মদিনার মসজিদে নববীর এক কোণে আহলুস সুফফার একটি দল বসে আছে। তাদের কাপড় মলিন, পেটে ক্ষুধার জ্বালা, তবু চোখে জ্ঞানের অদম্য তৃষ্ণা। মুহাম্মদ (সা.) নিজে তাদের কোরআন শিক্ষা দিচ্ছেন, তাদের জন্য খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছেন। এই দলের মধ্যে রয়েছেন আবু হুরায়রা (রা.), সালমান ফারসি (রা.), আবু সাঈদ খুদরি (রা.

)—যারা পরবর্তীকালে ইসলামি জ্ঞানের মহীরুহ ধারক হয়ে উঠবেন।

মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তির প্রথম দৃশ্যটি ছিল এমনই। জ্ঞান অর্জন ও প্রচারের জন্য আর্থিক ও সামাজিক সমর্থনের এই ঐতিহ্য পরবর্তী কয়েক শতকে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা ও সভ্যতার মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে।

এই প্রবন্ধে আমরা দেখব মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তির ধর্মীয় ভিত্তি, এর প্রাথমিক রূপ এবং সামাজিক প্রভাব কেমন ছিল।

মহানবী (সা.) আহলুস সুফফার শিক্ষার্থীদের প্রতি দুজনের জন্য প্রতিদিন এক মুদ খেজুর (প্রায় আধা কিলোগ্রাম) বরাদ্দ করতেন।আল-তাবারানি, আল-মুজাম আল-আওসাত, হাদিস: ৬,৩২৫শিক্ষাবৃত্তির ধর্মীয় ভিত্তি

মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)। এই শিক্ষা মুসলিমদের জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করেছে এবং শিক্ষার্থীদের সহায়তা করাকে একটি পুণ্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

তিনি আহলুস সুফফাকে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য জাকাত, অন্যান্য দান ও হাদিয়া (উপহার) থেকে খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি তাদের জন্য প্রতিদিন প্রতি দুজনের জন্য এক মুদ খেজুর (প্রায় আধা কিলোগ্রাম) বরাদ্দ করতেন (আল-তাবারানি, আল-মুজাম আল-আওসাত, হাদিস: ৬,৩২৫)।

এই দৃষ্টান্ত ছিল মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তির প্রথম মডেল।

কোরআন শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে এবং জ্ঞানীদের মর্যাদা প্রদান করে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের মর্যাদায় উন্নীত করেন’ (সুরা আল-মুজাদালা, ৫৮:১১)।

এই শিক্ষার আলোকে মুসলিম সমাজ শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানকে একটি ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে। ফকিহরা এই দায়িত্বকে আরও সুনির্দিষ্ট করে বলেন, শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা সমাজের ওপর ফরযে কিফায়া (সামাজিক দায়িত্ব), এবং প্রয়োজনে এটি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যেমন জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে খাত নির্দিষ্ট করা হয়। (ইবনে আবিদিন, আল-উকুদ আদ-দুররিয়্যা, ২.১২৫, দামেস্ক: দারুল মুস্তফা, ১৮৩৮)।

আরও পড়ুনশরণার্থীদের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা০৫ আগস্ট ২০২৫ফকিহগণ সুনির্দিষ্ট করে বলেন, শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা সমাজের ওপর ফরযে কিফায়া (সামাজিক দায়িত্ব) এবং প্রয়োজনে এটি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।নববী যুগে শিক্ষাবৃত্তির প্রাথমিক রূপ

ইসলামের প্রাথমিক যুগে শিক্ষাবৃত্তি ছিল সরল কিন্তু কার্যকর। মুহাম্মদ (সা.)মক্কায় যখন নবুওয়াত লাভ করেন, তখন কুরাইশদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন লিখতে জানতেন, যেমন হারব ইবনে উমাইয়া (মৃ. ৬০৭ খ্রি.) এবং আবু সুফিয়ান (মৃ. ৬৮০ খ্রি.)। (যাহাবি, সিয়ার আলাম আল-নুবালা, ১/১২৩, বৈরুত: ১৯৮৫ মুআসসাসাত আল-রিসালা)

