যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্যঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছে ভারত। যেসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যচুক্তি এখনো হয়ে ওঠেনি, তার মধ্যে প্রধান হলো দুই দেশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যঘাটতি। রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি হ্রাস করার বিষয়টি তো ছিলই।

সোমবার ভারতের পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসবিষয়ক মন্ত্রী হারদ্বীপ সিং পুরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের নতুন চুক্তির কথা জানিয়েছেন। এ চুক্তি অনুসারে, ভারত যে পরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করে, তার প্রায় ১০ শতাংশ করবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ বাস্তবতায় ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যচুক্তির প্রথম ধাপ শিগগিরই সই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। খবর সিএনবিসি ও ইকোনমিক টাইমস

ভারতের মন্ত্রী সামাজিক মাধ্যম এক্সে করা এক পোস্টে বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলো এক বছরের চুক্তি করেছে। এ সময় ২২ লাখ টন এলপিজি আমদানি করা হবে। এ চুক্তিকে তিনি ‘ঐতিহাসিক প্রথম’ চুক্তি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। বিষয়টি হলো মার্কিন এলপিজি আমদানির ক্ষেত্রে এটি দুই দেশের মধ্যে প্রথম কাঠামোগত চুক্তি।

জ্বালানিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত মূলত এলপিজি আমদানির উৎস বহুমুখী করতে এ উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে তাদের এলপিজির মূল উৎস মধ্যপ্রাচ্য। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত, তা হ্রাস করতেও এ উদ্যোগ।

ভারত বর্তমানে প্রতিবছর ২০–২১ মিলিয়ন বা ২ থেকে ২ কোটি ১০ লাখ টন এলপিজি আমদানি করে। এখন বাজারে যে দাম, তাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এর ১০ শতাংশ আমদানি করলে খরচ পড়বে ১০০ কোটি ডলারের মতো। যে বাণিজ্যঘাটতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, তাতে অবশ্য সামান্যই হেরফের হবে। কেননা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার।

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প যে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন, সেই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে ভারতের ওপর মার্কিন শুল্কের হার ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এবং বাকি ২৫ শতাংশ রাশিয়ার তেল কেনার জন্য শাস্তিমূলক শুল্ক।

ট্রাম্পের তোপ

ভারতের পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করেই ক্ষান্ত দেননি ট্রাম্প, সময়–সময় তোপও দাগছেন। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক ‘সম্পূর্ণ একপক্ষীয় বিপর্যয়’। তখন ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযুষ গয়াল যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তিনি বলেন, ভারত আগামী কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জ্বালানি–বাণিজ্য বাড়াবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও স্বাভাবিক অংশীদার। আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তার যেসব ক্ষেত্র আছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়বে।’

এর পর থেকে দুই পক্ষই সুর নরম করেছে। সম্প্রতি ট্রাম্প ভারতের শেষ সফরের কথা স্মরণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিনি ‘আমার বন্ধু’ ও ‘মহান মানুষ’ হিসেবে আখ্যা দেন। ৬ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এ কথা বলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও বলেন, ভারত ‘রাশিয়ার তেল কেনা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে’, যদিও তাঁর এ দাবির তথ্যগত ভিত্তি নেই।

বিশ্বজুড়ে তেল ও জ্বালানি–বাণিজ্যের হিসাব রাখে কেবলার। তাদের তথ্যানুসারে, ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত রাশিয়া থেকে ভারতের বিপুল পরিমাণে অপরিশোধিত তেল কেনা অব্যাহত ছিল। অক্টোবর মাসে তারা দৈনিক ১৬ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে। এখন কিনছে দৈনিক ১৮ লাখ ৫০ হাজার ব্যারেল।

কেপলারের মুখপাত্র মিউ ইউ ঝু বলেন, ক্রেতাদের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত রসনেফট ও লুকঅয়েলের সঙ্গে লেনদেন শেষ করার সময় দেওয়া হয়েছে। তাই ভারতীয় পরিশোধনাগারগুলো আগামী কয়েক দিনে যত বেশি ব্যারেল তেল আনা যায়, সেই চেষ্টা করছে।

