একসময় সাংবাদিকতা পড়া মানে ছিল এক ধরনের স্বপ্নে পা রাখা। সংবাদ কক্ষের ভেতরে ঝড়ের মতো কাজ, প্রেস কার্ড ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো, প্রথম পাতায় নাম ছাপা হওয়ার উত্তেজনা-এসব মিলেই সাংবাদিকতা অনেককে টেনেছে।

একসময় এই ‘গ্ল্যামার’ এর সঙ্গে যোগ হত তারুণ্যের বিদ্রোহ। যেন সমাজকে নাড়িয়ে দেওয়ার এক অনন্য অস্ত্র হাতে পাওয়া। সেই আগ্রহ থেকে অনেক তরুণ এ বিষয়ে পড়াশোনা করতে আসতেন।

গ্ল্যামার শব্দটা নিয়ে খটকা লাগতে পারে। পরিষ্কার করে বলা দরকার যে, আমি যখন ‘গ্ল্যামার’ বলছি, তখন শুধু ঝলমলে আলো বা ফ্যাশনের ব্যাপার বোঝাচ্ছি না। এখানে গ্ল্যামার মানে হলো, সাংবাদিকতার চারপাশে তৈরি হওয়া আকর্ষণ, জনপ্রিয়তা, আর এক ধরনের সামাজিক মর্যাদা। টিভি পর্দায় দেখা যাওয়া, খবরের কাগজে নাম ছাপা হওয়া—এসবই তরুণদের কাছে সাংবাদিকতাকে একসময় দারুণ মোহনীয় করে তুলেছিল। সেই দৃশ্যমানতা, সামাজিক প্রভাবই আসলে গ্ল্যামারের অন্য নাম। একাডেমিক ভাষায় এটিকে বলা যেতে পারে সাংবাদিকতার সামাজিক আকর্ষণ বা দৃশ্যমান মর্যাদা। তবে সাধারণ পাঠকের কাছে ‘গ্ল্যামার’ শব্দটি বেশি পরিচিত বলে সেটিই ব্যবহার করছি। 

এক দশক আগেও সাংবাদিকতার ক্লাসে ঢুকলেই বাতাসে একটা রোমাঞ্চ মিশে থাকত। শিক্ষকরা বলতেন, “তোমাদের হাতে আছে কলম, আর সেই কলমই পারে রাষ্ট্রকে নাড়িয়ে দিতে।” সেই কথাগুলো আমরা বিশ্বাসও করতাম। টিভি চ্যানেলের ঝলমলে স্টুডিও, সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় নিজের নাম দেখা, বড় কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর হইচই—এসব ছিল সেই গ্ল্যামারের আসল উপাদান।

সত্যি বলতে, সাংবাদিকতা আর আগের মতো চকচকে নেই। টেলিভিশন রিপোর্টার বা পত্রিকার সাংবাদিক হওয়ার রোমান্স অনেকটাই ম্লান। বেতন কম, কাজের চাপ আকাশ ছোঁয়া, আর চাকরির নিশ্চয়তা বলতে যা বোঝায়, সেটা প্রায় অদৃশ্য। তরুণরা তাই দ্বিধায় পড়ে যান। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়বেন, নাকি অন্য কোনো ‘নিরাপদ’ পেশার দিকে ঝুঁকবেন?

অথচ এ বিষয়ে পড়াশোনা একসময় অনেক আগ্রহের ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তো আছেই, কিন্তু সেই ‘আলোর’ টানেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একে একে খুলতে শুরু করে সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যম বিভাগ। প্রথম শুরু হয় ২০০২ সালে-ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমন্টে অল্টারনেটিভে (ইউডা)। এর পরপরই আসে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর একে একে অনেকগুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ যুক্ত হতে থাকে। কমিউনিকেশন বা গণযোগাযোগ আকারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো শুরু হয়, যার একটা অংশ সাংবাদিকতা।

তবে বাস্তবে এই ‘অংশই’ হয়ে ওঠে প্রাণ ও মূল আকর্ষণ। তাই কোথাও বিভাগের নাম কমিউকেশন, কোথাও জার্নালিজম, আবার কোথাও মিডিয়া স্টাডি। নাম আলাদা, তবে টান একটাই-সাংবাদিকতার চকচকে মোহ। সবাই ভেবেছিল, এ বিষয়ে ভর্তিচ্ছুদের ভিড় লেগেই থাকবে। কারণ তখন প্রায় অর্ধশত বেসরকারি টিভি চ্যানেল, ঝকঝকে স্ক্রিন, হাতে বুম। মুন্নি সাহা, শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম, শাহানাজ মুন্নি, সামিয়া জামান, সামিয়া রহমান, হারুন উর রশিদ, শাহেদ আলম, মঞ্জুরুল করিম পলাশদের মতো তারকা সাংবাদিক তখন ঘরে ঘরে পরিচিত নাম।

