Prothomalo:
2025-07-13@11:24:57 GMT

দূরদেশ অথবা বনসাই

Published: 13th, July 2025 GMT

মফস্সল শহরটায় ফিরে সে প্রথম সন্ধ্যায়ই একটা বাড়ির খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। বিশ বছর পর মিনারের এই ফিরে আসা কোথাও বুদ্বুদ তৈরি করে না। ফেলে যাওয়া শহরের পথঘাট ছাড়া আক্ষরিক অর্থে অন্য কেউ তাকে চিনতে পারেনি। ছিল মাত্র এক বছর। হাতে গোনা কিছু বন্ধু হয়েছিল। চলে যাওয়ার পর একবারের জন্যও এ শহরে আসা হয়নি। তখন সে ছোট ছিল, আসতে চাইলেই হয় না। বন্ধুদের ভেতর দুজন মানে বাবু আর তমাল প্রথম কিছুদিন চিঠি লিখলেও আস্তে আস্তে তা গতি হারায়। ফলে চলে যাওয়ার পর এ শহরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ ভেঙে পড়ে। এখন তাকে ওদের খুঁজে পেতে সময় দিতে হবে। তার আগে, শহরে পা ফেলে প্রথম সন্ধ্যাটায় মিনারের মনে হলো, বাড়িটা একবার দেখা দরকার।

শহর বিশ বছরে তার মূল কাঠামো ছাড়া সব বদলে ফেলেছে। একটা নদী পুরো শহরটাকে সাপের মতো পেঁচিয়ে বেরিয়ে গেছে। নদীটা আছে, কিন্তু তার ভেতর ঢুকে গেছে কারও বারান্দা বা কারও বাড়ির প্রায় পুরোটাই। নদীর ভেতর এসব বাড়ি এমনভাবে উঁকি দিয়ে আছে, যেন বখাটে ছেলেদের গার্লস স্কুলের সামনে উঁকি দেওয়া চোখ। মিনার যে স্কুলে পড়েছিল, সেই আঞ্জুমান স্কুল অবিকল আগের মতোই আছে এবং সে ফিরে এসেছে ওই স্কুলের শিক্ষক হয়ে। অবিকল আছে, কিন্তু পুরোপুরি আছে, তা বলা যাবে না। বড় বড় পাতার একটা কাঠবাদামগাছ ছিল। সেই গাঢ় সবুজ পাতার কাঠবাদামগাছ কোনো এক ঝড়ে ভেঙে পড়ায়, ওটা ছাড়া স্কুলটাকে মিনারের মনে হলো কেমন যেন নগ্ন! যেন সূর্যের আলো সরাসরি মাঠের মধ্যে পড়ে ছায়াময় স্কুলের রহস্যটাকে খেয়ে ফেলেছে। স্কুল ছাড়া শহরের মূল রাস্তা, মাছবাজার, রেলস্টেশন—এ রকম আরও কিছু ব্যাপার শৈশবে দেখা চেহারা ধরে রেখেছে। অন্য সব ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়া সেসব অতীতের ভেতর গজিয়ে উঠেছে কংক্রিটের নানা অবকাঠামো।

মানুষের কোলাহলে রাস্তা ভরে আছে। মিনারের রিকশা ব্রিজ পেরিয়ে গেলে মনে হয়, কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়িটার সামনে পৌঁছে যাবে। রাস্তার মূল কাঠামো সে চিনতে পারছে, কিন্তু শাখাপ্রশাখা বদলে গেছে। আধো চেনা শহরে ফিরে সে কি বাড়িটাকে চিনতে পারবে? ওই বাড়ির পাশেরটা ছিল রকিব ভাইদের। রকিব ভাই দিনরাত রবীন্দ্রসংগীত বাজাতেন। সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, দুপুর নেই, ওনার বাড়ি থেকে ‘আমারো পরানো যাহা চায়, তুমি তা–ই, তা–ই গো’ এসে রাস্তায় পড়ত। সময়জ্ঞান আর সংগীতজ্ঞানের ব্যাপারটা ওনার ভেতর ছিল না। ভৈরব, পূরবী, ললিত বা মালকোষ সময় ধরে গাওয়ার ব্যাপার যেমন, তিনি তেমন নন। দুপুরে মৃদু, আবার সকালে হয়তো খানিকটা উচ্চতালের কোনো গান ছেড়ে রাখতেন। তাও ভালো, মিনার রেখা পিসিদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে গন্ধরাজের ঘ্রাণ এসে যেমন নাকে–মুখে ঝাপটা দিত, এদিকে পৌঁছালে তেমন পাওয়া যেত রকিব ভাইদের বাসা থেকে রবীন্দ্রসংগীত, আর পাশের বাসা থেকে জবার মতো ফুটে থাকা চাহনি।

একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে মিনারকে ফিরতে হয়। যে সরকারি বাংলোতে আপাতত সে উঠেছে, সেখানে আজ সহকারীদের সাড়ে আটটার মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হবে। মিনার চাইলেও বলতে পারছে না যে আজ সাড়ে আটটায় নয়, দশটা পর্যন্ত থাকবে সবাই। পারছে না, কারণ, সে হাইস্কুলের একজন নিরীহ শিক্ষক। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, কিন্তু ক্ষমতা মেরুদণ্ডের অভিভাবক। মিনারকে বাড়িটার খুব কাছাকাছি এসেও রিকশা ঘুরিয়ে ফেলতে হলো। তার মনে পড়ে, কৈশোরে বহু বহুবার সে বাড়িটার দিকে যেতে চেয়েও পারেনি। যাহোক, পথজুড়ে তখন ছিল লালচে আলো, তাতে ফড়িং এসে বসত। এখন ঝলমলে আলো ছড়ানো পথ। তবে মনে হচ্ছে না, কৈশোর, সে বয়সের প্রেম—এসব কোথাও, কোনো গেটের ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে।

দুই

মিনার যে বাড়িতে উঠেছে, তা–ও নদীর ওপর। ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ দিকে একটা পাকা গলি ঢুকে গেছে। মিনিট দুই যাওয়ার পর ওটা ডানে মোড় নেয়। মোড় যেখানে, ওখান থেকে বরাবর রাস্তাটা ছোট হয়ে গেছে। ডানে মোড় নেওয়াটাই মূল গলি। মোড় থেকে বরাবর ছোট যে রাস্তা, তা ধরে ৫০ ফুট এগোলে তীর ঘেঁষে একটা মন্দির। মন্দিরের পাশে বটগাছ, যে কিনা বিপুল আগ্রহ নিয়ে মন্দিরটাকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে গা ছমছম ব্যাপারটা মন্দির পেরোতে গিয়ে কারও কারও হতে পারে। তা ছাড়া ব্রিজ পেরিয়ে গলিতে ঢুকে পড়লে হঠাৎ মনে হবে যেন খুব শান্ত নীরব কোনো এলাকায় ঢুকে পড়েছি। শহরের মূল রাস্তার টুংটাং কোলাহলের সঙ্গে এই রাস্তা একদম মেলে না। গলি ধরে মোড় পর্যন্ত এসে, মন্দিরের সামনে দিয়ে ছোট হয়ে যাওয়া পথ ধরে আরেকটু এগিয়ে মিনারের বাসা। বাসার একটা বারান্দা আছে, ওটা নদীর ভেতর ঢুকে আছে। মিনার এই বারান্দা দেখে অভিভূত। শরতে শান্ত নদীর পারে একটা বারান্দা নিয়ে তার এই নতুন জীবন মনে হচ্ছে আনন্দেরই হবে।

