সুরা মুহাম্মাদ আমাদেরকে এক অলৌকিক যাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে দুনিয়ার মায়াজাল থেকে শুরু করে আখিরাতের সত্যতা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে আল্লাহর অসীম রহমতের ছায়া। এই সুরার শেষ আয়াতগুলো (৩৬-৩৮) একটি বিশেষ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে: “আল্লাহ ধনী এবং তোমরা দরিদ্র”।
এটা জীবনের এক গভীর দর্শন।
সুরা মুহাম্মাদ মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলিমরা হুদায়বিয়ার সন্ধির পরের দিনগুলো পার করছে। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে যে, সুরা ফাতহের পর এই সুরা ‘কারে আল-গামিম’ (মক্কার কাছে এক স্থান) নামক স্থাকে অবতীর্ণ হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪১৭২)
এই সুরা মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিজয়ের পরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, কারণ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। ইমাম আলুসি বলেছেন, এই সুরা মুনাফিকদের সন্দেহ দূর করে এবং মুমিনদের ইমান বৃদ্ধি করে। (ইমাম আলুসী, রুহুল মা'আনি ফিত তাফসিরিল কুরআনিল আজিম, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৪১৫ হি.
আয়াতগুলো দুনিয়ার স্বরূপ বর্ণনা করে একটা ধাক্কা দিয়ে শুরু হয়: “নিশ্চয় দুনিয়ার জীবন কেবল ক্রীড়া ও কৌতুক।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬)
এই বর্ণনা দুনিয়াকে অবজ্ঞা করে না, বরং এর ক্ষণস্থায়িত্ব দেখিয়ে দেয়। দুনিয়া যেন শিশুদের খেলা—আনন্দময় কিন্তু অস্থায়ী। এর মোহে মত্ত হয়ে যাওয়া মানে আমাদের দায়িত্ব ভুলে যাওয়া। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় বা দানের ক্ষেত্রে, যখন মানুষ অর্থের জন্য পিছিয়ে যায়।
এই বর্ণনা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়া সৌন্দর্যের জন্য নয়, আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য। এক কবি বলেছেন, “যুবকের জীবনপ্রিয়তা তাকে অপমানিত করে... যদিও তার মধ্যে সাহস ও মর্যাদা থাকে”।
দুনিয়ার মায়ায় আটকে থাকলে আমরা শত্রুর সামনে দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু সত্যিকারের জীবন আখিরাতে, যেখানে আমাদের কাজের ফল পাব। এই শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য—দান করলে দুনিয়ার মোহ কমে, আখিরাতের দিকে হৃদয় ঝুঁকে যায়।
আরও পড়ুনব্যস্ত জীবনেও কোরআন খতমের কার্যকর কৌশল০৩ আগস্ট ২০২৫দ্বিতীয়: ইমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর পুরস্কারদুনিয়ার স্বরূপ বর্ণনার পর আসে উপায়: “আর যদি তোমরা ইমান আন এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে তোমাদের পুরস্কার দান করবেন।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬)
এখানে আগের আয়াতের নিষেধের (তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং সন্ধির আহ্বান করে বসো না, যখন তোমরাই প্রবল) সঙ্গে যুক্তি দেয়া হয়েছে যে ইমান ও তাকওয়া দুনিয়ার দুর্বলতা দূর করে এবং আল্লাহর পুরস্কার নিশ্চিত করে।
