জাপান যাওয়ার জন্য টাকা দিয়ে দালালের পেছনে ঘুরতে হবে না। সেখানে গিয়ে বেতন-ভাতাও পাওয়া যাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে যাওয়ার জন্য জানতে হবে জাপানি ভাষা। ছয় থেকে নয় মাসের ভাষা শিক্ষা কোর্স করেই যাওয়া যাবে জাপানে। পরে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগও আছে। এমনই আকর্ষণীয় জাপানের শ্রমবাজার। অথচ দেশটিতে কর্মী পাঠানোর এই সম্ভাবনা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ।

জাপানে সন্তান জন্মদানের হার গোটা বিশ্বেই সর্বনিম্ন। ১২৫ বছরের মধ্যে এ হার ২০২৪ সালে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে এসেছে। সংকট মোকাবিলায় জাপান সরকার ৩ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন জাপানি ইয়েনের ‘শিশু যত্ননীতি প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন অ্যান্ড সোশ্যাল সিকিউরিটি রিসার্চের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ২০৭০ সাল নাগাদ জাপানের জনসংখ্যা বর্তমানের তুলনায় ৩০ শতাংশ কমে ৮ কোটি ৭০ লাখে নেমে যেতে পারে। তখন দেশটির প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে ৪ জনের বয়স হবে ৬৫ বা তার বেশি।

সন্তান জন্মদানের হার কমে যাওয়ায় দেশটিতে কর্মক্ষম ও তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বছর বছর কমছে। অন্যদিকে বাড়ছে বয়স্ক লোকের সংখ্যা। দেশটিতে অবশ্য মৃত্যুহারও কম। সে জন্য জাপান এখন ‘বয়স্কদের দেশ’ হিসেবে পরিচিত। ২০২৪ সালের অক্টোবরে দেশটির জনসংখ্যা কমে ১২ কোটি ৩ লাখে নেমেছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ৯ লাখ কম। এসব কারণে জাপানের কোম্পানিগুলো কর্মী খুঁজে পাচ্ছে না। শ্রমিকসংকট চরম আকার ধারণ করায় তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক চাইছে। এ সুযোগটাই নিতে পারে বাংলাদেশ। মুশকিল হচ্ছে, জাপানি ভাষা শিক্ষা ছাড়া দেশটিতে কোনো কাজই পাওয়া যায় না।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গত আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে জাপান সফরে যান। দেশে ফিরে আসেন সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এরপর তিনি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে জাপানে কর্মী পাঠানো নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে জাপানে তিন মাসের মধ্যেই এক লাখ কর্মী পাঠানো সম্ভব। শর্ত হচ্ছে, কর্মীদের জাপানি ভাষা জানা থাকতে হবে। অনেকে মনে করেন, পরিচর্যাকারী (কেয়ার গিভার) পাঠাতে হবে। আসলে শুধু পরিচর্যাকারী নয়, আরও শ্রেণি আছে। জাপানিরা আমাকে বলেছেন যে ভাষাটা জানা থাকলে বাংলাদেশিদের চাকরি নিশ্চিত।’

চীন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে দীর্ঘদিন ধরেই কর্মী নিচ্ছে জাপান। এ তালিকায় আরও দেশে আছে। ২০১৯ থেকে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি জাপানের সঙ্গে প্রথম এ ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক সই হয় বাংলাদেশের। একই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে নীতিমালা জারি করে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তবে জাপানে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাপানে বর্তমানে ২৬ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করেন। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘বিস্ময়কর যে নেপাল আড়াই লাখ লোক পাঠিয়েছে জাপানে। জাপানিরা আমাকে বলেছেন, নেপালিরা খুব শৃঙ্খলা মেনে চলেন এবং ওই দেশে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম্য নেই।’

চাকরি আছে যে সব বিষয়ে

১৪টি খাতে জাপানে চাকরি করার সুযোগ আছে। এগুলো হচ্ছে নার্সিং কেয়ার বা কেয়ার গিভার, রেস্টুরেন্ট, কনস্ট্রাকশন, বিল্ডিং ক্লিনিং, কৃষি, খাবার ও পানীয় শিল্প, সেবা খাত, ম্যাটেরিয়ালস প্রসেসিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্যাকেজিং, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি, জাহাজ নির্মাণশিল্প, মৎস্যশিল্প, কার পেইন্টিং, ওয়েল্ডিং ও অটোমোবাইল মেকানিক বা অটোমোটিভ যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্প এবং এয়ারপোর্ট গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং অ্যান্ড এয়ারক্রাফট মেনটেন্যান্স (এভিয়েশন)

