সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পাকিস্তান-আফগানিস্তান শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়। এটি একটি শোচনীয় বাস্তবতাকে তুলে ধরছে। আফগান তালেবানের পররাষ্ট্রনীতি এখনো সেই একই বিচ্ছিন্নতা ও একগুঁয়েমির মধ্যে আটকে আছে। এই নীতিই দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানকে একঘরে ও অস্থিতিশীল করে রেখেছে।

একটি আন্দোলন বহু দশকের যুদ্ধের পর ‘স্থিতিশীলতা’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; কিন্তু আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপে অনীহার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। এটি তালেবানের দেখার দৃষ্টি ও শাসনক্ষমতার ব্যর্থতাকে তুলে ধরে।

পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আত্তাউল্লাহ তারারের মন্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন, আফগানপক্ষ মূল বিষয় থেকে সরে আসছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইসলামাবাদ সীমান্তে সন্ত্রাস কমানোর জন্য দৃঢ় নিশ্চয়তা চেয়েছিল। কিন্তু আফগান প্রতিনিধিদল এই প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। হয় এটি ইচ্ছাকৃত অস্বীকার, নয়তো আফগান মাটিতে কার্যরত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে তালেবানের অক্ষমতা।

কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় আয়োজিত ইস্তাম্বুল সংলাপটি সীমান্ত সংঘাতের পর তালেবান-পাকিস্তান সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল; কিন্তু সীমান্ত আক্রমণ বন্ধে পরিকল্পনা গ্রহণে অনীহা দেখিয়ে তালেবান কার্যত সেই সুযোগকে নষ্ট করেছে।

আরও পড়ুনতালেবান, দেওবন্দ এবং ভারতের ‘ধর্মীয় কূটনীতি’১৮ অক্টোবর ২০২৫

তালেবানের পররাষ্ট্রনীতিতে সংকীর্ণতা ও প্রতিরক্ষামূলক জাতীয়তাবাদের ছাপ স্পষ্ট। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার বদলে কাবুল সরকার কূটনীতিকে ব্যবহার করেছে তাদের সশস্ত্র নীতির সম্প্রসারণ হিসেবে।

এটি কেবল আত্মহানিকর নয়, আফগানিস্তানের অস্তিত্বের জন্যও বিপজ্জনক। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, খাদ্যনিরাপত্তা–সংকটের মুখোমুখি এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিহীন একটি রাষ্ট্র, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীকে বিরক্ত করতে পারে না।

পাকিস্তান বহু দশক ধরে ১০ লাখের বেশি আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। আফগানিস্তানকে বাণিজ্যিক পথ ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশ্ব যাতে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, সে জন্য পাকিস্তান বারবার আন্তর্জাতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে।

পাকিস্তানের এই সদিচ্ছার প্রতিদান না দিয়ে তালেবান নেতৃত্ব নিজেদের মাটিকে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দিচ্ছে। টিটিপির হামলায় এ পর্যন্ত কয়েক হাজার পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন। এই গোষ্ঠী পাকিস্তানে ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠা ও কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন চালু করতে চায়।
এ ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী থেকে দূরে না থাকতে পারাটা শুধু পাকিস্তানের আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়; বরং আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও বৈধতা নিয়েও বেপরোয়া জুয়াখেলা।

ইস্তাম্বুলে তালেবানের সামনে সুযোগ ছিল প্রাপ্তবয়স্ক আচরণ করার; কিন্তু তারা হঠকারিতার পথ বেছে নিল। এই সিদ্ধান্তের মূল্য বহন করতে হবে সাধারণ আফগান ও পাকিস্তানিদের যাঁরা, চাইলেই এড়ানো যায়, এমন আরেকটি যুদ্ধের ছায়ায় বসবাস করছেন। আর এর মূল্য দিতে হবে তালেবান সরকারকে। কেননা, বেইজিং আর মস্কো, শেষ বন্ধু দুজন যে তালেবানের ওপর ধৈর্য হারাচ্ছে।

তালেবান নেতৃত্ব এটা বুঝতে পারছে না যে তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে দেখছে না; বরং প্রতিটি আঞ্চলিক শক্তি যাচাই করছে যে একটি সার্বভৌম সরকার হিসেবে তালেবান কতটা দায়িত্বশীল আচরণ করছে।

