Prothomalo:
2025-10-02@21:16:42 GMT

সালভাদর দালির মনোজগৎ

Published: 2nd, October 2025 GMT

চিত্রকলার দুনিয়ায় সালভাদর দালিকে পাবলো পিকাসো ও অঁরি মাতিসের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তবে স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন, বিশেষ করে চিন্তাভাবনা ও আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ ও পরাবাস্তববাদী প্রভাবের কারণে নিজের চিন্তার জগতের মতো দালির শিল্পের জগৎও স্বতন্ত্র ছিল। কৈশোরে দালির মা মারা যান, তাই বাপের কাছে মানুষ হয়েছিলেন অভিমানে, অনুরাগে ও বিরাগে। পেশায় নোটারি আর ধর্মে অবিশ্বাসী বাপের প্রভাব তাঁর মনন গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। যদিও ‘পৈতৃক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করে আর জয়ী হয়, সে-ই প্রকৃত বীর’—ফ্রয়েডের এ কথা কখনো ভুলতেন না দালি। কৈশোরেই জ্ঞানের প্রতি সতৃষ্ণ দালি বাবার লাইব্রেরিতে নন্দনতত্ত্বের বই বেশি নাড়াচাড়া করতেন আর তাতে লক্ষ করতেন ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার নানা প্রমাণ। স্কুলের সেই প্রথম বছরে শিক্ষক দন ত্রায়েতের দালিকে বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে একটা মেয়েলি ব্যাপার।’ বিষয়টা তাঁকে ভাবাত তখন থেকে। এই সূত্রে দালি পরীক্ষা করেছেন ভলতেয়ারের অভিধানগ্রন্থও। আর ফ্রেডরিখ নিৎসে পড়তে গিয়ে কিশোর-মনে পেলেন ভীষণ চোট: ‘ঈশ্বর মৃত’—এমন ঘোষণায়। জরাথুস্ট্রের মাধ্যমে নিৎসে দালিকে আরও নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দিলেন। আর সে কারণে বাপে-বেটায় বিচ্ছেদও ঘটে; ঘরছাড়া হন একসময়। নিৎসের ব্যক্তিত্ব, খ্রিষ্টধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি দালিকে করে তুলেছিল নিৎসে-সুলভ নির্বিকার, জীবনবিমুখ ও উদাসীন; এমনকি বাহ্যিক চেহারা অনুকরণেও। তখন থেকে জুলফি বাড়তে দিয়েছেন ঠোঁটের কোনা পর্যন্ত। এ সময়টাকে দালি নিজের ‘আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ে’র কাল বলে স্বীকার করেছেন। মাত্র সাত বছর বয়সে যে দালি হতে চেয়েছিলেন নেপোলিয়ন, তারুণ্যে এসে স্থিত হন চিত্রকলায়; প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকলেন একে একে। এরই মধ্যে ফ্রয়েডের প্রভাবে যৌনতার চিত্রকল্প আর প্যারিসের পরাবাস্তববাদীদের দলে যোগ দিয়ে শিল্পের আঙ্গিকে আনলেন নানা নতুনত্ব। বদলে যায় দালির দুনিয়া আর আলোচনায় আসেন ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে।

পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে দালি বুঝেছিলেন, কোনো ধরনের যৌক্তিক নান্দনিক বা নৈতিক বাধা ছাড়াই চিন্তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু ছবি আঁকতে গিয়ে দেখতে পেলেন অন্য সব পরাবাস্তববাদী আদপে বুর্জোয়া–চরিত্রের লোক। বাস্তব আর যুক্তির জগতের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে এঁরাও অক্ষম। সুতরাং দালির সিদ্ধান্ত, আর যা-ই হোক, এটি শিল্প ও সাহিত্যের দল হতে পারে না। পরাবাস্তববাদের প্রবক্তা আঁদ্রে ব্রেতোঁকে চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন পিতা ভাবলেও তিনিও দালির পরাবাস্তববাদী ছবি মেনে নিতে পারেননি। কারণ, দালি ছবিতে মল ও পায়ুর চিত্র সংযোজন করেছেন। মনোবিশ্লেষণ আর পরাবাস্তববাদী দিক থেকে ছবিতে বর্জ্যের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আন্দোলনে এটা পরিত্যাজ্য বিবেচিত হয়। অথচ কী নিদারুণ ঘটনা দেখলেন দালি—যৌনাঙ্গ আঁকা যাবে, পায়ু আঁকা যাবে না—যদিও স্ত্রী-পায়ু সিদ্ধ তাঁদের কাছে! দালি পরাবাস্তববাদীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হলেন, নিজেও সরে এলেন এঁদের থেকে। কিন্তু এর আগে-পরে নিজের অভিজ্ঞতাকে চরম ও স্ববিরোধী পরিণতির দিকে নিয়ে যান দালি, বাস্তবে যা পরাবাস্তববাদী ধারণার বিপরীত। যেমন ব্রেতোঁ যেখানে ধর্ম সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করতেন, দালি সেখানে নতুন ধর্মচিন্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। দালির ধর্মচিন্তা নিষ্ঠুরতা, ধর্ষকাম ও মানসিক বিকলনপূর্ণ ছিল। ধর্মের এই ধারণাগুলো দালি পেয়েছিলেন আগস্ট কোঁৎ পড়ে। দালির ভাবনার মূলে হচ্ছে পরাবাস্তব জগৎ যদি সত্য হয়, তাহলে সেখানে অতীন্দ্রিয় ও ধর্মের বিষয় অনুপস্থিত থাকতে পারে না।

মাত্র সাত বছর বয়সে যে দালি হতে চেয়েছিলেন নেপোলিয়ন, তারুণ্যে এসে স্থিত হন চিত্রকলায়; প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকলেন একে একে। এরই মধ্যে ফ্রয়েডের প্রভাবে যৌনতার চিত্রকল্প আর প্যারিসের পরাবাস্তববাদীদের দলে যোগ দিয়ে শিল্পের আঙ্গিকে আনলেন নানা নতুনত্ব। বদলে যায় দালির দুনিয়া আর আলোচনায় আসেন ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে।

বিশ্বসৃষ্টির দালিনীয় তত্ত্ব নির্মাণে ব্যস্ত দালির ছবিগুলো তখন পাগলাটে কর্মকাণ্ডে ভরপুর ছিল। ছবিতে বৈপরীত্যের প্রকাশকে তিনি জন্মগত বৈপরীত্য-চেতনা বলে মনে করতেন। ক্যানভাসে পীতাভ রঙে চামড়ার স্ট্র্যাপে আটকানো শরীরের মাংস এঁকে হিটলারের ছবি আঁকলেন দালি। অর্থাৎ হিটলারের নিগূঢ় ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য পরাবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মর্ষকামী উপাদানের সঙ্গে ধর্মীয় উপাদান যুক্ত করেন তিনি। এমনরূপ ভাবনাকে দালি নিজে প্যারোনোইয়া-জনিত এবং অরাজনৈতিক বলে স্বীকার করেছেন। যদিও ব্রেতোঁসহ সবাই দালিকে হিটলার-অনুরাগী বলে ভুল বুঝেছিলেন। ব্রেতোঁর সঙ্গে দালির যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায় একসময়; এ ঘটনাকে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখেন দালি। কারণ, তাঁর মতে এর মাধ্যমে পরাবাস্তববাদের মৃত্যু হয় এবং নিজেই পরাবাস্তববাদ হয়ে ওঠেন। দালির দাবি পরাবাস্তববাদকে তিনি বস্তুতান্ত্রিকতামুক্ত করে আধ্যাত্মিকতাযুক্ত করেছেন; মহিমান্বিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আবিষ্কার করেন নিউক্লিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদ, যা দ্বারা সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের মেলবন্ধন করতে পারেন।

