ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বিপদ এখন ইসরায়েলের ভেতরেই
Published: 13th, November 2025 GMT
নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যেখানে খুবই প্রিয়, সেখানে একদিন কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়। সত্যকে দমন করতে যে শক্তি একসময় বাইরের সমালোচকদের মুখ চেপে ধরত, সেই শক্তিই এ সময় গ্রাস করতে শুরু করে ‘ভেতরের’ মানুষদেরও। বিশেষ করে বিবেকবানদের।
এমন মুহূর্ত সাধারণত বিস্ফোরণ বা বিদ্রোহের মতো দামামা বাজিয়ে আসে না। আসে নীরবে।
ইসরায়েল এখন এমনই এক মুহূর্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির সামরিক প্রধান প্রসিকিউটর ইয়িফাত তোমের-ইরুশালমির গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি নাকি এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে নির্যাতনের ভিডিও ফাঁস করেছিলেন। ব্যাপারটা ইসরায়েলের জন্য শুধু আইনি কেলেঙ্কারির বিষয় নয়। সেই ভিডিওর মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এমন এক আয়না, যেখানে একটি জাতি নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
তোমের-ইরুশালমি কোনো বহিরাগত বা শত্রু ছিলেন না। এই নারী ছিলেন ইসরায়েলের সবচেয়ে সুরক্ষিত কেন্দ্রের অংশ। ছিলেন সেই আইন ও সামরিক কাঠামোর অংশ, যা বহুদিন ধরে নিজেকে জাতীয় অস্তিত্বের রক্ষক বলে মনে করেছে। তবু সেই কেন্দ্রের ভেতর থেকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন মানবিক অবস্থান। বেছে নিয়েছিলেন সহানুভূতি।
আরও পড়ুনযে যুদ্ধে ইসরায়েল হেরে যাচ্ছে২৯ অক্টোবর ২০২৫নিষ্ঠুরতার মুখোশ উন্মোচনের সিদ্ধান্ত ইরুশালমির জন্য কোনো বিদ্রোহ ছিল না। ছিল নৈতিক সাহসের প্রকাশ। আর সেই সাহসের জন্যই তাঁকে শাস্তি পেতে হয়েছে। তাঁর পরিণতি আমাদের সামনে উন্মোচন করেছে এক গভীর সত্য। দেখিয়েছে, সরকার যখন নিয়ন্ত্রণে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখন সততাকেও তারা ভয় পেতে শুরু করে বিদ্রোহের মতো।
ইসরায়েল, যে দেশ একসময় বাইরের হুমকিতে আতঙ্কিত ছিল, সে দেশ এখন কাঁপছে নিজের অন্তর্নিহিত সত্যের সামনে। যখন সত্যকেই শত্রু মনে করা হয়, তখন জাতির শক্তি ভেতর থেকে ফাঁপা হয়ে যেতে শুরু করে।
দশকের পর দশক ধরে ‘নিরাপত্তা’ ছিল ইসরায়েলের অস্তিত্বের মূল শব্দ। ওই রাষ্ট্রের শুরুর সময়ে এই শব্দের মানে ছিল টিকে থাকা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিণত হয়েছে এক পবিত্র ধারণায়। যার নামে প্রায় সবকিছুকেই বৈধতা দেওয়া যায়। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করা সেখানে হয়ে উঠেছে এক নিষিদ্ধ কাজ (এমনকি রাষ্ট্রের ভেতর থেকেও)।
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫এই পবিত্রতার ট্র্যাজেডি হলো, এটি এমন এক দেয়াল তৈরি করে, যা শুধু সীমান্তের চারপাশ নয়, জাতির বিবেককেও চারপাশ থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। নিজেদের রক্ষার জন্য যে দেয়াল তোলা হয়, একসময় সেই দেয়াল ভেতরেই দম বন্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
অযাচিত ক্ষমতা একসময় ভুলে যায়, কাদের রক্ষার জন্য সে সৃষ্টি হয়েছিল। যে সহিংসতাকে একসময় ‘আত্মরক্ষা’ বলে মেনে নেওয়া হয়েছিল, তা পরিণত হয় অভ্যাসে। ন্যায় রক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো তখন নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতেই হিমশিম খায়।
নৈতিক পুনর্জাগরণের শেষ আশ্রয় যেসব সত্যবাদী, তাঁদেরও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। এ জন্য নয় যে তাঁরা নিরাপত্তার জন্য হুমকি; বরং তাঁরা হুমকি ভ্রান্ত ধারণার জন্য।
তোমের-ইরুশালমির ঘটনা তেমনই এক ট্র্যাজেডির প্রতীক। যে দেশ নিজেদের ওই অঞ্চলের ‘একমাত্র গণতন্ত্রপন্থী’ বলে দাবি করে, ওই দেশেই সহানুভূতি এখন অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ করা হয়ে উঠেছে নির্যাতন করার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।