মিউ আরও বলেন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের তেল আমদানিও অক্টোবর মাসে দ্রুত হারে বেড়েছে। সে মাসে তারা দৈনিক ৬৮ হাজার ব্যারেল তেল এনেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর যা সর্বোচ্চ।

জাপানি বিনিয়োগ ব্যাংক নোমুরার তথ্যানুযায়ী, ভারত দৈনিক প্রায় ৫০ লাখ ব্যারেল কাঁচা তেল আমদানি করে। একদিকে মার্কিন চাপ, অন্যদিকে রাশিয়ার তেলের ছাড় কমে যাওয়া—এই উভয় কারণে রাশিয়া থেকে ভারতের তেল আমদানির পরিমাণ তার মোট আমদানির ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমানে রাশিয়া ভারতকে ব্যারেলপ্রতি ৩ ডলার ছাড় দিচ্ছে।

চুক্তি হলো বলে

ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তির (বিটিএ) প্রথম ধাপের কার্যক্রম প্রায় শেষ, অর্থাৎ শিগগিরই চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাঁরা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে। এর দুটি অংশ—আলোচনার একটি অংশের সমাধান করতে সময় লাগবে। আরেকটি অংশ হলো এক প্যাকেজ—এটি মূলত পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে। উভয় দিক নিয়েই কাজ হচ্ছে। পারস্পরিক শুল্কের সমাধানজনিত প্যাকেজটি হলো বলে। শিগগিরই এটা পাওয়া যাবে।

কর্মকর্তারা বলেন, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ভারতের ওপর আরোপিত ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক সমস্যার সমাধান হবে। তা না হলে এই চুক্তির অর্থ হয় না। তাঁরা আরও বলেন, বিটিএর একাধিক ধাপ আছে। প্রথম ধাপে শুল্ক সমস্যার সমাধান হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র থ ক প রথম ধ প আরও বল ন আমদ ন র পর ম ণ এলপ জ

এছাড়াও পড়ুন:

রাজবাড়ী সরকারি মুরগি প্রজনন খামার জরাজীর্ণ, নষ্ট হচ্ছে কোটির টাকার সম্পদ  

জনবলস্বল্পতা ও সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ রাজবাড়ী সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। ১৪ জনের বিপরীতে এখানে কর্মরত আছেন ৫ জন। খামারে শুরুর দিকে হ্যাচারি চালু থাকলেও ১৯৯৭ সালে বন্ধ হয়ে যায়। সংস্কারের অভাবে মুরগির বাচ্চা পালনের শেডসহ কর্মচারীদের থাকার ঘরটিও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। ফলে নষ্ট হচ্ছে কোটি টাকার সম্পদ।

কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রয়োজনীয় জনবলের স্বল্পতা, অর্থ বরাদ্দ না থাকা এবং চাহিদার বিপরীতে নিয়মিত বাচ্চার জোগান দিতে না পারায় ওই সরকারি খামারের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। খামার নামের সঙ্গে ‘প্রজনন’ শব্দটি থাকলেও কার্যক্রম না থাকায় বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব হয় না।

খামার প্রতিষ্ঠার সময় চারটি শেড নির্মাণ ও বাচ্চা পালনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় বছরে ২০ হাজার। দুটি শেড পরিত্যক্ত থাকায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। আবদুল লতিফ, পোলট্রি টেকনিশিয়ান

খামার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সাধারণ মানুষের ডিম, মাংসের চাহিদা পূরণ ও বেকারত্ব ঘুচিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮১-৮২ সালে সরকারি হাঁস-মুরগির খামার স্থাপিত হয়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজবাড়ীর নতুনবাজার বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন প্রায় তিন একর জমিতে ওই খামার স্থাপিত হলেও এখন পর্যন্ত খামারে হাঁস পালন হয়নি। পাঁচ বছর আগে সরকারি আদেশে ‘হাঁস’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার’ লেখা হয়। মুরগির বাচ্চা পালনে চারটি শেড, প্রশাসনিক ভবন, ব্যবস্থাপকের বাসভবন, অতিথি কক্ষ, বিক্রয়কেন্দ্র, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আবাসিক ভবন তৈরি করা হয়। খামার প্রতিষ্ঠার পর হ্যাচারি কার্যক্রম (বাচ্চা ফোটানো) ছিল। অবকাঠামোগত সমস্যায় ১৯৯৭ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়।