ফরাসি কবি লতেঁ দালিকে একবার একটি গন্ডারের শিং উপহার দেন, যা দালি ভালোবাসতেন। এটা পেয়ে দালির মনে হয়েছিল, এই শিং তাঁর জীবন বাঁচিয়ে রাখবে। দালি পরে খ্রিষ্টের ছবি আঁকতে গিয়ে দেখেন, ভূতগ্রস্তের মতো সারা শরীরজুড়ে একটা গন্ডারের শিংই এঁকেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার যে পরে গোটা ছবিটি দালির মতে আধ্যাত্মিক ও নিখুঁত হয়ে ওঠে। এ জন্য দালি ফ্রয়েডকে ধন্যবাদ দিতে চান। কারণ, সত্যকে দেখার ক্ষমতা তিনিই তাঁকে দিয়েছেন। আর এ–ও ভাবেন, সারা জীবন ধরে তিনি একটা গন্ডারের শিংই এঁকেছেন। গন্ডারের শিঙের বাঁককে দালি মনে করতেন ঐশ্বরিক কিছু, যা সমস্ত শুদ্ধতা ও উগ্র নন্দনতত্ত্বের প্রধান ভিত্তি। সুতরাং গন্ডারের শিং দালির কাছে মরমি বা অতীন্দ্রিয় উপাদান।

এমনকি কখনো-সখনো নিজের মলকে গন্ডারের শিঙের আকারে দেখতেন এবং তা নিয়ে বেশ ভাবিত থাকতেন। মল দালির কাছে ভাবনার মতো বিষয় ছিল এবং এটা তাঁকে সব সময় দার্শনিক করে তুলত। পারাসেলসাসের মতো তিনিও মনে করতেন, মল মানুষের জীবনের সূত্র এবং আয়ুর সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক আছে। মধুর মতো তরল হলে মলের পক্ষে আয়ু বাড়ানো সম্ভব হতো আর জাগতিক অমরত্ব যদি খুঁজতে হয় তাহলে মল বা বর্জ্যের মধ্যেই খুঁজতে হবে। অন্যদিকে মলত্যাগের সঙ্গে দার্শনিকতা ও অধিবিদ্যাগত যে বিষয় জড়িত, উচ্চস্তরের মানুষও এ ব্যাপারে অনুভূতিহীন দেখে দালি বিস্মিত হতেন।

দ্য ডিসিনট্রেগেশন অব দ্য পারসিস্টেন্স অব মেমোরি (১৯৫৪), সালভাদর দালি.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ত রকল উপ দ ন পর ত য কর ছ ন প রক শ করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

সালভাদর দালির মনোজগৎ

চিত্রকলার দুনিয়ায় সালভাদর দালিকে পাবলো পিকাসো ও অঁরি মাতিসের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তবে স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এই শিল্পী অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন, বিশেষ করে চিন্তাভাবনা ও আঁকাআঁকির ক্ষেত্রে। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ ও পরাবাস্তববাদী প্রভাবের কারণে নিজের চিন্তার জগতের মতো দালির শিল্পের জগৎও স্বতন্ত্র ছিল। কৈশোরে দালির মা মারা যান, তাই বাপের কাছে মানুষ হয়েছিলেন অভিমানে, অনুরাগে ও বিরাগে। পেশায় নোটারি আর ধর্মে অবিশ্বাসী বাপের প্রভাব তাঁর মনন গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। যদিও ‘পৈতৃক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করে আর জয়ী হয়, সে-ই প্রকৃত বীর’—ফ্রয়েডের এ কথা কখনো ভুলতেন না দালি। কৈশোরেই জ্ঞানের প্রতি সতৃষ্ণ দালি বাবার লাইব্রেরিতে নন্দনতত্ত্বের বই বেশি নাড়াচাড়া করতেন আর তাতে লক্ষ করতেন ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার নানা প্রমাণ। স্কুলের সেই প্রথম বছরে শিক্ষক দন ত্রায়েতের দালিকে বলেছিলেন, ‘ধর্ম হচ্ছে একটা মেয়েলি ব্যাপার।’ বিষয়টা তাঁকে ভাবাত তখন থেকে। এই সূত্রে দালি পরীক্ষা করেছেন ভলতেয়ারের অভিধানগ্রন্থও। আর ফ্রেডরিখ নিৎসে পড়তে গিয়ে কিশোর-মনে পেলেন ভীষণ চোট: ‘ঈশ্বর মৃত’—এমন ঘোষণায়। জরাথুস্ট্রের মাধ্যমে নিৎসে দালিকে আরও নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দিলেন। আর সে কারণে বাপে-বেটায় বিচ্ছেদও ঘটে; ঘরছাড়া হন একসময়। নিৎসের ব্যক্তিত্ব, খ্রিষ্টধর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি দালিকে করে তুলেছিল নিৎসে-সুলভ নির্বিকার, জীবনবিমুখ ও উদাসীন; এমনকি বাহ্যিক চেহারা অনুকরণেও। তখন থেকে জুলফি বাড়তে দিয়েছেন ঠোঁটের কোনা পর্যন্ত। এ সময়টাকে দালি নিজের ‘আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ে’র কাল বলে স্বীকার করেছেন। মাত্র সাত বছর বয়সে যে দালি হতে চেয়েছিলেন নেপোলিয়ন, তারুণ্যে এসে স্থিত হন চিত্রকলায়; প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকলেন একে একে। এরই মধ্যে ফ্রয়েডের প্রভাবে যৌনতার চিত্রকল্প আর প্যারিসের পরাবাস্তববাদীদের দলে যোগ দিয়ে শিল্পের আঙ্গিকে আনলেন নানা নতুনত্ব। বদলে যায় দালির দুনিয়া আর আলোচনায় আসেন ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে।

পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে দালি বুঝেছিলেন, কোনো ধরনের যৌক্তিক নান্দনিক বা নৈতিক বাধা ছাড়াই চিন্তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতে হবে। কিন্তু ছবি আঁকতে গিয়ে দেখতে পেলেন অন্য সব পরাবাস্তববাদী আদপে বুর্জোয়া–চরিত্রের লোক। বাস্তব আর যুক্তির জগতের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে এঁরাও অক্ষম। সুতরাং দালির সিদ্ধান্ত, আর যা-ই হোক, এটি শিল্প ও সাহিত্যের দল হতে পারে না। পরাবাস্তববাদের প্রবক্তা আঁদ্রে ব্রেতোঁকে চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন পিতা ভাবলেও তিনিও দালির পরাবাস্তববাদী ছবি মেনে নিতে পারেননি। কারণ, দালি ছবিতে মল ও পায়ুর চিত্র সংযোজন করেছেন। মনোবিশ্লেষণ আর পরাবাস্তববাদী দিক থেকে ছবিতে বর্জ্যের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ হলেও, আন্দোলনে এটা পরিত্যাজ্য বিবেচিত হয়। অথচ কী নিদারুণ ঘটনা দেখলেন দালি—যৌনাঙ্গ আঁকা যাবে, পায়ু আঁকা যাবে না—যদিও স্ত্রী-পায়ু সিদ্ধ তাঁদের কাছে! দালি পরাবাস্তববাদীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হলেন, নিজেও সরে এলেন এঁদের থেকে। কিন্তু এর আগে-পরে নিজের অভিজ্ঞতাকে চরম ও স্ববিরোধী পরিণতির দিকে নিয়ে যান দালি, বাস্তবে যা পরাবাস্তববাদী ধারণার বিপরীত। যেমন ব্রেতোঁ যেখানে ধর্ম সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করতেন, দালি সেখানে নতুন ধর্মচিন্তায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। দালির ধর্মচিন্তা নিষ্ঠুরতা, ধর্ষকাম ও মানসিক বিকলনপূর্ণ ছিল। ধর্মের এই ধারণাগুলো দালি পেয়েছিলেন আগস্ট কোঁৎ পড়ে। দালির ভাবনার মূলে হচ্ছে পরাবাস্তব জগৎ যদি সত্য হয়, তাহলে সেখানে অতীন্দ্রিয় ও ধর্মের বিষয় অনুপস্থিত থাকতে পারে না।

মাত্র সাত বছর বয়সে যে দালি হতে চেয়েছিলেন নেপোলিয়ন, তারুণ্যে এসে স্থিত হন চিত্রকলায়; প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে থাকলেন একে একে। এরই মধ্যে ফ্রয়েডের প্রভাবে যৌনতার চিত্রকল্প আর প্যারিসের পরাবাস্তববাদীদের দলে যোগ দিয়ে শিল্পের আঙ্গিকে আনলেন নানা নতুনত্ব। বদলে যায় দালির দুনিয়া আর আলোচনায় আসেন ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে।