খ্যাতিমান তাফসিরকারক ইবনে আশুর বলেছেন, সন্ধির আহ্বান করার পিছনে অর্থের ভালোবাসা থাকতে পারে, কিন্তু ইমান ও তাকওয়া এই দুর্বলতা দূর করে দেয়। দরিদ্রকে দান করার মূলেও রয়েছে তাকওয়া অবলম্বন করা এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকা। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১২৩)
ইমান ছাড়া সকল কাজ অসম্পূর্ণ; তাকওয়া ছাড়া দান হৃদয়কে পরিষ্কার করে না। এই দুটি মিলে দানকে ইবাদত করে তোলে, যা আল্লাহর কাছে মর্যাদা বাড়ায়।
হাদিবিয়ার চুক্তির পর মুসলিমরা হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু ইমান ও তাকওয়ায় তারা অটল রয়েছিলেন। ফলে মক্কা বিজয় হয়েছে। তেমনি দান-সদকা যদি একনিষ্ঠ ইমানের সঙ্গে করা হয়, তাহলে তাতে সম্পদের ক্ষতি হয় না, বরং আখেরে লাভ হয়।
তৃতীয়: আল্লাহ তোমাদের সম্পদ চান নাআল্লাহর রহমতের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত এই আয়াতে: “আর তিনি তোমাদের সম্পদ চান না। যদি তিনি চাইতেন, তাহলে তোমাদের চাপ দিতেন তাহলে তোমরা কৃপণতা করতে আর তাতে তিনি তোমাদের বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দিতেন।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬-৩৭)
আল্লাহ জানেন মানুষের অর্থের প্রতি আকর্ষণ। তাই তিনি সবকিছু দাবি করেন না, বরং সামান্য অংশ (জাকাত, সাদাকা) চান।
কাতাদা বলেছেন, “আল্লাহ জানেন যে, অর্থ বের করলে হৃদয় থেকে গোপন বিদ্বেষ বের হয়ে যায়।” (ইমাম ইবনে কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯ খ্রি., খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৮৩)
ইবনে আশুর বলেছেন, এটি ফিতনার পথ বন্ধ করার মূল। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তুনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৩৪)
মদিনায় নবীজির সময় মুসলিমরা নবীজির অনুসরণ করে অর্থ দান করেছিলেন, কিন্তু মুনাফিকরা সন্দেহ করত। আল্লাহ তাদের অবস্থা বিবেচনা করে অল্প দাবি করেছেন। এই রহমত দেখিয়ে দানকে সহজ করে।
একজন দরিদ্র সাহাবী অল্প অর্থ দান করলেন, নবীজি (সা.) বললেন, “আল্লাহ তোমার মতো দরিদ্রের অল্প দানকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, কারণ এটি সত্যিকারের ত্যাগ”।
আরও পড়ুনযে দানে ত্যাগের অনুভূতি হয়, সেটিই প্রকৃত দান১১ ডিসেম্বর ২০২৪চতুর্থ: দানকারীই প্রথম লাভবান হয়আয়াতগুলো মুমিনদের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানায়: “তোমাদেরকে আহ্বান করা হচ্ছে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে। তোমাদের মধ্যে কেউ কৃপণতা করে, আর যে কৃপণতা করে সে তার নিজের প্রত কৃপণতা করে।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮)
এখানে আহ্বান দুই রকম: বাধ্যতামূলক (জাকাত) এবং উৎসাহমূলক (সাদাকা)। কার্পণ্যকারী নিজের প্রতিই কার্পণ্য করে, কারণ দানের লাভ তারই হয়।
ইবনে আশুর বলেছেন, কৃপণের সম্পদ শত্রুর হাতে পড়ে বা সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৪৫)
পঞ্চম: “আল্লাহ ধনী এবং তোমরা দরিদ্র”আল্লাহর ধন অসীম, আমাদের দারিদ্র্য সীমাবদ্ধ। ইবনে আশুর বলেছেন, আল্লাহের ধনাঢ্যতা সর্বব্যাপী ও চিরস্থায়ী, আমাদের দারিদ্র্য তাঁর সামনে সীমিত। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৫৬)
