ইরানে হামলা করে যে উভয়সংকটে ইসরায়েল
Published: 20th, June 2025 GMT
গত শুক্রবার শুরু হওয়া হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কয়েক মাসের মধ্যে পুনর্গঠন সম্ভব। এই হামলা ইরানের সরকার ও সাধারণ জনগণের মধ্যে পারমাণবিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
মাত্র কয়েক দিনের যুদ্ধেই ইসরায়েল ইরানের ১২ জনের বেশি শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যা করেছে। তাদের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করেছে। হামলা হয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ অংশে। কিন্তু ইরানের বিস্তৃত ও সুরক্ষিত পারমাণবিক কর্মসূচিকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। আর এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনা কমান্ডার ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার বিশেষজ্ঞরা একমত।
ইসরায়েলের প্রাথমিক হামলাগুলো ইরানকে একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার ক্ষমতা কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে পেরেছে, এমনটা জানিয়েছেন এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, ইরান বোমা তৈরি করতে আরও অন্তত তিন বছর দূরে ছিল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরান পারমাণবিক বোমার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে বলেই তিনি হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু সেটি সত্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল হয়তো আরও বেশি ক্ষতি করতে পারবে না।
আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫হামলাগুলো যা অর্জন করেছে, তা হলো ইরানের নেতৃত্বে ভীতি ও ইরানি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করা। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শিশুরা নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে পুরো তেহরানের মহল্লা খালি করার নির্দেশ গাজার ঘটনার ভয়াবহতার সঙ্গে মিল আছে। ফলে নিজের সরকারকে পছন্দ না করলেও তা ইরানিদের ইসরায়েলের প্রতি ঘৃণাকেই উসকে দিয়েছে। ইসরায়েল নিজে পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করেনি। বহু ইরানি এখন বিশ্বাস করেন, তাঁদেরও এমন অস্ত্র দরকার।
এক পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েলের হামলাগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের পক্ষেই কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘আমার নিজস্ব মত হলো, যদি এরপরও তাদের সক্ষমতা থাকে, তাহলে তারা যত দ্রুত সম্ভব পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে এগিয়ে যাবে।’
গত বছর ইসরায়েল স্পেশাল ফোর্স কমান্ডো পাঠিয়ে সিরিয়ায় এক গোপন হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা ধ্বংস করেছিল। ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা সুরক্ষিত হলেও ইসরায়েল এখন পশ্চিম ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবি করছে।ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সামরিকভাবে ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় বাধা হলো পবিত্র নগর কোমের কাছে ফোর্দো স্থাপনাটি। এটি পাহাড়ের গভীরে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমাও এর নাগাল পাবে না। এখানে সেন্ট্রিফিউজ ও উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বড় অংশ রয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী বাংকার ধ্বংসকারী বোমা হয়তো এটি ধ্বংস করতে পারে। তা–ও নিশ্চিত নয়।
প্রাথমিক হামলার সাফল্যে ইসরায়েলে যখন উচ্ছ্বাস, তখন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি সতর্ক করেছেন, ইরানি পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু সামরিক উপায়ে ধ্বংস করা যাবে না। তিনি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘স্থাপনায় হামলা করার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রক্রিয়া থামানো সম্ভব নয়।’ তার চেয়ে বরং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পথ সুগম করা উচিত, যাতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি থামানো যাবে।
এদিকে নেতানিয়াহু স্পষ্ট বলেছেন, তিনি কূটনৈতিক সমাধানের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা নিতে বেশি আগ্রহী। ট্রাম্পকে তাঁর যুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন নেতানিয়াহু।
আরও পড়ুনকোনো ইহুদিরাষ্ট্র ৮০ বছর টেকে না—যে ভয়ে ভীত ইসরায়েল০৬ নভেম্বর ২০২৩ইসরায়েলি নেতারা শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস নয়, তেহরানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের স্বপ্নও দেখেন। কিন্তু বেসামরিক এলাকায় ইসরায়েলের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত বর্তমান শাসনব্যবস্থার প্রতি ইরানি জনগণের সমর্থন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইসরায়েলি হামলার ভয় আরও বেড়েছে পশ্চিমা দেশের নীরবতার কারণে। গণহত্যা ও চরম সামরিক অন্যায় আক্রমণের পরও পশ্চিমারা কোনো বাধা দেয়নি। একসময় বিশ্বাস করা হতো আন্তর্জাতিক উদারপন্থী ব্যবস্থা ইসরায়েলকে লাগাম টেনে ধরবে। গাজার ধ্বংসস্তূপে সেই বিশ্বাসকে শেষ করে দিয়েছে।
যদি শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এই যুদ্ধে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে কোনো চুক্তি করতে দেরি করে, তাহলে ফোর্দোতে আরও বড় হামলা করতে ইসরায়েল দ্বিধা করবে না।
ইরানের বিশাল পারমাণবিক তথ্যের ভান্ডার ইসরায়েল হাতিয়ে নিয়েছে। তাতে সম্ভবত ফোর্দোর পারমাণবিক স্থাপনার পরিকল্পনা তারা পেয়েছে। এর মাধ্যমে স্থাপনার সহায়ক কাঠামো অচল করা, প্রবেশপথ বন্ধ করা বা বিশেষ বাহিনী দিয়ে স্থল অভিযানে প্ল্যান্ট ধ্বংস করা সহজ হয়ে যাবে।
গত বছর ইসরায়েল স্পেশাল ফোর্স কমান্ডো পাঠিয়ে সিরিয়ায় এক গোপন হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা ধ্বংস করেছিল। ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা সুরক্ষিত হলেও ইসরায়েল এখন পশ্চিম ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবি করছে। তাই সি-১৩০ বিমানে করে বিশেষ বাহিনী সেখানে পাঠিয়ে সাইটটি দখলের চেষ্টা ইসরায়েল করতে পারে।
ইসরায়েল এখন পড়ে গেছে উভয়সংকটে। তারা যদি হামলা বন্ধ করে, তাহলে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ আবার শুরু করবে। তখন তাদের আবার বোমাবাজি শুরু করতে হবে।
এমা গ্রাহাম-হ্যারিসন গার্ডিয়ানের মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান সংবাদদাতা
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ: জাভেদ হুসেন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ধ ব স কর ইসর য় ল আরও ব ইসর য র ইসর
এছাড়াও পড়ুন:
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের পথে সরকার কতটা এগুলো?