চীন খুব সতর্কতার সঙ্গে আফগানিস্তানের খনি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে। তালেবান সরকার উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় দেশটি খুবই উদ্বিগ্ন। এসব গোষ্ঠী চীনা নাগরিক এবং পাকিস্তানে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড মহাপ্রকল্পের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া জাতিগত উইঘুরদের সশস্ত্র সংগঠন ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট চীনের পশ্চিমাঞ্চল জিনজিয়াংকে স্বাধীন করার পথ খুঁজছে।

২০২৩ সালে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে ‘চীন, আফগানিস্তান ও গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বেইজিং তালেবানকে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

আরও পড়ুনতালেবান ও আরএসএস যে ইস্যুতে এক১৫ অক্টোবর ২০২৫

এ বছরের জানুয়ারি মাসে ন্যাশনাল মবিলাইজেশন ফ্রন্ট নামে আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই গোষ্টী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খনিতে কাজ করা একজন চীনা নাগরিককে হত্যা করে।

বেইজিং তালেবানের সঙ্গে লেনদেনভিত্তিক ও বাস্তবমুখী সম্পর্ক রাখছে; কিন্তু সেটি শর্তের বাইরে নয়। সীমান্ত পার হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় চীন মনে করতে পারে যে, আফগানিস্তান এখনো বড় ধরনের বিনিয়োগের জন্য খুব অস্থিতিশীল।

রাশিয়া সম্প্রতি তালেবানের সঙ্গে নীরব কূটনীতিতে জড়িত হয়েছে। পশ্চিমা প্রভাব ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে রাশিয়া আফগানিস্তানকে একটি সম্ভাব্য বাফার অঞ্চল হিসেবে মনে করছে। এখন ক্রেমলিনের ধৈর্যও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

আফগানিস্তানের মাটি থেকে জঙ্গিবাদ বিস্তার হয়ে মধ্য এশিয়ায় ছড়ালে সেটি মস্কোর নিরাপত্তা হিসাবনিকাশ পাল্টে দেয়। এমন একটি সরকার, যেটি নিজেদের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে বা আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে অক্ষম, সেটিকে কখনো নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখবে না রাশিয়া।

আরও পড়ুনআফগানিস্তান ও শরিয়াহ প্রসঙ্গ: আমার শিক্ষক মামুনুল হকের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন০১ অক্টোবর ২০২৫

সংক্ষেপে—তালেবানের এই অবাধ্যতা কেবল পাকিস্তান থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করছে না; বরং ২০২১ সালে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তান যে সামান্য বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছে, সেটিও ক্ষুণ্ণ করছে। বিশ্ব এখানে পরিষ্কার বার্তা পাচ্ছে। আফগানিস্তান এমন একটি রাষ্ট্র নয়, যেটি দায়িত্বশীল আচরণ করতে প্রস্তুত; বরং তালেবান হচ্ছে এমন একটি আন্দোলন যেটা এখনও অতীতের বিদ্রোহী মানসিকতায় আটকে আছে।

পাকিস্তান বহু বছর ধরে আফগান সীমান্ত এলাকা থেকে ছড়ানো সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে, তবু সংঘর্ষের চেয়ে কূটনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। দোহা, ইস্তাম্বুল আলোচনা এরই অংশ। তবে ধৈর্যেরও সীমা আছে। আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিমান হামলা কোনো যুদ্ধ ঘোষণা নয়; বরং একটি সতর্কবার্তা। আর সেই সতর্কবার্তা হলো, অবাধ আগ্রাসন দীর্ঘ সময় সহ্য করা হবে না। এর পরও ইসলামাবাদ স্পষ্ট করেছে যে কূটনীতি এখনো তাদের প্রধান পথ।

আরও পড়ুনডুরান্ড লাইনের দুদিকে ভূরাজনৈতিক ট্র্যাজেডিতে পাকিস্তান১৬ অক্টোবর ২০২৫

পাকিস্তানের জন্য এখন সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হলো দৃঢ়তার সঙ্গে দূরদর্শিতা বজায় রাখা। কেবল সামরিক পদক্ষেপ নিরাপত্তা দিতে পারবে না, যদি তা ধারাবাহিক কূটনীতি ও আঞ্চলিক সমঝোতার সঙ্গে মিলিত না হয়; কিন্তু সেই কূটনৈতিক পথ কার্যকর করতে হলে আফগানিস্তানকে প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে তারা সক্ষম ও ইচ্ছুক এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে।