আল্লাহর আমাদের প্রয়োজন নেই, তাঁর দান আমাদের জন্যই। এই সত্যতা বুঝলে আমরা অহংকার থেকে মুক্ত হতে পারব। দান করলে আল্লাহর কাছে আমাদের হৃদয় ঐশ্বর্যবান হয়ে যায়।
ষষ্ঠ: সবিশেষ সতর্কতাসুরা শেষ হয় সতর্কতায়: “আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক সম্প্রদায়কে আনবেন, যারা তারপর তোমাদের মতো হবে না।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮)
ইসলাম ধারণকারীরা যদি ক্ষমতাহীন হয়, আল্লাহ অন্যকে বেছে নেবেন। নবীজি (সা.) এই আয়াত তিলাওয়াত করে সালমান ফারসী (রা.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, “যে জাতিই এমন হবে, তার জন্যই এই নিয়ম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৮৬)।
এই সুন্নাহ আমাদেরকে সতর্ক করে যে, দান ও ত্যাগের দায়িত্ব পালন না করলে আমরা হারিয়ে যেতে পারি।
সুরা মুহাম্মাদের এই আয়াতগুলো আমাদেরকে শেখায় যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, ইমান ও তাকওয়া তার মোহ থেকে মুক্ত করে, আল্লাহর রহমত দানকে সহজ করে, দানের লাভ দাতারই এবং আল্লাহ ধনী—আমরা তাঁর কাছে দরিদ্র।
এই শিক্ষা আজকের দুনিয়ায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে লোভ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। দান করে আমরা নিজেকে সমৃদ্ধ করি এবং সমাজকে একত্রিত করি। আল্লাহ আমাদেরকে এই পথে চলার তাওফিক দিন। আমীন।
আরও পড়ুনআল-আজিজ, যিনি ইজ্জত দান করেন২০ জুন ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ১৯৮৪ হ আম দ র দ র বল র প রস র জন য ম দ রক আহ ব ন র জ বন এই স র দ ন কর দর দ র সতর ক
এছাড়াও পড়ুন:
“আল্লাহ ধনী, তোমরা দরিদ্র”
সুরা মুহাম্মাদ আমাদেরকে এক অলৌকিক যাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে দুনিয়ার মায়াজাল থেকে শুরু করে আখিরাতের সত্যতা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে আল্লাহর অসীম রহমতের ছায়া। এই সুরার শেষ আয়াতগুলো (৩৬-৩৮) একটি বিশেষ নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে: “আল্লাহ ধনী এবং তোমরা দরিদ্র”।
এটা জীবনের এক গভীর দর্শন।
সুরা মুহাম্মাদ মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে। মুসলিমরা হুদায়বিয়ার সন্ধির পরের দিনগুলো পার করছে। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে যে, সুরা ফাতহের পর এই সুরা ‘কারে আল-গামিম’ (মক্কার কাছে এক স্থান) নামক স্থাকে অবতীর্ণ হয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪১৭২)
এই সুরা মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিজয়ের পরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, কারণ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। ইমাম আলুসি বলেছেন, এই সুরা মুনাফিকদের সন্দেহ দূর করে এবং মুমিনদের ইমান বৃদ্ধি করে। (ইমাম আলুসী, রুহুল মা'আনি ফিত তাফসিরিল কুরআনিল আজিম, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১২৩)
প্রথম: দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া-কৌতুকআয়াতগুলো দুনিয়ার স্বরূপ বর্ণনা করে একটা ধাক্কা দিয়ে শুরু হয়: “নিশ্চয় দুনিয়ার জীবন কেবল ক্রীড়া ও কৌতুক।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬)