শিক্ষার প্রাথমিক খরচ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য কম, তবে বদরের যুদ্ধে (৬২৪ খ্রি.) অধিকৃত বন্দীদের মুক্তির ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ পাওয়া যায়। মুহাম্মদ (সা.) কিছু বন্দীকে মুক্তির বিনিময়ে আনসারদের ছেলেদের লেখাপড়া শেখানোর শর্ত দেন। এই শিক্ষার মূল্য ছিল প্রায় ৪০০ দিরহাম, যা বর্তমানে প্রায় ৮০০ মার্কিন ডলার। (যাদ আল-মাআদ, ৩/১৫৬, দামেস্ক: দারুল ফিকর, ১ত৩৫০)

আহলুস সুফফা ছিল নববী যুগের শিক্ষাবৃত্তির প্রথম সুসংগঠিত উদাহরণ। এই দরিদ্র শিক্ষার্থীরা মসজিদে নববীর একটি বিশেষ স্থানে বসবাস করতেন এবং মুহাম্মদ (সা.) তাদের শিক্ষা ও জীবিকার দায়িত্ব নিতেন। আবু নুয়াইম আল-ইসফাহানি (মৃ. ১০৪০ খ্রি.) বলেন, ‘তাদের প্রধান কাজ ছিল কোরআন বোঝা ও শেখা’ (হিলিয়াত আল-আওলিয়া, ১/৩৪৫, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৭)।

এই দলের সংখ্যা ছিল প্রায় সত্তর জন, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে ফিকহ ও হাদিসের মহান আলেম হয়ে ওঠেন। (আল-যাহাবি, সিয়ার, ২/৮৯)

মুহাম্মদ (সা.) শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ তোমাদের অনুসারী এবং তোমাদের কাছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা দ্বীন শিখতে আসবে। যখন তারা আসবে, তাদের প্রতি সদাচরণ করো’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৬৫০)

এই শিক্ষা সাহাবিদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগিয়েছিল, যা পরবর্তী কয়েক শতকে শিক্ষাবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গ্রহণ করে।

সাহাবি ও তাবিঈ যুগে

নববী যুগের পর শিক্ষাবৃত্তির ঐতিহ্য দ্রুত প্রসার লাভ করে। সাহাবি ও তাবিঈদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রতি আর্থিক ও সামাজিক সহায়তার প্রথা গড়ে ওঠে। ইবনে আব্বাস (মৃ. ৬৮৯ খ্রি.) তার ফারসি ভাষাভাষী শিক্ষার্থী আবু জুমরা নাসর ইবনে ইমরান আয-যুবাই (মৃ. ৭৪৬ খ্রি.)-কে তার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন এবং তার জন্য আর্থিক ভাতা বরাদ্দ করেন।

ইবনে আব্বাস আমাকে তার সাথে তার বিছানায় বসতে দিতেন এবং বলতেন, ‘আমার কাছে থাকো, আমি তোমাকে আমার সম্পদের একটি অংশ দেব।আবু জুমরা বলেন, আল-যাহাবি, সিয়ার, ৫/২৩৪

আবু জুমরা বলেন, ‘ইবনে আব্বাস আমাকে তার সাথে তার বিছানায় বসতে দিতেন এবং বলতেন, ‘আমার কাছে থাকো, আমি তোমাকে আমার সম্পদের একটি অংশ দেব।’’ (আল-যাহাবি, সিয়ার, ৫/২৩৪)

এই সহায়তার ফলে আবু জুমরা ইবনে আব্বাসের জ্ঞানসভায় ফারসি ভাষাভাষীদের জন্য তাৎক্ষণিক অনুবাদক হিসেবে কাজ করতে পারেন।

