কোনো মতেই পিআর পদ্ধতি মানবে না বিএনপি
Published: 12th, July 2025 GMT
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ কিংবা নিম্নকক্ষ নির্বাচন কোনো মতেই মানবে না বিএনপি। এ ছাড়া রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগসহ কোনো বিভাগকেই দুর্বল করার পক্ষে নয় দলটি।
সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিচার, নির্বাচনসহ সব বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল হাসান
সমকাল: সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক) নিয়ে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আপনাদের মতভেদ চলছে। এটা কেন, দ্বিমতের যুক্তিগুলো কী?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: অনেক যুক্তি। প্রথম যুক্তি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটা নতুন চিন্তা। আগে এর কোনো অভিজ্ঞতা কিংবা প্রচলনের ইতিহাস নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষ তার নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় একজন ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেখে অভ্যস্ত। যিনি তাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাঁকে দেখেই ভোট দেয়। একাধিক প্রতিনিধি মানুষের মধ্যে ভোটের আগ্রহ কমিয়ে দেবে এবং কার্যকরী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কোনো বিধানও এখানে নেই। একজন জনপ্রিয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি নির্বাচনে জয়লাভ করলেও কোথাও এমপি হতে পারবেন না। এ রকম বহুবিধ অসুবিধা আছে পিআর পদ্ধতিতে। এসব কারণে কোনো মতেই পিআর মানা সম্ভব না।
সমকাল: অন্য রাজনৈতিক দল কেন এই পদ্ধতিতে নির্বাচন চাচ্ছে?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: তারা মনে করছে, পিআর পদ্ধতিতে যদি নির্বাচন হয় তাহলে ভোটের শতকরা হিসাবে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এ দেশে সবচেয়ে বড় দল রেকর্ড ভোট হয়তো ৪০ শতাংশ পেয়েছে। সেই হিসাবেও পিআর পদ্ধতিতে ৩০০ আসনের মধ্যে ১২০ আসন পাবে। তাহলে সরকার গঠন করতে পারবে না। এ রকম জটিল অবস্থায় কোয়ালিশন সরকার গঠন হবে এবং ঝুলন্ত সংসদ হবে। এতে কোনো সরকারই দেশ পরিচালনা করতে পারবে না। কিন্তু ওই সব ক্ষুদ্র দল বা যারা জনগণের কম প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের সুবিধা হবে। তারা যদি ১০ ভাগ ভোট পায়, তাহলে ৩০টি আসন পাবে। কেউ ৫ ভাগ পেলে তারা ১৫টি আসন পাবে। এখন এসব দলের প্ররোচনায় যদি পিআর পদ্ধতি চালু হয়, তাহলে বাংলাদেশে সব সময় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যে অসুবিধাটা হবে, তাতে কি আমরা রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যেতে পারব?
সমকাল: কিন্তু ওই সব দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমরা একটা ফ্যাসিবাদকে হটিয়ে আরেকটা ফ্যাসিবাদকে আনতে চাই না। চলমান পদ্ধতিতে নির্বাচনে যদি বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পায়, তখন আবার আরেকটা ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে পারে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: রাজনীতি হচ্ছে নির্বাচনী কৌশল। আগামীতে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। এখন বিচার বিভাগ প্রায় স্বাধীন এবং দুদকের কার্যক্রম মোটামুটি দৃশ্যমান। এই অবস্থায় জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিলে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে সেটা জনগণের ইচ্ছা। এখানে তো আমাদের হস্তক্ষেপ করার কিছু নেই। সংবিধানে জনগণ হচ্ছে ক্ষমতার উৎস। সে ক্ষেত্রে তারা কি জনগণের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপরে হস্তক্ষেপ করার মতো বিষয় বিবেচনা করতে পারেন? একজন স্বৈরাচার হয়েছিল সেটা মাথায় রেখেই সব কিছু যদি আমরা সাজাতে থাকি, তাহলে তো সংসদীয় ব্যবস্থাই থাকে না। তাহলে তো নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করে, সেটাকে অকার্যকর করতে হয়। যে প্রবণতা এখন দেখছি। নির্বাহী বিভাগকে তার আইনের এবং সাংবিধানিক সীমানার মধ্যে থেকে কাজ করতে দিতে হবে। সে যেন সীমা লঙ্ঘন না করে। সংবিধানের তিনটা বিভাগ পরস্পর পরস্পরের ভারসাম্য হিসেবে কাজ করবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেলে কারোরই স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ থাকবে না। সরকার কাঠামো দুর্বল করে রাষ্ট্র কোনোভাবে এগোতে পারবে না।
