চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের সারিকাইত গ্রামের পাকা মসজিদ গলি দিয়ে সাগরপারের রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোতেই চোখে পড়ে সরু রাস্তার দুই পাশে দুটি ঘর। জীর্ণ ঘরগুলোর একটি প্রবাসী সাহাবুদ্দিনের, অন্যটি বাবলুর। ঘরগুলোর সামনে কয়েক শ মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই প্রবাসী বাবলুর ঘর থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ঘরে উঁকি দিতেই চোখে পড়ে, মেঝেতে পড়ে বিলাপ করছেন এক নারী।

লোকজনকে প্রশ্ন করে জানা গেল, তিনি বাবলুর মা জোসনে আরা বেগম। বিলাপ করে বারবার ছেলের কথা বলছিলেন। ক্ষণে ক্ষণে ছেলের বন্ধু সাহাবুদ্দিনকে ডাকছিলেন। বিলাপের সুরে জোসনে আরা বলছিলেন, ‘জীবনে তারা এক লগে আছিল, মরণেও তারা একলগে গেল।’

আজ বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় সারিকাইত গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। শোকে হতবিহ্বল গ্রামবাসী একসঙ্গে এতগুলো তরতাজা যুবকের মৃত্যু মানতে পারছেন না।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ সময় বিকেলে চারটায় ওমানে সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সাত প্রবাসী নিহত হন। এর মধ্যে সারিকাইত ইউনিয়নের বাসিন্দাই পাঁচজন। এ ছাড়া মাইটভাঙার একজন ও রহমতপুর ইউনিয়নের একজন বাসিন্দা আছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাগরে মাছ শিকার শেষে বাড়ি ফেরার পথে ওমানের ধুকুম সিদ্দা এলাকায় প্রবাসীদের বহন করা গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন সারিকাইতের আমিন মাঝি, মো.

আরজু, মো. রকি, সাহাব উদ্দিন ও মো. বাবলু এবং মাইটভাঙার মো. জুয়েল ও রহমতপুরের মো. রনি।

সাহাবুদ্দিন আর বাবলু ছিল অভিন্ন হৃদয়। বিদ্যালয়ে যাওয়া, বেড়ে ওঠা সবই একসঙ্গে। একসঙ্গে দুই বন্ধু দেশে এসেছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর একই ফ্লাইটে  তাঁরা ওমানে ফিরে গেছেন। বুধবারের দুর্ঘটনাও তাঁদের আলাদা করতে পারেনি। ঘটনার দিন বাবলুর মা জোসনে আরা ছিলেন চট্টগ্রামে। গতকাল বিকেল পাঁচটায় প্রথমে তিনি ছেলের দুর্ঘটনার কথা শুনলেও মৃত্যুর খবর জানতেন না। পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর ছেলে আর বেঁচে নেই। বাবলুর তিন বছরের ছেলে আর দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। জোসনে আরা তাদের কী বলে সান্ত্বনা দেবেন জানেন না।

সারিকাইত ইউনিয়নের নিহত পাঁচ প্রবাসীর সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। স্বপ্ন দেখেছিলেন বিদেশে রোজগার করে আবার একসঙ্গে দেশে ফিরবেন তাঁরা। সংসারে ফিরবে সচ্ছলতা। কিন্তু সেই স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়েছে। আজ সকালে সারিকাইতের শিবের হাটের দক্ষিণে পাকা মসজিদ এলাকায় পৌঁছালে এলাকাবাসীর শোক টের পাওয়া যায়। পাকা মসজিদ থেকে সাগরপারের দিকে একই রাস্তায় দুর্ঘটনায় নিহত চারজনের বাড়ি।

ঘরের মেঝেতে বসে বিলাপ করছিলেন সাহাবুদ্দিনের মা নাজমা বেগম

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র ঘটন একসঙ গ ব বল র প রব স

এছাড়াও পড়ুন:

