জুলাই গণঅভ্যুত্থান: সিরাজগঞ্জে ৪ আগস্ট নিহত হয় ২৯ জন
Published: 4th, August 2025 GMT
২০২৪ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল প্রেক্ষাপটে যখন দেশ স্বপ্ন দেখছিল মুক্তির, ঠিক তার আগের দিন ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের পুরো জেলায় ঘটে যায় বিভীষিকাময় ঘটনা। আন্দোলনে অংশ নেয়া নিরীহ ছাত্র-জনতাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। সেই আন্দোলনে সিরাজগঞ্জে প্রাণ হারায় ১৫ পুলিশ সদস্যসহ ২৯ জন। এক বছর পেরিয়ে গেলেও স্বজনরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। অভিযুক্তরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। উদ্ধার হয়নি হামলায় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রও।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জ জেলা উত্তাল হয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিছু হঠে। শহরের এস এস রোডে অবস্থিত আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়া আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষ শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলিতে প্রথম মারা যায় জেলা যুবদলের সহ-সম্পাদক সোহানুর রহমান রঞ্জু খান। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্রদলকর্মী সুমন সেখ ও বিএনপিকর্মী আব্দুল লতিফের মৃত্যু হয়। এ খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কিছু সময়ের মধ্যে এনায়েতপুরে গুলিতে শিক্ষার্থী শিহাব আহম্মেদ ও সিয়াম হোসেন এবং তাঁত শ্রমিক ইয়াহিয়া আলীসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপরই এনায়েতপুর থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুট করা হয়। হামলাকারীদের মারধরে ১৫ পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়।
একই সময়ে রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। নেতাকর্মীরা রায়গঞ্জ প্রেস ক্লাবে আশ্রয় নেন। সেখানে মারধরে এক সাংবাদিক ও পাঁচজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়। এছাড়া এমপি হেনরীর বাসা থেকে দুই ছাত্রলীগকর্মী পৌরসভার গয়লা মহল্লার আসিফ ও জানপুরের শাহিনের পোড়া কংকাল উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
আরো পড়ুন:
চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২
আশুলিয়ায় উল্টো পথে চলা রিকশাকে চাপা দিল লরি, নিহত ৩
বিকেলে সিরাজগঞ্জ শহরের মুজিব সড়কে অবস্থিত সিরাজগঞ্জ-২ আসনের এমপি ড.
থানা ও কোর্ট পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলায় মোট ৯টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় ৪টি, এনায়েতপুর থানায় আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় ৩টি এবং ১৫ পুলিশ হত্যা ও থানায় হামলা এবং অস্ত্র লুটের ঘটনায় ১টি এবং উল্লাপাড়া থানায় ১টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া হাটিকুমরুল থানায় হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা ৬৭২। অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ৫ থেকে ৬ হাজার।
এর বাইরে অতীতের ঘটনার জেরে এবং গত এক বছরে নানা সময়ের ঘটনা মিলে জেলায় মোট ২৯টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, সাবেক এমপি ড. জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক এমপি তানভীর ইমাম, সাবেক এমপি চয়ন ইসলাম, সাবেক এমপি ডা. আব্দুল আজিজ, জেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবু ও উল্লাপাড়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সেলিনা মির্জা মুক্তি ও সিরাজগঞ্জ বারের সাবেক পিপি অ্যাড. আব্দুর রহমানসহ ১৬৩ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ পর্যন্ত কাজিপুর ও সলঙ্গা থানায় দায়ের হওয়া দুটি মারামারি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। এনায়েতপুরে গুলিতে নিহত ৩ জনের পরিবারের আপত্তির কারণে তাদের ময়নাতদন্ত হয়নি।
জেলায় জুলাই যোদ্ধা হিসেবে শহীদদের তালিকাভুক্ত হয়েছেন ১৩ জন। তাদের মধ্যে ৬ জনের ঢাকায় এবং সিরাজগঞ্জে ৭ জনের মৃত্যু হয়। জেলায় আহতদের মধ্যে জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন ৫২৪ জন।
এনায়েতপুর থানায় নিহত ১৫ পুলিশ সদস্যরা হলেন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক, এস.আই রইস উদ্দিন খান, তহছেনুজ্জামান, প্রনবেশ কুমার বিশ্বাস, নাজমুল হোসাইন, আনিসুর রহমান মোল্লা, এএসআই ওবায়দুর রহমান, কনস্টেবল আব্দুস সালেক, হাফিজুর ইসলাম, রবিউল আলম শাহ, হুমায়ন কবির, আরিফুল ইসলাম, রিয়াজুল ইসলাম, শাহিন উদ্দিন ও হানিফ আলী।
জেলায় ১৩ জন জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তরা হলেন, সিরাজগঞ্জের আন্দোলনে নিহত জেলা যুবদলের যুগ্ম-সম্পাদক সোহানুর রহমান রঞ্জু খান, ছাত্র সুমন সেখ, চা বিক্রেতা আব্দুল লতিফ, ভ্যান চালক শিহাব উদ্দিন, ছাত্র শিহাব আহম্মেদ, ছাত্র সিয়াম হোসেন ও তাঁত শ্রমিক ইয়াহিয়া আলী প্রামানিক। এ ছাড়াও সিরাজগঞ্জ জেলায় বসবাসকারীদের ঢাকায় আন্দোলনে শহীদরা হলেন ব্যবসায়ী সুজন মাহমুদ, ছাত্র অন্তর ইসলাম, স্যানেটারি মিস্ত্রি জাহাঙ্গীর হোসেন, রিকশাচালক মো. লেবু, নৌ বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ও পোশাককর্মী নজরুল ইসলাম।