প্রথম দিন বাড়িটার খোঁজে বেরিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর মিনার আর ওদিকে মুখ ফেরায়নি। আপাতত তার যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। মনে হয়, বাড়ির সামনে গেলেও দীপাকে তো আর দেখতে পাবে না। নাহয় দেখতে পেলই, দেখা হয়ে গেল দুজনের। পেলেও চিনতে পারবে না। চিনতে পারলেও কী! কিছু যায়–আসে না। তবু যেকোনো দিন মিনার ওই বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৈশোরের উত্তেজনা, বুক ঢিপঢিপ, একটু চাহনি পেলেই মনে হতো স্বর্গ পাওয়া—এসব ঘটনা যে জায়গা ঘিরে, সেই তীর্থস্থান দেখে আসতে চায় কোনো একদিন।

মিনার এর মধ্যে আরেকটি আশ্চর্য ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় সে বাসায় ফিরে যখনই একটু বই বা ল্যাপটপ নিয়ে বসে, তখনই দেখতে পায়, মন্দিরের পাশে অনেকগুলো তরুণ, হাতে বড়শি। ওরা নদীতে বড়শি ফেলে ঝিম মেরে বসে থাকে। মাছ ধরা পড়ে কি না, তা আর মিনারের দেখা হয় না। নতুন বাসা গোছানো বা রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে ছেলেগুলোর কথা একদম ভুলে যায় সে। কাজ শেষে উঁকি দিয়ে কোথাও কাউকে আর দেখতে পায় না। ভিড় করে থাকা ছেলের দল একদম লাপাত্তা। ওপারে থাকা সরকারি বাংলোগুলোর আলো এসে তখন নদীকে আরেকটা চেহারা দেয়। এসব বাড়ি থেকে পানিতে আলো পড়ে, আর ঢেউ এসে সে আলো ভেঙে ভেঙে অনেকটা জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। মিনারের অবাক লাগে। ছেলেগুলো একসঙ্গে সন্ধ্যায় জড়ো হয়, আবার একসঙ্গে গুটিয়ে চলে যায়! এটা কি মাছ ধরার কোনো সিম্ফনি; সুর? একই সময়ে এতজন বসে, আবার সময় ধরে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা মিনারের কাছে পরিষ্কার নয়। এ সময় কি নদীতে মাছ বেশি পাওয়া যায়? নাকি অন্ধকার একটু বেশি হলে, মাছ ধরার ব্যাপারে ওদের আর আগ্রহ থাকে না! এসব কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। তবে বড়শি নিয়ে বসার ব্যাপারটা তাকে আনন্দিত করে। কৈশোরে এই নদীতে পানি যখন স্থির হয়ে যেত, সেই ঋতুতে তার স্বপ্ন ছিল, জাল ফেলে মাছ ধরার। লোকগুলো হাতের ভাঁজে জালটা মেলে যেভাবে ছুড়ে মারে, তা ছিল এক অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার। ফেলার পর জালটা আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনত হাতের মুঠোয়। তখন দেখা যেত, জালে আটকে পড়া মাছগুলো লাফাচ্ছে। পুঁটির সাদা আঁশ জ্বলজ্বল করছে, টেংরা বা চিংড়ি, তাজা সব মাছ শিকারের আনন্দ অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা হবে না। ভোরে কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মিনার দেখত, জাল ফেলছে কেউ। লোকটার গোড়ালি পর্যন্ত কাদায় ডুবে আছে। মাছ ধরার ব্যাপারটা দেখতে পেলে মিনার ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ত। আর বাসায় ছোট মামার বেড়াতে আসার জন্য অপেক্ষা করত। মামা এলে মাছ ধরার ইচ্ছাটার কথা জানাত সে। কিন্তু জাল ফেলার ব্যাপারটা তার এ জীবনে স্বপ্নই থেকে গেল। ছোট মামা যতবার মাকে বলেছে, ততবার মা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘পাগল, তুই তাহলে জালো হইতে চাস!’ কিন্তু কেউ বোঝার চেষ্টা করেনি যে এটা একটা স্বপ্নে মতো ব্যাপার। কুয়াশার ভেতর, স্থির পানিতে ঝপ করে জাল পড়ার পর দু–একটা মাছের লাফ, পানির সিম্ফনি—এসব তো ভাষায় ধরা যাবে না, এ দৃশ্যের সৌন্দর্য ভাগ হয় হৃদয় আর মস্তিষ্কে। যাহোক, সন্ধ্যায় যুবকদের মাছ ধরার দৃশ্য দেখে মিনারের মনে হলো, একটা বড়শি কিনে আনলে কেমন হয়? বারান্দা থেকে বড়শিতে যদি বড় কোনো মাছ উঠে আসে, সেটা জীবনের বিরাট এক স্মৃতিময় ঘটনা হয়ে যাবে।

তিন

স্কুল ভালো লাগছে। স্কুলের লম্বা বারান্দা দেখে মনে হচ্ছে, জীবন বড়। স্কুলে একসঙ্গে চারজন নতুন শিক্ষক জয়েন করেছে, চারজনই ব্যাচেলর। আশ্চর্যজনকভাবে, দুজন ছেলে আর দুজন মেয়ে। এর মধ্যে এষা, অঙ্কশিক্ষিকা, দুচোখে পৃথিবীর মায়া আর রহস্য জড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেই মায়া আর রহস্যঘেরা চোখজোড়া মিনারের দিকে নজর রাখছে। ক্লাসের ফাঁকে টুকটাক কথা হচ্ছে দুজনের। কথা শুরু হচ্ছে এষার কাছ থেকে। মিনার ব্যাপারটাকে ঠিক কোনো ধারণার মধ্যে ফেলছে না। সে ক্লাস নিয়ে, তার পুরোনো স্কুলের বারান্দায় হেঁটে হেঁটে দেখে স্মৃতি রোমন্থন করে দিনাতিপাত করছে। পুবের জানালায় উঁকি দিয়ে, বকুলগাছটা আছে কি না, তা দেখার চেষ্টা করে। গাছটা আছে, জাঁকজমকের সঙ্গেই আছে। বর্ষা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো ফুল ফুটে আছে। একদিন সময় করে গাছের নিচ থেকে কিছু বকুল কুড়াতে হবে, যেন ব্যাপারটা কৈশোর কুড়ানো!