১৯৭১ সালে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলা, যেখানে নাগরিকদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অন্যতম সাংবিধানিক অঙ্গীকার হলো প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু নির্বাচন জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বহুলাংশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আবার কিছু নির্বাচন ছিল একতরফা ও বিতর্কিত, যে নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় কিংবা সামরিক সরকারের অধীনে।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বস্তুত নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে পড়েছিল এবং জবাবদিহির কাঠামো ভেঙে পড়েছিল। ফলে দেশের সর্বস্তরে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। তাই এ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল।
আরো পড়ুন:
ফিরে দেখা আমাদের জুলাই বিপ্লব
জুলাই গণঅভ্যুত্থান: সিরাজগঞ্জে ৪ আগস্ট নিহত হয় ২৯ জন
আশার কথা হলো, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে এবং ৮ই আগস্ট তারিখে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। কিন্তু কেমন ছিল সরকারের প্রথম এক বছরের শাসন?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল নির্বাচনব্যবস্থাসহ দেশের বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন, যাতে দেশে আর কর্তৃত্ববাদী শাসন জেঁকে বসতে না পারে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে অচলাবস্থার অবসান হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও জবাবদিহির কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পরিচালিত হয়। জনগণের আরও প্রত্যাশা ছিল জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার করা এবং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচ আয়োজন করা। সংক্ষেপে বলতে গেলে সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা হলো, বিচার, সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন।
প্রথমত, জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামীদের বিচার শুরু হয়েছে। বর্তমানে বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে প্রধান অভিযুক্তদের বিচার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য খাত, শ্রম, স্থানীয় সরকার এবং নারী বিষয়ক আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের কার্যক্রম শেষ করে ৭০০-এর অধিক সুপারিশ প্রণয়ন করে। এরপর উক্ত কমিশনগুলোর সুপারিশ সম্পর্কে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি জাতীয় সনদ প্রণয়নের জন্য ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ নামে নতুন একটি কমিশন গঠন করার কথা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলের মতামত সংগ্রহের জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন পাঁচটি স্বতন্ত্র স্প্রেডশিট তৈরি করে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব বলে স্প্রেডশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ৫টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে এ স্প্রেডশিটগুলো তৈরি করা হয় এবং ০৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে তা ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে তাদের মতামত প্রদানের জন্য প্রেরণ করা হয়। ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ছিল ২০টি।
স্প্রেডশিট প্রেরণের পর কিছু কিছু দল স্প্রেডশিটে মতামত দেওয়ার পাশাপাশি কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখিত সুপারিশের ব্যাপারে বিস্তারিত মন্তব্য ও বিশ্লেষণ জমা দেয়। স্প্রেডশিটে মতামত সংগ্রহের পরবর্তী ধাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করে। ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে ২০২৫ পর্যন্ত মোট ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের প্রথম পর্বের ওই বৈঠকগুলোতে অনেকগুলো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পরিবর্তন হয়। তবে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এ পর্বে ঐকমত্য হয়নি। প্রথম পর্বের আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি বা দলগুলোর অবস্থান কাছাকাছি সেসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোকে নিয়ে ২ জুন ২০২৫ থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত উক্ত আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
শেষ দিনের আলোচনা শেষে গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি সংস্কার বিষয়ে দল ও জোটগুলোর মধ্যে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। তবে এসবের কিছু কিছু ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট আছে। যে বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো হলো: ১. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০; ২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; ৩. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ; ৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান; ৫. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ: (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ; ৬. জরুরি অবস্থা ঘোষণা; ৭. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; ৮. সংবিধান সংশোধন; ৯. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান; ১০. নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত; ১১. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল; ১২. পুলিশ কমিশন গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব; ১৩. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; ১৪. উচ্চকক্ষের গঠন ও এর সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার, ইত্যাদি; ১৫. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি; ১৬. তত্ত্বাবধায়ক সরকার; ১৭. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব; ১৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি; ১৯. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব।
ইতোমধ্যে জাতীয় সনদের একটি খসড়া রাজনৈতিক দলের কাছে মতামত প্রদানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আশা করা যায়, বাস্তবায়নের ওপর আলোচনার পর খুব শীঘ্রই জাতীয় সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হবে। এছাড়া সংস্কার কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারি করা-সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়-সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো।
তৃতীয়ত, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে এবং এ জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৬০ হাজার সেনাসদস্য নির্বাচনী ডিউটিতে থাকবে বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এবং নির্বাচনকে ঘিরে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় আরো জোরদার করতে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য একটি মিডিয়া সেন্টার খোলার নির্দেশনা আদেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশন ‘ফুল গিয়ারে’ প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন এ এম এম নাসির উদ্দিন।
আমরা আশা করি, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্ধারিত সময়ে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং এর মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটবে। আর সেটিই হবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা।
নেসার আমিন: লেখক ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর
তারা//