ইস্তাম্বুলে তালেবানের সামনে সুযোগ ছিল প্রাপ্তবয়স্ক আচরণ করার; কিন্তু তারা হঠকারিতার পথ বেছে নিল। এই সিদ্ধান্তের মূল্য বহন করতে হবে সাধারণ আফগান ও পাকিস্তানিদের যাঁরা, চাইলেই এড়ানো যায়, এমন আরেকটি যুদ্ধের ছায়ায় বসবাস করছেন। আর এর মূল্য দিতে হবে তালেবান সরকারকে। কেননা, বেইজিং আর মস্কো, শেষ বন্ধু দুজন যে তালেবানের ওপর ধৈর্য হারাচ্ছে।

মাজহার সিদ্দিক খান, পাকিস্তানের আইনজীবী
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন র র পরর ষ ট র সন ত র স ক টন ত র জন য ন একট সরক র ণ করত ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

নারীর সম্মানহানি ও সাইবার বুলিংয়ের পেছনের রাজনীতি

বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই আগের বছরের চেয়ে সহিংসতার শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা মনে হয় বাড়তে থাকে।

গত ১৩ অক্টোবরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন নারী (৭৬ শতাংশ) তাঁদের জীবনে অন্তত একবার জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতা।

এর প্রায় অর্ধেক নারী (৪৯ শতাংশ) গত এক বছরে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই জরিপে নন-পার্টনার (সঙ্গী নয় এমন ব্যক্তি ও সত্তা) দ্বারা সহিংসতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ নারী প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত নির্দিষ্ট কিছু জেন্ডারভিত্তিক (লৈঙ্গিক) সহিংসতার (টেকনোলজি-ফ্যাসিলিয়েটেড জেন্ডার-বেজড ভায়োলেন্স) শিকার হয়েছেন, যা যৌন ব্ল্যাকমেল, ছবি নিয়ে অপব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত।

আরও পড়ুনরাজনীতি থেকে কি হারিয়ে যাবেন নারীরা০১ অক্টোবর ২০২৫

নির্দ্বিধায় বলা যায়, সমাজের যেকোনো স্তরের, যেকোনো পেশার নারীই বাস্তবে বা অনলাইনে সংঘটিত এ ধরনের জেন্ডারভিত্তিক আক্রমণের শিকার হয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক কালে একজন নারী গণমাধ্যমকর্মীর আত্মহত্যার ঘটনায় একই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘বাজে আচরণের’ মতো গুরুতর অভিযোগ আনেন তাঁদেরই সহকর্মী। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষকও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন কিছুদিন ধরে।

শারীরিকভাবে আঘাত না করেও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নারীদের সম্মানহানি ও বুলিং করার এই প্রবণতাকে বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না; বরং এর পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে বুঝতে হবে। ফরাসি নারীবাদী ও সমাজতাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত দ্য সেকেন্ড সেক্স বইটি আধুনিক নারীবাদী চিন্তার অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ, যা নারী-পুরুষ সম্পর্কের সামাজিক, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ভিত্তি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়।

একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করা সম্ভব যে সৌন্দর্যের কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড নেই। কিন্তু বর্তমান সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কেবল নির্দিষ্ট ওজন, চেহারা, বয়স, ও ত্বকের রংকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে বহু বছর ধরে। বহু নারী সেই মানদণ্ড পূরণের চেষ্টায় সময়, অর্থ ও শক্তি ব্যয় করেন, যার ফলে তাঁরা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টার পরিবর্তে নিজের দেহকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনের বস্তুতে পরিণত করে ফেলে নিজের অজান্তেই।

বইটির কেন্দ্রীয় তত্ত্ব হলো ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠেন।’ অর্থাৎ নারী-পুরুষের পার্থক্য কেবল জৈবিক নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দ্বারা সেটি নির্মিত হয়ে থাকে। সব জায়গায় পুরুষকে ‘মানুষ’ বা ‘সর্বজনীন সত্তা’ হিসেবে দেখা হয়েছে; আর নারীকে দেখা হয়েছে সেই পুরুষের তুলনায় ‘অন্য’, ‘অধীন’ বা ‘বিচ্যুত’ সত্তা হিসেবে। তিনি লিখেছেন: ‘হি ইজ দ্য সাবজেক্ট, হি ইজ দ্য অ্যাবসলিউট—শি ইজ দ্য আদার’ (পুরুষ হলেন কর্তা, পুরুষ হলেন পরম—নারী হলেন অপর)। এর কারণ হলো, শৈশব থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় কীভাবে ‘নারীসুলভ’ হতে হয়—কোমলতা, আনুগত্য ও সংবেদনশীলতার মাধ্যমে।