মিনারের মনে পড়ে, তার একটা বড়শি কেনা দরকার। বড়শিটা কেমন হবে, ছোট না বড়, সাধারণ বড়শি, নাকি তাতে হুইল লাগানো থাকবে, এসব নিয়ে সে ভাবতে থাকে। সে আরও ভাবনায় পড়ে যায়, পরের কয়েকটি সন্ধ্যায় বড়শি হাতে যুবকদের দেখে। মাছ কেমন ধরা পড়ে, ওরা কী রকম বড়শি হাতে বসেছে, এসব লক্ষ করতে গিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নজর রাখে মিনার। দেখতে পায়, কেউই আসলে মাছ ধরায় মনোযোগী নয়। তাদের মনোযোগ অন্য কিছু নিয়ে। বড়শি ফেলে বাঁ দিকে, মানে পশ্চিমে, মূল রাস্তা থেকে যেদিক প্রথমে গলিটা ঢুকেছে, যেখানে ব্রিজটা দেখা যায়, ব্রিজের পর থেকে নদীর ওপর ঝুঁকে থাকা বাড়িগুলো, সেদিকে যুবকদের চোখ। মিনারের মনে হয়, মাছ কি ওদিক থেকে আসে? ওদিকটায় নদীর কি কোনো আলাদা বিশেষত্ব আছে? ব্যাপারটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এ রকমই হয়, এক এলাকার ইতিহাস, আচরণ অন্য এলাকা থেকে এসে প্রথমে ধরা যায় না। সে যখন এই শহরে ছিল, তখন ছোট। গাছ দেখে, পথ দেখে, নদী দেখেই মুগ্ধ। মানুষের ভেতরের আবহ তখন তার বোঝার কথা নয়। এখানে মাছ ধরার ধরনটা মনে হয় আলাদা! মিনার নিশ্চয়ই খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, নাহয় খেলাটা সে নিজের মতো করে খেলবে।

আরেকটা ব্যাপার। ব্রিজ থেকে মোড় নিয়ে গলিতে ঢুকেই একটা বাড়ি। যার গেট দেখে যে কারও চোখ আটকে যাবে। গেট অদ্ভুত রকম বড়, তাতে অপরূপ কারুকাজ। কিন্তু সহসা এসব কারুকাজের কোনো অর্থ বের করা যাবে না। আসলে মিনার কখনো গেটের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়ায়নি, দাঁড়ানোটা তো শোভনও নয়। কাউকে দাঁড়াতে দেখেওনি, দাঁড়ালে হয়তো বুঝতে পারত। শুধু গেটের একপাশে নামফলকে লেখা ‘সরকার বাড়ি’। বিরাট গেট ও উঁচু প্রাচীরঘেরা বাড়িটা নিশ্চয়ই ক্ষমতাবান কারও। বাড়ির উঁচু প্রাচীর ভেতরটাকে বাইরের জগৎ থেকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলেছে। বাইরে থেকে গাছের সারি আর মিনারের মতো একটা টাওয়ার দেখা যায়। রাতে ওই উঁচু টাওয়ারের একটা বা দুটো ঘরে অস্পষ্ট আলো চোখে পড়ে। সেসব আলো সাদা না অন্য কোনো রঙের, কিছু বোঝার উপায় নাই, ক্যামোফ্লেজ বানিয়ে রাখে। এই দৃশ্য মিনার তার নতুন বাসার বারান্দা থেকেও দেখেছে অনেকবার।

চার

বড়শি কিনতে গিয়ে মিনারকে এমন এক পরিস্থিতির ভেতর পড়তে হয়, যা তার কল্পনায়ও ছিল না। বড়শি কেনার কথা শুনে দোকানদার পান চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, ভাইজান, আপনার বাসাটা জানি কই?’ মিনার এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পার না। সে যে এ শহরে নতুন এসেছে, আঞ্জুমান স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে, এত সব কথা তো বলা যায় না। যায় হয়তো, তার বলতে ভালো লাগে না। মিনার চুপ করে থাকায় দোকানদার এবার জানতে চায়, ‘বাবলা ভাইয়ের পারমিশন আছে?’

বাবলা ভাইয়ের পারমিশন মানে! লোকটার কথা মিনারের কাছে দুর্ভেদ্য লাগে। তার মনে হয়, লোকটার মাথায় ছিট আছে। বড়শি কিনতে আবার অনুমতি লাগে নাকি? এটা কি বন্দুক, নাকি কার্তুজ? মিনার কথা না বলায় দোকানদার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘যান, চলে যান। এভাবে বড়শি কিনতে পারবেন না।’

একটা বড়শি কেনার ব্যাপারে কারও কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়, জীবনে এই প্রথম শুনল মিনার। এখানে মিনার ক্লাস ফোরে পড়ার একটা বছর ছিল। যথেষ্ট ছোট থাকায় বোধ হয় কখনো জানতে পারেনি যে বড়শি কিনতে অনুমতি নিতে হয়। বা তখন হয়তো ব্যাপারটা ছিলই না। কিন্তু এখন কেন থাকবে? এটা তো বাংলাদেশেরই একটি শহর। এখানে বড়শি কেনার জন্য আলাদা আইন থাকার কথা নয়। সে বিরক্ত হয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসে। বের হয়ে রাস্তায় নামামাত্র দেখতে পায়, স্কুলের দপ্তরি লিটন দাঁড়িয়ে। মিনারকে সালাম দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনে এইখানে?’

মিনারের এবার আরও বিরক্ত লাগে। এই সময়ে লিটনকে কেন এখানে আসতে হবে? সে কোনো কথা বলে না। লিটন এর মধ্যে হাসি হাসি মুখ করে মিনারকে পাশ কাটিয়ে দোকানে ঢুকে যায়।

‘কাকা, উনি আমাদের স্কুলের নতুন স্যার। বড়শি নিতে আইছিল নাকি? উনি কিন্তু উঠছেন নিরঞ্জন কাকার বাড়িতে।’

এ কথার পরমুহূর্তে দোকানদারের সুর পাল্টে যায়, ‘কোন নিরঞ্জন, নদীর পাড়ের নিরঞ্জন দাদা?’

উত্তরে লিটন মাথা নাড়ালে দোকানদার ছিটকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। হন্তদন্ত হয়ে কয়েক পা এগিয়ে মিনারের পথ রোধ করে দাঁড়ায়।

‘স্যার, বলবেন না যে আপনে নিরঞ্জন দাদার বাড়িতে উঠছেন। আসেন স্যার, আসেন। উনার বাড়ি নদীর উপ্রে, ওখানে থাকলে তো বড়শি দরকারই।’

কী ঘটছে, মিনার তার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সে ‘আমার বড়শি লাগবে না’ বলে পা বাড়ালে দোকানদার আবার পথ আটকায়। এবার কণ্ঠ কাকুতিভরা, ‘স্যার, বড়শির টাকা এখন দেওয়ার দরকার নাই। নিয়ে যান, যখন ইচ্ছা হয় দিয়েন।’

লোকটার কথায় একটা বিরাট সংশয় মিনারের মাথায় ঢুকে পড়েছে। সে একটু ভয়ও পাচ্ছে। সে তড়িঘড়ি দোকানদারকে পাশ কাটিয়ে হাঁটা শুরু করলে পেছন থেকে লোকটা বলে, ‘স্যার, বড়শিটা নিয়ে গিয়ে আমাকে বাঁচান। স্যার, নিয়ে যান।’

এ কথায় মিনার হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। তার মনে হয়, এই বড়শি কেনার সঙ্গে ঘোরতর কোনো ব্যাপার জড়িয়ে আছে, তার এখান থেকে দূর সরে পড়াই মঙ্গল।

পাঁচ

মধ্যাহ্নবিরতিতে হঠাৎ টিচার্স রুমটা প্রায় খালি হয়ে গেল। মিনার ছাড়া আর আছে শুধু দুজন। তার দুই চেয়ার পর এষা। আর টেবিলের উল্টো দিকে একই সঙ্গে জয়েন করা আরেকজন; ফিরোজ। এই ফাঁকা হয়ে যাওয়ার দুপুরে তিনজন মানুষ পুরো টিচার্স রুমের পাহারায় থেকে গেল। এর ভেতর এষা ব্যাগ থেকে একটি টি-প্যাক বের করে মিনারকে ইশারা করে বলল, ‘আল গ্রে খাবেন?’

