হামলার শিকার মাজারগুলোর কোনোটির সময় ৫৬ বছরের বেশি। কোনোটি তিন দশক আগে গড়ে উঠেছে। কোনোটি পেরিয়েছে এক দশক। তবে কখনোই সেগুলোতে হামলার ঘটনার কথা শোনেননি এলাকার মানুষ। বৃহস্পতিবার হঠাৎ একের পর এক গ্রামের চার মাজারে হামলা দেখে বিস্মিত তাঁরা। একই সঙ্গে আতঙ্কিত নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আসাদপুর গ্রামে পৃথক চারটি মাজারে হামলার ঘটনা ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.

)-কে নিয়ে কটূক্তিমূলক একটি পোস্ট করার এক দিন পর এই হামলা হয়। যদিও বিতর্কিত পোস্ট করার অভিযোগ ওঠার পরই একটি মাজার পরিচালনায় যুক্ত ওই যুবককে গ্রেপ্তার করে মামলা দায়েরের পর কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

মাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁরা ভেবেছিলেন গ্রেপ্তারের মাধ্যমেই বিষয়টির সুরাহা হয়েছে। কিন্তু ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন উসকানি দিয়ে মাজারে হামলা করা হয়। হামলাকারী শুধু ভাঙচুরই করেনি, ঘটনার সময় লুটপাটও চালিয়েছে। নগদ টাকাসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনটি মাজারের খাদেম এবং আরেকটির ভক্তরা।

হামলার শিকার ওই চারটি মাজার হচ্ছে ওই গ্রামের আলেক শাহের বাড়িতে অবস্থিত তাঁর বাবা কফিল উদ্দিন শাহের মাজার, একই গ্রামের আবদু শাহের মাজার, কালাই (কালু) শাহের মাজার এবং হাওয়ালি শাহের মাজার। এর মধ্যে হাওয়া বেগম নামে এক নারী ‘হাওয়ালি শাহ’ মাজার পরিচালনা করেন। তবে সেখানে কোনো ব্যক্তি সমাহিত নেই, ওই বাড়িতে মাজারসদৃশ বস্তু ও ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে। কফিল উদ্দিনের ছেলে মহসিনের বিরুদ্ধে বুধবার সকালে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তিমূলক পোস্ট করার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় বুধবার তাঁকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার সকালে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, কফিল উদ্দিন শাহের মাজারে ভক্তদের ভিড়। হোমনা ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও মাজারে আগুনে দেওয়ার খবরে এসেছেন ভক্তরা। আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া আলেক শাহের বসতবাড়ি এবং ভাঙচুর হওয়া মাজারটি দেখতে এসেছেন নারীসহ গ্রামের মানুষজনও। তাঁদের সবাই এমন ঘটনায় হতবাক। তবে এই বাড়ি ও মাজার প্রাঙ্গণে আলেক শাহের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। বাকি তিনটি মাজারে গিয়েও দেখা গেছে ভক্তদের ভিড়। ওই সব মাজার প্রাঙ্গণে খাদেমসহ সংশ্লিষ্টদের দেখা গেছে। এ ছাড়া চারটি মাজারের সামনের এলাকায় পুলিশের অবস্থান দেখা গেছে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের পুরো গ্রামে টহল দিতে দেখা গেছে।

কফিল উদ্দিন শাহের মাজারে প্রায় ১৫ বছর কাজ করেন সিলেট সদরের বাসিন্দা শাহজাহান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটি প্রায় ৩০ বছরের পুরোনো মাজার। আলেক শাহ ও তাঁর তিন ছেলে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে একই বাড়িতে বসবাস করেন। ভক্তদের থাকার জন্য কক্ষও রয়েছে। তিনটি বসতঘর, একটি মোটরসাইকেল, খরের গাদাসহ সবকিছু পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মাজারে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে। দানবাক্সে থাকা টাকাসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই পরিবারের সদস্যরা এলাকা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হামলাকারীদের মধ্যে এলাকার বাইরের অনেক লোকও ছিল। আমাদের এলাকায় এমন ঘটনা আগে ঘটেনি। কেউ অন্যায় করলে তাঁর বিচার হবে। এখানে মাজার ও বসতবাড়ির কী অপরাধ?’
হাওয়ালি শাহ নামে পরিচিত মাজারটির পরিচালনাকারী হাওয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর ধরে বছরে একবার আসাদপুর বাজারসংলগ্ন স্থানে তৈরিকৃত এই ভান্ডারি আস্তানায় ভক্তদের জমায়েত হয়। দুর্বৃত্তরা আস্তানাটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। হামলাকারীরা আস্তানা থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে। চার লাখ টাকার বেশি রেখেছিলাম আস্তানার পাশে জায়গা কেনার জন্য। হামলাকারীরা কিছুই রেখে যায়নি।’

কালু শাহ মাজারের খাদেম এবং কালু শাহের নাতি এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর এই মাজারের ৫৬তম বার্ষিক ওরস হয়েছে। কোনো অপরাধ ছাড়াই এ মাজারে সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে তারা। দানবাক্স, স্টিলের আলমারি, ফ্যান, বড় ডেগ কিছুই রাখেনি। সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে।’