আরও পড়ুনমুসলিম সভ্যতায় রসায়নের সোনালি যুগ৩ ঘণ্টা আগে

ইমাম আবু হানিফা (মৃ. ৭৬৮ খ্রি.) তার শিক্ষার্থী আবু ইউসুফ (মৃ. ৭৯৮ খ্রি.)-কে আর্থিক সহায়তা প্রদানের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। আবু ইউসুফ দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছিলেন এবং তার বাবার ক্ষুদ্র দোকান তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারত না। আর্থিক সংকটের কারণে তিনি আবু হানিফার হালাকা (পাঠচক্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আবু হানিফা তার অবস্থা জেনে তাকে এক ব্যাগে ১০০ দিরহাম দেন এবং বলেন, ‘হালাকায় নিয়মিত আসো। এই টাকা শেষ হলে আমাকে জানিও’ (আল-যাহাবি, সিয়ার, ৮/৫৬)

এইভাবে আবু হানিফা আবু ইউসুফকে বারবার আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে সক্ষম করেন। ফলস্বরূপ, আবু ইউসুফ হানাফি মাযহাবের প্রধান পণ্ডিত এবং ইসলামী ইতিহাসে প্রথম কাযী আল-কুযাত (প্রধান বিচারপতি) হয়ে ওঠেন।

ইমাম শাফিঈ (মৃ. ৮২০ খ্রি.)-এর জীবনেও শিক্ষাবৃত্তির গুরুত্ব ফুটে ওঠে। তিনি শৈশবে দরিদ্র ছিলেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার ফি দিতে পারতেন না। তার শিক্ষক তাকে শিক্ষার বিনিময়ে শ্রেণিতে শিশুদের সাহায্য করার দায়িত্ব দেন, যা এক ধরনের শিক্ষাবৃত্তি ছিল। (আল-বায়হাকি, আহকাম আল-কোরআন, ২/১৮৯, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯০)

পরবর্তীকালে বাগদাদে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শাইবানি (মৃ. ৮০৫ খ্রি.) তরুণ শাফিঈর প্রতিভা লক্ষ্য করে তাকে আর্থিক সহায়তা দেন। শাফিঈ বলেন, ‘আমি তার কাছ থেকে একটি পুরুষ উটের বোঝা পরিমাণ জ্ঞান লিখেছি।’ (আল-সাইমারি, আখবার আবি হানিফা, পৃ. ১২৩, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৮৫)

এই সহায়তা শাফিঈকে হানাফি ও মালিকি ফিকহের গভীর জ্ঞান অর্জনে সক্ষম করে, যা পরবর্তীতে শাফিঈ মাযহাব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।

ইমাম আবু ইউসুফ আর্থিক সংকটের কারণে আবু হানিফার হালাকা (পাঠচক্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আবু হানিফা তাকে ১০০ দিরহাম দেন এবং বলেন, ‘হালাকায় নিয়মিত আসো। এই টাকা শেষ হলে আমাকে জানিও।’শিক্ষাবৃত্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার

ইসলামী শিক্ষাবৃত্তি শুধু জ্ঞান প্রচারের মাধ্যম ছিল না, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি হাতিয়ার ছিল। শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সমাজের উচ্চ স্তরে উঠে আসতে পারত। যাকাত, ওয়াকফ এবং ধনী ব্যক্তিদের দান থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হতো, যা তাদের শিক্ষার খরচ, বই, কলম, কাগজ এবং জীবিকার ব্যয় মেটাতে ব্যবহৃত হতো। ফকিহরা বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য বই ও শিক্ষা সামগ্রী কেনা যাকাতের একটি বৈধ খাত। (আল-বুহুতি, কাশশাফ আল-কিনা, ২/২৮৭, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৮৩)।

শিক্ষাবৃত্তি সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য দূর করত। আবু ইউসুফের মতো দরিদ্র শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে সমাজের শীর্ষে পৌঁছেছেন। এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করত যে প্রতিভা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যে কেউ শিক্ষা লাভ করতে পারে, সম্পদ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে। এটি ইসলামী সমাজের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, যা আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাবৃত্তি ব্যবস্থার পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আরও পড়ুনমুসলিম জীবনে হিজরি সালের গুরুত্ব৩০ আগস্ট ২০১৯