এই বর্ণনা দুনিয়াকে অবজ্ঞা করে না, বরং এর ক্ষণস্থায়িত্ব দেখিয়ে দেয়। দুনিয়া যেন শিশুদের খেলা—আনন্দময় কিন্তু অস্থায়ী। এর মোহে মত্ত হয়ে যাওয়া মানে আমাদের দায়িত্ব ভুলে যাওয়া। বিশেষ করে যুদ্ধের সময় বা দানের ক্ষেত্রে, যখন মানুষ অর্থের জন্য পিছিয়ে যায়।
এই বর্ণনা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়া সৌন্দর্যের জন্য নয়, আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য। এক কবি বলেছেন, “যুবকের জীবনপ্রিয়তা তাকে অপমানিত করে... যদিও তার মধ্যে সাহস ও মর্যাদা থাকে”।
দুনিয়ার মায়ায় আটকে থাকলে আমরা শত্রুর সামনে দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু সত্যিকারের জীবন আখিরাতে, যেখানে আমাদের কাজের ফল পাব। এই শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য—দান করলে দুনিয়ার মোহ কমে, আখিরাতের দিকে হৃদয় ঝুঁকে যায়।
আরও পড়ুনব্যস্ত জীবনেও কোরআন খতমের কার্যকর কৌশল০৩ আগস্ট ২০২৫দ্বিতীয়: ইমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর পুরস্কারদুনিয়ার স্বরূপ বর্ণনার পর আসে উপায়: “আর যদি তোমরা ইমান আন এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে তোমাদের পুরস্কার দান করবেন।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬)
এখানে আগের আয়াতের নিষেধের (তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং সন্ধির আহ্বান করে বসো না, যখন তোমরাই প্রবল) সঙ্গে যুক্তি দেয়া হয়েছে যে ইমান ও তাকওয়া দুনিয়ার দুর্বলতা দূর করে এবং আল্লাহর পুরস্কার নিশ্চিত করে।
খ্যাতিমান তাফসিরকারক ইবনে আশুর বলেছেন, সন্ধির আহ্বান করার পিছনে অর্থের ভালোবাসা থাকতে পারে, কিন্তু ইমান ও তাকওয়া এই দুর্বলতা দূর করে দেয়। দরিদ্রকে দান করার মূলেও রয়েছে তাকওয়া অবলম্বন করা এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকা। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১২৩)
ইমান ছাড়া সকল কাজ অসম্পূর্ণ; তাকওয়া ছাড়া দান হৃদয়কে পরিষ্কার করে না। এই দুটি মিলে দানকে ইবাদত করে তোলে, যা আল্লাহর কাছে মর্যাদা বাড়ায়।
হাদিবিয়ার চুক্তির পর মুসলিমরা হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু ইমান ও তাকওয়ায় তারা অটল রয়েছিলেন। ফলে মক্কা বিজয় হয়েছে। তেমনি দান-সদকা যদি একনিষ্ঠ ইমানের সঙ্গে করা হয়, তাহলে তাতে সম্পদের ক্ষতি হয় না, বরং আখেরে লাভ হয়।
তৃতীয়: আল্লাহ তোমাদের সম্পদ চান নাআল্লাহর রহমতের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত এই আয়াতে: “আর তিনি তোমাদের সম্পদ চান না। যদি তিনি চাইতেন, তাহলে তোমাদের চাপ দিতেন তাহলে তোমরা কৃপণতা করতে আর তাতে তিনি তোমাদের বিদ্বেষভাব প্রকাশ করে দিতেন।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৬-৩৭)
আল্লাহ জানেন মানুষের অর্থের প্রতি আকর্ষণ। তাই তিনি সবকিছু দাবি করেন না, বরং সামান্য অংশ (জাকাত, সাদাকা) চান।
কাতাদা বলেছেন, “আল্লাহ জানেন যে, অর্থ বের করলে হৃদয় থেকে গোপন বিদ্বেষ বের হয়ে যায়।” (ইমাম ইবনে কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, দারু তাইবা, রিয়াদ, ১৯৯৯ খ্রি., খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৮৩)