ইসরায়েলের নেতারা এখনো গণতন্ত্রের কথা বলেন, বিশৃঙ্খলার মধ্যেও টিকে থাকার দাবি করেন। কিন্তু সেই কথাগুলো এখন ফাঁপা শোনায়। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো—বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং তদারক সংস্থাগুলো নীরবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আদালত এখন দুর্বলদের নয়, রক্ষা করছেন শক্তিধরদের। সংবাদমাধ্যম দ্বিধায় ভুগছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো, যারা একসময় দেশের বিবেক ছিল, তাদের করে ফেলা হয়েছে কোণঠাসা।অধিকৃত এলাকার (পশ্চিম তীর) জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একসময় যে অস্ত্রগুলো তৈরি হয়েছিল, এখন তা ব্যবহার হচ্ছে ভেতরের দিকে। যা আগে ছিল রাজনৈতিক, এখন তা হয়ে উঠেছে মানসিক, সাংস্কৃতিক—এমনকি স্বভাবগত।
যখন সত্য বলা বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে যায়, তখন সেই ব্যবস্থা আর শৃঙ্খলা রক্ষা করছে না; বরং নিজস্ব বিকাশের ক্ষমতাকেই শ্বাস রোধ করে ফেলছে।
তোমের-ইরুশালমির গ্রেপ্তারের বার্তাটি যেন পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিটি করিডরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যেখানে নীরবতাই আনুগত্য আর সততাই বিশ্বাসঘাতকতা। সহানুভূতির জায়গা দখল নিয়েছে ভয় আর ঐক্যের জায়গা নিয়েছে সন্দেহ। এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো হারাচ্ছে বৈধতা, মানুষ হারাচ্ছে আস্থা।
আরও পড়ুননেতানিয়াহু যেভাবে ইসরায়েলকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন২৮ আগস্ট ২০২৫এ ক্ষত কেবল রাজনৈতিক নয়, মানবিকও। যেখানে নাগরিকেরা ধীরে ধীরে চোখ ফিরিয়ে নিতে শেখেন; কর্মকর্তারা নিজেকে বোঝান যে তাঁরা কেবল ‘আদেশ মানছেন’; সৈন্যরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে নিষ্ঠুরতাই প্রয়োজন। তখন রক্ষক আর দমনকারীর সীমারেখা মুছে যায়। থেকে যায় এক প্রকার নৈতিকতার নিদ্রা।
ইসরায়েলের নেতারা এখনো গণতন্ত্রের কথা বলেন, বিশৃঙ্খলার মধ্যেও টিকে থাকার দাবি করেন। কিন্তু সেই কথাগুলো এখন ফাঁপা শোনায়। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো—বিচারব্যবস্থা, সংবাদমাধ্যম এবং তদারক সংস্থাগুলো নীরবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আদালত এখন দুর্বলদের নয়, রক্ষা করছেন শক্তিধরদের। সংবাদমাধ্যম দ্বিধায় ভুগছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো, যারা একসময় দেশের বিবেক ছিল, তাদের করে ফেলা হয়েছে কোণঠাসা।
শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বিপদ তার সীমান্তের বাইরে নয়; বরং ভেতরে। সহানুভূতি, আস্থা আর বিবেকের অবক্ষয়ই তাদের সবচেয়ে বড় বিপদ। কোনো জাতি যুদ্ধ, একঘরে হয়ে পড়া, কিংবা বিশৃঙ্খলার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে। কিন্তু নৈতিক বোধের মৃত্যু ঘটলে কোনো সমাজই টিকে থাকতে পারে না।
আরও পড়ুননেতানিয়াহু ইসরায়েলের ত্রাণকর্তা না ধ্বংসকারী?১৫ এপ্রিল ২০২৪যখন সত্য বলা অপরাধে পরিণত হয়, তখন পতন বিস্ফোরণের শব্দের মতো আসে না। আসে নিঃশব্দে, নীরবতার মাধ্যমে, ভয়ের মধ্য দিয়ে। তখন ম্লান হওয়া শুরু করে সেসব, যা একসময় তারা বিশ্বাস করত।
তোমের-ইরুশালমির গল্প কোনো সাধারণ কেলেঙ্কারি নয়। এটি এক সতর্কবার্তা। এটি দেখায়, যখন একটি জাতি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে নিজের ছায়াকেই বেশি ভয় পায়, তখন কী ঘটে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ক্ষমতার সবচেয়ে বড় শত্রু বিদ্রোহ নয়—জাগরণ।
কারণ, যে শাসনব্যবস্থা মানবতাকে ভুলে যায়, তার পরিণতি একটাই। একসময় সে নিজের অস্ত্রের লক্ষ্য বানায় নিজেকেই। তখন আর শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, মসনদ হারিয়ে ফেলে নিজের আত্মাকেও।
পিটার রজারস কলামিস্ট। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিবিষয়ক লেখক
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণতন ত র র ইসর য় ল র সহ ন ভ ত ব যবস থ র সবচ য় র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার প্রয়োজন হবে না: এ জেড এম জাহিদ