আপাতত কেয়ার গিভার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্যাকেজিং, ওয়েল্ডিং ও অটোমোবাইল মেকানিক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্যাকেজিংয়ে টেকনিক্যাল ইন্টার্ন (টিআই) হিসেবে বেশি লোক নিচ্ছে তারা। বাংলাদেশ অবশ্য বসে নেই। প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জাপানে যেতে আগ্রহীদের জন্য আলাদা একটি সেল গঠন করেছে। এর নাম ‘জাপান সেল’।

সম্প্রতি ‘জাপান: নতুন শ্রমবাজার, কর্মী প্রেরণের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, জাপানের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে বাংলাদেশিদের কাজের সুযোগ। জাপানের বাজার ধরতে বাংলাদেশকে প্রস্তুতি নিতে হবে। জাপানকে বলেছি, তারা যেন নিজেরা ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়ে লোক নিয়ে যায়। তারাও আগ্রহী। তিনি আরও বলেন, জাপান বাংলাদেশের শ্রমবাজারের নতুন গন্তব্য হতে পারে। জাপানে লোক পাঠানোর খরচ খুব বেশি না। সেখানে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে লোক নিয়োগের সুযোগ নেই।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে জাপানের সবচেয়ে বেশি লোক দরকার নার্সিং কেয়ার শ্রেণিতে। এ সংখ্যা ৬০ হাজার। জাপানের মানুষের গড় আয়ু ৮৪ বছর হলেও ১০০ বা তার অধিক বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। বয়স্ক এসব মানুষের সেবা দেওয়ার জন্যই এ শ্রেণিতে বেশি লোক নেওয়ার চাহিদা রয়েছে দেশটির।

সূত্রগুলো জানায়, ২০২৬ সালে পাঠানো হবে ২ হাজার, ২০২৭ সালে ৬ হাজার, ২০২৮ সালে ১২ হাজার, ২০২৯ সালে ৩০ হাজার এবং ২০৩০ সালে ৫০ হাজার কর্মী পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। খাত বিবেচনায় নির্মাণে ৪০ হাজার, কলকারখানায় ২০ হাজার, কেয়ার গিভার হিসেবে ২০ হাজার এবং কৃষি ও গাড়ি সার্ভিসিংয়ের জন্য ২০ হাজার কর্মী যেতে পারেন।

বেতন কত

জাপানের শ্রম আইন অনুযায়ী, একজন কর্মীর ন্যূনতম বেতন ঘণ্টায় বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০০ টাকা। কর্মীরা দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন। সে হিসাবে একজন কর্মী মাসে পাবেন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য সপ্তাহে ৪৪ ঘণ্টা কাজ করার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বেতনের টাকা দেওয়া হয় ব্যাংক হিসাবে।

দেশে এ পর্যন্ত ২৭টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ জাপানে লোক পাঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে টাকা নেওয়ার অভিযোগে একটির অনুমতিপত্র বাতিল করা হয়েছে। বাকিরা কাজ করছে। জাপানি ভাষা সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো কেন্দ্র থেকে শিখলে কোনো অসুবিধা নেই বলেও জানান তিনি।

ভাষা কোথায় শেখা যাবে

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ইতিমধ্যেই ৩২টি কেন্দ্রের মাধ্যমে জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে। বিএমইটির অধীনে দেশে কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার) চার মাস মেয়াদি জাপানি ভাষা শিক্ষার কোর্স চালু করা হয়েছে। প্রতিটি কোর্সে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৪০ জন করে। এ ছাড়া রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে কারিগরি ও ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেমন মিরপুরে রয়েছে আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘একুশ’।

জানা গেছে, ভাষা শেখানোর জন্য কাওয়াই গ্রুপ জাপান লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার বিরুলিয়ায় ২২ বিঘা জমির ওপর একটি আবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। ১ অক্টোবর থেকে এখানে জাপানি শিক্ষকদের মাধ্যমে ভাষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিও জাপানি ভাষা শেখায়।

ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একুশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নূরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খুব যত্নের সঙ্গে জাপানি ভাষা শেখাচ্ছি। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে ভাষা শিখে অনেকেই জাপান গেছেন এবং আরও যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।’

বিএমইটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ কোরিয়া টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার বা কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র (টিটিসি) মিরপুর, মহিলা টিটিসি (মিরপুর), বাংলাদেশ কোরিয়া টিটিসি (চট্টগ্রাম), নরসিংদী টিটিসি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসি, টাঙ্গাইল টিটিসি ও খুলনা টিটিসি। এগুলোতে ‘এন-ফোর’ পর্যায়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জাপানি ভাষা বোঝার মৌলিক ক্ষমতা অর্জন করাকেই এন-ফোর পাস বোঝানো হয়। এসএসসি পাসের সনদ থাকলেই ভর্তি হওয়া যায়।

এ ছাড়া আরও ‘হাইব্রিড মডেল’ নাম দিয়ে আরও কয়েকটি জাপানি ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ কোরিয়া টিটিসি (মিরপুর), মহিলা টিটিসি (মিরপুর), বাংলাদেশ কোরিয়া টিটিসি (চট্টগ্রাম), চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসি, খুলনা টিটিসি, মৌলভীবাজার টিটিসি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া টিটিসি, কিশোরগঞ্জ টিটিসি, কাপাসিয়া টিটিসি, বরিশাল টিটিসি, রাজবাড়ী টিটিসি, চাঁদপুর সদর টিটিসিসহ আরও কয়েকটি কেন্দ্র। প্রশিক্ষণের পর পরীক্ষায় বসেন কর্মীরা। উত্তীর্ণ হলে জাপানের ব্যবস্থাপনায় আরও চার মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষানবিশ হিসেবে তাঁদের জাপানে নেওয়া হয়।

বিএমইটির আওতায় থাকা জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে দক্ষ জাপানি ভাষা শিক্ষকের অভাব রয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য় র জন য ব এমইট দ শট ত র কর ম সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নিভৃতচারী কৃষকের আর্তনাদ কি আমরা শুনছি

কৃষি এবং কৃষকই এ দেশের প্রাণ—এই ধ্রুব সত্যটি নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু বেদনাদায়ক বাস্তবতা হলো, মধ্যস্বত্বভোগী ও কপট ব্যবসায়ীদের কারণে কৃষকের স্বার্থ বরাবরই উপেক্ষিত। নীতিনির্ধারক ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের নীরবতা এবং কৃষকের সমস্যা নিয়ে সম্প্রতি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যকে ‘ট্রল’ করার মতো দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা আমাদের জাতীয় সংবেদনশীলতার অভাবকেই প্রকটভাবে তুলে ধরে।

করোনাকালীন ভয়াবহ সংকটে কৃষি যেভাবে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে অর্থনীতিকে রক্ষা করেছে, তা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অথচ এত কমিশন গঠিত হলেও, কৃষি কমিশন গঠন করা হয়নি। এর মূল কারণ সম্ভবত নিভৃতে কাজ করে যাওয়া কৃষক বা কৃষিশ্রমিকের মূল্য এই সমাজে অনেক সস্তা।

বর্তমানে কৃষি খাত নিয়ে যত আলোচনা—তা সবই যেন নিরাপদ কৃষি, বাণিজ্যিক কৃষি, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ভ্যালু চেইন ও উৎপাদন বৃদ্ধিকেন্দ্রিক। প্রধান স্টেকহোল্ডার কৃষক ও তাঁর জীবন-জীবিকার স্বার্থ প্রায়শই থেকে যাচ্ছে অন্তরালে। অন্যান্য পেশাজীবীর মতো কৃষকের কোনো সক্রিয় সংগঠন নেই। চাষাবাদ ফেলে ঢাকা শহরে দাবি আদায়ের আন্দোলনে নামাও তাঁদের পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে তাঁদের পেটে ভাত জুটবে না।

