যুদ্ধেও মানবিকতা মহানবী (সা.) অনন্য শিক্ষা
Published: 6th, August 2025 GMT
মহানবী (সা.) ১৪০০ বছর আগে যুদ্ধের এমন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ইসলামের মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই নিয়মগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিরক্ষামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসামরিক নাগরিক, সম্পত্তি ও পরিবেশের সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। চলুন, আমরা একবার নজর বুলিয়ে আসি।
কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গিপবিত্র কোরআন যুদ্ধের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে। সুরা হজ্জের ৪০-৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কারণ তাদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে.
এই আয়াতে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের অনুমতির কথা বলা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ইসলাম পালনের স্বাধীনতা রক্ষা করা। এটি সর্বজনীন ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিও ইসলামের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। ফলে এখানে মন্দির, গির্জা, সিনাগগ এবং মসজিদের সুরক্ষার বিষয়টিও স্পষ্ট করা হয়েছে।
আরও পড়ুনযুদ্ধ না করেও যিনি শহীদ২৪ জুলাই ২০২৫মহানবী (সা.)-এর যুদ্ধের নিয়মমহানবী (সা.) যুদ্ধক্ষেত্রে আচরণের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম প্রদান করেছিলেন, যা মানবিকতা ও নৈতিকতার একটি উচ্চ মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছিল। তিনি যুদ্ধে বলা যায় কয়েকটি বাতলে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ৬টি এমন:
১. বিশ্বাসঘাতকতা নিষিদ্ধ: যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা বা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া নিষিদ্ধ।
২. মৃতদেহের অবমাননা নিষিদ্ধ: শত্রুর মৃতদেহের অঙ্গচ্ছেদ বা অবমাননা করা যাবে না।
৩. শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের হত্যা নিষিদ্ধ: এদের উপর কোনো আক্রমণ করা যাবে না।
৪. গাছের ক্ষতি নিষিদ্ধ: ফলদায়ক গাছ পোড়ানো বা ধ্বংস করা নিষিদ্ধ।
৫. পশুদের হত্যা নিষিদ্ধ: খাদ্যের প্রয়োজন ছাড়া শত্রুপক্ষের পশুদের হত্যা করা যাবে না।
৬. সন্ন্যাসীদের উপর আক্রমণ নিষিদ্ধ: যারা ধর্মীয় জীবনের জন্য নিবেদিত, তাদের অব্যাহতি দেওয়া হবে।
(ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নববিয়্যাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০০৪, খণ্ড ২, পৃ. ২৩৪-২৩৬)
যদি আল্লাহ কিছু মানুষের দ্বারা অন্যদের প্রতিহত না করতেন, তবে মঠ, গির্জা, সিনাগগ এবং মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেত।সুরা হজ্জ, আয়াত: ৪০-৪১অন্যান্য নিয়মগুলো, যেমন শত্রুর সঙ্গে চুক্তি রক্ষা করা, বন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করা, অ-যোদ্ধাদের সম্পত্তি রক্ষা করা, এবং অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ না করা, বিভিন্ন হাদিসে ছড়িয়ে আছে (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৩১; সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২৬১৩)।
