বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন: বাস্তবতা, প্রভাব ও করণীয়
Published: 20th, June 2025 GMT
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে আলোচিত ও উদ্বেগজনক একটি বিষয়। তবে এর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাবগুলো পড়ছে উন্নয়নশীল ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর, যার অন্যতম উদাহরণ বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, ঘনবসতি, দারিদ্র্যতা, দুর্বল অবকাঠামো ও নদীনির্ভর জীবনধারার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের অন্যতম ভুক্তভোগী।
যদিও বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস (পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্যাসের নিঃসরণ) নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান অত্যন্ত সামান্য, তবুও এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশের কোটি কোটি মানুষকে।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যা পৃথিবীর বৃহত্তম নদী ব্যবস্থার (গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা) মুখে অবস্থিত। এর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা, নিচু ভূ-প্রকৃতি ও ঘনবসতি বাংলাদেশের জলবায়ু সংবেদনশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে।
আরো পড়ুন:
যানজটমুক্ত ঢাকার স্বপ্ন: জুলাই থেকে নামছে ইলেকট্রিক বাস
তথ্য এখন জাতীয় নিরাপত্তার কৌশলগত অস্ত্র: পরিবেশ উপদেষ্টা
বিগত কয়েক দশকে দেশের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, বর্ষার আচরণ বদলেছে, এবং ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েছে। একদিকে যেমন খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে উত্তরাঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে উপকূলে লবণাক্ততা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
উজান থেকে নেমে আসা ঢলের সাথে পাথর ও কয়লা নদী থেকে আহরণে ব্যস্ত স্থানীয়রা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে
১.
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ভোলা প্রভৃতি উপকূলীয় জেলা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এসব এলাকায় লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। মাটির উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় কৃষিজ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে স্থানচ্যুত হচ্ছে, যা একটি নতুন সংকট ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’।
২. চাষাবাদ ও খাদ্য নিরাপত্তা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষির মৌসুমি স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে। আগে নির্দিষ্ট সময়ে যে বৃষ্টি হতো, এখন তা কখনো অতিরিক্ত, কখনো একেবারেই অনুপস্থিত। আমন ধান, পাট, গম, আলুসহ বহু কৃষিপণ্য উৎপাদনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, যা দারিদ্র্য ও অপুষ্টি বাড়াতে পারে।
৩. স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি
উচ্চ তাপমাত্রা, পানির অভাব এবং দূষণের কারণে বাংলাদেশে ডায়রিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও হিটস্ট্রোকের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে। তাপদাহ শহরাঞ্চলে ক্রমাগত বাড়ছে, যার প্রভাব বেশি পড়ছে শিশু ও বয়স্কদের ওপর।
৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি
ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ (২০০৭), ‘আইলা’ (২০০৯), ‘আম্পান’ (২০২০) ইত্যাদি ঝড়গুলো প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন আরও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। এই ধরনের দুর্যোগে জীবনহানির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ও কৃষি ব্যবস্থাও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. খাদ্যাভ্যাস ও গৃহপালিত গবাদি পশুর ওপর প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্যাভ্যাস ও গবাদি পশুর ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় গবাদি পশুর খাদ্য সংকট তৈরি করে। এর ফলে, গবাদি পশুদের স্বাস্থ্য, প্রজনন ক্ষমতা, এবং দুধ উৎপাদনও কমে যায়। একই সাথে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে রোগ-বালাই ও পরজীবী সংক্রমণও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গবাদি পশুর জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলেছে।
বাংলাদেশের মূল খাদ্যশস্য ধান আহরণ করছেন কৃষক
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন, জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। এছাড়া, উপকূলীয় অঞ্চলে অভিযোজন প্রকল্প গ্রহণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমেও সরকার এই সংকট মোকাবিলায় কাজ করছে। ২০০৯ সালে ‘Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP)’ তৈরি করা হয়। এর আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেমন: উপকূলীয় বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়ন, সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন ও সম্প্রসারণ, লবণাক্ততা সহনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন, পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ ব্যবস্থা।
‘ক্লাইমেট প্রোসপারিটি প্ল্যান’–এর মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা “Climate Vulnerable Forum” (CVF)-এর সভাপতিত্ব করে বৈশ্বিক জলবায়ু ন্যায়বিচার দাবি করে আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় করণীয়
১. নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রসার
সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, বায়োগ্যাস ইত্যাদির ব্যবহার বাড়িয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। এতে পরিবেশ দূষণ কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি খাতে স্বনির্ভরতা আসবে।
২. বনায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ
বনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। নদী, খাল, বিল ও জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে এবং শহরে সবুজ এলাকা বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
৩. জনসচেতনতা বৃদ্ধি
স্কুল-কলেজে পরিবেশ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
৪. জলবায়ু অভিযোজন প্রযুক্তি প্রসার
লবণসহিষ্ণু ও খরারোধী ফসল উদ্ভাবন, বন্যা সহনশীল গৃহনির্মাণ, এবং পানি সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ন্যায়বিচার দাবি