বিশ্বসৃষ্টির দালিনীয় তত্ত্ব নির্মাণে ব্যস্ত দালির ছবিগুলো তখন পাগলাটে কর্মকাণ্ডে ভরপুর ছিল। ছবিতে বৈপরীত্যের প্রকাশকে তিনি জন্মগত বৈপরীত্য-চেতনা বলে মনে করতেন। ক্যানভাসে পীতাভ রঙে চামড়ার স্ট্র্যাপে আটকানো শরীরের মাংস এঁকে হিটলারের ছবি আঁকলেন দালি। অর্থাৎ হিটলারের নিগূঢ় ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য পরাবাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মর্ষকামী উপাদানের সঙ্গে ধর্মীয় উপাদান যুক্ত করেন তিনি। এমনরূপ ভাবনাকে দালি নিজে প্যারোনোইয়া-জনিত এবং অরাজনৈতিক বলে স্বীকার করেছেন। যদিও ব্রেতোঁসহ সবাই দালিকে হিটলার-অনুরাগী বলে ভুল বুঝেছিলেন। ব্রেতোঁর সঙ্গে দালির যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায় একসময়; এ ঘটনাকে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখেন দালি। কারণ, তাঁর মতে এর মাধ্যমে পরাবাস্তববাদের মৃত্যু হয় এবং নিজেই পরাবাস্তববাদ হয়ে ওঠেন। দালির দাবি পরাবাস্তববাদকে তিনি বস্তুতান্ত্রিকতামুক্ত করে আধ্যাত্মিকতাযুক্ত করেছেন; মহিমান্বিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আবিষ্কার করেন নিউক্লিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদ, যা দ্বারা সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের মেলবন্ধন করতে পারেন।

ফরাসি কবি লতেঁ দালিকে একবার একটি গন্ডারের শিং উপহার দেন, যা দালি ভালোবাসতেন। এটা পেয়ে দালির মনে হয়েছিল, এই শিং তাঁর জীবন বাঁচিয়ে রাখবে। দালি পরে খ্রিষ্টের ছবি আঁকতে গিয়ে দেখেন, ভূতগ্রস্তের মতো সারা শরীরজুড়ে একটা গন্ডারের শিংই এঁকেছেন। আশ্চর্য ব্যাপার যে পরে গোটা ছবিটি দালির মতে আধ্যাত্মিক ও নিখুঁত হয়ে ওঠে। এ জন্য দালি ফ্রয়েডকে ধন্যবাদ দিতে চান। কারণ, সত্যকে দেখার ক্ষমতা তিনিই তাঁকে দিয়েছেন। আর এ–ও ভাবেন, সারা জীবন ধরে তিনি একটা গন্ডারের শিংই এঁকেছেন। গন্ডারের শিঙের বাঁককে দালি মনে করতেন ঐশ্বরিক কিছু, যা সমস্ত শুদ্ধতা ও উগ্র নন্দনতত্ত্বের প্রধান ভিত্তি। সুতরাং গন্ডারের শিং দালির কাছে মরমি বা অতীন্দ্রিয় উপাদান।

এমনকি কখনো-সখনো নিজের মলকে গন্ডারের শিঙের আকারে দেখতেন এবং তা নিয়ে বেশ ভাবিত থাকতেন। মল দালির কাছে ভাবনার মতো বিষয় ছিল এবং এটা তাঁকে সব সময় দার্শনিক করে তুলত। পারাসেলসাসের মতো তিনিও মনে করতেন, মল মানুষের জীবনের সূত্র এবং আয়ুর সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক আছে। মধুর মতো তরল হলে মলের পক্ষে আয়ু বাড়ানো সম্ভব হতো আর জাগতিক অমরত্ব যদি খুঁজতে হয় তাহলে মল বা বর্জ্যের মধ্যেই খুঁজতে হবে। অন্যদিকে মলত্যাগের সঙ্গে দার্শনিকতা ও অধিবিদ্যাগত যে বিষয় জড়িত, উচ্চস্তরের মানুষও এ ব্যাপারে অনুভূতিহীন দেখে দালি বিস্মিত হতেন।

দ্য ডিসিনট্রেগেশন অব দ্য পারসিস্টেন্স অব মেমোরি (১৯৫৪), সালভাদর দালি

সম্পর্কিত নিবন্ধ