রায়গঞ্জ উপজেলায় নিহত ৬ জন হলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সরওয়ার লিটন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মেহেদি হাসান ইলিয়াস, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-আমিন সরকার, ব্রহ্মগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম হোসেন টিটু, রায়গঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর আলম এবং রায়গঞ্জ প্রেস ক্লাবের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা প্রদীপ কুমার ভৌমিক। এই ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
এনায়েতপুর ও হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে এখনো ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এ দুটি মামলায় এ পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই দুটি থানার কার্যক্রম বর্তমানে ভাড়া করা ভবনে চলছে।
এনায়েতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনারুল ইসলাম জানান, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট এনায়েতপুর থানায় হামলা, ভাঙচুর, অস্ত্র লুট ও ১৫ পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রউফ জানান, ৪ আগস্ট থানায় হামলা, ভাঙছুর ও ২৫টি বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র লুট করা হয়। এরমধ্যে ১৭টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হলেও এখনো ৮টি আগ্নেয়ান্ত্র উদ্ধার হয়নি। এই মামলায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন ও জুলাই অভ্যুত্থান ২০২৪ হতাহতদের তালিকা যাচাই-বাছাই জেলা কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. নুরুল আমিন জানান, এ পর্যন্ত জেলায় বসবাসকারী ১৩ জন জুলাই শহীদ ও ৫২৪ জন জুলাই যোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন শহীদ ও ৪৪৮ জন জুলাই যোদ্ধার নাম ইতিমধ্যে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়েছে। বাকিরা অপেক্ষমাণ রয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে কাজিপুর ও সলঙ্গা থানায় দায়ের হওয়া দুটি মারামারি মামলার চার্জশিট হয়েছে। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে।
পুলিশ আরও বলেন, নিহত পুলিশ সদস্যদের চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় মারা গেলে সরকারি বিধান মতে প্রাপ্ত অনুদান ১৪ পুলিশ সদস্যকে প্রদান করা হয়েছে। বাকি একজনের অনুদান ওয়ারিশ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এখনো দেওয়া হয়নি। তবে তিনিও অনুদান পাবেন।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, ইতিমধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জুলাই শহীদরা ১০ লাখ টাকা করে সঞ্চয়পত্র পেয়েছেন। কিছু জুলাই যোদ্ধাদের ১ লাখ টাকা করে চেক দেওয়া হয়েছে। বাকিরা পরবর্তীতে পাবেন। এছাড়াও জেলা পরিষদের মাধ্যমে প্রতিজন শহীদ পরিবারকে দুই লাখ ও আহতদের ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শহীদ সুমনের বাবাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি অটোরিকশা সহায়তা করা হয়েছে। শহরের বাজার স্টেশন মুক্তির সোপানে ১৩ শহীদের নামে একটি করে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে।
জেলায় প্রথম জুলাই শহীদ জেলা যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক সোহানুর রহমান রঞ্জু খানের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে জেলা বিএনপি। গত (১ আগস্ট) দুপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু পৌরসভার মাছুমপুর মহল্লার সরুত মোড়ে শহীদ রঞ্জু খানের বাড়ির পাশে স্মৃতিস্তম্ভের উদ্বোধন করেছেন।
ঢাকা/রাসেল/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন হত গণঅভ য ত থ ন ১৫ প ল শ সদস য ল গ র ন ত কর ম আগ ন য় স ত র স র জগঞ জ দ য় র হওয় ছ ত র জনত স ব ক এমপ কর মকর ত জন জ ল ই র রহম ন র ঘটন য় র সদস য ৪ আগস ট ল ইসল ম র য়গঞ জ সরক র শহর র অবস থ ১৩ জন উপজ ল আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সকল শক্তির ঐক্য অটুট রাখতে হবে: সংস্কৃতি উপদেষ্টা
সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে লালন-পালন এবং ধারণ করতে এ অভ্যুত্থানের সকল শক্তির ঐক্য অটুট রাখতে হবে। বিভেদ, বিদ্বেষ কিংবা বৈষম্যের সৃষ্টি হলে তা ফ্যাসিবাদের ফিরে আসার উপলক্ষ তৈরি করতে পারে।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান- বিক্ষুব্ধ কবি-লেখক সমাজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, ‘‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে একটি কালচারাল ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে, যা এর প্রেক্ষাপট, প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতাকে অমলিন ও অটুট রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের মনন ও বোধকে ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক ধারা নির্মাণ করবে।’’
সভায় বক্তৃতা করেন গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, কবি রায়হান জহির, ফারুক খান, তানজিম তানিম, কাজল রশীদ শাহীন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আনাসের মা সানজিদা খান দীপ্তি প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অবদানের জন্য কবিদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।
ঢাকা/এএএম//