ইরানে হামলা করে যে উভয়সংকটে ইসরায়েল
Published: 20th, June 2025 GMT
গত শুক্রবার শুরু হওয়া হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা কয়েক মাসের মধ্যে পুনর্গঠন সম্ভব। এই হামলা ইরানের সরকার ও সাধারণ জনগণের মধ্যে পারমাণবিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
মাত্র কয়েক দিনের যুদ্ধেই ইসরায়েল ইরানের ১২ জনের বেশি শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যা করেছে। তাদের শীর্ষ সামরিক নেতৃত্বের বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করেছে। হামলা হয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ অংশে। কিন্তু ইরানের বিস্তৃত ও সুরক্ষিত পারমাণবিক কর্মসূচিকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। আর এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনা কমান্ডার ও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার বিশেষজ্ঞরা একমত।
ইসরায়েলের প্রাথমিক হামলাগুলো ইরানকে একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার ক্ষমতা কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে পেরেছে, এমনটা জানিয়েছেন এক ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, ইরান বোমা তৈরি করতে আরও অন্তত তিন বছর দূরে ছিল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরান পারমাণবিক বোমার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে বলেই তিনি হামলা চালানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু সেটি সত্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল হয়তো আরও বেশি ক্ষতি করতে পারবে না।
আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫হামলাগুলো যা অর্জন করেছে, তা হলো ইরানের নেতৃত্বে ভীতি ও ইরানি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করা। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শিশুরা নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে পুরো তেহরানের মহল্লা খালি করার নির্দেশ গাজার ঘটনার ভয়াবহতার সঙ্গে মিল আছে। ফলে নিজের সরকারকে পছন্দ না করলেও তা ইরানিদের ইসরায়েলের প্রতি ঘৃণাকেই উসকে দিয়েছে। ইসরায়েল নিজে পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করেনি। বহু ইরানি এখন বিশ্বাস করেন, তাঁদেরও এমন অস্ত্র দরকার।
এক পশ্চিমা সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েলের হামলাগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের পক্ষেই কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘আমার নিজস্ব মত হলো, যদি এরপরও তাদের সক্ষমতা থাকে, তাহলে তারা যত দ্রুত সম্ভব পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে এগিয়ে যাবে।’
গত বছর ইসরায়েল স্পেশাল ফোর্স কমান্ডো পাঠিয়ে সিরিয়ায় এক গোপন হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা ধ্বংস করেছিল। ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা সুরক্ষিত হলেও ইসরায়েল এখন পশ্চিম ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবি করছে।ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সামরিকভাবে ধ্বংস করার সবচেয়ে বড় বাধা হলো পবিত্র নগর কোমের কাছে ফোর্দো স্থাপনাটি। এটি পাহাড়ের গভীরে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমাও এর নাগাল পাবে না। এখানে সেন্ট্রিফিউজ ও উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বড় অংশ রয়েছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী বাংকার ধ্বংসকারী বোমা হয়তো এটি ধ্বংস করতে পারে। তা–ও নিশ্চিত নয়।
প্রাথমিক হামলার সাফল্যে ইসরায়েলে যখন উচ্ছ্বাস, তখন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি সতর্ক করেছেন, ইরানি পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু সামরিক উপায়ে ধ্বংস করা যাবে না। তিনি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘স্থাপনায় হামলা করার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রক্রিয়া থামানো সম্ভব নয়।’ তার চেয়ে বরং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পথ সুগম করা উচিত, যাতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি থামানো যাবে।
এদিকে নেতানিয়াহু স্পষ্ট বলেছেন, তিনি কূটনৈতিক সমাধানের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা নিতে বেশি আগ্রহী। ট্রাম্পকে তাঁর যুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন নেতানিয়াহু।
আরও পড়ুনকোনো ইহুদিরাষ্ট্র ৮০ বছর টেকে না—যে ভয়ে ভীত ইসরায়েল০৬ নভেম্বর ২০২৩ইসরায়েলি নেতারা শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস নয়, তেহরানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের স্বপ্নও দেখেন। কিন্তু বেসামরিক এলাকায় ইসরায়েলের প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত বর্তমান শাসনব্যবস্থার প্রতি ইরানি জনগণের সমর্থন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইসরায়েলি হামলার ভয় আরও বেড়েছে পশ্চিমা দেশের নীরবতার কারণে। গণহত্যা ও চরম সামরিক অন্যায় আক্রমণের পরও পশ্চিমারা কোনো বাধা দেয়নি। একসময় বিশ্বাস করা হতো আন্তর্জাতিক উদারপন্থী ব্যবস্থা ইসরায়েলকে লাগাম টেনে ধরবে। গাজার ধ্বংসস্তূপে সেই বিশ্বাসকে শেষ করে দিয়েছে।