সমকাল: সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির বিষয়ে আপনাদের সিদ্ধান্ত কী?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: আমরা উচ্চকক্ষের বিষয়ে আমাদের মতামত দিয়েছি। সেটা হচ্ছে, নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে হবে। যেভাবে সংরক্ষিত মহিলা আসন নির্ধারণ করা হয়। সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্য দিয়ে হতে হয়। উচ্চকক্ষে পিআর থাকলে সেটা কোনোদিনই হবে না। তখন অন্যদের বক্তব্য ছিল আমরা (বিএনপি) তো সংবিধান সংশোধন চাই না। কিন্তু সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। এটা ১০ বছর, ২০ বছর পরও সমাজের চাহিদার ভিত্তিতে, মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে পরিবর্তন হতে পারে এবং পরিবর্তন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সমকাল: উচ্চকক্ষ গঠন নিয়ে আপনাদের ভাবনাটা কী?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: উচ্চকক্ষে তারাই আসবেন যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রেখেছেন। সমাজের ও রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য, এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে যারা অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন সেই মানুষগুলোকে নিয়ে আসা হবে। সেই শ্রেণি-পেশার লোকজন বলতে এখানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ক্রীড়াবিদ, নারীদের প্রতিনিধিত্ব, মানবাধিকার কর্মী এবং বঞ্চিত বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। যাদের মেধা, প্রতিভা ও অবদান জাতিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। অর্থাৎ– ‘নেশন বিল্ডিং অ্যাক্টিভিটিস’-এর ক্ষেত্রে তাঁরা অবদান রাখবে। এই ধারণা থেকেই আমরা উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করেছিলাম।
সাধারণ দৃষ্টিতে আইন পাস হবে উচ্চকক্ষে। যদি পাস না করে বাধ্যবাধকতা নেই। তারা মতামত দিয়ে সুপারিশ নিম্নকক্ষে পাঠাবে। তবে উচ্চকক্ষের ক্ষমতার বিষয়ে যদি বিকল্প প্রস্তাব আসে তাহলে আমরা সেটা আলোচনার টেবিলে নিয়ে যেতে পারি।
সমকাল: পিআরসহ আরও কিছু ইস্যুতে আপনাদের সমমনা কিংবা যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো ভিন্নমত পোষণ করছে। এটা কী তাদের নিজস্ব অবস্থান, নাকি আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দরকষাকষির কৌশল মনে করছেন?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: এখানে দুটি বিষয় আছে। এর মধ্যে এসব দলেরও নিজস্ব কিছু আদর্শ আছে, কৌশল আছে। সেই ভিত্তিতে তারা কিছু কথা বলে। আরেকটা হচ্ছে, তাদের নিয়েই আমরা নির্বাচন করব, সরকার গঠন করব বলেছি। এখানে তাদের কিছু কিছু বিষয়ে হয়তো দরকষাকষির পাল্লাটা ভারী করার চেষ্টা আছে। এটাও রাজনৈতিক কৌশল।
সমকাল: বর্তমান পরিস্থিতিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাবনা কতটুকু?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: কারও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আদর্শ ভিন্ন থাকতে পারে। তাদের নির্বাচনী কৌশল ভিন্ন থাকতে পারে, কিন্তু আমরা এখন সাংবিধানিক পদ্ধতির মধ্যে আছি। সংবিধান অনুযায়ী সরকার চলছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হতে হবে। এখানে যদি কোনো দল সুবিধা করতে পারবে না মনে করে, তখন তারা বিভিন্ন ইস্যু তুলে হয়তো বলবে– নির্বাচনে যাব না। এটা তাদের স্বাধীনতা। ওই রকম রাজনৈতিক বক্তব্যকে খুব বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আমি দেখি না। কিছু কিছু দল হয়তো নির্বাচন হলে ১ ভাগ ভোট পাবে না। রাজনীতিতে জনমতের মূল্য সবচেয়ে বেশি। সেই হিসাবে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে জনমতই প্রাধান্য পাবে। আমরা খুবই আশাবাদী, এই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হবে।