শিল্পীরা সমকালকে কীভাবে ধরেন

জুলাই অভ্যুত্থানের মতো বড় ঘটনা ঘটে গেল দেশে। অথচ গত দেড় বছরে এর তীব্র অভিঘাত শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে খুবই কম। সমকালের বড় একটা ঢেউ লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের কি আসলেই স্পর্শ করেনি? এমন জিজ্ঞাসা নিয়ে গিয়েছিলাম পাঁচ শিল্পীর প্রদর্শনী ‘রেজোনেন্স অব টাইম’ দেখতে। মনে আশা জাগল নামটা দেখে, ‘সময়ের অনুরণনের’ কথা আছে, নিশ্চয় সমকালকেও খুঁজে পাওয়া যাবে।

চট্টগ্রামের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে ২৪টি ছবি নিয়ে পাঁচ দিনের এই প্রদর্শনী শুরু হয় ১৫ নভেম্বর, শনিবার। শেষ হয় ২০ নভেম্বর। পাঁচ শিল্পীর কেউ অ্যাক্রিলিক, কেউ কালি-কলম, কেউ চারকোল-কাগজ আর কেউবা ধাতুর পাতকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে শিল্পী সঞ্জীব বড়ুয়ার শিল্পকর্ম ‘টাইম অ্যান্ড রিয়েলাইজেশন’ সিরিজের ছবিগুলো। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা একটি ছবির বিবরণ দেওয়া যাক। নানা তলে সন্নিবেশিত ছবিটি প্রথম দেখায় মনে হবে জলরঙের ওয়াশে আঁকা। জলের ওপর লাল রক্তের ফোঁটা যেন মিশে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে স্থির হয়ে গেছে। যেন অন্ধকার বনভূমির পটভূমিতে কেউ একটি ফুল ফুটিয়েছে। ছড়িয়ে থাকা গাছগুলোর ঠিক কেন্দ্রেই এই রক্তচিহ্ন। আবার তার ভেতরে একটা আবছা ধারালো দা। সব মিলিয়ে ক্ষত, জন্ম, মৃত্যু, অন্ধকারের বিস্তার সব এসে গ্রাস করে দর্শককে। অর্গানিক অ্যাবস্ট্র্যাকশনের ভেতরে বর্তমান সময়ের নৈরাজ্য যেন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে।

সবাই চুপ করে থাকলেও ঘটনা নিজেই তার বিবরণ হয়ে দাঁড়ায়। সমকালের এই বার্তা কে এড়াতে পারে? শিল্পী সঞ্জয় কুমার দাশের ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’ দেখতে দেখতে এমন ভাবনা দর্শকের মনে দোলা দিয়ে যায়। তাঁর ছবি দেখে ভীষণভাবে ফরাসি চিত্রশিল্পী মার্ক শাগালের কথা মনে পড়ে। শাগাল যেভাবে বহুতলকে একসঙ্গে একটা বাস্তবতায় হাজির করেন সঞ্জয়ও তা করেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম বিশৃঙ্খল, সহিংস ও মানবিক ট্র্যাজেডিতে ভরা নগর বাস্তবতার রূপকে ধারণ করে। মৃত্যু, হাসপাতাল, উর্দি পরা নিরাপত্তা বাহিনী, তর্কপ্রবণ মানুষ—সব মিলিয়ে একই জমিনে বিশৃঙ্খল বিচ্ছিন্ন দৃশ্য একসঙ্গে মিলিত হয়ে একটি সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে। রঙের ব্যবহার তীব্র ও উজ্জ্বল—নীল, সবুজ, কমলা, বেগুনি ইত্যাদি রং মিলেমিশে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা তৈরি হয়। এই ডিস্টোপিয়ান আরবান ল্যান্ডস্কেপের ভেতরে দর্শক সমকালীন বাংলাদেশকেই খুঁজে পাবেন।

