ঔপনিবেশিক রীতিনীতি ও অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা
Published: 21st, June 2025 GMT
সরকারি কর্মচারীদের বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট, যদিও চর্চাটি ঠিক এর উল্টো। সার্ভেন্টরা তো মাস্টারদেরই ‘স্যার’ বা ‘মহোদয়’ সম্বোধন করবেন, কিন্তু দেখা যায় প্রতিটি দপ্তরে সেবা নিতে আসা নাগরিককে উল্টো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘স্যার’ সম্বোধন করতে হয়। ব্রিটিশরা নেটিভদের যা শিখিয়েছে তা নিজেদের দেশে তারা চর্চা করে না, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিলেতি-মার্কিনি কেউই শিক্ষকদেরও ‘স্যার’ সম্বোধন করেন না। নাম ধরেই ডাকেন। আমাদের দেশে অনেক সম্বোধনই অতিরঞ্জিত। এ পর্যন্ত যা শুনে এসেছি ‘মহামান্য’ কিংবা নাটক-সিনেমায় আদালতের দৃশ্যে যা দেখে এসেছি ‘ধর্মাবতার’, ‘মি লর্ড’– এ সবই ঔপনিবেশিক যুগের ‘হিজ এক্সেলেনসি’, ‘হার ম্যাজেসটি’ কিংবা ‘হার রয়্যাল হাইনেস’ এসব সম্বোধনের অনুরণন। এগুলো টিকে আছে কমনওয়েলথের ছায়ায়, কোথাও কোথাও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের চর্চায়। আমাদের দেশে রাজতন্ত্র যেমন নেই, নেই অত্যাচারের প্রতীক জমিদারি-তালুকদারিও। উপনিবেশও নেই, রয়ে গেছে উপনিবেশের ভূত অথবা প্রেতাত্মা।
কেবল পদ-পদবির কারণে এ দেশে জনগণ ও জনসেবকদের মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস সৃষ্ট ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর, তৎপরবর্তী ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কমিশনার পদবিগুলো নিঃসন্দেহে ঔপনিবেশিক। অনেকে তীব্র আপত্তি তুলেছেন ডেপুটি কমিশনারের বাংলা কী করে হয় ‘জেলা প্রশাসক’?
সার্বিক রাষ্ট্র পরিচালনার একটি অংশ হচ্ছে আইন ও বিচার ব্যবস্থা। সেখানে এখনও কোনোই সংস্কার হয়নি। বিগত সরকারের ১৫ বছরে এবং তারও আগে ঔপনিবেশিক ধারার অনুকরণে একটার পর একটা নিবর্তনমূলক আইন (বিশেষ নিরাপত্তা আইন, সন্ত্রাস দমন আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি) প্রণীত হয়েছে। এই আইনগুলো প্রণীত হয়েছিল রাষ্ট্রের সন্দেহজনক নাগরিকদের দমন করার উদ্দেশে। এইসব নিবর্তনমূলক আইন যাতে সরকারগুলো বানাতে না পারে তার কোনো সাংবিধানিক ব্যবস্থা না থাকায় এটি সম্ভব হয়েছিল।
যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারগুলো ক্ষমতায় আসে তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ মধ্যবর্তী সময়ে দেখা না গেলে সে সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনার আইনগত বিধান সংবিধানে থাকা জরুরি। এমন ব্যবস্থা ছিল না বলে হাসিনা সরকার চরম কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত হতে পেরেছিল। আমরা ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের শিকার হয়ে তার জন্য যে ব্রিটিশকে এ যাবৎকাল সমালোচনা করে এসেছি, সেই ব্রিটেনেও জনগণ তাদের ক্ষমতা উপভোগ করতে পারে– যা আমাদের দেশের জনগণ চিন্তাও করতে পারে না। এ জন্যই বরিস জনসনের সরকারকে মধ্যবর্তী সময়ে বিদায় নিতে হয়েছিল।
ঔপনিবেশিক শাসন পাততাড়ি গোটালেও তার চর্চা রয়ে গেছে সর্বত্র, যার পুরো ফায়দা লুটছেন দেশের আমলারা। বাংলাদেশের সংবিধানে আইন আগাগোড়াই প্রণীত হওয়ার কথা পার্লামেন্ট তথা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা। কিন্তু সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের ওপর যে আদেশ-বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন বা আইনগত কার্যকারিতাসম্পন্ন অন্যান্য চুক্তিপত্র (এস.