বাংলাদেশের মতো দেশের প্রয়োজনে জলবায়ু তহবিল নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর উচিত পরিবেশ দূষণের জন্য দায় স্বীকার করে অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা বৃদ্ধি করা।
তীব্র দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে পদ্মানদীর চরে গা ভাসিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে মহিষের পাল
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু একটি পরিবেশগত সংকট নয়, এটি একটি মানবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটও বটে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশে এই সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস না করে, পরিবেশবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে জলবায়ু ন্যায়বিচার দাবি করেই টেকসই ভবিষ্যতের পথ তৈরি করা সম্ভব।
পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে দেশের কিছু অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে বেশকিছু আশানুরূপ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মধ্যে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ উল্লেখযোগ্য। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব-নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষা করা এবং জলবায়ু সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। কারণ এই পৃথিবী কেবল আমাদের নয়, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেরও।
ঢাকা/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ব শ জলব য উপক ল ব যবস থ উপক ল য পর ব শ র ওপর জলব য় জলব য
এছাড়াও পড়ুন:
পদ্মাপাড়ের আহত জারুল ও পাখিরা
পদ্মাপাড়ের শক্তিশালী বাতাস সঞ্চয় করে ডানা ঝাপটানো পাখিরা হারিয়ে যায় দূরে। হয়তো সে সময়টা খুব ভোরে, যখন পারাবারের ফেরিকর্মী খসরু পানকৌড়ি, মাছরাঙা পাখিদের মতোই টুপ করে বারবার জলে ডুব দিয়ে গোসল করে তার সাবানের ফেনাসমেত শরীরটা নিয়ে। যে সাবানের সাদা ফেনা সরিয়ে ফেললে তার কালো কষ্টিপাথরের মতো শরীরটা বের হয়ে যায়, যার ভেজা চেকপ্রিন্টের লুঙ্গি নিতম্ব ঊরুতে লেপটে থাকলেও তা তার দেখা সিনেমার নায়িকাদের মতো যৌন কামনার বদলে উদ্রেক করে বিরক্তির, গা শিরশির করা ঘৃণার। এ সময় প্রতিদিন ভোরে ছন্দার মাকেও দেখা যায় এক পাশে এসে বাসনকোসন মেজে নিয়ে যেতে। খসরু যতবার ডুব দেয়, ঠিক সেই বরাবর ততবারই ছন্দার মা একদলা থুতু পানিতে ফেলে, যাতে তা খসরুর গোসলকে অসম্পূর্ণই রেখে দেয়। একই সঙ্গেই সাবানের ফেনা মেখে ফরসা হতে বাধা দেয়, নিতম্ব ঊরু সব সময় অবহেলিত হয়েই পড়ে থাকে। কোনো পাখি হয়তো নদীপাড়েরই উঁচু একটা ঢিবির ওপর রাখা বাঁশে গোসল শেষ করে উঠে এদিক-ওদিক তাকায়, পাশেই কিছু উলঙ্গ শিশুও কাদা নিয়ে খেলা শেষে গোসল করতে ঝুপঝাপ লাপ দেয় পাড়ের অল্প পানিতে। কোনো পাখি হয়তো গভীর রাতে ফেরিঘাটের এই ব্যস্ততা, সারি সারি বাস, ট্রাক আর আলো-অন্ধকার ভেদ করে কালো গভীর পানিতে ছুটে চলা ফেরি চুপচাপ দেখে যায়; যেখানটায় ‘ফেরি ক্যামেলিয়া’ নামফলক লেখা দেখা যায়, ঠিক সেখানটায় বসে।
