সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে পাকিস্তান-আফগানিস্তান শান্তি আলোচনা ভেস্তে যায়। এটি একটি শোচনীয় বাস্তবতাকে তুলে ধরছে। আফগান তালেবানের পররাষ্ট্রনীতি এখনো সেই একই বিচ্ছিন্নতা ও একগুঁয়েমির মধ্যে আটকে আছে। এই নীতিই দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানকে একঘরে ও অস্থিতিশীল করে রেখেছে।

একটি আন্দোলন বহু দশকের যুদ্ধের পর ‘স্থিতিশীলতা’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল; কিন্তু আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপে অনীহার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। এটি তালেবানের দেখার দৃষ্টি ও শাসনক্ষমতার ব্যর্থতাকে তুলে ধরে।

পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আত্তাউল্লাহ তারারের মন্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন, আফগানপক্ষ মূল বিষয় থেকে সরে আসছিল। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইসলামাবাদ সীমান্তে সন্ত্রাস কমানোর জন্য দৃঢ় নিশ্চয়তা চেয়েছিল। কিন্তু আফগান প্রতিনিধিদল এই প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। হয় এটি ইচ্ছাকৃত অস্বীকার, নয়তো আফগান মাটিতে কার্যরত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে তালেবানের অক্ষমতা।

কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় আয়োজিত ইস্তাম্বুল সংলাপটি সীমান্ত সংঘাতের পর তালেবান-পাকিস্তান সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল; কিন্তু সীমান্ত আক্রমণ বন্ধে পরিকল্পনা গ্রহণে অনীহা দেখিয়ে তালেবান কার্যত সেই সুযোগকে নষ্ট করেছে।

আরও পড়ুনতালেবান, দেওবন্দ এবং ভারতের ‘ধর্মীয় কূটনীতি’১৮ অক্টোবর ২০২৫

তালেবানের পররাষ্ট্রনীতিতে সংকীর্ণতা ও প্রতিরক্ষামূলক জাতীয়তাবাদের ছাপ স্পষ্ট। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার বদলে কাবুল সরকার কূটনীতিকে ব্যবহার করেছে তাদের সশস্ত্র নীতির সম্প্রসারণ হিসেবে।

এটি কেবল আত্মহানিকর নয়, আফগানিস্তানের অস্তিত্বের জন্যও বিপজ্জনক। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, খাদ্যনিরাপত্তা–সংকটের মুখোমুখি এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিহীন একটি রাষ্ট্র, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীকে বিরক্ত করতে পারে না।

পাকিস্তান বহু দশক ধরে ১০ লাখের বেশি আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে। আফগানিস্তানকে বাণিজ্যিক পথ ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। বিশ্ব যাতে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে, সে জন্য পাকিস্তান বারবার আন্তর্জাতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে।

পাকিস্তানের এই সদিচ্ছার প্রতিদান না দিয়ে তালেবান নেতৃত্ব নিজেদের মাটিকে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দিচ্ছে। টিটিপির হামলায় এ পর্যন্ত কয়েক হাজার পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন। এই গোষ্ঠী পাকিস্তানে ইসলামিক আমিরাত প্রতিষ্ঠা ও কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন চালু করতে চায়।
এ ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী থেকে দূরে না থাকতে পারাটা শুধু পাকিস্তানের আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়; বরং আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও বৈধতা নিয়েও বেপরোয়া জুয়াখেলা।

ইস্তাম্বুলে তালেবানের সামনে সুযোগ ছিল প্রাপ্তবয়স্ক আচরণ করার; কিন্তু তারা হঠকারিতার পথ বেছে নিল। এই সিদ্ধান্তের মূল্য বহন করতে হবে সাধারণ আফগান ও পাকিস্তানিদের যাঁরা, চাইলেই এড়ানো যায়, এমন আরেকটি যুদ্ধের ছায়ায় বসবাস করছেন। আর এর মূল্য দিতে হবে তালেবান সরকারকে। কেননা, বেইজিং আর মস্কো, শেষ বন্ধু দুজন যে তালেবানের ওপর ধৈর্য হারাচ্ছে।

তালেবান নেতৃত্ব এটা বুঝতে পারছে না যে তাদের পররাষ্ট্রনীতিকে কেউ বিচ্ছিন্নভাবে দেখছে না; বরং প্রতিটি আঞ্চলিক শক্তি যাচাই করছে যে একটি সার্বভৌম সরকার হিসেবে তালেবান কতটা দায়িত্বশীল আচরণ করছে।