মিনারের শব্দটা পরিচিত মনে হলো না। ম্যাডামের হাতে ঝুলতে থাকা চায়ের প্যাক দেখে তার মনে হলো, চায়ের কোনো ব্র্যান্ড বা ফ্লেভার হবে। সবেগে মাথা নাড়িয়ে মিনার জানিয়ে দিল যে সে খেতে আগ্রহী। মিনারের সম্মতি পাওয়ার এক মিনিটের মধ্যে চা হয়ে গেল। কেটলিতে পানি গরমই ছিল। এষা ম্যাডাম নিজে চা বানিয়ে মিনারের সামনে কাপটা রেখে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। মিনার খানিকটা বিব্রত হয়ে বলল, ‘আপনি নিজে বানালেন! লিটন কোথায়? ওকে বললেই তো হতো।’

‘ও তো আজ ছুটিতে। আর চা আমি নিজে বানাতে পছন্দ করি। আমার প্রিয় ফ্লেভার, খেয়ে জানাবেন, কেমন লাগল।’ মিটিমিটি হেসে কথাগুলো বলল এষা। লিটনের কথা ওঠায় গতকালের ঘটনাটা মাথায় এসে ধাক্কা দেয়। এতে সুন্দর দুপুরটা কেমন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। আরেকটা অস্বস্তি লাগে মিনারের, টেবিলের উল্টো দিকে বসা ফিরোজ, তার দিকে এষা একবারের জন্যও তাকাল না। মিনার খানিকটা বিব্রত ও লজ্জিত ভঙ্গিতে ফিরোজকে বলল, ‘ভাই, চা চলবে?’ উত্তরে ফিরোজ না–সূচক মাথা নাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এষা তাদের কথায় কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ করে না।

এত কাছে বসায় এষার শরীরের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে মিনারের। চায়ে চুমুক দিলে, নাকে এসে লাগল অন্য আরেকটা ঘ্রাণ। এষা বলে যায়, ‘চা আমার পছন্দ। বিশেষ করে ব্ল্যাক টি। নানা রকম চা আমার সঙ্গে থাকে। আপনার ভালো লাগলে জানাবেন। আর জানেন, এখানে একটা চায়ের দোকান হয়েছে। যাবেন? খুব নাকি সুন্দর! আজ সন্ধ্যায় সময় হবে?’

মিনারের মনে হলো, একটা সুন্দর দুপুর তার পাশে এসে বসেছে। ঘ্রাণ, অধর, চোখ, শাড়ি পরা এষার নিশ্বাস নেওয়ার গতি আর ফাঁকা হয়ে যাওয়া রুম—কেমন অপূর্ব সব ব্যাপার! এষা একটানা এতগুলো কথা বলে ফেললেও মিনারের বিরক্ত লাগল না।

‘যাওয়া যায়। সন্ধ্যায় আমার তেমন কোনো কাজ নেই।’ এ কথার উত্তরে এষা মিনারের কাছ থেকে তার নম্বরটা চেয়ে, নিজেরটাও দিয়ে রাখল।

ছয়

মিনার ক্লাস শেষে সরাসরি বাসায় চলে আসে। পথে সে দেখতে পায়, মন্দিরের কাছে বড়শি হাতে কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওদের খুব গম্ভীর দেখায়, কিন্তু চোখে-মুখে অসম্ভব অস্থিরতা। আজ মাছ ধরার ব্যাপারটা নিয়ে মিনার আর ভাবতে চায় না। কিন্তু এর মধ্য থেকে দুটা ছেলে বড় বড় চোখ করে মিনারকে দেখে। ওদের চাহনিতে রাগ স্পষ্ট, চোখ খুব লাল। মিনার অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে, না দেখার ভান করে বাসায় ঢুকে পড়ে। তার মনে হয়, মাছ ধরার আগে ছেলে দুটো নেশা করে নিয়েছে।

মিনারের সময় যাচ্ছে না একদম। তৈরি হয়ে দেখে, ছয়টা বাজতে আরও এক ঘণ্টা বাকি। রিকশায় পাশাপাশি বসে, এই ছোট্ট মফস্সল শহরে এক রহস্যঘেরা চোখের নারীর সঙ্গে সন্ধ্যাটা ভাগ নেওয়ার ব্যাপারটা একদম অপ্রত্যাশিত। কখন কী ঘটবে, তা কোনোমতেই আগে অনুমান করা যায় না। তবে এমন পরিস্থিতিতে কী কথা হবে তাদের, এটা মিনারকে ভাবায়। সে বরাবর চুপচাপ, সুতরাং এটাই তার সহজাত। এষা যা বলবে, তার উত্তর ধরেই এগোবে সে।

কেউ একজন দরজায় নক করে। মিনার ‘কে’ বলতে বলতে দরজা খুলে দেখে, বাড়ির মালিক নিরঞ্জন কাকা। ‘মাস্টার সাব কি কোথাও বাইর হইতাছেন?’ বলে ঘরে ঢুকে পড়েন তিনি। মিনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়।

‘আমার বাসায় অনেক রকম বড়শি আছে। এমন ছিপ আছে, যার চেহারা দেখলে প্রেমে পইড়া যাইবেন।’ মিনার কোনো কথা না বলে লোকটার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তিনি আবার বলতে শুরু করেন, ‘শুনেন। বড়শি, ছিপ বা হুইল বড় কথা না। মাছ ধরার কৌশলটা, মানে চালাকিটা জানতে পারাটা, বুঝতে পারাটাই বড় কথা।’

নিরঞ্জন বাবুর কথা শুনতে শুনতে মিনার উসখুস করে। তাকে তো একটু পর বের হতে হবে, এষা ম্যাডাম তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। নিরঞ্জন কাকা যে লাইনে হাঁটতে শুরু করেছেন, তা বড়শি বিক্রেতার মতোই, কেমন জানি দুর্ভেদ্য! মিনার মনে মনে প্রস্তুতি নেয়, কিছু একটা বলে বিদায় দেওয়ার। ঠিক তখন নিরঞ্জন বাবু বলতে শুরু করেন, ‘শুনেন, দোকানদার আইসা আপনার জন্য একটা বড়শি রাইখা গেছে। ওইটা খুব ভালো ছিপ, তা বলা যাবে না। আমার বাসার কোনো ভাড়াটিয়া বড়শি কিনতে গেলে চা-নাশতা খাওয়াইয়া বড়শি বিক্রি করে। এই শহরের বড়শি বিক্রেতাদের জন্য এটা নিয়ম। আপনাকে প্রথমে চিনতে পারে নাই। তার জন্য তিন মাস ওর বড়শির দোকান বন্ধ থাকব। যা–ই হোক, চলেন, আমার বাসার বড়শি দেখাই। কত রকমের ছিপ আর হুইল যে আছে! দেখবেন, পুরা একটা ঘরভর্তি। আপনার অন্য কাজ এক ঘণ্টার জন্য রাখেন। এই আজকে বড়শি দেখার বিষয়টা ধরেন আপনার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠবে।’

