শুধু ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করাকেই গ্রাহকসেবা বলে না
Published: 8th, October 2025 GMT
এলিফ্যান্ট রোডে জুতা কোম্পানির নামে নামকরণ হওয়া সিগন্যালে বিখ্যাত এক জুতার দোকানে গিয়েছি। বিল করার সময় দেখা গেল, দোকানের প্রতিনিধি সর্বমোট বিল এবং কতগুলো আইটেম হলো সেটি বলছেন। মনিটরে বিলগুলো গ্রাহকের দেখার সুযোগ নেই। কারণ, স্ক্রিন দোকানের প্রতিনিধির দিকে ফেরানো। এর মধ্যে আবার ফোন নম্বর চেয়ে নিলেন। বের হওয়ার সময় রিসিট চাইলে কণ্ঠে ব্যাপক ‘আধুনিক’ সুর এনে বললেন, ‘রিসিট আপনার মোবাইলে চলে গেছে।’
মেসেজে দেখা গেল, রিসিটের লিংক দেওয়া আছে, অর্থাৎ ইন্টারনেট না থাকলে বিলগুলো দেখা যাবে না। এ রকম অত্যাধুনিক বিপণিবিতানের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে বিল দেখা তো দূরে থাক, লজ্জায় মুখ দেখানোই কঠিন হয়ে যাবে। ক্লিক করে দেখা গেল, চার হাজার টাকার জুতার দাম আট হাজার চলে এসেছে। অনুসন্ধানে জানা গেল, সঙ্গে রাখা অন্য একটি জুতার দাম চার হাজার হলেও বিল করা জুতার দাম আট হাজারই।
যে বিক্রয় প্রতিনিধি জুতা দিয়েছেন, তিনি জানান, দেখানোর সময় চার হাজার টাকার জুতার দাম বলা হলেও পছন্দ হয়ে যাওয়ায় অন্যটির দাম বলেননি, কারোরই আর দামের ট্যাগটিও দেখা হয়নি। কাউন্টার থেকে বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই স্যার, আপনি অন্য জুতাটি নিয়ে আসুন।’ আধুনিকতার এ এক সুবিধা। সব গ্রাহককে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু অন্য জুতাটি নিয়ে আসার পর বলা হলো, ‘আমাদের টাকা ফেরত দেওয়ার নিয়ম নেই। বাকি চার হাজার টাকার অন্য কিছু কিনতে হবে।’
বললাম, ‘আমি তো কাউন্টার থেকে পণ্য নিয়ে বেরই হইনি, এটা তো ফেরত দেওয়া না। এটা তো ভুল করে এক জুতা বলে অন্য জুতা নেওয়া।’ প্রতিটি বাক্যের শেষে ‘স্যার’ যুক্ত করে তিনি বলে চললেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই স্যার, এটা কোম্পানির পলিসি।’ পরবর্তী পদক্ষেপের মাধ্যমে টাকা ফেরত পেয়েছি; কিন্তু একজন গ্রাহকের জন্য পরবর্তী যেকোনো পদক্ষেপ চিন্তা করাটাই অপ্রয়োজনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত।
গ্রাহক ‘স্যার’ শোনার আগে চান তাঁদের অর্থের বিনিময়ে কেনা পণ্য বা পরিষেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক অধিকার। শুধু ‘স্যার’ কিংবা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করে কথা বললেই গ্রাহকসেবা হয়ে যায় না।এবার চলে আসা যাক কাঁটাবন মোড়ের সুবিশাল ফেব্রিকস ও টেইলার্সের দোকানে। সেখান থেকে শার্ট কেনার পর গিফট রিসিট চাওয়া হলো। গিফট রিসিট এখন মোটামুটি মানের সব দোকানের স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস। যাকে গিফট দেওয়া হলো, তিনি চাইলে যেন পরিবর্তন—বিশেষ করে শার্টের সাইজ ছোট-বড় করতে হলে এ সুবিধা বলতে গেলে আবশ্যক। কিন্তু বিক্রয়কর্মী বললেন, ‘সরি স্যার, আমরা গিফট রিসিট দিই না, আপনি যাঁকে দেবেন, ওনাকে মানি রিসিটটা নিয়ে আসতে বলবেন।’ ‘গিফটের সঙ্গে মানি রিসিট দেব?’ এ প্রশ্ন করতেই অপ্রসন্ন মুখভঙ্গি নিয়ে তিনি বললেন, ‘কোম্পানির পলিসি স্যার, আমাদের কিছুই করার নেই।’
আরও পড়ুনস্মার্ট বাংলাদেশে কাস্টমার সার্ভিস কেন এত আনস্মার্ট২০ জানুয়ারি ২০২৪এবার একটি ব্যাংকের গ্রাহকসেবার কথা বলি। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের জন্য ওনারা সিলগালা করে পাসওয়ার্ড পাঠিয়েছেন, যেটি কাজ করছে না। কাছের ব্রাঞ্চে গিয়ে জানাতেই প্রথমে বললেন, ‘আপনার অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত স্যার।’ ওনার দুঃখমিশ্রিত ‘স্যার’ সম্বোধন শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। ‘এখন কী করতে পারি’ জিজ্ঞেস করতেই সমাধান দিলেন, ‘আপনি ৫০০ টাকা দিয়ে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে পারবেন।’ আমি বললাম, ‘পরিবর্তন কেন, আমি তো আপনাদের দেওয়া পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করতে পারছি না।’ স্যুট–টাই পরা ভদ্রলোক সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘সরি স্যার, এটিই আমাদের ব্যাংকের পলিসি।’
মতিঝিলে থাকা এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কথাই বলা যাক। রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানে আপনি যদি প্রবেশ পাস নিতে যান, রিসেপশনের লোকজনের সঙ্গে কথা হলে মনে হবে, পাস নয় যেন নিজের গোটা মাসের বেতন আপনার হাতে তুলে দিচ্ছেন। যে প্রতিষ্ঠানে এত এত সুযোগ্য মানুষ কাজ করেন, সে প্রতিষ্ঠানের রিসেপশনে কী ধরনের মানুষ থাকা উচিত, সেটি নিশ্চয়ই এ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বোঝেন। অথচ পদক্ষেপ নিলে সচিবালয়ের মতো পাস দেওয়ার বিষয়টি স্বয়ংক্রিয় করে ফেলা যায়।