চীন খুব সতর্কতার সঙ্গে আফগানিস্তানের খনি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে। তালেবান সরকার উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় দেশটি খুবই উদ্বিগ্ন। এসব গোষ্ঠী চীনা নাগরিক এবং পাকিস্তানে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড মহাপ্রকল্পের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া জাতিগত উইঘুরদের সশস্ত্র সংগঠন ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট চীনের পশ্চিমাঞ্চল জিনজিয়াংকে স্বাধীন করার পথ খুঁজছে।

২০২৩ সালে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে ‘চীন, আফগানিস্তান ও গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বেইজিং তালেবানকে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

আরও পড়ুনতালেবান ও আরএসএস যে ইস্যুতে এক১৫ অক্টোবর ২০২৫

এ বছরের জানুয়ারি মাসে ন্যাশনাল মবিলাইজেশন ফ্রন্ট নামে আরেকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবানের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই গোষ্টী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খনিতে কাজ করা একজন চীনা নাগরিককে হত্যা করে।

বেইজিং তালেবানের সঙ্গে লেনদেনভিত্তিক ও বাস্তবমুখী সম্পর্ক রাখছে; কিন্তু সেটি শর্তের বাইরে নয়। সীমান্ত পার হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় চীন মনে করতে পারে যে, আফগানিস্তান এখনো বড় ধরনের বিনিয়োগের জন্য খুব অস্থিতিশীল।

রাশিয়া সম্প্রতি তালেবানের সঙ্গে নীরব কূটনীতিতে জড়িত হয়েছে। পশ্চিমা প্রভাব ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে রাশিয়া আফগানিস্তানকে একটি সম্ভাব্য বাফার অঞ্চল হিসেবে মনে করছে। এখন ক্রেমলিনের ধৈর্যও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

আফগানিস্তানের মাটি থেকে জঙ্গিবাদ বিস্তার হয়ে মধ্য এশিয়ায় ছড়ালে সেটি মস্কোর নিরাপত্তা হিসাবনিকাশ পাল্টে দেয়। এমন একটি সরকার, যেটি নিজেদের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে বা আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে অক্ষম, সেটিকে কখনো নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখবে না রাশিয়া।

আরও পড়ুনআফগানিস্তান ও শরিয়াহ প্রসঙ্গ: আমার শিক্ষক মামুনুল হকের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন০১ অক্টোবর ২০২৫

সংক্ষেপে—তালেবানের এই অবাধ্যতা কেবল পাকিস্তান থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করছে না; বরং ২০২১ সালে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তান যে সামান্য বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছে, সেটিও ক্ষুণ্ণ করছে। বিশ্ব এখানে পরিষ্কার বার্তা পাচ্ছে। আফগানিস্তান এমন একটি রাষ্ট্র নয়, যেটি দায়িত্বশীল আচরণ করতে প্রস্তুত; বরং তালেবান হচ্ছে এমন একটি আন্দোলন যেটা এখনও অতীতের বিদ্রোহী মানসিকতায় আটকে আছে।

পাকিস্তান বহু বছর ধরে আফগান সীমান্ত এলাকা থেকে ছড়ানো সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে, তবু সংঘর্ষের চেয়ে কূটনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছে। দোহা, ইস্তাম্বুল আলোচনা এরই অংশ। তবে ধৈর্যেরও সীমা আছে। আফগানিস্তানে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বিমান হামলা কোনো যুদ্ধ ঘোষণা নয়; বরং একটি সতর্কবার্তা। আর সেই সতর্কবার্তা হলো, অবাধ আগ্রাসন দীর্ঘ সময় সহ্য করা হবে না। এর পরও ইসলামাবাদ স্পষ্ট করেছে যে কূটনীতি এখনো তাদের প্রধান পথ।

আরও পড়ুনডুরান্ড লাইনের দুদিকে ভূরাজনৈতিক ট্র্যাজেডিতে পাকিস্তান১৬ অক্টোবর ২০২৫

পাকিস্তানের জন্য এখন সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ হলো দৃঢ়তার সঙ্গে দূরদর্শিতা বজায় রাখা। কেবল সামরিক পদক্ষেপ নিরাপত্তা দিতে পারবে না, যদি তা ধারাবাহিক কূটনীতি ও আঞ্চলিক সমঝোতার সঙ্গে মিলিত না হয়; কিন্তু সেই কূটনৈতিক পথ কার্যকর করতে হলে আফগানিস্তানকে প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে তারা সক্ষম ও ইচ্ছুক এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে।