যদি শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এই যুদ্ধে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে কোনো চুক্তি করতে দেরি করে, তাহলে ফোর্দোতে আরও বড় হামলা করতে ইসরায়েল দ্বিধা করবে না।
ইরানের বিশাল পারমাণবিক তথ্যের ভান্ডার ইসরায়েল হাতিয়ে নিয়েছে। তাতে সম্ভবত ফোর্দোর পারমাণবিক স্থাপনার পরিকল্পনা তারা পেয়েছে। এর মাধ্যমে স্থাপনার সহায়ক কাঠামো অচল করা, প্রবেশপথ বন্ধ করা বা বিশেষ বাহিনী দিয়ে স্থল অভিযানে প্ল্যান্ট ধ্বংস করা সহজ হয়ে যাবে।
গত বছর ইসরায়েল স্পেশাল ফোর্স কমান্ডো পাঠিয়ে সিরিয়ায় এক গোপন হিজবুল্লাহ ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা ধ্বংস করেছিল। ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনা সুরক্ষিত হলেও ইসরায়েল এখন পশ্চিম ইরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবি করছে। তাই সি-১৩০ বিমানে করে বিশেষ বাহিনী সেখানে পাঠিয়ে সাইটটি দখলের চেষ্টা ইসরায়েল করতে পারে।
ইসরায়েল এখন পড়ে গেছে উভয়সংকটে। তারা যদি হামলা বন্ধ করে, তাহলে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির কাজ আবার শুরু করবে। তখন তাদের আবার বোমাবাজি শুরু করতে হবে।
এমা গ্রাহাম-হ্যারিসন গার্ডিয়ানের মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান সংবাদদাতা
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ: জাভেদ হুসেন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ধ ব স কর ইসর য় ল আরও ব ইসর য র ইসর
এছাড়াও পড়ুন:
৩৫৬ কোটি টাকা কি পানিতে গেল
দেশের ১৪টি জেলায় ডাকব্যবস্থাকে আধুনিক ও গতিশীল করার লক্ষ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার (এমপিসি) নির্মাণ করেছিল। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এই সেন্টারগুলো কার্যত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে, শতকোটি টাকার সরঞ্জাম পরিণত হয়েছে ‘ভাগাড়ে’। এভাবে জনগণের অর্থ অপচয়ের প্রকল্প খুবই হতাশাজনক। এ প্রকল্প কেন ব্যর্থ হলো, কারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এখন।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২৮৯ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৩ ধরনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মতো প্রধান সেন্টারগুলোতেও অনেক সরঞ্জাম এখনো বাক্সবন্দী বা অযত্নে পড়ে আছে। মেটাল ডিটেক্টর, আর্চওয়ে গেট, ট্রলি, এক্স-রে গুডস—সবকিছুই অব্যবহৃত। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও একই চিত্র। ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম—সবখানেই কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অলস পড়ে আছে, অনেকগুলো আবার নষ্ট, যা পচনশীল পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ একটি সরঞ্জাম চিলার চেম্বার, সেটিরও কোনো ব্যবহার নেই।
সার্ভিস সেন্টারগুলো চালু না হওয়ার কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে সফটওয়্যারের অভাব এবং দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। স্মার্ট পোস্টেজ সলিউশন (এসপিএস) চালুর জন্য সফটওয়্যার না দেওয়ায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা ৪২০ সেট হার্ডওয়্যারও অব্যবহৃত। এমনকি এই এসপিএস প্যাকেজ এমপিসি প্রকল্পের অধীনে কেনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, কারণ এটি মূলত ডাকঘরের পার্সেল ও ই-কমার্স সেবার জন্য কেনা হয়েছিল। এটি কি কেবলই ভুল পরিকল্পনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেছে? সম্ভাব্যতা যাচাই ও চাহিদার মূল্যায়ন না করায় এ প্রকল্পটির এমন বেহাল পরিণতি হলো। এখানে সরঞ্জাম কেনার পেছনে বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ, যার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি।
ডাক বিভাগের ওয়েবসাইটে এমপিসি সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকা এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট জবাব না পাওয়ার বিষয়টিতে স্পষ্ট হয়, এখানে জবাবদিহির চরম অভাব ছিল। প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁরাই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কাছে অবশ্যই জানতে চাওয়া হোক কেন বিপুল ব্যয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করার পর এর বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হলো না? কেন অদরকারি সরঞ্জাম কেনা হলো?
জনগণের টাকার এমন অপচয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে এই এমপিসি প্রকল্পের একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। কারা এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী, কেন শতকোটি টাকার সরঞ্জাম অকেজো হয়ে পড়ে আছে এবং কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব, তা খুঁজে বের করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।