কথা বলতে বলতে নিরঞ্জন কাকার চোখ ভীষণদর্শন হয়ে ওঠে। গলার স্বরও গম্ভীর এবং আদেশের মতো শোনায়। মিনার আর কিছু বলার সাহস পায় না। সে বুঝে উঠতে পারে না, এই বাড়ির মালিক নিরঞ্জন বাবু কোন ধরনের লোক! প্রথম দিন বাসা নিতে এসে মনে হয়েছিল একজন নিরীহ, সাতপাঁচে না থাকা মানুষ। শহরটাই বা কোন ধরনের, তা–ও সে বুঝতে পারছে না।

যখন বড়শি আর নানা রকম ছিপের ঘরটা দেখানো শেষ হলো, তখন ঘড়ির কাঁটা ৬টা পেরিয়ে আরও ৩০ মিনিট এগিয়ে গেছে। নিরঞ্জন বাবু বলেন, ‘আপনাকে বোধ হয় বড়শি নিয়ে বসতে হবে, এবারের বড় মাছটা আপনার হাতে ধরা পড়বে, আমি দেখতে পাচ্ছি।’ মিনার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ভাবে, লোকটা কি ছিটগ্রস্ত? বড়শির দোকানদারের সঙ্গে এর কি কোনো যোগসাজশ আছে? মিনার কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিরঞ্জন বাবু মিনারকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘বোধ হয় কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যান যান, দেখা করেন গিয়ে। কিন্তু তাড়াতাড়ি চইল্যা আইসেন।’

শেষের কোনো কথা মিনারের মাথায় ঢোকে না। সে বাড়ি থেকে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে এষা দুবার কল করেছিল। ধরার মতো অবস্থায় তখন ছিল না। এবার মিনার এষাকে ফোন করে। কিন্তু অপর প্রান্তে কেউ ফোন রিসিভ করে না। সে মোড়ে এসে একটা রিকশা পেয়ে গেলে এক লাফে উঠে বলে, ‘তেরি বাজার।’

সাত

গলি থেকে মূল রাস্তায় উঠে মিনার আবার কল করে। এবার এষা ফোন রিসিভ করলে, ‘সরি, একটা অসুবিধায় পড়ে গিয়েছিলাম। রওনা হয়ে গেছি’ কথাগুলো একটানা বলে মিনার। উত্তরে অন্য প্রান্ত থেকে স্থির ও কোমল স্বরে একটা শব্দ ফিরে আসে, ‘আসুন।’

মিনার একটু ভালো বোধ করে। এষার সঙ্গে রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা আবার মাথায় ফিরে এসেছে। সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে এষার সঙ্গে রিকশা ভাগাভাগি করা মুহূর্ত মনে হলো উঁকি দিয়ে আছে। রিকশা ব্রিজ পেরিয়ে মোক্তারপাড়ায় চলে এল। এষা কয়েক মিনিটের দূরত্বে। তখন কেউ একজন তীব্র স্বরে ডেকে ওঠে, ‘এই মিনার, এই।’

এই ডাকে মিনারের আত্মা কেঁপে ওঠে। এত স্পষ্ট আর তীব্র স্বরে এই শহরে কে আছে তাকে ডাকার? সে রিকশা থামাতে বললে একটা মোটরসাইকেল সামনে এসে দাঁড়ায়।

‘মিনার, তুই যে এসেছিস, আমাদের স্কুলের মাস্টার হইছিস, সে খবর আমি পাইছি। কাজের কারণে শহরের বাইরে ছিলাম দুই সপ্তাহ। কাল ভাবছিলাম স্কুলে যাব দেখা করতে। পথে তোরে পাইয়া গেলাম।’

মিনার চিনে ফেলে, এটা তমাল। সে রিকশা থেকে নেমে আবার উঠে পড়ে। তমাল বলে, ‘কী রে, নেমে আবার উঠে পড়লি যে! রিকশা ছেড়ে দে। চল, দুই বন্ধু চা খেয়ে আসি।’

মিনার সঙ্গে সঙ্গে ফোনের সুইচ অফ করে দেয়। তার মনে হয়, এষাকে কিছু বলার মতো শব্দ তার কাছে নেই। এখন কি তার ‘সরি! একটা বড় ঝামেলায় পড়ে গেছি’ বা ‘আজ মাফ করে দিন’—এ রকম মেসেজ লেখা সম্ভব? রিকশা ছেড়ে দিয়ে মিনার তমালের পেছনে উঠে বসে। তমাল বলে, ‘নতুন একটা চা খাওয়ার জায়গা হইছে, শহরের পাশে, খুব সুন্দর। চল, ওইখানে।’

মিনার এ নিয়ে কথা বাড়ায় না। বিশ বছর পর বন্ধুর সঙ্গে দেখা, এটা তো কোনোভাবেই ডিঙানো সম্ভব নয়। হাওয়ায় শার্ট উড়ছে, চুল উড়ছে, উড়তে উড়ড়ে দুজন একটা চায়ের দোকানে পৌঁছায় দুজন। পৌঁছে মনে হয়, মফস্সল শহরে এমন একটা চা খাওয়ার জায়গা রীতিমতো কল্পনাকেও হার মানাচ্ছে। রাস্তার পাশে চায়ের দোকান মানে ক্যাফেটা, পাশে ধানখেত, এর ভেতর এ যেন এক আলো-আঁধারির বাগান। পুরো জায়গায় চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে একটি ঘোরতর সুন্দর বসার জায়গা বানিয়ে রেখেছে। তমাল মিনারকে সঙ্গে নিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়ে। দুটোই চেয়ার, টেবিলটায়; আর পাশে একদম লেগে থাকা একটা গন্ধরাজগাছ। ফুল কয়েকটা আছে, অসম্ভব সুন্দর ঘ্রাণ ছাড়াচ্ছে।

‘আমি শুনছি, তুই আমাদের শহরে ফিরে আসছিস। তবে তার চেয়ে বড় কথা, তুই বিরাট ভাগ্য নিয়ে আসছিস।’

তমালের কথা ঠিক বুঝতে পারে না মিনার। এ শহরের মানুষদের কথাগুলো কি এ রকমই! নিজেরা নিজেদেরটা হয়তো বোঝে। কিন্তু বাইরে থেকে কেউ এল, তার জন্য খুব দুর্বোধ্য!

‘কী বিরাট ভাগ্য, বল তো?’

মিনারের কথায় তমাল শব্দ করে হেসে ওঠে। বলে, ‘দাঁড়া, চায়ের অর্ডারটা দিই আগে। কী চা পছন্দ তোর?’