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র থ দ র জন য এই শ ক ষ ম হ ম মদ আর থ ক স আল য হ ব ব যবস থ পরবর ত দর দ র প রথম র একট করত ন ক রআন ইসল ম ইউস ফ

এছাড়াও পড়ুন:

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতি-সমাজ ও সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষা

গণঅভ্যুত্থান সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। কেননা এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রকাশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের সামাজিক হতাশা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার বহিঃপ্রকাশ। এই গণআন্দোলনের অভিঘাত শুধু রাজনীতিতেই নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিবাদের অভিঘাত কেবল শাসনব্যবস্থা নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর তলদেশেও অনুরণন তুলেছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির অবস্থা ও আকাঙ্ক্ষাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।

গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও মোড় ঘুরেছে। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়, যার ফাঁকে নতুন নেতৃত্ব ও বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তার উত্থান ঘটছে। অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আগের সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটে। নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা পূরণের অঙ্গীকার দিয়ে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের মূল লক্ষ্য সুষ্ঠু নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্কার তথাপি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কাঁধে দায়িত্ব নিয়েছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দিকে ‘আস্থা ফেরানোর সরকার’ হিসেবে বিবেচিত হলেও বছর শেষে তার সাফল্য মিশ্র। স্বচ্ছ নির্বাচনি রূপরেখা, প্রশাসনের দলীয়করণ রোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এই তিনটি অঙ্গীকারের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন প্রক্রিয়া আংশিক অগ্রগতি পেলেও, বাকিগুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। প্রশাসনের মধ্যে পুরোনো গোষ্ঠীগত আনুগত্য এখনো প্রবলভাবে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে বলা যায়- দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি ‘সততা ও স্বচ্ছতার বার্তা' দিয়েছে। তাদের কিছু কর্মকাণ্ড জনগণের আস্থার ভিত্তি গড়েছে। মানুষ রাস্তায় কথা বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভয়হীনভাবে লেখালেখি করছে, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা-সমাবেশ করছে যা ২০২৪ সালের তুলনায় এক বিশাল পরিবর্তন। এটি প্রমাণ করে, অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত ‘শ্বাস নেওয়ার সুযোগ’ তৈরি করেছে।

আরো পড়ুন:

শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ

বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের পথে সরকার কতটা এগুলো?

দেশের তরুণরা রাজনীতি নিয়ে ভাবছে, কিছু নতুন রাজনৈতিক দল জন্ম নিয়েছে। এতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ‘নেতৃত্বশূন্যতা’র ফাঁকা জায়গায় আলো দেখা যাচ্ছে। এরা দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় স্বচ্ছতার দাবিকে কেন্দ্র করে নিজেদের কর্মসূচি সাজাচ্ছে। অনেক তরুণ, বিশেষ করে যারা সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে, তারা এই নতুন বিকল্পের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও, পুরোনো দলগুলো বারবার অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ফলে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়তে সরকার সফল হয়নি। বিচার ও জবাবদিহিতায় স্পষ্ট অগ্রগতি নেই, জনগণ চেয়েছিল, র‌্যাব, ডিবি বা পুলিশকে আরও মানবিক ও নিরপেক্ষ করা হোক। কিন্তু বাহিনীগুলোর আচরণ ও কাঠামোয় দৃশ্যমান কোনো সংস্কার আসেনি। বরং কিছু এলাকায় এখনও পুরোনো ভীতি বজায় রয়েছে। জনগণ চেয়েছিল, সব রাজনৈতিক শক্তি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একমত হয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করুক। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা, পাল্টাপাল্টি দোষারোপ এবং সংলাপে অনীহার কারণে জনগণের এই প্রত্যাশা আদৌও পূরণ হবে কি না, তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে! এই সংস্কারপ্রক্রিয়া জনগণের সম্পূর্ণ আশা পূরণ করতে পারবে— এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু এটি একটি ভাঙা সিস্টেমে ‘আস্থার সূচনা’ করতে পেরেছে, যা ভবিষ্যতের জন্য হয়ত বড় পরিবর্তনের ভিত্তি হতে পারে। 