জনগণকে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বসবাসের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। এটিই অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট। স্পিরিটের সঙ্গে গতি বা স্পিডকেও যুক্ত করতে হবে (যতটা সম্ভব)। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর উপর্যুপরি চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে এবং নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ও আদায় করে নিয়েছে, তাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুযোগ হাতছাড়া হয় কিনা, সে শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন ড. ইউনূস সরকার বরাবর পেশ করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দেশের প্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে বিগত ৫৩ বছরে দুই ডজনের বেশি কমিশন ও কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং বিভিন্ন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছিল। সেগুলো প্রধানত দুটি কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও টেকসই হয়নি। প্রথমত, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব সুপারিশ গ্রহণ করেননি এবং যেসব সুপারিশ গ্রহণ করেছিলেন তার বাস্তবায়নে তারা আন্তরিক বা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, স্বার্থগত দ্বন্দ্বের জন্য সংশ্লিষ্ট আমলারা তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেননি (অধ্যায় চার, জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের আচরণগত ও দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার)।’ জুলাই অভ্যুত্থান ডাক দিয়ে যায়– রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা ও আমলারা জনমুখী, জনবান্ধব এবং জনগণের সেবক হয়ে উঠুন, যে প্রতিশ্রুতি আপনারা দিয়ে থাকেন রাজনীতির মাঠে কিংবা পরীক্ষা-
প্রশিক্ষণ-দপ্তরের সুশোভিত কক্ষে ও হলরুমে। দেশটা যে আপনাদের, আমাদের সবারই
অন্নদাতা জনগণের!
এ জনগণকে প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ দিতে যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল ৫ আগস্ট, ২০২৪-এ, তার বদৌলতেই রাজনীতিবিদরা খোলামেলা রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছেন, বৈষম্য নিরসনার্থে সরকারি কর্মকর্তারা অকল্পনীয়ভাবে ফিরে পেয়েছেন তাদের হারানো চাকরি এবং নজিরবিহীনভাবে অবসরোত্তর ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি।
গোলাম শফিক: কথাসাহিত্যিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ঔপন ব শ ক র জন ত হয় ছ ল র জন য আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
কোনো দলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হলে জোট হতে পারে: সারজিস আলম
আগামীর বাংলাদেশ এবং জনগণের স্বার্থ সামনে রেখে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়, তাহলে নির্বাচনী জোট হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এসসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
আজ সোমবার সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ নগরের একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। এনসিপির কমিটি গঠন উপলক্ষে ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার আহ্বায়ক এবং সদস্যসচিবের সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সারজিস আলম বলেন, ‘যদি তারা (রাজনৈতিক দল) জুলাই সনদ বাস্তবায়নে একমত থাকে, বিচারিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একমত থাকে, যদি তারা বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী এবং আওয়ামী ফ্যাসিস্টবিরোধী তাদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারে—এ বিষয়গুলোতে যদি আমরা ঐকমত্য হতে পারি, তাহলে জনগণের স্বার্থে অ্যালায়েন্স (নির্বাচনী জোট) হতে পারে। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা চলমান, তবে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’
আগামী নির্বাচনে এনসিপি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কাজ করছে জানিয়ে সারজিস আলম বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে যদি প্রতিটি ওয়ার্ডে এনসিপির আহ্বায়ক কমিটি থাকে, তাহলে ৩০০ আসনে শক্তিশালী প্রার্থী দিতে পারবেন। কমিটি গঠনের বিষয়ে কাজ চলছে।
আগামী সংসদ নির্বাচনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির (জাপা) অংশগ্রহণ করার কোনো অধিকার নেই উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে এনসিপি নেতা সারজিস আলম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এবং তাদের যারা দোসর জাতীয় পার্টি, তাদেরও আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো অধিকার নেই। এই জাতীয় পার্টির কত বড় সাহস, এই জিএম কাদেররা এবং এঁদের যারা সাঙ্গপাঙ্গ আছে, এরা যে খুনিদের দোসর এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ওই খুনিদের মদদদাতা, তার প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়। তারা যখন বলে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না! তাদের জন্মদাতা যে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ যে তাদের পেলেপুষে বড় করেছে, এর প্রমাণ তারা আবার নতুন করে দিচ্ছে। তাদের জাত চেনাচ্ছে। এই খুনিদের আগামীর বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অধিকার নেই।’
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব কি না, এমন প্রশ্নে সারজিস আলম বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন আমাদের শাপলা প্রতীক দিতে গিয়ে তারা তাদের জায়গা থেকে একটি লম্বা সময় স্বেচ্ছাচারিতা করেছে এবং কোনো আইনগত বাধা না থাকা সত্ত্বেও আমাদেরকে শাপলা না দিয়ে শাপলা কলি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে আমাদের জায়গা থেকে আহ্বান করব, তারা যদি ওই একই ধরনের আচরণ আগামী দিনে করে, তাহলে তাদের ওপর আস্থার সংকট তৈরি হবে। আমরা চাই, তারা সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠুভাবে তাদের প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন যে সাংবিধানিক অবস্থা, তা যেন বজায় রাখে। তারা যেন পূর্বের মতো কোনো দলীয় নির্বাচন কমিশনে পরিণত না হয়। যদি কারও ভেতর এমন চিন্তা বা চেষ্টা থাকে, তাহলে তাদের পরিণতি তাদের পূর্বসূরিদের মতো হবে।’
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব নাহিদা সারোয়ার, বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকিন আলম প্রমুখ।