মিনার হাসতে হাসতে বলে, ‘আল গ্রে।’

‘মানে!’ তমাল একটু অবাক হওয়ার ভান করে। পরমুহূর্তে ঘাড় ফিরিয়ে গলা উঁচু করে বলে, ‘দুইটা মালাই চা।’

দুজন মুহূর্তেই তাদের কৈশোরের গল্পে ঢুকে যায়। তানি নামে যে এক মেয়ে ছিল, যার জন্য প্রায় পুরো ক্লাস পাগলপ্রায়, তাকে নিয়ে দুই বন্ধু আলাপে ঢুকে পড়ে। সেই তানি কোথায়, তা কেউ জানে না। তানির বাবা বদলি হয়ে প্রথমে যায় ঢাকায়, তারপর দিনাজপুরে। ওই পর্যন্ত খোঁজ ছিল, তারপর আর কিছু জানা যায় না। চা চলে এলে দুজন আধো অন্ধকারে, গন্ধরাজ ঘিরে থাকা টেবিলে বসে তানির জন্য বিষণ্ন বোধ করে। কী অদ্ভুত, মুহূর্তে কৈশোর এসে দুইবন্ধুকে বিষণ্ন করে দেয়! তখন একটা রিকশা এসে থামে ক্যাফের গেটে। রিকশায় এষা আর ফিরোজ। এই দৃশ্য দেখে হঠাৎ মিনার বিষণ্নতার সঙ্গে গম্ভীরও হয়ে যায়। সে অবাক হয়ে লক্ষ করে, ওরা এসে ঠিক পাশের টেবিলটায় বসে। ওই টেবিল ঘিরে আছে একটা বেলি ফুলের গাছ। ওদের খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। এষা কি জানত, মিনার এষাকে রেখে তার বন্ধুর সঙ্গে এখানে আসবে? তার জন্য সে প্রতিশোধ নিল? ধুর, এ রকম জানা যায় নাকি? তমালের সঙ্গে দেখা হবে, তেমন কোনো সম্ভাবনাই তো ছিল না। ছেলেমানুষের রোমান্টিসিজম দেখে সৃষ্টিকর্তাও বোধ হয় এদের গর্দভ বলে ডাকে। সে যা–ই হোক, কিন্তু এত পাশে বসার পরও মিনারকে ওরা দেখতে পেল না কেন? এষার বোধ হয় না দেখার অসুখ আছে!

আট

‘বিরাট ভাগ্য’ বিষয়ক আলোচনাটা আর হলো না। দুই বন্ধু কিছুক্ষণ খাপছাড়া কথার ভেতর ঘুরপাক খেয়ে চলে এল। ব্রিজের কাছে মিনারকে নামিয়ে দিয়ে তমাল বলল, ‘আমি যাই, ওইটুকু তোকে রিকশা করে যেতে হবে। আমার যাওয়ার নিয়ম নাই।’

তমাল আর একমুহূর্ত দেরি না করে চলে গেল। এসব অদ্ভুত কথা মিনারের মাথায় ঢোকে না। শহরের প্রত্যেক মানুষ, যার সঙ্গেই মিনারের কথা হচ্ছে, মনে হচ্ছে কমবেশি ছিটগ্রস্ত। তমাল চলে গেলে মিনারের একা একা বোধ হয়। মনে হয়, দুই সপ্তাহ পেরোনো এই নতুন জীবনে হঠাৎ সে একা হয়ে গেছে। তখন একটা রিকশা এসে বলে, ‘স্যার, যাইবেন? এরপর আর রিকশা কিন্তু পাইবেন না।’ কী আশ্চর্য, কী বলে এসব! মিনার এদের কথা বুঝতে পারে না। কিন্তু সে ভয় পায়। কিছু একটা আছে এদের কথায়। সে একলাফে রিকশায় উঠে পড়ে। বলে, ‘চলেন।’

গেট পার হয়ে বারান্দায় উঠে আসবে, তখন দেখে নিরঞ্জন কাকা, সঙ্গে আরও দুজন দাঁড়িয়ে।

‘কী ব্যাপার মাস্টর সাইব, এত দেরি যে? উনারা আইছেন আপনারে নিতে। তাড়াতাড়ি যান।’

কী বলছে লোকটা! এরা কারা? দুজন বিশালবপুর মানুষ খুব বিনয়ের সঙ্গে নিরঞ্জন বাবুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই বিনয় মিনারকে আশ্বস্ত করে না। তার ভয়ে হাত-পা কাঁপতে থাকে। বলে, ‘কোথায় যাব, নিরঞ্জন কাকা।’

‘যাবেন তো আপনার সৌভাগ্যে, যান।’ তার পাশে রাখা হুইলওয়ালা একটা বড়শি ধরিয়ে দিয়ে নিরঞ্জন বাবু প্রায় ধাক্কা মেরে মিনারকে বারান্দা থেকে নামিয়ে দেয়। মিনার ধাক্কা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নিরঞ্জন বাবু লোকটা আসলে কে? এর উত্তর তার জানা সম্ভব না হলেও, তাকে যে নির্দেশ পালন করতে হবে, সেটা নিশ্চিত। নিরঞ্জন বাবু বলে যায়, ‘যান, তাড়াতাড়ি যান। আপনার বিরাট ভাগ্য। ভাগ্য বলেই তো নদীর ওপর এমন সুন্দর ঘর আপনি পেয়েছেন।’

নয়

গাড়ি সরকার বাড়ির প্রথম গেট বিনা বাধায় পার হয়ে ঢুকে গেলে মিনার ভাবে, এটাই তাহলে সৌভাগ্য? সে বাসা থেকে বেরিয়ে দেখে, বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শব্দহীন গাড়ির ড্রাইভিং সিটে দুজনের একজন, তার পেছনের সিটে বড়শি হাতে মিনার, মিনারের পেছনের সিটে অন্যজন। এ রকম একটা ভয়ানক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে মিনার সরকার বাড়ির গেটে পৌঁছায়। প্রথম গেটের পর আরেকটা গেট। দ্বিতীয় গেটে এসে মিনার দেখে, ডজনখানেক পাহারাদার, এর মধ্যে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীও আছে। এখানকার সবার ভঙ্গিতে বিনয় গলে পড়ছে, কিন্তু চেহারা ভয়ালদর্শন। গাড়ি দেখে পাহারাদারের দল টপাটপ স্যালুট করে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। মিনারের মনে হয়, স্যালুট বোধ হয় তার সঙ্গে থাকা দুটো লোকের জন্য বরাদ্দ হলো। আবার মনে হয়, তাকে দেখেই এমন আনুগত্য দেখাচ্ছে। কিন্তু এই অনুভূতিও তার ভয়ের পরিমাণ কমাতে পারে না। দ্বিতীয় গেট পেরোনোর পর গাড়ি বদল হলো। মিনারকে নিয়ে আসা গাড়ি এবং সঙ্গের বিশালবপুর দুজন এখানে থেকে গেল। অন্য এক পেশিবহুল সুদর্শন দুই সিটের একটা গাড়িতে মিনারকে উঠিয়ে নেয়। মিনার কয়েক মিনিট ধরে সেই গাড়িতে যেতে যেতে অভিভূত হয়ে চারদিকটা দেখে। বাইরে থেকে সে নদীর পাড়ঘেঁষা লম্বা লম্বা গাছের সারি দেখেছে, কিন্তু এর ভেতরটা এত বিশাল, এত অভিজাত, তা তার কল্পনাতীত।

