শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ। কড়কড়ে রোদের তেজও প্রখর। সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে ভেসে আসছে ছইবিহীন ছোট ছোট নৌকা। প্রতিটি নৌকার খোলে সাজানো গোলাভর্তি চাল। কোনো নৌকায় সাদামাটা ইঞ্জিন, কোনোটিতে নিছক বইঠাই ভরসা। তাঁরা সবাই কুটিয়াল—যাঁরা ধানকে রূপ দেন চালের দানায়, সেই চালকে ভাসান নদীর বাজারে। নদীর বুক যেন এক মুহূর্তে হয়ে ওঠে ভাসমান এক দোকানপাটের শহরে।

চালভর্তি নৌকাগুলো সকাল থেকেই ভিড়তে শুরু করে বরিশালের বানারীপাড়া পৌর শহরের লাগোয়া সন্ধ্যা নদীর বুকে গড়ে ওঠা হাটে। মায়াবী সন্ধ্যার জলে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে হয়ে ওঠে এক অভাবনীয় দৃশ্য। একেকটি নৌকাই যেন ভাসমান দোকান আর তার ভেতরে শতাব্দীর ঐতিহ্য। ক্রেতারা আসেন, দর-কষাকষি করেন। কেউবা আবার চালের বোঝা পাইকারি নৌকায় তুলে দেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে এই হাট। শনি ও মঙ্গলবার সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ধ্যা নদী জেগে ওঠে এক বিশেষ উৎসবে। স্থানীয় লোকজন এই হাটকে ‘ভাসান মহল’ বলে ডাকেন।

চালের হাট থেকে ধানের হাট

চালের হাট বসে নদীর এক পাড়ে। ঠিক বিপরীত পাড়ে বসে ধানের হাট। কুটিয়ালরা এখান থেকে ধান কেনেন, নিয়ে যান চাতালে। কয়েক দিনের মধ্যে সেই ধান রূপ নেয় চালের সোনালি দানায়। ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে চালের হাট। এরপর জমে ওঠে ধানের হাট। ধানের মৌসুমে হাটের রং আরও গাঢ় হয়। তখন রবি ও বুধবার অতিরিক্ত হাট বসে, যাকে স্থানীয় লোকজন বলেন ‘গালা’।

একসময় এই হাট ছিল বালাম চালের মোকাম। এই চালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বরিশালজুড়ে। বানারীপাড়ার মলঙ্গা গ্রামে ছিল এই চাল প্রক্রিয়াকরণের আস্তানা। আজ সেই বালাম চাল প্রায় বিলুপ্তির পথে। স্থানীয় জাতের ধান ও ব্রি ধানের চাল এখন হাটের মূল ভরসা। যদিও সেই চালে নেই বালামের সুঘ্রাণ। তবু ভাসমান হাটে মিশে আছে গৃহস্থালির মাটির গন্ধ, স্বাদে স্নিগ্ধতা।

নগদের হাট, নেই মধ্যস্বত্বভোগী

হাটের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো—সব লেনদেন হয় নগদে। বাকির কোনো প্রথা নেই। এ জন্য হাটটি ‘নগদের হাট’ নামে পরিচিত। কৃষক বা কুটিয়ালরা নগদ টাকায় ধান-চাল বিক্রি করেন। দেশের অন্য বাজারগুলোতে যেখানে পণ্য বিক্রির করতে গেলে মধ্যস্বত্বভোগীদের চোরা ফাঁদে প্রান্তিক কৃষকদের টাকা গুনতে হয়, আছে খাজনার বাজনা। কিন্তু এই হাট পুরোপুরি ব্যতিক্রম। এখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই। কাউকে খাজনাও দিতে হয় না। বিক্রেতারা নদীর বুকেই নোঙর করেন, ক্রেতা এসে পছন্দমতো ধান-চাল কিনে নিয়ে যান। স্বতঃস্ফূর্ত এই লেনদেনই ভাসমান হাটের প্রাণ।