ভরদুপুরে এমনই একটা পাখি আহত হয়ে পড়ে থাকে নদীপাড়ের উত্তপ্ত সাদা বালুতে। দলছুট হয়ে উড়তে না পারায় পাখি হতবিহ্বল হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। বাকি পাখিরা উড়ে চলে পাল্লা দিয়ে ফেরির সাথে আর নিচে চাকায় ঘুরতে থাকা স্রোতের সাথে। সে সময় হয়তো বগুড়া থেকে বরিশালগামী নবীনবরণ বাসটাও ফেরিতে নদী পার হয়। বাস থেকে হন্তদন্ত হয়ে সাদা পাঞ্জাবি–পায়জামা পরে ইসহাক ব্যাপারীকে নামতে দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে যে কেউ হয়তো বলবে ফেরির এক পাশে যে শৌচাগার আছে, ঠিকঠাক দরজার খিল দেওয়া ছাড়া, ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার আর গন্ধময়, ব্যাপারীর হয়তো সেখানে যাওয়ার জন্যই এত তাড়াহুড়ো। কিন্তু শৌচাগার ছাড়িয়েও সে সামনে এগোয় আশপাশে না তাকিয়ে। নাহ, শুধু একবার তাকায় যেখানে চানাচুর দিয়ে মসলা, তেল, পেঁয়াজ, ধনেপাতাকুচি মুড়িতে মেশানো হয় এক ইচ্ছাকৃত উচ্চ শব্দে, সর্বনিম্ন দশ টাকার এই মুড়ি মাখার ঘ্রাণ ব্যাপারীকে তাকাতে বাধ্য করে। মুড়িমাখাওয়ালা আর তার চারপাশের ভিড় সব অগ্রাহ্য করে একটা মাইক্রোবাস আর একটা ট্রাকের মাঝখানের অল্প ফাঁকের ভেতর দিয়ে শুকনো শরীরটা ঢুকিয়ে দেয় অল্পতেই পার হওয়ার জন্য। সে সবকিছু ফেলে প্রায় দৌড়ে হাটে। খাড়া লোহার সিঁড়ির হাতল ধরে পৌঁছে যায় তিনতলায়।
খসরু তিনতলায় ব্যস্ত সবাইকে খাবারদাবার ও ভাত দেওয়ায়। তিনতলায় এক পাশে তার চিপস, প্যাকেটের ভাজাপোড়া, চা–কফির দোকান। ফ্রিজটা আপাতত নষ্ট, নাহয় সেখানে আইসক্রিম থাকে। তারই আশপাশে দুটি টেবিল আর কিছু বেঞ্চ পেতে রাখা সবার ভাত খাওয়ার আর বসার জন্য। এক কোণে তার রান্না করার ছোট রুম। এখান থেকে বের হয়েই উঁচু বেঞ্চে সে গামলা ভরে ভাত, মাছ-মাংস, তরকারি, ডাল রাখে। সে একা সব দিক সামাল দিয়ে উঠতে না পারায় এখান থেকে সবাই যে যার মতো নিয়ে খায়। মাঝেমধ্যে খসরু এসে তদারকি করে, কেউ তাকে ওতে পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। বিশেষত যেসব বাস–ট্রাকের ড্রাইভার, সুপারভাইজাররা নিয়মিত আসে। তার আজকের মেন্যু লালশাকভাজি, বেগুনভাজি, নদীর মাছ ভুনা আর পাতলা ডাল। ডাল সবার জন্য ফ্রি। শাপলা বাসের ড্রাইভার লালশাকের গামলা থেকে অর্ধেক শাক একাই খেয়ে ফেলে, আবার যাওয়ার সময় টাকা না দিয়েই মুহূর্তেই তিনতলা থেকে উধাও হয়ে যায়। খসরুর এখন সময় নেই তার পিছু নেওয়ার কিন্তু সে ধরবেই, এমনই সিদ্ধান্ত তার। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে সে বাকিদের ডিমভাজি আর ডাল দেয়। এমন সময়-ই ব্যাপারী সেখানে এসে উপস্থিত হয়। ব্যাপারীকে খুব তাড়াহুড়ো করে বলতে শোনা যায়—“তত্তোরি দ্যাওসেন, দেরি হইয়্যা যাইতাসে তো।’ অল্পক্ষণ পরে মেলামাইনের জোড়া প্লেটের ওপর ভাত, ডাল, ডিমভাজি আর পাতলা শরীরটা নিয়ে ছুটতে দেখা যায় নিচে, বাসের ভেতরে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগবে সে ওপরে না খেয়ে এত ছোটাছুটির কারণ কী? কারণ সেখানে তার ছেলে আবদুর রহমান আর স্ত্রী অপেক্ষায়। ছেলেকে খাইয়ে সে আবার ছুটে চলে ফেরির তিনতলায় প্লেট-গ্লাস ফেরত দেওয়ার জন্য। তাকে একটা গ্লাসও চেয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে খসরুর কাছ থেকে; কারণ আবদুর রহমান গ্লাস ছাড়া শুধু বোতলে মুখ দিয়ে পানি খেতে পারে না।
