বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্ন আজ শুধু রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয় নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অন্যতম শর্তও। এই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্প্রতি ৭৩টি সংস্থার একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে, যারা আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব নিতে পারে। কিন্তু অনুসন্ধানে যা উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক ও হতাশাজনক।

তালিকার অনেক সংস্থা কার্যত অকার্যকর। যেমন কুড়িগ্রামের ‘অগ্রযাত্রা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ বর্তমানে কোনো কার্যক্রমই পরিচালনা করছে না। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নিজেই স্বীকার করেছেন, একসময় প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও নারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করলেও এখন প্রতিষ্ঠানটি নিষ্ক্রিয়। উপরন্তু ভিজিডি কর্মসূচিতে দুর্নীতির অভিযোগে মামলাও চলছে তাদের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন হলো মামলায় অভিযুক্ত, কর্মীবিহীন, কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি সংস্থাকে কীভাবে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হলো?

তালিকায় স্থান পাওয়া অনেক সংস্থার ঠিকানা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কোথাও সংস্থাটির প্রধানের ব্যক্তিগত বাসভবনকে অফিস দেখানো হয়েছে, কোথাও নির্মাণাধীন ভবনকে কার্যালয় বলা হয়েছে। কোনো সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মী বলতে বাবা-ছেলে দুজন ছাড়া কেউ নেই। কোথাও আবার পরিত্যক্ত ঘরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। এর থেকে স্পষ্ট, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের নামে নামসর্বস্ব সংগঠনের প্রসার ঘটছে, যাদের এই কাজে প্রকৃত সক্ষমতা নেই।

সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আরও দুশ্চিন্তা তৈরি করে। নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, যে সংস্থার নির্বাহী বা পরিচালনা পর্ষদের কেউ সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, তারা পর্যবেক্ষক হিসেবে অনুমোদন পাবে না। অথচ প্রাথমিক তালিকায় এমন বেশ কিছু সংস্থা রয়েছে, যাদের নেতারা অতীত বা বর্তমানে সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ অবস্থায় নিরপেক্ষতা কি আদৌ সম্ভব? নির্বাচন পর্যবেক্ষণ যদি রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতপূর্ণ হয়, তবে তা জনগণকে বিভ্রান্ত করবে এবং ভোটের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতার অভাবও বড় একটি সমস্যা। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কোনো সহজ কাজ নয়। এর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী, গবেষণার দক্ষতা, মাঠপর্যায়ে সংগঠিত কাঠামো ও আর্থিক স্বচ্ছতা অপরিহার্য। অথচ তালিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে ৫০ জনের বেশি কর্মী আছে মাত্র ছয়টিতে। অনেক সংস্থা আগে কখনো এককভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেনি। এর ফলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন আসার বদলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।

এখানে ইসির ভূমিকা সবচেয়ে বড় প্রশ্নের মুখে। ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব স্বীকার করেছেন যে যাচাই-বাছাই খুব পদ্ধতিগতভাবে করা হয়নি। তাহলে কি এ ধরনের গুরুতর কাজে অবহেলা করা হয়েছে? যদি তা–ই হয়, তবে এটি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।  

অতীতে আমরা দেখেছি, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেও নামসর্বস্ব সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তখনো ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে কেন আবার একই ভুল করা হচ্ছে? যদি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের নামে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো মাঠে নামে, তবে তাদের প্রতিবেদনের ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরাও আস্থা রাখতে পারবে না। 

নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয় নয়; এটি জনগণের আস্থা অর্জনেরও প্রশ্ন। নামসর্বস্ব সংস্থাকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে আস্থা অর্জন করা অসম্ভব। ইসিকে তাই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

জরুরি হলো প্রকৃতপক্ষে সক্রিয়, অভিজ্ঞ ও স্বচ্ছ সংস্থাগুলোকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া। স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে যেসব সংস্থা দীর্ঘদিন মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসনের প্রশ্নে কাজ করছে, সেসব সংস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, আর্থিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক

এছাড়াও পড়ুন:

স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের

প্রাচীন গ্রিসে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগররাষ্ট্র ছিল। সেখানে নগরের অধিবাসীকেই বলা হতো নাগরিক, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল নাগরিকের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা সেই সব ব্যক্তিকে নাগরিক বলব, যাদের আইন প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণের ক্ষমতা আছে।’ তাঁর মতে, যে ব্যক্তি নগররাষ্ট্রের শাসনকাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে অক্ষম, তিনি প্রকৃত নাগরিক নন।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নাগরিককে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে—যেকোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, রাষ্ট্র প্রদত্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়ের সঙ্গে পালন করেন, তাঁকেই নাগরিক বলা যায়। একই সঙ্গে নাগরিককে অবশ্যই অন্য মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ন না করার ব্যাপারেও সজাগ থাকতে হবে।

প্রতিটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো সৎ, যোগ্য ও নীতিবান নাগরিক। রাষ্ট্রের কাঠামো ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে নাগরিকের চরিত্র ও আচরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক—যিনি নিজের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত। এ জ্ঞান ও সচেতনতাই রাষ্ট্রকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে বলা হয় জনগণের অংশগ্রহণে, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের কল্যাণে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকেন, তবে কি গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে? বাস্তবতা হলো নাগরিকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাই স্বৈরতন্ত্রকে জন্ম দেয়।

প্রথমত, যেখানে মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ, সেখানে শাসকগোষ্ঠী সহজেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন—এসব বিষয়ে নাগরিক উদাসীন থাকলে শাসকের জবাবদিহি বিলীন হয়ে যায়, তখন গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকলেও এর প্রাণশক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, নাগরিকেরা ভয়, অজ্ঞতা বা উদাসীনতার কারণে যখন অন্যায় ও অনিয়ম মেনে নেন, তখনই স্বৈরতন্ত্র শিকড় গাড়ে। শাসকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত তারা অন্ধভাবে মেনে নিলে সরকার জবাবদিহি এড়িয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে; কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—শক্তিশালী শাসকের শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় কেবল তখনই, যখন জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। জার্মানি থেকে পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের অতীত—সবখানেই দেখা যায়, নাগরিক–সচেতনতার অভাবেই স্বৈরতন্ত্রের বিস্তার ঘটেছিল।

তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ দুর্বল হলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন কিংবা নাগরিক সংগঠনগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। তখন শাসকেরা সহজেই বিকল্প কণ্ঠরোধ করে ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অর্থাৎ, নাগরিকের নীরবতাই শাসকের জন্য সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রে পরিণত হয়।

অতএব, স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নাগরিক শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতা। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে মানুষকে জানতে হবে তাদের অধিকার, কর্তব্য ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি করার উপায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে হবে সত্য প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম, তোষণ বা প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়। মনে রাখতে হবে—অধিকার চর্চা না করলে অধিকার হারিয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য হলো নিজের অধিকার সম্পর্কে জানা ও তা প্রয়োগ করা।

সবশেষে বলা যায়, নাগরিকের অধিকার বিষয়ে অসচেতনতা কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; বরং তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর। সচেতন নাগরিক সমাজই পারে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে আর অসচেতন নাগরিক সমাজই সৃষ্টি করে স্বৈরতন্ত্রের জন্মভূমি।

ইসরাত জাহান

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মনোযোগ জুলাই সনদে, আছে নির্বাচনী ঐক্যের চিন্তাও
  • এমন মানুষও আছে, যারা বলছে ৫ বছর থাকুন, ১০ বছর থাকুন, ৫০ বছর থাকুন
  • স্বৈরতন্ত্র উত্থানের দায় আসলে কাদের
  • পিআরের নামে জামায়াত ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে: কায়সার কামাল