জনবলসংকটে কার্যক্রম অনেকটা স্থবির। খামারের ব্যবস্থাপক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. কামাল বাশার স্বাক্ষরিত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শূন্য পদের তালিকা গত বছরের ১২ মে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালকের (উৎপাদন) কাছে পাঠানো হয়। এতে খামার পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট অফিসার, দুজন পোলট্রি টেকনিশিয়ান, একজন অফিস সহকারী এবং একজন নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছেন।

এ ছাড়া খামার ব্যবস্থাপকসহ এফএ (ফডার), ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভার, পোলট্রি অ্যাটেনডেন্ট, হ্যাচারি অ্যাটেনডেন্ট, নৈশপ্রহরী, এমএলএসএস ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পদ শূন্য রয়েছে। ব্যবস্থাপকের পদটি এক যুগ ধরে শূন্য। দীর্ঘদিন শূন্যের পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে মো. মেহেদী হাসান যোগদান করেন।

চারদিকে দেয়ালঘেরা খামারের মূল ফটক পেরোলে বাঁয়ে প্রশাসনিক ভবন, ডানে বিক্রয়কেন্দ্রসহ একতলা ও টিনশেডের ১৩টি স্থাপনা। বাচ্চা পালনে চারটির মধ্যে দুটি শেড পরিত্যক্ত থাকলেও সম্প্রতি একটি শেড সংস্কার করা হয়। পানির ট্যাংকের খুঁটিতে ফাটল ধরায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। ব্যবস্থাপকের বাসভবন ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আবাসিক ভবন এবং অপর শেডটি জরাজীর্ণ। মাদকসেবীদের উৎপাত থেকে রক্ষায় পরিত্যক্ত অতিথি কক্ষের দরজায় কাঁটাযুক্ত ডালপালা রাখা হয়েছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় জেনারেটর, পানির পাম্প, গাড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ মালামাল অকেজো হয়ে গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারি এই খামারে বাজারের তুলনায় অনেক কম দামে মুরগির বাচ্চা পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ কিনতে আগ্রহী থাকলেও বাচ্চা নিতে এসে অধিকাংশ মানুষ খালি হাতে ফিরে যান। 

পোলট্রি টেকনিশিয়ান আবদুল লতিফ বলেন, খামার প্রতিষ্ঠার সময় চারটি শেড নির্মাণ ও বাচ্চা পালনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় বছরে ২০ হাজার। দুটি শেড দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে গত বছর আরেকটি শেড সংস্কার শেষে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২০ হাজার ১৫০টি বাচ্চা পালন করা হয়। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ হাজার ৪০৫টি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৫০টি পালন হয়। 

পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট অফিসার মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘জনবলসংকট ও জরাজীর্ণ স্থাপনার কারণে কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ১৮ বছর ধরে বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সংস্কার না হওয়ায় তিনটির মধ্যে দুটি শেড প্রায় ১৫ বছর বন্ধ ছিল। সম্প্রতি একটি শেড সংস্কার করা হয়েছে। বছরে ২০ হাজার বাচ্চা পালনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ১৩-১৪ হাজার বাচ্চা পালন করা যায়। অন্য জেলা থেকে বাচ্চা সরবরাহ করতে হয় বলে চাহিদা দেওয়ার পরও নিয়মিত পাই না। শেড সংস্কারে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে পাইনি। ফলে কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, আপাতত হ্যাচারি চালুর পরিকল্পনা না থাকলেও আগামী অর্থবছরে রাজস্ব খাত থেকে জরাজীর্ণ শেড এবং আবাসিক ভবন সংস্কারের জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