লাউগাছের পাতা হলদে হয়েছে, গোড়ায় ধরেছে পচন। পাতা কুঁচকে গেছে শিমগাছের, পুকুরের মাছ মরে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে গরুর। এমন নানা সমস্যা নিয়ে আমিনুল ইসলামের কাছে আসেন কৃষক ও খামারিরা। সব শুনে তিনি পরামর্শ দেন। কখনো কৃষকের সঙ্গে ছুটে যান খেতখামারে। তাঁর পরামর্শ ও সেবায় উপকৃত হচ্ছেন সবাই।

৪৯ বছর বয়সী আমিনুল ইসলামের বাড়ি দিনাজপুর সদর উপজেলার সুন্দরবন গ্রামে। সেই বাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সমন্বিত কৃষি ক্লিনিক’। সেখানে শুধু কৃষিসেবাই নয়, সাধারণ জৈব সার, কেঁচো সার, ট্রাইকো কম্পোস্ট, অণুজীব সার প্রস্তুত করেছেন। এসব সার নিজ জমিতে ব্যবহারের পাশাপাশি স্থানীয় কৃষকদের কাছে বিক্রিও করছেন। যা থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। ২৬ বছর ধরে সেবা দিয়ে কৃষক-খামারিদের ভরসা এবং আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে আমিনুলের কৃষি ক্লিনিক।

সেই সেবা দিতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পরিহার করে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন।

সম্প্রতি এক সকালে আমিনুলের বাড়িতে ঢুকতেই প্রাচীরে সাঁটানো ‘সমন্বিত কৃষি ক্লিনিক’ সাইনবোর্ডটি চোখে পড়ে। বাড়ির একটি কক্ষে থরে থরে সাজানো দেড় সহস্রাধিক কৃষি, মৎস্য, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন ও চিকিৎসাবিষয়ক বই ও ম্যাগাজিন। এ ছাড়া মাইক্রোস্কোপ, বীজ শোধনযন্ত্র, মাটি-পানি পরীক্ষার সরঞ্জাম, পশুচিকিৎসার যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন রকম ওষুধ, জৈব বালাইনাশক সরঞ্জামে ঠাসা কক্ষটি। আঙিনায় গবাদিপশু চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে।

যেভাবে শুরু আমিনুলের

শৈশবে বাবার কাছেই কৃষিতে হাতেখড়ি আমিনুলের। পড়ালেখা করেছেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। ১৯৯৫ সালে বাড়ির পাশে একটি রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের দোকানে কাজ নেন। সে সময় দোকানে আসা কৃষক-খামারিদের কাছে ফসল ও পশুর সমস্যার কথা শুনতেন। কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছে জেনে পরে কৃষকদের পরামর্শ দিতেন। ধীরে ধীরে এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আমিনুল। ১৯৯৯ সালের কর্তৃপক্ষ দোকান বন্ধ করলে কর্মহীন হয়ে পড়েন তিনি।

একই বছরেই ঠাকুরগাঁও যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যোগাযোগ করেন আমিনুল। প্রাণী, মৎস্য, ফসল উৎপাদন ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় শুরু করেন পশুচিকিৎসা। এবার হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। কৃষক ও খামারিদের ডাকে ব্যস্ততা বাড়ে তাঁর। প্রতিদিন নিয়ম করে মোটরসাইকেলে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সরবরাহ করা ওষুধের দাম নেন। খুশি হয়ে অনেকে পারিশ্রমিকও দেন আমিনুলকে।

আমিনুল এখন ‘দক্ষ কৃষি ডাক্তার’

স্থানীয় প্রাণিসম্পদ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে ধীরে ধীরে আমিনুল ইসলামের যোগাযোগ তৈরি হয়। ২০১৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সমন্বিত কৃষি ক্লিনিক। এতে কৃষক-খামারিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। বর্তমানে গ্রামে গিয়ে পশুচিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি পরিচালনা করছেন কৃষির রকমারি বিতান অ্যান্ড সিড ফার্ম, লাইভস্টক ফিশারিজ মেডিসিন শপ। উৎপাদন করছেন জৈব বালাইনাশক ও জৈব সার।

আমিনুল সঙ্গে রাখেন পিএইচ মিটার, অক্সিজেন মিটার, অ্যামোনিয়া পরীক্ষার কিট। ফলে পুকুরের পানি দেখলেই বলতে পারেন অ্যামোনিয়া গ্যাসের মাত্রা বেড়েছে কিংবা অক্সিজেন-স্বল্পতার কথা। এ ছাড়া মোটরসাইকেলে বিভিন্ন আকৃতির চারটি ব্যাগে সঙ্গে রাখেন সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, ওষুধসামগ্রী, পাটের দড়ি ও চিটাগুড়। আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পশুর যত্নে মানুষ এখনো সচেতন না। এ জন্য ব্যাগে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের পাশাপাশি চিটাগুড়সহ নানা জিনিসপত্র সঙ্গে রাখি। অর্থ আয় নয়, সেবাটাই আমার কাছে মুখ্য।’

২০১৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলোজি বিভাগের প্লান্ট ডিজিজ ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকে বিভিন্ন বিষয়ে মোট ২১ দিন প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে সনদ ও স্বীকৃতিপত্রও দেওয়া হয় তাঁকে। বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক এম বাহাদুর মিয়া ও তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মেদ আলী হোসেন স্বাক্ষরিত স্বীকৃতিপত্রে বলা হয়, প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এলাকার কৃষি সমস্যার বাস্তবমুখী সমাধানে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ‘দক্ষ কৃষি ডাক্তার’ হিসেবে কাজ করে কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

এ ছাড়া জেলায় বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত কৃষি মেলায় সফল উদ্যোক্তার পুরস্কারও পেয়েছেন। বর্তমানে প্রতিদিন ৮-১০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে।