অথচ কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, শারীরিকভাবেও চরম ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষ রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পেশায় কৃষক! মাস্ক, গ্লাভস বা রাবারের জুতা চোখে না দেখা, ছেঁড়া গামছা মুখে পেঁচিয়ে বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করা ভূমিহীন মানুষটা আমাদের কাছে হয়তো ‘কৃষিশ্রমিক’, ‘কৃষক’ নন; কিন্তু খাদ্য উৎপাদনচক্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে মৌলিক এবং তাঁর স্বাস্থ্যঝুঁকিও সবচেয়ে বেশি।

সমাজের চোখে ‘কৃষক’ বলতে যখন বিঘার পর বিঘা জমির মালিক, শিক্ষিত বাণিজ্যিক উদ্যোক্তাদের বোঝানো হচ্ছে, তখন প্রান্তিক, নিরক্ষর মানুষগুলোর অস্তিত্ব ও সংগ্রাম প্রায় অস্বীকৃত থেকে যাচ্ছে।

আবার কৃষক ও কৃষির সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত নয়, এর শিকড় প্রোথিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতেও। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাণিজ্যিক কৃষিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমাদের শিক্ষায় কৃষির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো প্রায় উপেক্ষিত।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কৃষির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আলোচনা বা গবেষণা নেই। কীভাবে নারীর হাত দিয়ে কৃষির সূচনা হয়েছিল—ফসলের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বপন ও পরিচর্যার প্রথম ধাপগুলোয় নারীর যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দিকগুলো পড়ানো হয় না বললেই চলে।

বাংলার কৃষিকাজে লোকায়ত জ্ঞানের অন্যতম ধারক খনার বচন প্রাসঙ্গিক হলেও আবহাওয়া, ফসল রোপণের সময়, মাটির গুণাগুণ–সম্পর্কিত হাজার বছরের পরীক্ষিত প্রথাগত প্রজ্ঞা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে স্থান পায় না। এর বদলে শুধু স্থান পায় আধুনিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকীকরণের তত্ত্ব।

ধান লাগানো থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াকরণ, বীজ সংরক্ষণ, ফসল মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের মতো অনেক ধাপে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের কৃষিতে অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বিভিন্ন গবেষণায় এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এই বিশাল শ্রমশক্তি ও তাঁদের সমস্যা নিয়ে মূলধারার একাডেমিক আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও সস্তা শ্রম আর অধিকার বঞ্চনার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কৃষিতে নারীর উপস্থিতি বাড়ছে।

কৃষকের নিবিড় জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্ম প্রায়শই অন্ধকারে থাকছে। গান গাইতে গাইতে ধান কাটা, ধান লাগানো বা নবান্ন উৎসব—এসব প্রথা ও রীতিনীতি কেবল সংস্কৃতি নয়, কৃষকের জীবনের আনন্দ, দুঃখ ও শ্রমের প্রকাশ। পাঠ্যক্রমে এসবের অনুপস্থিতি কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে নাগরিকসচেতনতা বৃদ্ধির পথে এক বড় বাধা।

কৃষির এই বহুমুখী সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে শুধু যান্ত্রিকীকরণ আর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই চলবে না। প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী নীতিগত পরিবর্তন।

যা করা যেতে পারে:

ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ: সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসল কেনার সরকারি উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে শক্তিশালী ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: প্রান্তিক কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন কীটনাশকপ্রতিরোধী মাস্ক, গ্লাভস এবং সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা।

শিক্ষায় কৃষির সাংস্কৃতিক পাঠ অন্তর্ভুক্তিকরণ: উচ্চশিক্ষা ও স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে কৃষির উৎপত্তি, নৃতত্ত্ব, নারীর ভূমিকা, লোকায়ত জ্ঞান (যেমন খনার বচন) এবং কৃষকের জীবন ও সংস্কৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি: নারীর কৃষিভিত্তিক শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা। কৃষিশ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ও স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় আলাদা বরাদ্দ রাখা।

সর্বোপরি নীতিগত সদিচ্ছা এবং কৃষকের ন্যায্য অধিকার ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধিই পারে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার মূল ভিত্তি—নিভৃতচারী কৃষককে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে। কৃষি ও কৃষক সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতা বৃদ্ধি এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

মো. জুবায়ের ইবনে কামাল অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