গাড়ি মিনিট দুই চলে একটা বিশাল প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। মিনার ভাবে, এ রকম এক প্রাসাদ এই মফস্সল শহরে, নদীর স্যাঁতসেঁতে পাড় ঘেঁষে আছে, এটা বিস্ময়কর! এমন এক পরিস্থিতিতে সে এই প্রাসাদের সৌন্দর্যের ভেতর বসে ভয়ের কথা ভাবছে না।

প্রাসাদের সামনে কয়েকজন নারীকে ফুল হাতে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এরা প্রত্যেকেই সুন্দর ও স্মার্ট। মিনার এই দৃশ্যের নিচে পৌঁছে বিহ্বল হয়ে থাকে। ফুলের তোড়া হাতে অপরূপ নারীরা হাসিমুখে তাকে বরণ করে নেয়। এ মুহূর্তে তার মনে হয়, পৃথিবী যেন এক আশ্চর্য রঙ্গমঞ্চ। মানুষ এর ভেতর একটা হাইড্রোজেনের পিণ্ড। যেকোনো সময় তা ফেটে যাবে, মিলিয়ে যাবে, ঢাকা পড়বে মাটিতে। মিনারকে নারীরা প্রাসাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে, একটা টেবিলের সামনে বসিয়ে দেয়। টেবিলে অনেক খাবার সাজানো। খাবার দেখে মিনারের মনে হয়, বাসায় ফিরে সে খাওয়ার সময়টুকুও পায়নি। পাবলো নেরুদা বনের ভেতর কয়েকজন সুন্দর সাদা পোশাকের নারীর কাছ থেকে যে আদর-আপ্যায়ন পেয়েছিল, সেটা কি তার জীবনেও ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু সে তো কবি নয়। এখানকার সবকিছু এত ঝকঝকে যে ঘোর লেগে যাচ্ছে বারবার। মিনার খাবারের কথা ভুলে মুহূর্তে দেয়ালে ঝুলে থাকা বিশাল পেইন্টিং আর কাঠের নানা কারুকাজ দেখে হা হয়ে বসে থাকে। দাবার কোর্টের মতো মেঝে দেখে মনে হয়, এটা কোনো ফারাও রাজার প্রাসাদ। মিনারকে এখানে বসিয়ে নারীরা চলে যায়। অপরূপ নারীদের এই প্রস্থান মিনারকে ব্যথিত করে।

কিন্তু এই ব্যথিত হওয়ার মুহূর্ত ক্ষণকালের। এক অপরূপ নারী ঢুকে যায় পরের দৃশ্যে। তার পেছন পেছন আসে অস্ত্রসজ্জিত পাহারাদারের দল। মিনার এই দৃশ্য দেখে সটান দাঁড়িয়ে যায়। নারীটি হাসিমুখে মিনারের কাছে এসে বসে। পাহারাদারদের কেউই দরজা পার হয় না। পরমুহূর্তে নারীটির ইশারা পেয়ে ওরা পিছু হটে, মানে আড়ালে চলে যায়।

‘কেমন আছ, মিনার?’

এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে মিনার? চোখ তুলে কী বলবে? এত দিন কোথায় ছিলেন? সে মাথা নামিয়ে বসে থাকে।

‘আমি দীপা। তুমি আমাকে চিনতে পারোনি? এই প্রাসাদ কি তোমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে?’

এ কথার পর মিনার মাথা তোলে। মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘হ্যাঁ।’

কিন্তু এ দীপা নয়। তার মনে হয়, দীপা যথেষ্ট সুন্দরী ছিল, এ কোনোভাবেইই দীপা হতে পারে না। নারীটি ইশারা করলে দুজন মেয়ে এসে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মিনার খেতে খেতে আড়চোখে নারীটিকে দেখে। একবার তার মনে হয়, এটা দীপা, আরেকবার মনে হয়, এটা দীপা হতে পারে না। দীপা হলে তার কৈশোরের অন্যরা কোথায়? দীপা এমন এক প্রাসাদের মালিক হবে, তার অতীত ইতিহাস তো তা বলছে না।

খাবার শেষ হলে নারীটি বলে, ‘চলো।’

মিনার আদেশপ্রাপ্ত হয়ে পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে, যেন রোবট। পাশের একটি ঘরে নানা রকম বনসাই। নারীটি বনসাইয়ের বিশাল সংগ্রহ দেখাতে মিনারকে নিয়ে আসে। গাছগুলো দেখিয়ে বলে, ‘আমার মন খারাপ হলে এখানে এসে একা সময় কাটাই। একেকটা বনসাইয়ের সৌন্দর্য একেক রকম। এদের আর্তনাদও আলাদা আলাদা। আমি ওদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। তারপর আস্তে আস্তে যখন মন স্থির হয়, তখন আবার কাজে ফিরি।’

নারীটির এমন নির্দয় সত্যদর্শন মিনারকে হতবাক করে দেয়। এ ঘর থেকে বেরিয়ে লম্বা বারান্দা ধরে নারীটি হাঁটতে থাকলে, মিনারকেও হাঁটতে হয়। আর অনেকটা পেছনে পাহারাদারের দল। কিছ দূর যাওয়ার পর মিনারের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়। নদীর পানি একটা জায়গা পর্যন্ত উঠে আসছে। পরের ঢেউটাও ঠিক একই জায়গায় এসে আর এগোচ্ছে না। কোনোভাবে এটার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এখানে পানি এত স্বচ্ছ যে ভেতরের মাছ দেখা যাচ্ছে। মিনার যে বাড়িতে উঠেছিল, সেখান থেকে একবারও মনে হয়নি, এই নদীর পানি এত স্বচ্ছ। নারীটি বলল, ‘মাছ ধরার জন্য এটা খুবই উপযুক্ত জায়গা। আর মন খারাপ হলে পানির মধ্যে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে মাছ এসে পা কামড়ে যায়। শিকারি মাছ, তবে ভয়ের কিছু নেই, এখানে শার্ক থাকে না।’

মিনার কোনো কথা বলে না। নারীটি মিনারকে তুমি–তুমি করে কথা বলছে। এর ফলে মিনারের একবার ভালো লাগছে, একবার অপমানিত বোধ হচ্ছে। মিনার অপমানের ভেতর আছে, না ভালো লাগার ভেতর, তা সে তুমি বা আপনি বলতে পারলে বুঝতে পারত। কিন্তু ভয়ে তার কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।

নারীটি হঠাৎ বলে, ‘আমি আসি। তোমাকে অন্যরা সময় দেবে।’ এ কথা বলে নারীটি পাশের এক বারান্দা দিয়ে মিলিয়ে গেল। তখন দুজন পাহারাদার এসে বলল, ‘স্যার, আসুন।’

মিনার তো স্যারই। তবু এই ‘স্যার’ শব্দ তাকে স্বস্তি দিল। এদের সঙ্গে এগিয়ে গেলে মিনারকে একটা ঘর দেখিয়ে বলে, ‘স্যার, এটা আপনার ঘর।’