এই নিয়মগুলোর মধ্য দিয়ে যুদ্ধে মানবিক আচরণের একটি সম্পূর্ণ কাঠামো পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনখন্দকের যুদ্ধ ইতিহাসে অমর০৬ অক্টোবর ২০২৪উসামা বিন জায়েদের ঘটনানবীজি (সা.)-এর যুদ্ধের নিয়মের বাস্তব প্রয়োগ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায় দেখা যায়। উসামা বিন জায়েদ একজন শত্রু সৈনিকের সঙ্গে মল্ল যুদ্ধে জয়ী হন। সৈনিকটি ক্ষমা প্রার্থনা করে ‘কালেমা’ পড়লেও উসামা তার কথা উপেক্ষা করে তাকে হত্যা করেন। কারণ, তার ধারণা ছিল, সৈনিকটি সত্যিকার অর্থে মুসলিম হতে নয়, বরং মৃত্যুর ভয়ে কালেমা পড়েছে।
এই ঘটনা জানার পর মহানবী (সা.) উসামার এই কাজকে ইসলামে যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে বলে তিরস্কার করেছেন। কেননা, ক্ষমা প্রার্থনা করে কালেমা পড়ার পর সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করা উচিত ছিল, কারণ তার বুক চিড়ে তো দেখা সম্ভব নয় যে, সে মিথ্যা বলেছে কি না। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪২৯৭)
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানবিক আচরণনবীজি (সা.)-এর পরে তাঁর অনুসারীরা এই নিয়মগুলো কঠোরভাবে পালন করেছিলেন। খলিফা উমর (রা.) এবং পরবর্তীকালে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুসালেমে সে–সকল ইহুদির যথাযোগ্য অধিকার দিয়ে ফিরিয়ে দেন, যারা খ্রিষ্টান শাসনের অধীনে ছিল নিপীড়িত। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০১২, খণ্ড ৭, পৃ. ৫৬-৫৮)
ক্ষমা প্রার্থনা করে কালেমা পড়ার পর সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করা উচিত ছিল, কারণ তার বুক চিড়ে তো দেখা সম্ভব নয় যে, সে মিথ্যা বলেছে কি না।যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মুসলিমদের আচরণও উল্লেখযোগ্য ছিল। ইসলামের ‘সমালোচক’ স্যার উইলিয়াম ম্যুর স্বীকার করেছেন যে, বন্দীদের ভালোভাবে খাওয়ানো হতো এবং তাদের মুক্তিপণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারিত হতো। দরিদ্র বন্দীদের জন্য মুক্তিপণ হিসেবে দশজন ছেলেকে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। (ম্যুর, ডব্লিউ., দ্য লাইফ অব মুহাম্মদ, লন্ডন, ১৮৬১, পৃ. ৩৪৫)
মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর যুদ্ধের নিয়ম ইসলামের মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর বর্ণিত নিয়ম শুধু বেসামরিক নাগরিক, সম্পত্তি এবং পরিবেশের সুরক্ষা নয়, বরং শান্তির জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার নির্দেশ দিয়েছে। এই নিয়মগুলো ইসলামের শান্তি ও ন্যায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতির প্রতীক হিসেবে আজও প্রাসঙ্গিক।
আরও পড়ুনইসলামের দ্বিতীয় যুদ্ধ ওহুদের শিক্ষা২৪ মে ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র স রক ষ বন দ দ র কর ছ ল ন ইসল ম র র জন য ম নব ক
এছাড়াও পড়ুন:
এশিয়া কাপে আচরণবিধি ভঙ্গের শাস্তি পেলেন রউফ-সূর্যকুমারসহ পাঁচজন
এশিয়া কাপ-২০২৫ এ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ঘিরে উত্তেজনা কেবল মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, পৌঁছে গেছে শৃঙ্খলাজনিত ব্যবস্থাতেও। খেলোয়াড়দের আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় এবার শাস্তির মুখে পড়েছেন দুই দেশের কয়েকজন তারকা ক্রিকেটার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) সূর্যকুমার যাদব ও হারিস রউফের ওপর জরিমানা ও ‘ডিমেরিট পয়েন্ট’ আরোপ করেছে। আর ভারতীয় পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ পেয়েছেন আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা।