সেই জায়গা থেকে ক্রমেই দীর্ঘ হতে থাকে এই বিভাগ যুক্ত করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। আজ তালিকা করলে অবাক হতে হয়। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ), স্টেট ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি-কোথায় নেই? প্রায় সব বড় বেসরকারিতেই কোনো না কোনো আকারে আছে এই বিভাগ।

হ্যাঁ, একটা কিন্তু আছে সবখানে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না, বরং এইচএসসি পাস শিক্ষার্থীদের অনুপাত হিসেব করলে গাণিতিকভাবে সেই সংখ্যা কমছেই বলা যায়। আগের মতো ভর্তিচ্ছুদের ভিড় আর নেই। দুই-তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কারোরই তেমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী নেই। একসময় যে গ্ল্যামার ভিড় টানত, সেটাই আজ ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

অন্তত চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সবার মন্তব্য প্রায় একই, শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে আগ্রহ কমছে। আবার যারা পড়ছেন, তাদের অনেকেরই পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছেও নেই।

এটা শুধু সংখ্যা কমার গল্প নয়, এটা আসলে পরিবর্তিত সময়ের প্রতিচ্ছবি। চাকরির বাজার অনিশ্চিত, বেতন কাঠামো দুর্বল, ভবিষ্যতের স্থিরতা নেই, এই সব মিলিয়ে তরুণরা ভাবছেন অন্যভাবে। আসল প্রশ্ন হলো-সাংবাদিকতা কি সত্যিই তার গ্ল্যামার হারিয়েছে? নাকি আমাদের চোখে তার সংজ্ঞাই বদলে গেছে?

হয়ত আমরা যে গ্ল্যামারের কথা বলি, সেটা আসলে ছিল বাহ্যিক। টেলিভিশনে দেখা, খবরের কাগজে নাম ওঠা। এখন তো সেই জায়গাটা দখল করেছে সোশ্যাল মিডিয়া। একটা ফেসবুক পোস্ট বা ইউটিউব ভিডিও কখনো কখনো কয়েক লাখ মানুষ দেখে ফেলে। ফলে সাংবাদিকতার সেই পুরনো রোমান্স, ‘আমি রিপোর্টার’ এই পরিচয়ের ঝলক একটু ম্লান হয়েছেই। কিন্তু তাই বলে কি সাংবাদিকতার মূল্য কমেছে? বরং দায়িত্ব বেড়েছে।

আগে গ্ল্যামার মানে ছিল কাগজে নাম ছাপা, পরে টিভিতে মুখ দেখানো। এখন সেটা হয়ত ভাইরাল স্টোরি। একটা ইউটিউব ভিডিও বা ইনস্টাগ্রাম রিল—হয়ত কয়েক ঘণ্টায় লাখো মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তরুণরা গ্ল্যামার দেখছেন সেখানে, এবং এটা সাংবাদিকতার ভেতর থেকেই বের হচ্ছে।

কিন্তু একটা সত্যও আছে, গ্ল্যামার আসলে কখনো সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। সাংবাদিকতা টিকেছিল দায়িত্ববোধে। টিকেছিল সমাজের সামনে সত্য তুলে ধরার নেশায়। তবে আজকের সাংবাদিককে শুধু খবর জানালেই হয় না। তাকে জানতে হয় ডিজিটাল টুলস, বুঝতে হয় ডেটা, সামলাতে হয় ভুয়া তথ্যের স্রোত। তাকে যেমন মাঠে গিয়ে রিপোর্ট করতে হয়, তেমনি অনলাইনে গল্প বলতে হয় নতুন ফরম্যাটে।

গ্ল্যামারের জায়গাটা হয়ত বদলেছে, কিন্তু সমাজে প্রভাব তৈরি করার ক্ষমতা এখনো অক্ষুণ্ন। বরং আরো বিস্তৃত। গ্ল্যামার হয়ত দরকারও নেই। কারণ গ্ল্যামার অনেক সময় বিভ্রান্তি তৈরি করে। সাংবাদিকতা কখনো শুধুই ঝলক দেখানোর জায়গা ছিল না, এটা ছিল দায়বদ্ধতার জায়গা, সত্য প্রকাশের জায়গা, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহসের জায়গা।