মিনার ঘরে ঢুকে যথারীতি অভিভূত হয়ে যায়। জানালা দিয়ে নদী দেখা যাচ্ছে, নদীর ওপারে শহরটা কী সুন্দর এখানে! পাহারাদার দুজন মিনারকে রেখে চলে যায়। ওরা চলে যাওয়ার পর আসে একজন পরিপাটি পুরুষ। সে এসে সালাম দিয়ে একটানা বলতে থাকে, ‘স্যার, আমি আপনার ব্যক্তিগত সহকারী। নিরঞ্জন স্যার আপনাকে যে বড়শিটা দিয়েছে, তা দিয়ে আপনাকে নদীর বড় মাছটা ধরতে হবে। তাহলেই দীপা ম্যাডামের মন আপনি পাবেন। এর সঙ্গে পাবেন এখানে দুবছর থাকার সুযোগ। দুবছর থাকতে পারা মানে হলো, এরপরের জীবনটা আপনি কোনো দূরদেশে বিত্ত-বৈভব নিয়ে আরাম করে কাটিয়ে দিতে পারবেন। আর যদি ব্যর্থ হন, তাহলে একটি বনসাই হয়ে ওই ঘরে জীবন কাটানো ছাড়া আর পথ থাকবে না। ব্যর্থ হয় না, ব্যর্থ হয় খুব কম মানুষ। আপনি তো দেখেছেন, হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা বনসাই। কিন্তু জয়ী হয়ে বিত্ত-বৈভবঘেরা জীবন কাটাচ্ছে, সে তালিকা অনেক দীর্ঘ। স্যার, শুভরাত্রি, সকালে আবার দেখা হবে।’

ব্যক্তিগত সহকারী নামে লোকটা চলে যাওয়ার পর মিনারের মাথা কেমন জানি স্থবির হয়ে যায়। তার পেট গোলাতে শুরু করে, মনে হয় পেট থেকে খাবার সব বেরিয়ে আসবে। সামনের জীবনটা তাকে বনসাই হয়েই কাটাতে হবে। দীপা নামক এক রাক্ষসীর অপরূপ প্রাসাদে মিনার পরিণত হবে একটি বনসাইয়ে। তার মাথা আর কাজ করে না। এমন একটা মুহূর্তে দরজায় কেউ একজন নক করলে মিনার বেশ কড়া স্বরে বলে, ‘আসুন।’

‘আমি দীপা।’ মিনার তাকিয়ে দেখে, সামনে দাঁড়ানো নারীটি সত্যি সেই দীপা, যাকে কৈশোরে এ শহরে হারিয়ে ফেলেছিল।

‘দীপা!’ মিনারের স্বর কাঁপে।

‘আমি তোমাকে সঙ্গ দিতে এসেছি। দূরদেশ বা বনসাই—তোমার জীবন এইভাবে ভাগ করা হয়েছে। আর আমি তোমার জন্য কৈশোরকে হাতে করে নিয়ে এসেছি।’

মিনার দীপার কথার উত্তরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার একবার মনে হয়, এটা কৈশোরের দীপা, আরেকবার মনে হয়, না, এটা অপরূপ রাক্ষসী দীপা!

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পর ম ন র ম ন র র মন এই দ শ য পর স থ ত মন দ র র দ র ভ তর ন র জন য দ ক নদ র ত র জন য ত র ভ তর র স ন দর এমন এক দ জন ম র স বর অন য ক ভ তর এ র জ বন র কয় ক ত র এক ত র মন এই প র ব রক ত র দ জন নদ র প য় র পর ব ধ হয় ম ন রক আম র ব র দ খত র স মন র ওপর আপন ক র একট সরক র বনস ই এ রকম অপর প ই একট প রথম ন একট রহস য র বড়শ এ শহর শহর র একব র দরক র আপন র

এছাড়াও পড়ুন:

জরুরি অবস্থা জারিতে লাগবে মন্ত্রিসভার অনুমোদন, থাকবেন বি‌রোধীদলীয় নেতা

জরুরি অবস্থা কীভা‌বে জা‌রি হ‌বে, এ বিষ‌য়ে ঐকমত‌্য হ‌য়ে‌ছে রাজ‌নৈ‌তিক দলগু‌লো। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী এককভা‌বে নন, ম‌ন্ত্রিসভার অনু‌মোদ‌নে জা‌রি হ‌বে জরু‌রি অবস্থা। এ-সংক্রান্ত ম‌ন্ত্রিসভার বৈঠ‌কে উপ‌স্থিত থাক‌বেন বি‌রোধীদলীয় নেতা বা উপ‌নেতা। 

রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১২তম দিনে এই ঐকমত্যে পৌঁছায় দলগুলো। সংলাপে সিদ্ধান্ত হয়- জরু‌রি অবস্থা হ‌লে নাগরিকের ‘জীবনের অধিকার’ এবং ‘নির্যাতন থে‌কে রক্ষা পাওয়ার অধিকার থাক‌বে’। জরু‌রি অবস্থা ঘোষণা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব‌্যবহার করা হ‌বে না। 

জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, ১৪১ এর ক এর ১ ধারা মতে রাষ্ট্রপতির কাছে যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, যা যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের দ্বারা বাংলাদেশ বা যেকোনো অংশের নিরাপত্তার বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তা হলে তিনি অনধিক ৯০ দিনের জন্য জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে বৈধতার জন্য জরু‌রি অবস্থা ঘোষণার আগে মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। 

বিদ্যমান সংবিধানে ১২০ দিনের কথা বলা আছে। একই সঙ্গে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রীর সই প্রয়োজন হয়। 

জরুরি অবস্থা নিয়ে গত ৭ ও ১০ জুলাই আলোচনা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে রোববারের আলোচনায় বলা হয়, বিদ্যমান ১৪১ (ক) সংশোধনের সময় অভ্যন্তরীণ গোলযোগের শব্দগুলোর পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখন্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সইয়ের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা। ওই সময়ে নাগরিকের দুটো অধিকার অলঙ্ঘনীয় করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৭ (৩) এর বিধান সাপেক্ষে কোনো নাগরিকের জীবন অধিকার, নির্যাতন ও নিষ্ঠুর, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর আচরণে বা শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার খর্ব করা যাবে না।
 
সংলাপে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সইয়ের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত দেখা যায়। 

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মন্ত্রিসভার পরিবর্তে সর্বদলীয় বৈঠক থেকে  সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আহমদ আবদুল কাদের মন্ত্রিসভার সঙ্গে বিরোধী দলকে যুক্ত করা প্রস্তাব দেন। 

আলোচনার এক পর্যায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জরুরি অবস্থা নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতার উপস্থিতি নিশ্চিতের প্রস্তাব করেন। এতে সমর্থন জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরে ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বিরোধীদলীয় নেতা না থাকলে কে উপস্থিত থাকবেন তা নিয়ে কথা বলেন। তিনি সে সুযোগ রাখার প্রস্তাব করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানান, বিরোধী দলীয় উপনেতাও প্রতিমন্ত্রী পদ মর্যাদার। পরে সিদ্ধান্ত হয়, জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সইয়ের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতা উপস্থিত থাকবেন। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