আরও পড়ুনমাইকে ঘোষণা দিয়ে কুমিল্লার ৪ মাজারে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ১২ ঘণ্টা আগে

হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসেছিলেন উপজেলার বড় ঘারমোড়া গ্রামের কৃষক আবদুল আউয়াল। তিনি বলেন, এই গ্রামে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মাজারে আসেন ভক্তরা। যে যার মতো করে ধর্ম পালন করে। এমন ঘটনা এর আগে কখনোই ঘটেনি।
আবদু শাহ মাজারের ৭০ বছর বয়সী খাদেম ওহাব মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, হামলাকারীদের তাণ্ডবে এক দশকের বেশি পুরোনো মাজারটির কিছুই রক্ষা হয়নি। এমন তাণ্ডব জীবনেও দেখেননি।

স্থানীয় আসাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. ডালিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দুই শতাধিক লোকজন চারটি মাজারে ভাঙচুর চালিয়েছে। এঁদের বেশির ভাগই তরুণ। যাওয়ার সময় খালি হাত দেখা গেলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর দা, বঁটি, লোহার পাইপ যে যা পেয়েছে, তা দিয়েই তাণ্ডব চালিয়েছে। এতে আশপাশের নারী ও শিশুরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সবাই পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চান।

কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তিমূলক পোস্ট করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরপরও এমন ঘটনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ঘটনায় কারা উসকানি ও ইন্ধন দিয়েছে, তাদেরও চিহ্নিত করা হবে। এসব ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক এমন ঘটন আল ক শ হ প স ট কর ম হ ম মদ আস ত ন ঘটন য় ন ঘটন ঘটন র

এছাড়াও পড়ুন:

উড়োজাহাজ খাতে প্রতিযোগিতায় স্বচ্ছতা ও বৈষম্য বিলোপের তাগিদ ইইউ রাষ্ট্রদূতের

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা বোয়িং এবং ইউরোপের এয়ারবাসের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে হঠাৎ এয়ারবাসের সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছিল। আর চলতি বছর পাল্টা শুল্কের দর–কষাকষির ইস্যুতে বোয়িং অন্যতম শর্ত হিসেবে সামনে এসেছে।

এমন এক প্রেক্ষাপটে ঢাকায় এক আলোচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার উড়োজাহাজ খাতে ব্যবসায় স্বচ্ছতা ও বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি সব পক্ষের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের তাগিদ দিয়েছেন। এই খাতে ‘অন্য অংশীদারদের’ তুলনায় ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাতে কম গুরুত্ব দেওয়া না হয়, সে বিষয়টি বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে বলেছেন।

মঙ্গলবার ঢাকায় ফ্রান্স-জার্মান দূতাবাসে ‘বাংলাদেশের এভিয়েশন গ্রোথ’ শীর্ষক এক আলোচনায় তিনি এ অভিমত দেন। আলোচনায় মাইকেল মিলার ছাড়াও যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জ্যঁ-মার্ক সেরে-শার্লে, জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লটজ এবং এয়ারবাসের কমার্শিয়াল সেলস ডিরেক্টর (চিফ রিপ্রেজেনটেটিভ, বাংলাদেশ) রাফায়েল গোমেজ নয়া অংশ নেন।

ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি এ দেশে এয়ারবাসের উপস্থিতির বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে জোর দিচ্ছি। আমি খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, স্বচ্ছতা এবং বৈষম্যহীনতার দীর্ঘদিনের আশ্বাস পূরণ করে এটিকে যেন বিমানের বহরকে আধুনিকীকরণ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ দেশের উড়োজাহাজ খাতে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিত।’

ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জ্যঁ-মার্ক সেরে-শার্লে বলেন, ফ্রান্স ও ইউরোপের উড়োজাহাজ শিল্পের কেন্দ্রে অবস্থান করছে এয়ারবাস। প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও উদ্ভাবনের অনন্য সমন্বয়ই এটিকে বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর এক বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই খাতে বাংলাদেশের বিকাশ পর্বে এয়ারবাস হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাঁর মতে, বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধনশীল সংযোগ ও ভৌগোলিক অবস্থান এই দেশকে আকাশপথে যোগাযোগের আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। বিমান বাংলাদেশের বহরে এয়ারবাস যুক্ত হলে এর স্থিতিশীলতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা আরও বাড়বে।

জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লটজ বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিমানের এখন প্রয়োজন আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব উড়োজাহাজ, যেখানে এয়ারবাস শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আকাশপথে যোগাযোগের আঞ্চলিক কেন্দ্র হওয়ার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য সব সময় পাশে থাকবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বাণিজ্যিক যোগ্যতার ভিত্তিতে ইইউর অর্থনৈতিক উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সুযোগ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা সবার জন্য সমান সুযোগ প্রত্যাশা করি। এর অর্থ হলো বাংলাদেশকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপারেটরদের অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের তুলনায় কম সুবিধা দেওয়া হবে না।
প্রসঙ্গত, বোয়িং ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ২৫টি উড়োজাহাজ বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে, আর এয়ারবাস দিয়েছে ১৪টির। এর মধ্যে রয়েছে ১০টি এ৩৫০ ও ৪টি এ৩২০ নিও।

সম্পর্কিত নিবন্ধ