বাইরের বহু সুপারশপ আছে যেখানে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া পণ্য ফেরত দিলে পুরো টাকা ফেরত দেবে। ডেলিভারি দেওয়ার তারিখে পণ্য হাতে না পাওয়ায় অ্যামাজনকে জানালে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ডেলিভারি দেয়। দুই দিন পর দেখা গেল একই পণ্যের দুই কপি বাসায় এসে হাজির।
এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহক সন্তুষ্টি অনেক বড় ব্যাপার। অন্য দেশের সিস্টেম হুবহু হয়তো আমাদের দেশে কাজ করবে না; কিন্তু কী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কী সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, আমাদের সব জায়গায় গ্রাহক সন্তুষ্টি যেন ‘ভিনগ্রহের কোনো ধারণা’।
গ্রাহকদের অধিকার সুরক্ষায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ রয়েছে। আছে ২০২০ সালে প্রণীত বিধিমালা ও ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটে চলছে, সেটির প্রভাব এসে পড়ছে সব ব্যবসা–বাণিজ্য, সেবা-পরিষেবায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব বিধিবিধান যেমন হালনাগাদ করা প্রয়োজন, তেমনি আবার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন গ্রাহকসেবার মান বাড়াতে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণের।
বর্তমানের পরিবর্তিত বিশ্বে অসন্তুষ্ট গ্রাহক বাড়তে থাকায় বহু প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে, যেটি কখনোই কাম্য নয়। গ্রাহক ‘স্যার’ শোনার আগে চান তাঁদের অর্থের বিনিময়ে কেনা পণ্য বা পরিষেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক অধিকার। শুধু ‘স্যার’ কিংবা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করে কথা বললেই গ্রাহকসেবা হয়ে যায় না।
ড.
বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক ও পরিচালক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র হকস ব পদক ষ প আম দ র গ র হক বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
কুড়িগ্রামে ভেসে এল মৃত গন্ডার, হাড়গোড় যাবে জাদুঘরে
কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দুধকুমার নদে একটি মৃত গন্ডার ভেসে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা, কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে ভারতের কোনো বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এলাকা থেকে ভেসে এসেছে এটি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কয়েক দিনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রবল বন্যা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ধস ও বনাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দুধকুমার নদ দিয়ে কাঠের গুঁড়ি, মৃত গরু, সাপ, মাছসহ নানা প্রাণী ভেসে আসছে। গত সোমবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় দুধকুমার নদের স্রোতে গন্ডারটিকে মৃত অবস্থায় প্রথমবার ভাসতে দেখা যায়। পরে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার তিলাই ইউনিয়নের দক্ষিণছাট গোপালপুর গ্রামের চরে আটকে পড়ে প্রাণীটির দেহ।
আরও পড়ুন‘পুষ্পা’ সিনেমার মতো কুড়িগ্রামে ভেসে এল কাঠ, ‘লাল চন্দন’ ভেবে কাড়াকাড়ি৬ ঘণ্টা আগেমঞ্জুরুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, উজানের ঢলে কালজানি ও দুধকুমার নদে শত শত গাছের গুঁড়ি ও কাঠ ভেসে এসেছে। এর সঙ্গে ওই মৃত গন্ডার ভেসে আসে।
খবর পেয়ে আজ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান তিলাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান, কুড়িগ্রাম রেঞ্জ কর্মকর্তা (সামাজিক বনায়ন) সাদিকুর রহমান, উপজেলা বন কর্মকর্তা সেকেন্দার আলী ও যমুনা সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর জুয়েল রানা।
আরও পড়ুনকুড়িগ্রামের কালজানি নদীতে ভেসে আসছে হাজারো গাছের গুঁড়ি০৫ অক্টোবর ২০২৫ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘গতকাল এলাকাবাসী মৃত দেহটি দেখতে পেয়ে আমাকে খবর দিলে আমি বন বিভাগকে জানাই। আজ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ যমুনা সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।’
কুড়িগ্রাম বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান বলেন, গন্ডারটি খুব বড় ও ভারী হওয়ায় সরানো সম্ভব হয়নি। তাই মাটিতে গর্ত করে সেখানেই পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জাদুঘরের লোকজন এর হাড়গোড় সংগ্রহ করবেন।
যমুনা সেতু আঞ্চলিক জাদুঘরের কিউরেটর জুয়েল রানা বলেন, গন্ডারটির দেহ পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। দুই মাস পর পচনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে হাড়গোড় সংগ্রহ করে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। এগুলো শিক্ষা ও গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হবে।
আরও পড়ুনতিস্তার পানি কুড়িগ্রামে বিপৎসীমার ওপরে, লালমনিরহাটে নিচে০৬ অক্টোবর ২০২৫