জৈব ও কেঁচো সারে বাড়তি আয়

গোবর, গোমূত্র, চিটাগুড়, বেসন, বিশুদ্ধ মাটি দিয়ে আমিনুল বাড়িতেই তৈরি করেন সলিড অণুজীব সার। এ ছাড়া নিম, মেহগনি, বেল, আতা, ধুতরা, ভেন্নাসহ মোট ১০টি গাছের পাতা পেঁচিয়ে আমিনুল তৈরি করছেন ‘দশপাতা রস’। এই সার ও রস গাছ-ফসলের পুষ্টিজনিত সমস্যা দূর করে। আমিনুল নিজে তা ব্যবহার করছেন এবং প্রায় অর্ধশত কৃষককে এগুলো প্রস্তুত করতে উদ্বুদ্ধ করছেন।

আমিনুলের বাড়ি-সংলগ্ন চার হাজার স্কয়ার ফুট জায়গায় উৎপাদন করছেন কেঁচো সার। পাশেই গোবর, কচুরিপানা, শুঁটকি মাছের গুঁড়া, হাড়ের গুঁড়া, সবজির উচ্ছিষ্টের মিশ্রণে উৎপাদন হচ্ছে ট্রাইকো কম্পোস্ট। প্রতি কেজি ট্রাইকো কম্পোস্ট ১২ টাকা, ভার্মি কম্পোস্ট ১৫ টাকা ও প্রতি ড্রাম অণুজীব সার বিক্রি করছেন ৯০০-১০০০ টাকায়।

আমিনুলের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ভুষিরবন্দর এলাকায় সার উৎপাদন করছেন নাঈম ইসলাম (৩৫)। আলাপকালে নাঈম বলেন, তিন বছর হলো এসব জৈব বালাইনাশক ও কেঁচো সার বিক্রি করছেন তিনি। এরই মধ্যে দিনাজপুর ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প থেকে নিবন্ধনও পেয়েছেন। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে তাঁর গড়ে ৪০ হাজার টাকা আয় থাকছে।

বাড়িজুড়ে বাহারি ওষধি গাছ

বাড়ির প্রধান ফটকের বাঁ পাশে বাগানে ঘৃতকাঞ্চন, লজ্জাবতী, কারিপাতা, তুলসী, নীলকণ্ঠ এবং ডান পাশে ঘরের দেয়ালে সঙ্গে অ্যালোভেরা, চুইঝাল, সর্পগন্ধাসহ নানা ওষধি গাছ দেখা গেল। বারান্দার পাশে বড় হচ্ছে করমচা, নিম, বহেড়া, হরীতকী, বাসক পাতা ও ঈশ্বরমূল। বাড়ির আঙিনাসহ চারপাশে ৭৫ রকমের ওষধি গাছ আছে বলে জানালেন আমিনুল। ছোট ছোট সাইনবোর্ডে প্রতিটি গাছের নামও লিখে রেখেছেন।

সংগৃহীত বিভিন্ন বই-পুস্তক ঘেঁটে এসব ওষধি গাছের গুণাগুণ রপ্ত করেছেন আমিনুল। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে অনেকে পাগল-ছাগল বলত। আমার সার ও বালাইনাশক কেউ কিনত না। এখন অনেকেই আগাম অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন। ফসল উৎপাদনে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। নয়তো রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কারণে ভবিষ্যতে ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়বে মানুষ।’

আমিনুলের বিষয়ে দিনাজপুর সদর উপজেলার (সদ্য বিদায়ী) কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, তিনি (আমিনুল) নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের একজন সফল চাষি ও একজন উদ্যোক্তা। বেশ কিছু জৈব বালাইনাশকও উদ্ভাবন করেছেন, যা ফসলের জন্য উপকারী। আশপাশের অনেক কৃষককে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সচেতন করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া এলাকায় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির চিকিৎসাসেবা দেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম ন ল ইসল ম কম প স ট আম ন ল র ন আম ন ল ব যবহ র সমন ব ত কর ছ ন সমস য করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

আলজেরিয়া জাতীয় দলে ডাক পেলেন জিদানের ছেলে লুকা

ফ্রান্সের কিংবদন্তি জিনেদিন জিদানের ছেলে লুকা জিদানকে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডেকেছে আলজেরিয়া। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোয় আগামী বছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের খুব কাছাকাছি আছে আলজেরিয়া।

২৭ বছর বয়সী গোলরক্ষক লুকা ফ্রান্সের বয়সভিত্তিক দলে খেললেও কখনো সিনিয়র দলে সুযোগ পাননি। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের অনূর্ধ্ব-২০ দলে খেললেও জাতীয় দলে ডাক পাননি। বাবার পারিবারিক সূত্রে আলজেরিয়ার হয়ে খেলার যোগ্যতা রাখেন লুকা। তাঁর জন্ম ফ্রান্সের মার্শেইয়ে হলেও রয়েছে আলজেরিয়ার নাগরিকত্বও। লুকার বাবা জিদান আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত। দাদা ইসমাইল ও দাদি মালিকা ছিলেন আলজেরিয়ান।

দুই সপ্তাহ আগে ফিফা লুকার জাতীয় দল পরিবর্তনের অনুমোদন দেয়। জিদান রিয়াল মাদ্রিদের কোচ থাকাকালীন সেখানেও খেলেছেন লুকা। রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমিতে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু। পরে খেলেছেন স্পেনের রেসিং সান্তানদের, রায়ো ভায়েকানো ও এসডি এইবারে। বর্তমানে খেলছেন স্পেনের দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব গ্রানাদায়।

বাবা ও মায়ের সঙ্গে লুকা জিদান

সম্পর্কিত নিবন্ধ