ইবনে আশুর বলেছেন, এটি ফিতনার পথ বন্ধ করার মূল। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তুনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৩৪)
মদিনায় নবীজির সময় মুসলিমরা নবীজির অনুসরণ করে অর্থ দান করেছিলেন, কিন্তু মুনাফিকরা সন্দেহ করত। আল্লাহ তাদের অবস্থা বিবেচনা করে অল্প দাবি করেছেন। এই রহমত দেখিয়ে দানকে সহজ করে।
একজন দরিদ্র সাহাবী অল্প অর্থ দান করলেন, নবীজি (সা.) বললেন, “আল্লাহ তোমার মতো দরিদ্রের অল্প দানকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন, কারণ এটি সত্যিকারের ত্যাগ”।
আরও পড়ুনযে দানে ত্যাগের অনুভূতি হয়, সেটিই প্রকৃত দান১১ ডিসেম্বর ২০২৪চতুর্থ: দানকারীই প্রথম লাভবান হয়আয়াতগুলো মুমিনদের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানায়: “তোমাদেরকে আহ্বান করা হচ্ছে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে। তোমাদের মধ্যে কেউ কৃপণতা করে, আর যে কৃপণতা করে সে তার নিজের প্রত কৃপণতা করে।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮)
এখানে আহ্বান দুই রকম: বাধ্যতামূলক (জাকাত) এবং উৎসাহমূলক (সাদাকা)। কার্পণ্যকারী নিজের প্রতিই কার্পণ্য করে, কারণ দানের লাভ তারই হয়।
ইবনে আশুর বলেছেন, কৃপণের সম্পদ শত্রুর হাতে পড়ে বা সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৪৫)
পঞ্চম: “আল্লাহ ধনী এবং তোমরা দরিদ্র”আল্লাহর ধন অসীম, আমাদের দারিদ্র্য সীমাবদ্ধ। ইবনে আশুর বলেছেন, আল্লাহের ধনাঢ্যতা সর্বব্যাপী ও চিরস্থায়ী, আমাদের দারিদ্র্য তাঁর সামনে সীমিত। (মুহাম্মাদ আত-তাহির ইবনে আশুর, আত-তাহরির ওয়াত তানওয়ির, আদ-দারুত তুনুসিয়া, তিউনিস, ১৯৮৪ হি., খণ্ড: ২৪, পৃষ্ঠা: ১৫৬)
আল্লাহর আমাদের প্রয়োজন নেই, তাঁর দান আমাদের জন্যই। এই সত্যতা বুঝলে আমরা অহংকার থেকে মুক্ত হতে পারব। দান করলে আল্লাহর কাছে আমাদের হৃদয় ঐশ্বর্যবান হয়ে যায়।
ষষ্ঠ: সবিশেষ সতর্কতাসুরা শেষ হয় সতর্কতায়: “আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য এক সম্প্রদায়কে আনবেন, যারা তারপর তোমাদের মতো হবে না।” (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৩৮)
ইসলাম ধারণকারীরা যদি ক্ষমতাহীন হয়, আল্লাহ অন্যকে বেছে নেবেন। নবীজি (সা.) এই আয়াত তিলাওয়াত করে সালমান ফারসী (রা.)-এর কাঁধে হাত রেখে বলেছেন, “যে জাতিই এমন হবে, তার জন্যই এই নিয়ম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৭৮৬)।
এই সুন্নাহ আমাদেরকে সতর্ক করে যে, দান ও ত্যাগের দায়িত্ব পালন না করলে আমরা হারিয়ে যেতে পারি।
সুরা মুহাম্মাদের এই আয়াতগুলো আমাদেরকে শেখায় যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, ইমান ও তাকওয়া তার মোহ থেকে মুক্ত করে, আল্লাহর রহমত দানকে সহজ করে, দানের লাভ দাতারই এবং আল্লাহ ধনী—আমরা তাঁর কাছে দরিদ্র।
এই শিক্ষা আজকের দুনিয়ায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে লোভ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। দান করে আমরা নিজেকে সমৃদ্ধ করি এবং সমাজকে একত্রিত করি। আল্লাহ আমাদেরকে এই পথে চলার তাওফিক দিন। আমীন।
আরও পড়ুনআল-আজিজ, যিনি ইজ্জত দান করেন২০ জুন ২০২৫