‘আপনারা এত দিন দেখেছেন, টাকা না হলে স্কুলের মাস্টারের চাকরি হয় না অথবা দপ্তরির চাকরি হয় না, পিয়নের চাকরি হয় না, একটা কনস্টেবলের চাকরি হয় না। ইনশা আল্লাহ, টাকাপয়সার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র কোনো ধরনের অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। শুধু আপনি আপনার যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাবেন। আমাকে অথবা আমার দলের কোনো নেতা-কর্মীর কাউকেই আপনাদের টাকাপয়সা দিয়ে, ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন হবে না।’
আজ মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার হরিনাথপুর হাইস্কুল মাঠে ৮ নম্বর মাহমুদপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আয়োজনে এক পথসভা হয়। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন। পথসভায় সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ৩ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সভাপতি শরিফুল ইসলাম।
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট ভাষায় তাদের সাবধান করে দিতে চাই, যারা আজকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে, পেছনের দরজা দিয়ে জনগণের অধিকারকে আবারও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। মনে রাখবেন, এই মাহমুদপুর শুধু নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো অবস্থাতেই স্বৈরাচারের পুনরুত্থান বাংলাদেশের মানুষ আর গ্রহণ করবে না। যে বা যাঁরা জনগণের ভোটাধিকার ছাড়া ২০১৪ সালে সংসদে গিয়েছিলেন, ২০১৮ সালে রাতে ভোট দিয়েছিলেন, ২০২৪ সালে প্রার্থী পান নাই, তাঁরা আবার ষড়যন্ত্র করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে ইনশা আল্লাহ জাতীয় নির্বাচন হবে। ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২৪ সালে আপনাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অনেকেই সুযোগ পান নাই। অনেকেই যাঁরা এখানে উপস্থিত আছেন, তাঁদের অনেকেই এত বেশি গায়েবি মামলায় জর্জরিত ছিলেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে ছিলেন, অনেকে বাড়িতে থাকতে পারেন নাই। খেতে-খামারে রাত্রী যাপন করতে হয়েছে। অনেকেই জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। আমি নিজেও ১৪ মাস জেল খেটেছি।’
জিয়া পরিবারের কথা উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি অত্যাচার হয়েছে জিয়া পরিবারের ওপর। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমানকে বিনা চিকিৎসায় প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে। ২০১৫ সালে ২৪ জানুয়ারি তিনি (খালেদা জিয়া) তাঁর ছেলেকে যে ঠিকমতো দাফন করবেন, সে ব্যবস্থা করতে পারেন নাই। তখন তাঁকে পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। আমাদের নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ২০০৭ সালের পর তাঁর কোমর ভেঙে দেওয়ার মতো অবস্থা, উনি যখন পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিলেন, তখন কোর্টের পারমিশনে (অনুমতিতে) চিকিৎসার জন্য তিনি দেশের বাইরে যান। তিনি সারা বাংলাদেশে ভোটাধিকার হারা, গণতন্ত্র হারা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ৮ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে আমাদের সবাইকে সংগঠিত করেছেন। শুধু বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দল যারা গণতন্ত্র চায়, মানুষের অধিকার চায়, ভোটাধিকার চায়, আইনের শাসন চায়, তাদের তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন।’
পথসভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির দিনাজপুর জেলা শাখার সদস্য আবু তাহের, নবাবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তরিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, ঘোড়াঘাট পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি আবদুস সাত্তার, ৮ নম্বর মাহমুদপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি খলিলুর রহমান, ৩ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের প্রমুখ।