আইসিসির এলিট প্যানেল অব ম্যাচ রেফারিরা সেপ্টেম্বর ১৪, ২১ ও ২৮ তারিখে অনুষ্ঠিত ভারত-পাকিস্তান ম্যাচগুলোর কয়েকটি ঘটনার তদন্ত করেন।
প্রথমবার, সেপ্টেম্বর ১৪:
প্রথম ম্যাচেই মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ওই ম্যাচে ভারতের সূর্যকুমার যাদব এবং পাকিস্তানের হারিস রউফ ও সাহিবজাদা ফারহানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় আইসিসির আচরণবিধির ২.২১ অনুচ্ছেদ ভঙ্গের দায়ে। যেখানে বলা আছে, এমন আচরণ যা খেলাটির সুনাম ক্ষুণ্ন করে।
ফলাফল হিসেবে সূর্যকুমারকে জরিমানা করা হয় ম্যাচ ফি’র ৩০ শতাংশ এবং দেওয়া হয় দুই ডিমেরিট পয়েন্ট। ফারহান পান আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা ও এক ডিমেরিট পয়েন্ট। রউফের শাস্তিও একই; ৩০ শতাংশ জরিমানা ও দুই ডিমেরিট পয়েন্ট।
দ্বিতীয়বার, সেপ্টেম্বর ২১:
এক সপ্তাহ পরের ম্যাচে আবার বিতর্ক। ভারতীয় পেসার অর্শদীপ সিং অভিযুক্ত হন আইসিসির ২.৬ অনুচ্ছেদে, “অপমানজনক ভঙ্গি প্রদর্শনের” অভিযোগে। তবে ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফটের শুনানিতে প্রমাণ না মেলায় তিনি মুক্তি পান। কোনো শাস্তি হয়নি তার।
ফাইনালের উত্তেজনা, সেপ্টেম্বর ২৮:
এশিয়া কাপের ফাইনালও ছাড় পায়নি শৃঙ্খলাভঙ্গের ছোঁয়া থেকে। ভারতের জাসপ্রিত বুমরাহ স্বীকার করেন যে তিনি খেলাটির মর্যাদাবিরোধী আচরণ করেছেন। ফলে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করা হয় ও দেওয়া হয় এক ডিমেরিট পয়েন্ট। যেহেতু তিনি অপরাধ স্বীকার করেছিলেন, তাই আলাদা শুনানির প্রয়োজন হয়নি।
অন্যদিকে, হারিস রউফ আবারও জড়িয়ে পড়েন একই ধরনের ঘটনায়। ম্যাচ রেফারি রিচি রিচার্ডসনের শুনানিতে দোষী প্রমাণিত হয়ে তিনি আবার জরিমানা পান ম্যাচ ফি’র ৩০ শতাংশ এবং আরও দুই ডিমেরিট পয়েন্ট। এতে তার মোট ডিমেরিট পয়েন্ট দাঁড়ায় চার। যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞায় ফেলে। ফলে নভেম্বর ৪ ও ৬ তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পাকিস্তানের দুইটি ওয়ানডে থেকে ছিটকে গেলেন তিনি।
আইসিসির নিয়ম অনুযায়ী, লেভেল–১ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ম্যাচ ফি জরিমানা এবং দুই ডিমেরিট পয়েন্ট পর্যন্ত দেওয়া যায়। কোনো খেলোয়াড় যদি ২৪ মাসের মধ্যে চার বা তার বেশি ডিমেরিট পয়েন্ট পান, তবে তা রূপান্তরিত হয় সাসপেনশন পয়েন্টে। অর্থাৎ পরবর্তী ম্যাচে নিষেধাজ্ঞা অবশ্যম্ভাবী।
এশিয়া কাপে শাস্তিপ্রাপ্ত খেলোয়াড়দের তালিকা:
সূর্যকুমার যাদব (ভারত): ম্যাচ ফি’র ৩০% জরিমানা, ২ ডিমেরিট পয়েন্ট।
সাহিবজাদা ফারহান (পাকিস্তান): আনুষ্ঠানিক সতর্কবার্তা, ১ ডিমেরিট পয়েন্ট।
হারিস রউফ (পাকিস্তান): দুই আলাদা অপরাধে দু’বার জরিমানা, মোট ৪ ডিমেরিট পয়েন্ট ও ২ ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা।
জাসপ্রিত বুমরাহ (ভারত): সতর্কবার্তা, ১ ডিমেরিট পয়েন্ট।
অর্শদীপ সিং (ভারত): অভিযোগ থেকে মুক্ত, কোনো শাস্তি নয়।
এশিয়া কাপের মাঠে যেমন ব্যাট-বল লড়াই জমেছিল, মাঠের বাইরে ঠিক তেমনই শৃঙ্খলাভঙ্গের নাটকও কম আলোচনার জন্ম দেয়নি। ক্রিকেটের সৌন্দর্য রক্ষায় এবার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে আইসিসি- “খেলা উত্তেজনার হতে পারে, কিন্তু সীমা অতিক্রম নয়।”
ঢাকা/আমিনুল