ইস্তাম্বুলে তালেবানের সামনে সুযোগ ছিল প্রাপ্তবয়স্ক আচরণ করার; কিন্তু তারা হঠকারিতার পথ বেছে নিল। এই সিদ্ধান্তের মূল্য বহন করতে হবে সাধারণ আফগান ও পাকিস্তানিদের যাঁরা, চাইলেই এড়ানো যায়, এমন আরেকটি যুদ্ধের ছায়ায় বসবাস করছেন। আর এর মূল্য দিতে হবে তালেবান সরকারকে। কেননা, বেইজিং আর মস্কো, শেষ বন্ধু দুজন যে তালেবানের ওপর ধৈর্য হারাচ্ছে।

মাজহার সিদ্দিক খান, পাকিস্তানের আইনজীবী
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আফগ ন স ত ন র র পরর ষ ট র সন ত র স ক টন ত র জন য ন একট সরক র ণ করত ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় যাত্রীকে তুলতে অস্বীকৃতি উবার চালকের

চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার জন্য সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবারের একটি গাড়ি ডেকেছিলেন মাইকেল। গাড়িটি আসার পর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যেতেই বাধল বিপত্তি। ‘অতিরিক্ত মোটা’ হওয়ায় চালক তাঁকে গাড়িতে তুলতে অস্বীকৃতি জানান। যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

গেমিং প্ল্যাটফর্ম টুইচের জনপ্রিয় স্ট্রিমার মাইকেল। ওই প্ল্যাটফর্মে তাঁর ৬০ হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। তিনি তাঁর কল অব ডিউটি গেমপ্লের জন্য পরিচিত।

মাইকেল সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। ভিডিওর শিরোনামে তিনি লিখেছেন, ‘আমি মজা করছি না। আমার উবার চালক বলেছেন, আমি নাকি অনেক বেশি মোটা। তাই তাঁর গাড়িতে আমাকে নেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি তিনি আমার দিকে বন্দুক তাক করার হুমকিও দিয়েছেন।’ মাইকেলের ওই ভিডিও পাঁচ কোটিবারের বেশি দেখা হয়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, মাইকেল উবারের গাড়িচালককে বলছেন, ‘আপনি এইমাত্র বললেন, আমি নাকি অনেক বেশি মোটা। আমি কিন্তু আপনার ভিডিও করছি।’ উত্তরে উবার চালক নারী বলেন, ‘এটা যুক্তি আর বাস্তবতার ব্যাপার। আর আমি এটা বলার অধিকার রাখি।’ কিন্তু বাক্যটি শেষ করার আগেই মাইকেল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘না, আপনি এটা বলতে পারেন না।’ তখন ওই নারী হাত উঁচিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি পারি। এটা আমার গাড়ি। আপনি এখান থেকে চলে যান।’

বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে ওই উবার চালক বলেন, ‘আপনি কি চান, আমি আমার বন্দুকটা বের করি?’ এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাইকেল গাড়ির দরজা বন্ধ করে সেখান থেকে চলে যান। এক্সে দেওয়া অন্য একটি পোস্টে মাইকেল বলেন, এ ঘটনার কারণে তিনি সেদিন চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেননি।

উবারের নীতি অনুযায়ী, চালকেরা বৈধ কারণ ছাড়া কোনো যাত্রীকে গাড়িতে তুলতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না। ওজন, লিঙ্গ, বর্ণ কিংবা ধর্মের ভিত্তিতে কোনো যাত্রীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

এই ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর উবার চালকের আচরণের তীব্র সমালোচনা করেছেন অনেকে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিফাক শব্দের অর্থ কী এবং মুনাফিকের লক্ষণগুলো কী
  • বৈষম্যের খাঁচা আদৌ কি আমরা ভাঙতে চাই
  • হবিগঞ্জে কনসার্টে বিশৃঙ্খলার পর নারীদের হেনস্তা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ
  • পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা ভিনগ্রহের বস্তু নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ইলন মাস্ক
  • অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় যাত্রীকে তুলতে অস্বীকৃতি উবার চালকের