শিল্পীরা কি এই সময়ে কেবলই অন্ধকার দেখছেন। কোথাও প্রেম, আশা আর স্বপ্নের রেশ দেখতে পাননি কেউ? উত্তর খুঁজতে গিয়ে উত্তম কুমার তালুকদারের অ্যাক্রিলিকে আঁকা একটি চিত্রকর্মে চোখ আটকে যায়। ‘দ্য লাইফ অব টাইম অ্যান্ড মাই পেইন্টিং’ শিরোনামে তিনটি ছবি আছে তাঁর। প্রায় ৭ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ৪ ফুট প্রস্থের একটি ছবির কথা বলি। ক্যানভাসে এক কোণে লাল আপেলের প্রতিকৃতি মনে করিয়ে দেয় আদি পাপের বেদনা। ক্যানভাসের ছড়িয়ে থাকা নানা ফিগারে প্রকৃতি, ফুল আর জীবনের নানা অনুষঙ্গ জড়াজড়ি করে আছে। মানব-মানবীর যুগল অবয়বে নবজন্মের ইশারা। স্বর্গ থেকে মানবের বিতাড়নের কারণ প্রেম। আর প্রেম আছে বলেই জীবন আছে, মৃত্যুও আছে। যুদ্ধ আর হিংসার ভেতরে সেটাই তো আশার আলো।

উত্তমের চিত্রকর্মে মানবদেহ, প্রাণী, ফুল ও জৈবিক মোটিফগুলো একত্রে একটি ঘন প্রতীকী জগৎ তৈরি করে। রং ব্যবহারে তীব্র কনট্রাস্ট—বিশেষত নীল, লাল ও বাদামির উপস্থিতি—দৃশ্যকে নাটকীয় করে তোলে, আর সাদা ফাঁকা অঞ্চলগুলো যেন অসম্পূর্ণতার ভেতর লুকোনো সম্ভাবনার ইঙ্গিত। চরিত্রগুলোর মুখে স্পষ্ট পরিচয় নেই; এই অবয়বহীনতা ব্যক্তিগত বেদনা, দেহ-রাজনীতি কিংবা অস্তিত্বগত অনিশ্চয়তার দিকে দর্শকের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়। ছবিতে লতানো সবুজ শিরা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভেতরে-বাইরে প্রবহমান রেখা—এসব যেন মানবজীবনের অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের জড়িত থাকার অনিবার্যতাকে তুলে ধরে।

জাবের আহমেদ চৌধুরীর কাজ নানা দিক থেকেই আলাদা। প্রদর্শনীতে তিনি ‘সরোস অ্যান্ড হ্যাপিনেস’ শিরোনামে দুই ফুট বাই দুই ফুট মাপের চারটি রিলিফ ভাস্কর্য উপস্থাপন করেছেন। এসএস মেটাল শিটের ওপর করা ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যগুলো দ্বিমাত্রিক তলের বিভ্রম তৈরি করে। আনন্দ–বেদনার এই কাব্য পুরোটাই সাদাকালো। কালো এসএস শিট কেটে যে স্থান বা স্পেস তৈরি করেছেন শিল্পী, সাদা দেয়ালের পটভূমিতে তাকে সাদাকালোয় পরিণত করেছেন। সেখানে নিবিড় প্রকৃতি ও বনের কেন্দ্রে রয়েছে নিঃসঙ্গ মানুষ। এই বিভক্তিতা বা অ্যালিয়েনেশন আধুনিক মানুষের নিয়তি। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ থেকে দূরের এই দুনিয়া খুব চেনা লাগে।

অরুণ কুমার শীল পেন-পেপারে কাজ করেছেন। ঘন ডিটেলে ভরা বহুতলের সিরিজগুলোর নাম ‘সারকমস্টেনসেস’। জীবন ছুঁয়ে চলে যাওয়া পরিপার্শ্ব তাঁকে ভাবিয়েছে। প্রদর্শনীতে তাঁর ৬টি ছবিতে অসংখ্য ঘটনা একসঙ্গে ভিড় করেছে। তবে ঘটনা একান্ত দৈনন্দিন। সেখানে বাজারের থলে হাতে মানুষ যেমন দেখা যাবে, তেমনি দেখা যাবে সবজির গাড়ি, মুদিরদোকান, ছাদের কোণে কাস্তের মতো চাঁদ। সব মিলিয়ে জীবনের প্রবহমানতা দর্শককে ভীষণভাবে আলোড়িত করে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংসার চালাতে হিমশিম, একসঙ্গে তিন চাকরি করতেন এ আর রাহমানের বাবা
  • ভূমিকম্পে নিহত বাবা-ছেলের দাফন সম্পন্ন, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
  • শিল্পীরা সমকালকে কীভাবে ধরেন