২.নদীর পাড়ে আহত পাখিটা সূর্যের উত্তাপে গরম হওয়া বালুতে ফুটতে থাকে। মনে হয় কে যেন শরীর থেকে একটা একটা করে নরম পালক টেনে খুলে ফেলছে। বিস্ফারিত কমলা কালো চোখের মণি নিয়ে ওপরের আকাশের দিকে তাকায়, সেখানের সূর্যের আলো তার চোখে ধাঁধার সৃষ্টি করে। সূর্য আর তার মাঝখানে রংধনুর মতো একটা রাস্তা দেখা যায়। সব শক্তি সঞ্চয় করে সে ওড়ে। হায়, এক হাত সামনে যেতেই সে আবার বালুর ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে। ইসহাক ব্যাপারী এবার তিনতলা থেকে দ্রুত নেমে আসে দোতলায় নামাজ পড়ার জায়গায়। নামাজের ভেতর কণ্ঠনালি, জিহ্বায় জোর দিয়ে পড়া ‘ইয়া কানা’বুদু ওয়া ইয়া কানাস্তাইন’ মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়, মিলিয়ে যায় নদীপাড়ের সুবিস্তৃত হাওয়ায়, সাদা চিকচিক বালুতে। তাতে বাইরের আর্দ্রতা কিছু না কমলেও ব্যাপারীর ভেতর পুরোটা দ্রবীভূত হয়ে যায়। সে প্রস্তুতি নেয় সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু বলার, দীর্ঘ কোনো মোনাজাত ধরার।
৩.আহত পাখির দৃষ্টি কয়েক হাত দূরের আকন্দগাছের ঝোপের দিকে। তার চোখে ঝাপসা ধরা দেয় হালকা ময়লা বেগুনিরঙা আকন্দ ফুলের থোকাগুলো, মনে হয় এই দিনের আলোয়ও অসংখ্য তারা ফুটে আছে। যেভাবেই হোক ঝোপের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে ছায়া মিলবে। পাখি তাকায় ঝোপের দিকে একবার, বিপরীত দিক থেকে রক্তের গন্ধ পেয়ে ছুটে আসা লাল পিঁপড়ার সারির দিকে একবার আর আকাশের স্বচ্ছ কাচরঙা রোদের দিকে। সে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ে গন্তব্য নিয়ে।
ওদিকে নবীনবরণ বাসের যাত্রীরা সবাই উঠে পড়েছে। বাসের সুপারভাইজার মাথা গুনছে, সবাই ঠিকঠাক উঠল কি না। বাসের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফেরি থেকে ডাঙায় এপারে ওঠার জন্য তৈরি। ইসহাক ব্যাপারীর বউ আকলিমা পাশে অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, নাক–মুখ বোরকায় ঢাকা আকলিমার ক্ষীণকণ্ঠ সর্বশক্তি দিয়ে বলছে—‘এই যে শুনছেননি ডেরাইভার সাব, আমাগো বাবুর আব্বা তো এক্ষনো আইসা পৌঁছায় নাই যে। হ্যায় নামাজ পড়বার গ্যাছে তো কইল। হে কই গ্যাছে, খুঁইজ্যা আনেন যে।’ সামনের সিটের দাঁড়ানো পায়জামা-পাঞ্জাবি টুপি পরা বারো-তেরো বছর বয়সী ছেলেটাও এ মুহূর্তে হাতের শসা খাওয়া বন্ধ রেখে একবার আকলিমার দিকে আরেকবার দরজার দিকে, ড্রাইভারের দিকে তাকায়। বিটলবণসহ শসার রস বেয়ে তার পাঞ্জাবির দুই হাতা ভিজিয়ে ফেলে, সেদিকে নজর দেওয়ার সময় এ মুহূর্তে না। ফেরির তৃতীয় তলায় সে সময় খসরু একটা বড় গামলায় ডাল, ডিমভাজি আর পোড়া শুকনা মরিচ নিয়ে ভাত খেতে বসে যায়। ঠিক দরজায় ঠাসা সুন্দর ঊরু বের করা লাস্যময়ী নায়িকার ছবির মুখোমুখি হয়ে। সারা দিনের এই একমুহূর্ত সময় পাওয়ার জন্য সে ছটফট করে। এ সময় সে ভাত খায় আর নায়িকার সঙ্গে একান্তে কথা বলে সুখ–দুঃখের, কোন কাস্টমার তার সঙ্গে কী ব্যবহার করল। সবশেষে প্রতিদিন এই আলাপ শেষ হয় এক কষ্ট নিয়ে। নায়িকাকে সে বলে—‘বুঝলানি আমি এই খসরু এত মাইনষেরে রান্না কইরা খাইওইলাম শুধু বাদ থাকলা আমার পেয়ারের লোক তুমি। আমার হাতের ইলিশ মাছ ভাজা শুকনা মরিচ পোড়া দিয়া আর কচি ডাঁটা চিংড়ির ঝোল খাইলে তুমি আমারে সারাডা জীবন মনে রাকতা গো, ভুলবার পারতা না, হ্যাভি টেস।’ সে গোগ্রাসে ভাত মুখে দিয়ে আবার বলতে থাকে—‘সারাডা দিন শুটিংয়ে থাহো, কী যে খাও, সবার রান্দন তো বালা না, কাছত থাকলে যত্ন–আত্তি কত্তামনি। তহন শুধু তুমার রান্দনই রানতাম গো নাইকা ।’ বলেই সে লজ্জা পেয়ে হাসে, আশপাশে কেউ দেখে ফেলল কি না খেয়াল করে। ফেরির দোতলায় সে সময় নামাজের মোনাজাতে ক্রন্দনরত ইসহাক বলছে বিড়বিড় করে—‘ইয়া আল্লাহ, আমার কথা শোনো গো আল্লাহ, কবুল কইর্যা লও সে, আমার পোলাডারে তুমি লইয়া যাইও না গো আল্লাহ। ও আল্লাহ, সারা জাহানের মালিক তুমি মায়ের কোলডা খালি কইরো না। আমি হ্যার মায়েরে কী দিয়া বুঝ দিমু গো আল্লাহ? হ্যায় তো জানে বড় হওনের লগে লগে পোলা ঠিক হইয়্যা যাইব। পোলাতো আরও রোগে পড়তাছে, হ্যার মা’য় তো সন্দেহ করতাসে আমারে। মায়ের মন তো!! আমি যেন হ্যার লগে মিছা কতা না কই। ও মাবুদ, আমি কেমনে কমু পোলার মায়েরে এই ডাউন সিনডোমের পোলার হায়াত আছে আর কয়ডা বছর মাত্র।’
৪.আকাশে হঠাৎ ছায়া নেমে আসে। কোত্থেকে মেঘের গর্জন শোনা যায়, বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি পড়ে। নদীপাড়ের অরিন গার্মেন্টস আরবিঅ্যান্ডবি ব্রিকফিল্ডের ছাইরঙা ধোঁয়া তখনো কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশের দিকে ঊর্ধ্বমুখী। আহত পাখি তার ঠোঁট হাঁ করে, বৃষ্টির পানির স্বাদ নেয় তার পিপাসার্ত জিহ্বায়। তার চোখ, শরীর ভেজে, আহত ডানার রক্ত ধুয়ে যায়। খসরু সে সময় তিনতলায় হাঁড়ি–পাতিল ধোয়ার কাজে ব্যস্ত, চুলায় তার রাতের ভাত টগবগ করে ফুটতে থাকে। সে উদাস দৃষ্টিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখে নাকি অন্য কিছু ভাবে, সেটা বলা মুশকিল। ইসহাক ব্যাপারীর এ মুহূর্তে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি নেমে আসে। যা এতক্ষণ ধরে বহু চেষ্টায়ও কেন জানি আসেনি। সে বলতে থাকে—‘ইয়া মাবুদ, মাবুদ রে, রাহমানুর রাহিম তুমি তো তোমার বান্দারে খালি হাতে ফেরত দাও না। আমারেও দিয়ো না। প্রয়োজন হইলে আমারে লইয়্যা যাও গো আল্লাহ, তার বিনিময়ে আমার পোলাডার জীবনডা ভিক্ষা দাও, যেমন কইর্যা ফেরত দিসিলা বাদশার পোলারে (এ সময় সে বাসা থেকে মনে করে আসা বাদশাহ বাবর আর তাঁর পুত্র হুমায়ুনের নাম বহুকষ্ট করেও মনে করতে পারে না )। ব্যাপারী আবার শুরু করে—‘আল্লাহ তুমি তো পানির ওপর থাকন অবস্থায় তোমার অসহায় বান্দার দোয়া কবুল করো। আমার চোখের সামনে আমার আবদুর রহমানরে নিয়ো না আল্লাহ।’ ব্যাপারীর সময়জ্ঞান লোপ পায়, তার হুঁশ থাকে না মোনাজাতে কতটা সময় পেরিয়ে যায়। নিচে ফেরিঘাটে এসে পৌঁছায়। হঠাৎ করে নেমে আসা বৃষ্টিতে পুরো ফেরি পিচ্ছিল কাদাময় হয়ে যায়। যারা এতক্ষণ কোনো বাস ছাড়াই শুধু নদী পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা ছিল, তারা তাদের বস্তা বেডিং, বাচ্চা ছেলের মেয়েদের হাত ধরে পার হয় গাড়িগুলো পাড়ে ওঠার আগেই। আশপাশের ছোট ছোট মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মালবাহী ট্রাক ছোটে ধীরে ধীরে। পেছনে যাত্রীসহ নবীনবরণ বাসের ড্রাইভার গাড়ি ধীরগতিতে এগিয়ে নেয় সিরিয়াল অনুযায়ী ফেরি থেকে পাড়ে ওঠার। ব্যাপারীর বউয়ের চিৎকার, কান্নাকাটিতে আশপাশের দু–একজন সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় ব্যাপার কী জানতে। এ সময় ব্যাপারীর অসুস্থ প্রতিবন্ধী ছেলেরও ঠোঁটের দুপাশে লালা গড়িয়ে পড়ে, চোখের মণি বিস্ফারিত করে সর্বশক্তি দিয়ে সে বহুকষ্টে উচ্চারণ করে—‘আব...বা...আআআ...আব...বা...আআআ।’
অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।ই–মেইল: [email protected]