার
স্কার্ফ: লা রিভ
ছবি: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আপন র পছন দ র স ক র ফ স ক র ফ ব যবহ র কর স ক র ফ র ব যবহ র র ড জ ইন ড জ ইন র ক ধরন র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
সরকার বলছে সম্ভাবনা দলগুলোর সন্দেহ
চট্টগ্রাম বন্দরে চালু থাকা চারটি কনটেইনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। ৯৫০ মিটার দীর্ঘ এই টার্মিনালেই গত বছর বন্দরের মোট কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ ওঠানামা হয়েছে এককভাবে। একসঙ্গে এতে চারটি সমুদ্রগামী কনটেইনার জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল উপযোগী একটি ছোট জাহাজ নোঙর করা যায়। বন্দরের অন্য কোনো টার্মিনালে নেই এত সুবিধা।
জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার জন্য এ টার্মিনালে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যধুনিক যন্ত্র ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ রয়েছে ১৪টি। অন্যান্য টার্মিনালে এ সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। বছরে ১০ লাখ একক কনটেইনার ওঠানামার সক্ষমতা থাকা এই টার্মিনাল গত বছরও হ্যান্ডল করেছে ১২ লাখ ৮১ হাজার কনটেইনার। এই টার্মিনাল থেকে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্বও পাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
‘সোনার হরিণ’ হিসেবে পরিচিত এই টার্মিনাল ঘিরেই এসেছে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব। এনসিটি ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করতে সরকারের পরিকল্পনায় পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়েছে বন্দর ব্যবহারকারীসহ বিভিন্ন মহল। বিদেশি বিনিয়োগে নতুন সম্ভাবনা দেখছে সরকার। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এতে পাচ্ছে ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’।
বিদেশি কোম্পানিকে বন্দর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করার উদ্যোগের প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ শুরু করেছে বিভিন্ন বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল-সংগঠন। আজ বিকেলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আগামী সোমবার চট্টগ্রাম বন্দর গেটে বৃহত্তর শ্রমিক সমাবেশের ডাক দিয়েছে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ)।
কোন টার্মিনালের কত অবদান
বন্দরের কনটেইনারের ৪৪ শতাংশ এনসিটিতে ওঠানামা হলেও তার পাশে থাকা চিটাগং কনটেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) গত বছর ১৯ শতাংশ এবং জেনারেল কার্গো বার্থ-জিসিবিতে ৩৬ শতাংশ কনটেইনার ওঠানামা করেছে। সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল প্রথম ১০ মাসে তাদের টার্গেটের মাত্র ১২ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডল করেছে। ২০২৪ সালের জুন থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠান নবনির্মিত এই টার্মিনাল পরিচালনা করলেও পুরোদমে চালু হয়নি এটি।
বন্দরের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সাল থেকে আংশিক চালু ছিল এনসিটি। পরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে এই টার্মিনালে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামার কাজ শুরু হয়। এর পরে কমতে থাকে জাহাজের অপেক্ষমাণ সময়ও। আগে একটি জাহাজ ১২ থেকে ১৫ দিন পণ্য নিয়ে অপেক্ষায় থাকলেও এখন সেটি নেমে এসেছে দুই থেকে তিন দিনে।
২০০৭ সালে আংশিক চালু হওয়ার প্রথম বছরে এনসিটিতে বাণিজ্যিক জাহাজ আসে ৪৩৬টি। ২০২৪ সালে এনসিটিতে জাহাজ এসেছে ১ হাজার ২৫০টি। ১৭ বছরের ব্যবধানে জাহাজ আসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। জিসিবি, সিসিটি, এনসিটি এবং বহির্নোঙর মিলিয়ে ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৩০০টি।
সবচেয়ে বেশি আয় এনসিটিতে
চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটিতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের পাশাপাশি ৩৩টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনও স্থাপন করা হয়েছে এই টার্মিনালে। প্রতি বছর গড়ে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আয় হয় এখান থেকে। এই টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দিলে বন্দরের আয় নির্ভর করবে বিদেশিদের সঙ্গে দরকষাকষির ওপর। এই টার্মিনাল পরিচালনা করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ দুই বছরে কনটেইনারপ্রতি বিল পেয়েছে ৭০০ টাকা বা প্রায় সাড়ে ৬ ডলার। সব খরচ বাদ দিয়ে গত দুই বছরে তাদের প্রকৃত আয় হয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে কনটেইনারপ্রতি বন্দরের প্রকৃত আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৭ ডলার। সৌদি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়া পতেঙ্গা টার্মিনাল থেকে বন্দর পাচ্ছে কনটেইনারপ্রতি মাত্র ১৮ ডলার। সেখানে অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ শুধু জেটি নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে।
চার কারণে বিতর্ক
এনসিটি ঘিরে সরকারের তৎপরতা, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ না করা, বন্দরের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার চিন্তা এবং সবচেয়ে বেশি আয় আসা টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন– যে টার্মিনালটি ১৭ বছর ধরে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার হ্যান্ডল, সবচেয়ে বেশি আয় এবং কর্মসংস্থান করেছে, সেটি কেন দিতে হবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে। ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে এই টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে এই টার্মিনালের জন্য। বিদেশি প্রতিষ্ঠান নতুন আর কী বিনিয়োগ করবে এই টার্মিনালে– এই প্রশ্ন সামনে এনেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। নতুন কোনো স্থানে নতুন করে টার্মিনাল করে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করলে আপত্তি নেই তাদের।