অপর দিকে ছেলেদের শেখানো হয় কীভাবে ‘পুরুষালি’ হতে হয় রাগ, আত্মনির্ভরতা ও কর্তৃত্বশীলতার মাধ্যমে। অথচ একজন নারীর যেমন স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন, একজন পুরুষের তেমনি সংবেদনশীল হওয়া ততটাই জরুরি। কিন্তু তার পরিবর্তে ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ বা ‘বিষাক্ত ব্যাটাগিরি’র দুষ্ট চক্রে যেমন পুরুষদের আবদ্ধ করে ফেলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তেমনি নারীদের জীবনের ব্রতও হয়ে ওঠে ‘অন্যের জন্য বাঁচা’।

এই অসম সামাজিক প্রক্রিয়ায় পুরুষ নিজেকে ‘সাবজেক্ট’ (কর্তাসত্তা) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, আর নারীকে করে ‘অবজেক্ট’ (অধীন সত্তা) হিসেবে। এই সামাজিকীকরণের ফলে মেয়েরা নিজেদের অস্তিত্বকে পুরুষের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে শেখেন, যা তাঁদের আত্মচেতনার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে বোভোয়ারের মূল তত্ত্ব হলো ‘অস্তিত্ববাদী স্বাধীনতা’, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ নিজের জীবনের অর্থ নিজেই নির্ধারণ করবে এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করবে, যা মূলত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সামাজিক সমান সুযোগ ছাড়া অসম্ভব।

সিমোন দ্য বোভোয়ার যেমন সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী-পুরুষের জৈবিক পার্থক্যকে ব্যবহার করে নারীকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখার কৌশলের কথা বলেছেন, পরবর্তী সময় ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ–বিশ্লেষক সিলভিয়া ওয়ালবিও তাঁর থিওরাইজিং প্যাটরিয়ার্কি (১৯৯০) বইয়ে পিতৃতন্ত্রকে (প্যাটরিয়ার্কি) কেবল নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য নয়; বরং একটি জটিল সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখিয়েছেন, যা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মিত ও কার্যকর হয়ে থাকে। তিনি বলেন, নারীর ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ একক নয়; বরং এটি ছয়টি পরস্পর-সংযুক্ত কাঠামো বা সিক্স প্যাটরিয়ার্কাল স্ট্রাকচারসের মাধ্যমে বজায় থাকে, যা পিতৃতন্ত্রকে অর্থনীতি, পরিবার, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত একটি বহুস্তরীয় সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে। ছয়টি কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি কীভাবে পিতৃতান্ত্রিকতাকে ধারণ ও পুনরুৎপাদন করে, সেটি ব্যাখ্যা করা যাক। 

ওয়ালবি যুক্তি দেন, রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোও পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধে গঠিত। অর্থাৎ এগুলো দেখতে ‘সাধারণ’ বা ‘সবার জন্য’ মনে হলেও বাস্তবে পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার বা নারীদের অধীন অবস্থায় রাখার প্রয়াস চলমান থাকে। যেমন গত ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক তরুণীকে পোশাক নিয়ে হেনস্তা করা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। একই সঙ্গে পোস্টটিতে ‘কারও পোশাক দৃষ্টিকটু লাগলে যথাস্থানে অভিযোগ জানাতে’ আহ্বান জানানো হয়েছে। এমনকি কিছুদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে উত্ত্যক্তকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে থানায় ঢুকে যেভাবে ভিডিও–সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ও জামিন লাভের পর পুলিশের সামনেই তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে, সেটা রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার, আমাদের জন্য হতাশার।