সমকাল: সংস্কার, বিচার, তারপর নির্বাচন– চলমান এই বিতর্ক কীভাবে দেখছেন?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: সংস্কার বলতে কী বোঝায় তা তারা স্পষ্ট করছে না। সংস্কার কমিশনে এসে তারা তাদের বক্তব্য দিচ্ছে। কিছু কিছু প্রস্তাবে তারা আপত্তি জানাচ্ছে। আর বিচারের বিষয় হলো– এর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্য নিশ্চিত করতে হবে। যাতে সব পক্ষই সুবিচার পায় এবং সেটা নিশ্চিত করতে গেলে কিছু সময় লাগবেই। বিচারের জন্য সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না। বিচার বিচারের মতো চলবে। কিন্তু বিচার না হলে নির্বাচনে যাব না– এটা খুব অপরিপক্ব কথা। যারা এগুলো বলছে, তারা নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে বলছে। কিন্তু জনগণই শেষ বিচারক। তাদের কাছে সেই আবেদন কতটুকু পৌঁছায়, সেটা দেখতে হবে।
সমকাল: বিএনপির মিত্র দল জামায়াত ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে নির্বাচনী কোনো সমঝোতা হতে পারে বলে মনে করেন কিনা?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী জোট গঠনের সম্ভাবনা নেই। অতীতে কৌশলগত কারণে আমরা জামায়াতের সঙ্গে জোট করেছি; কিন্তু এবার প্রয়োজন অনুভব করছি না। বিএনপি এখন মূলত সেই দলগুলোর সঙ্গে জোট ও জাতীয় সরকার গঠনে মনোযোগী, যারা একযোগে আন্দোলনে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক জোট নিয়ে আলোচনা চলবে। কী হয় তা সময়ই বলে দেবে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী কৌশল অবলম্বন করে এবং কার সঙ্গে সমঝোতা করে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সেখানে এনসিপির বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সমকাল: আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী?
সালাহউদ্দিন আহমেদ: আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো, তারা এখন রাজনৈতিক দল হিসেবে অস্তিত্বহীন। আওয়ামী লীগ অনেক বছর আগেই তার রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়েছে। তারা একটা মাফিয়া সংগঠন হিসেবে, অগণতান্ত্রিক শক্তি ও ফ্যাসিস্ট শক্তি হিসেবে নিজেদের রূপান্তর ঘটিয়েছে। তাদের ইতিহাসের মধ্যে কখনও গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। এই ফ্যাসিস্টদের আবার ফেরার পথ সুগম হবে না। ফ্যাসিস্টবিরোধী যেসব দল ছিল, যারা আন্দোলন করেছে; তাদের সেই ঐক্য নষ্ট হওয়ার কারণে বিভিন্ন ইস্যুতে পরাজিত ফ্যাসিস্ট সামনে আসছে; কিন্তু তারা সফল হবে না।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সালাহউদ্দিন আহমেদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ল হউদ দ ন আহম দ ব এনপ স ল হউদ দ ন আহম দ সরক র গঠন ন ম নকক ষ র জন ত ক আপন দ র র র জন র জন য সব দল অবদ ন ব এনপ আসন প সমক ল
এছাড়াও পড়ুন:
অনেকে বলেন দামারি বিল, কেউ কেউ নাম দিয়েছেন ‘আরেক রাতারগুল’, সিলেটে গেলে ঘুরে আসতে পারেন এই জায়গা
দিনভর ভ্যাপসা গরম ছিল। বিকেলে মেঘে মেঘে আকাশ ঢেকে গেল। দলছুট মেঘ জমাট বাঁধতে না বাঁধতেই দূর থেকে বয়ে আসা বাতাসে ভেসে এল বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। এমনই বিকেলে রওনা হলাম দামারি হাওরে। অনেকে একে বলেন দামারি বিল, কেউ কেউ নাম দিয়েছেন আরেক রাতারগুল।
বছর পাঁচেক আগে এই হাওরের জলে পা ভিজিয়েছি, ঘটা করে পুরো হাওর ঘুরে দেখেছি। শুকনা মৌসুমেও মোটরবাইক নিয়ে হাওরের মাঝখানে গিয়েছি অনেকবার। শুষ্ক কিংবা বর্ষা—দামারির রূপের যেন শেষ নেই। তাই হাওরকে এবার দেখতে চাইলাম অন্য চোখে, অন্যভাবে।
‘দামারি হাওরে’ আধা ডুবো হয়ে আছে হিজল-করচগাছ