সম্ভাবনা দেখছে সরকার
তবে সরকার বলছে, এনসিটির বর্তমান সক্ষমতা ও দক্ষতা আমূল পাল্টে দেবে বিদেশি প্রতিষ্ঠান। কীভাবে তারা এটা করবে– সেই পরিকল্পনাই তাদের কাছ থেকে চেয়েছে সরকার। যে প্রতিষ্ঠানকে তারা ভাবছে, তারা বিশ্বের সেরা বন্দরগুলোতে কাজ করছে। তাদের কর্মদক্ষতার কারণেই ওইসব বন্দর আছে বিশ্বসেরার তালিকায়। বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে কারও চাকরি যাবে না। উল্টো কর্মক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়বে। বাড়বে সুযোগ-সুবিধা। এমনই মত এই সরকারের।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে এসে গত ১৪ মে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড হলো চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু যে সাইজে এই হৃৎপিণ্ড আছে, তাতে চলে না। এই হৃৎপিণ্ডকে বিশ্ব সাইজের হৃৎপিণ্ড বানাতে হবে। কাজেই আমরা বললাম যে, পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে, তাদের ডাকো। দেখলাম যে, আগেই ডাকা হয়েছে; কিন্তু কাজটা ঠিকমতো এগোচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি– এটা তাড়াতাড়ি করে দাও। যতই দিন যাবে, এই হৃৎপিণ্ডকে আর ওইভাবে স্থাপন করতে পারব না। এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
ওই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জানান, তিনি নৌপরিবহন উপদেষ্টাকে বলেছেন, যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে; যেভাবেই হোক।
এর আগে বন্দর পরিদর্শনে এসে অভিন্ন ইচ্ছার কথা বলেছেন বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তারা বিশ্বে ৭০-৮০টি বন্দর পরিচালনা করা দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ইঙ্গিত দেন। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই তারা এটি শেষ করতে চান। এমন বক্তব্য ও তৎপরতার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল ইস্যুটি সবার সামনে চলে আসে।
যে পথে হাঁটছে সরকার
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার ব্যাপারে কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালের মার্চে নিউমুরিং টার্মিনালটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে এটি আর বেশি দূর এগোতে পারেনি।
পরে এ কাজ এগিয়ে নিতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকার। গত বছরের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভা ডাকার উদ্যোগ নেয় তারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মে মাসের মধ্যে আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট-টিএসআর প্রদান করবে। এ প্রতিবেদন অনুমোদনের পর দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। সেপ্টেম্বরে এ ব্যাপারে কনসেশন চুক্তি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। চুক্তির পর টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারাই মাশুল আদায় করবে, লোকবল নিয়োগ দেবে। চুক্তি অনুযায়ী, বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থ দেবে ডিপি ওয়ার্ল্ড।
যা বলছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা
বন্দরের জেটি পরিচালনাকারী বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বার্থ অপারেটরস, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরস ও টার্মিনাল অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে একরাম চৌধুরী বলেন, এনসিটি ভালো করছে; লোকসানেও নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি আয় করছে এই টার্মিনাল দিয়ে। এর মাধ্যমে দক্ষও হয়ে উঠছে তারা। সক্ষমতার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ না পেলে ভবিষ্যতে বিদেশিরা ছেড়ে দিলে পরিচালনায় সংকট তৈরি হবে।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তাদের মাধ্যমে আমাদের আয়, সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে, সেটি যাতে সত্য হয়। সরকারকে এ ব্যাপারে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, আমাদের অপারেটরদের তুলনায় বাইরের অপারেটররা অনেক বেশি দক্ষ– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও জোরালো হবে। তবে চুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবার সঙ্গে কথা বললে আর বিতর্ক থাকত না।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভিমত
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য এবং ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সমকালকে বলেন, এনসিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলে সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আগে আলোচনা করতে হবে। সেটি না করাতে এখানে বিতর্ক হচ্ছে; সন্দেহ বাড়ছে। এই বন্দরই আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ইচ্ছা হলেই কেউ এটা বিদেশিদের দিয়ে দিতে পারে না। এনসিটি না দিয়ে অন্য যেখানে বিদেশিদের বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে, সেই টার্মিনাল দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
সরকারের পদক্ষেপের প্রতিবাদে সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। তারা বলেছে, দেশের টাকায় সবকিছু করে এখন বিদেশিদের হাতে টার্মিনাল তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক।
বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করে এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার সমালোচনা করেন।
এনসিটি বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনার প্রতিবাদে গত ২০ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও। সংগঠনটির চট্টগ্রাম নগর শাখার আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু সেই বিনিয়োগ হোক তাদের নিজেদের তৈরি করা টার্মিনালে; আমাদের তৈরি টার্মিনালে নয়।