আরও পড়ুনপোশাক বদলালেই কি বদলে যাবে দৃষ্টিভঙ্গি২৬ জুলাই ২০২৫

ওয়ালবি একে বলেন ‘দ্বৈত রাষ্ট্রীয় চরিত্র’ (ডুয়েল ক্যারেক্টার অব দ্য স্টেট)। অপর দিকে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও পিতৃতন্ত্রকে পুনরুৎপাদন করে থাকে বলে ওয়ালবি আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, পিতৃতন্ত্রকে সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে টিকিয়ে রাখে এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। কারণ, এটি মানুষের চিন্তা, মান ও আচরণের ভেতরে পুরুষ আধিপত্যকে ‘স্বাভাবিক’ করে তোলে। আমরা যদি বাংলাদেশের মিডিয়া, বিশেষত টেলিভিশন, সিনেমা, বিজ্ঞাপনগুলো পর্যবেক্ষণ করি, সেখানে দেখব—নারীর শরীর, আবেগ ও ভূমিকাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেখানে নরম, কোমলতা আর আনুগত্যের মিশেলে ‘আদর্শ’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ নারীকেও যেমন বারবার চিত্রায়ণ করা হয়। 

অপর দিকে নারীর সক্রিয় বা ক্ষমতাধর ভূমিকাগুলোকে প্রায়ই ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে দেখানো হয়। এ ছাড়া ওয়ালবির মতে, সংবাদমাধ্যম কেবল পিতৃতান্ত্রিক বার্তা বহন করে না; বরং তা নিজেই একটি পুরুষনিয়ন্ত্রিত কাঠামো। কেননা বেশির ভাগ মালিকানা, সম্পাদকীয় পদ ও নীতিনির্ধারণী জায়গাগুলো পুরুষের দখলেই থাকে। ফলে সংবাদমাধ্যম নারী-পুরুষের যে গল্প বলে, তা পুরুষের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোণ থেকেই মূলত নির্মিত হয়ে থাকে।

সমসাময়িক নারীবাদী লেখকেরাও পরবর্তী সময় দেহরাজনীতি ও সৌন্দর্যবাদ কীভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে নারীকে নিয়ন্ত্রণের সামাজিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সে প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। মার্কিন নারীবাদী লেখক ও সাংবাদিক নাওমি উলফ তাঁর দ্য বিউটি মিথ (১৯৯০) বইয়ে দেখান, আধুনিক সমাজে যখন নারীরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক অধিকারে অগ্রগতি অর্জন করছেন, তখন নতুনভাবে সৌন্দর্যের আদর্শ (বিউটি স্ট্যান্ডার্ডস) তাঁদের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উলফ বলেন, ‘সৌন্দর্যের মিথ’ হলো এমন একটি সাংস্কৃতিক কৌশল, যা নারীদের নিজের শরীর নিয়ে অনিশ্চয়তা ও অপরাধবোধে ভোগাতে বাধ্য করে।

অথচ একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করা সম্ভব যে সৌন্দর্যের কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড নেই। কিন্তু বর্তমান সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কেবল নির্দিষ্ট ওজন, চেহারা, বয়স, ও ত্বকের রংকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে বহু বছর ধরে। বহু নারী সেই মানদণ্ড পূরণের চেষ্টায় সময়, অর্থ ও শক্তি ব্যয় করেন, যার ফলে তাঁরা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টার পরিবর্তে নিজের দেহকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনের বস্তুতে পরিণত করে ফেলে নিজের অজান্তেই।

যত দিন পরিবারে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শুধু বাবা হবেন, ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুর প্রতি আচরণে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য হবে, স্কুলগুলো সঠিকভাবে জেন্ডারবিষয়ক শিক্ষা পড়ানো থেকে বিরত থাকবে, তত দিন ন্যূনতম পরিবর্তন ঘটানোও কঠিন হবে। 

উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জাতীয় নির্বাচনে দল ও প্রার্থীরা পোস্টার ব্যবহার করতে পারবেন না
  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের পদত্যাগ চাইলেন রাকসুর প্রতিনিধিরা
  • ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রেজিস্ট্রারের অপসারণ চায় রাকসু
  • সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতে হবে: ভূমি উপদেষ্টা
  • যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বহিষ্কার দাবি, ‘ষড়যন্ত্র’ বললেন শিক্ষক
  • রেজিস্ট্রারের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় আম্মার বললেন, ‘আমি রাকসুর নির্বাচিত জিএস’
  • ন্যূনতম ঐক্য না হলে নির্বাচন শঙ্কায় পড়বে
  • ‘ওই মানুষটা আমার মুখ চেপে ধরেছিল...’, ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা জানালেন নায়িকা
  • নারীর সম্মানহানি ও সাইবার বুলিংয়ের পেছনের রাজনীতি
  • মুন্সীগঞ্জে ৬৩ সহকারী শিক্ষকের বেতন হঠাৎ বন্ধ