আবদুল হাই নামের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী মনে করিয়ে দেন, পুরোনো দিনের কথা। বলেন, স্বাধীনতার আগে বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালীর খেপুপাড়া, গলাচিপা এমনকি সাতক্ষীরার ব্যবসায়ীরাও এই হাটে আসতেন। ধান বিক্রি করে চাল কিনে নিজ এলাকায় ফিরতেন। সেই সোনালি দিনের ভিড় আজ আর দেখা যায় না।

নারীদের নীরব অবদান

কুটিয়ালদের চালের নৌকা ভাসানোর আগে ঘরে রাতভর চলে প্রস্তুতি। চাল শুকানো, বস্তায় ভরা, নৌকা প্রস্তুত—সবই হয় পরিবারের সবাইকে নিয়ে। নারীরা রাত জেগে তাঁদের পাশে থাকেন। শেষ রাতে তাঁরা বিদায় জানান, নৌকা আর পুরুষ সদস্যদের। যাঁরা ভোর হতে না হতেই ভেসে পড়েন নদীর বুকে হাটের উদ্দেশে। এক অদৃশ্য অথচ অমূল্য অবদান রাখেন কুটিয়াল পরিবারের নারীরা, যাঁদের ছাড়া এই হাটের চাকা ঘুরতই না।

৩৫ বছর ধরে ভাসমান বাজারে চাল বিক্রি করা ফারুক হোসেন বলেন, প্রথমে তিনি ধান কিনে বাড়িতে নিয়ে সেদ্ধ করেন। তিন থেকে পাঁচ দিন রোদে শুকিয়ে মিলে নিয়ে চাল বানিয়ে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। এই কাজে স্ত্রীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে সহায়তা করেন।

দুই শতকের সাক্ষী আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভাসমান হাট ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। কুটিয়ালরা বংশপরম্পরায় দুই শতাব্দী ধরে হাটটি টিকিয়ে রেখেছেন। বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা নদীতে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: নদ র ব ক এই হ ট সন ধ য

এছাড়াও পড়ুন:

দলের দুই পক্ষের বিরোধ মেটাতে যাচ্ছিলেন সালিস বৈঠকে, পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বিএনপি নেতার

দলের দুটি পক্ষের মধ্যে হাতিহাতি ও সংঘর্ষের ঘটনায় বিরোধ মীমাংসায় ডাকা হয়েছিল সালিস বৈঠক। সে বৈঠকে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন ফেনীর পরশুরামের বিএনপি নেতা পারভেজ মজুমদার (৫৮)। পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন তাঁর এক সহযোগী।

পারভেজ মজুমদার ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের নিজকালিকাপুর গ্রামের সাদেক মজুমদারের ছেলে। তিনি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।

পুলিশ ও নিহত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রোববার দুপুরে নিজকালিকাপুর গ্রামে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় উভয় পক্ষের চারজন আহত হন। সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরশুরাম উপজেলা সদরে সন্ধ্যায় একটি সালিস বৈঠকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সালিসে যোগ দিতে স্থানীয় বিএনপি নেতা পারভেজ মজুমদার ও তাঁর সহযোগী মোহাম্মদ হারুন মোটরসাইকেলে নিজকালিকাপুর থেকে পরশুরাম যাচ্ছিলেন। তাঁদের বহন করা মোটরসাইকেলটি সুবার বাজার-পরশুরাম সড়কের কাউতলী রাস্তার মাথায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে মোটরসাইকেল আরোহী দুজন গুরুতর আহত হন।

স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করে প্রথমে পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরে ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পারভেজের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে পরিবারের সদস্যরা রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে পথে তাঁর মৃত্যু হয়।

পরশুরাম মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নুরুল হাকিম মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বিএনপি নেতা পারভেজ মজুমদারের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় বিনা ময়নাতদন্তে মরদেহ বাড়ি নিয়ে যায় স্বজনরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