তবে হ্যাঁ, আরেকটা দিকও আছে। শিক্ষার্থীরা যেহেতু চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত, তাই বিষয় হিসেবে সাংবাদিকতা হয়ত কিছুটা পিছিয়ে পড়ছে; এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু গ্ল্যামার নেই মানে এই নয় যে, এর গুরুত্ব কমে গেছে। বরং যারা এই সময়েও সাংবাদিকতা পড়তে আসছেন, তাদের আমি বেশি সম্মান করি। কারণ তারা আসছেন প্রভাব খুঁজতে, দায়িত্ব নিতে, পরিবর্তনের পথে দাঁড়াতে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সাংবাদিকতার পড়াশোনা আসলে এক ধরনের প্রস্তুতি, সমাজকে দেখার চোখ তৈরি করা, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহস গড়ে তোলা। এসবের দাম কোনো হিসেবে মাপা যায় না।

(লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, যোগাযাগ ও গণমাধ্যম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ)

ঢাকা/মেহেদী

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব দ কত র ব সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

হোয়াটসঅ্যাপ আসার আগে মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য অ্যাপ বানিয়েছিলাম

তখন হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না। বাইরে থেকে বাংলাদেশে টেলিফোন করাটা ছিল এক বিরাট ঝক্কি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায়ই সময়ে অসময়ে আমাকে বাংলাদেশে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হতো। টেলিফোন করার দু-একটা অ্যাপ আমার আইফোনে ছিল, কিন্তু সেগুলো ছিল খুব বাজে।

হঠাৎ লাইন কেটে যেত, ক্রেডিট কার্ড থেকে বেশি পয়সা কেটে নিতো। একসময় মনে হলো নিজেই একটা টেলিফোন অ্যাপ বানাই না কেন। যেহেতু আইফোন ব্যবহার করি, তাই নিয়েই শুরু করলাম।

কিছুদিন পড়াশোনা করে বুঝলাম, কাজটা সহজ নয়। আর বেশ সময়সাপেক্ষ। ভয়েসওভার টেলিফোন (ভিওআইপি) অ্যাপ্লিকেশন এমনিতেই বেশ জটিল ধরনের অ্যাপ। আর আমরা যেসব প্ল্যাটফর্মে কাজ করি, সেগুলো কতগুলো নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড ও প্রচলিত প্রটোকল মেনে চলে।

কিন্তু স্টিভ জব আপেলের জন্য সবকিছু নিজস্ব ধারায় করে গেছেন। আপেল তাদের প্ল্যাটফর্মে সব কিছুতে এখনো নিজেদের তৈরি কাস্টম মেনে চলে। তবু কাজ শুরু করলাম, দেখা যাক কতটুকু যাওয়া যায়!

অ্যাপের নাম দিলাম ‘কলকরো’

প্রথমে স্ক্রিনের কাজ, যেমন ডায়াল প্যাড ও বিভিন্ন আইকন। যুক্তরাষ্ট্রে এসব গ্রাফিকসের কাজ খুব ব্যয়বহুল। ঠিক করলাম, বাইরের ফ্রিলান্সার দিয়ে করাব। ইন্টারনেটে ফ্রিলান্সারদের ভালো কিছু প্ল্যাটফর্ম আছে। আমার পছন্দ ‘আপওয়ার্ক’। কী কী লাগবে তার বিবরণ দিয়ে একটা ‘প্রয়োজন’ পোস্ট করলাম।

দুই দিনের মধ্যেই সারা দুনিয়ার গ্রাফিকস ডিজাইনার হাজির! দুজনকে বাছাই করে কয়েক দিন ধরে তাঁদের সঙ্গে আমার প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে কথা বললাম। দুজনের মধ্যে ইউক্রেনের ডিজাইনার ছিলেন ব্যয়বহুল।

তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতীয় একজন ডিজাইনারকে নিয়োগ দিলাম। এখানে বলে রাখি, ফ্রিলান্সারের পারিশ্রমিক ও টাকাকড়ির লেনদেন সব আপওয়ার্ক ব্যবহার করে করা হয় এবং একটা অংশ তারা কমিশন হিসেবে কেটে নেয়।

গ্রাফিকস ডিজাইন এমন কাজ যে একবারে তৃপ্ত হওয়া যায় না, বারবার আরও ভালো করার চেষ্টা চলতে থাকে। একসময় ডিজাইন শেষ হলো। স্ক্রিন লে–আউট ডিজাইনও বেশ কষ্টসাধ্য। পরের ধাপগুলো ছিল রুটিন—আপেল এপিআই ব্যবহার করে ব্যাকগ্রাউন্ড সার্ভিসগুলো তৈরি করে ব্যবহারকারী ও ব্যাকগ্রাউন্ড সার্ভিসের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি।

অ্যাপস্টোরে ‘কলকরো’ অ্যাপ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হোয়াটসঅ্যাপ আসার আগে মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য অ্যাপ বানিয়েছিলাম
  • ঝিনাইদহে ৩২ বছর পর ছেলে পেলেন পিতৃপরিচয়, মা পেলেন স্ত্রীর স্বীকৃতি