গণআন্দোলনের পর মানুষ যে ‘শুদ্ধিকরণ ও ন্যায়বিচার’-এর স্বপ্ন দেখেছিল তা এখনও অসম্পূর্ণ। এখনও প্রশাসনের দলীয় আনুগত্য ভাঙা যায়নি। তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দলীয় আনুগত্য বা গোষ্ঠীস্বার্থ এখনও বহাল আছে। অনেক স্থানে তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘অস্থায়ী’ ভেবে আগের অভ্যাসেই চলছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ এশীয় কয়েকটি রাষ্ট্র অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উদ্যোগ (বিশেষত নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি) প্রশংসা করেছে। তবে বিচারিক স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকার কমিশনের অকার্যকারিতার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।

এই অভ্যুত্থান এক ধরনের শ্রেণিচেতনাকে সামনে নিয়ে আসে। সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর (যেমন: দিনমজুর, পরিবহনশ্রমিক, রিকশাচালক, পোশাকশ্রমিক, হিজড়া জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়) ওপর রাষ্ট্র ও প্রশাসনের নিপীড়ন এবার মিডিয়া ও আন্দোলনে বেশি করে চিত্রিত হয়। গণঅভ্যুত্থান একটি বৃহত্তর নাগরিক জাগরণ সৃষ্টি করে। শিক্ষক, চিকিৎসক, পরিবেশকর্মী, আইনজীবী; যারা এতদিন নিঃশব্দ ছিলেন, তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলেন। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আমরা ন্যায়ভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক সমাজ আমরা চাই যেখানে রাষ্ট্র ও প্রশাসন আইনের শাসনের প্রতি বাধ্য থাকবে, গরিব-বড়লোক, ক্ষমতাবান-সাধারণ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না, গায়েবি মামলা, ক্রসফায়ার, হয়রানি, বিনাবিচারে আটক এসবের কোনো স্থান থাকবে না। সরকার নয়, ন্যায় হবে সবচেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ। আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন সমাজ চাই, যেখানে ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি, অঞ্চল, ভাষা কিংবা রাজনৈতিক মতভেদ কখনো নাগরিক অধিকার কেড়ে নেবে না, হিজড়া, দলিত, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু, পাহাড়ি সবার জন্য থাকবে সমান সুযোগ। আমরা চাই মর্যাদা-ভিত্তিক নাগরিকত্ব, করুণার নয়।

গণঅভ্যুত্থানের প্রাণ ছিল তরুণরা। তাই আমরা চাই, একটি জিজ্ঞাসু সমাজ, যেখানে প্রশ্ন করা 'অপরাধ' নয়। শিক্ষা হবে কেবল সার্টিফিকেটের জন্য নয়, মানুষ গড়ার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র, ছাত্রাবাস হবে নিপীড়নের স্থান নয়। অভ্যুত্থানের সময় আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা চাই, সেই সহানুভূতির চর্চা আমাদের সমাজব্যবস্থায় স্থায়ী হোক। একজন রিকশাচালকের মৃত্যু যেন কেবল 'সংখ্যা' না হয় বরং দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উঠুক; দুর্যোগে সাহায্য, প্রতিবাদে সংহতি, শোকেও ভাগাভাগি হোক। কারও বাড়িতে ‘সোয়া দুই কোটি টাকার চেক’ আবার কেউ চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারে না। আমরা এই বৈষম্যমূলক চর্চার বাইরে সমাজটিকে দেখি। শ্রমিকের ঘামে যে অর্থনীতি চলে, সে অর্থনীতির মালিকও শ্রমিকই হবে,সব নাগরিকের জন্য ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা ও স্বাস্থ্যসেবা থাকবে। আমরা শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাই না, আমরা ‘ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন’ চাই।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কৃতির চেহারায় এক নতুন জাগরণ প্রত্যাশিত। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গোঁজামিল, ফ্যাসিবাদের ছায়া এবং দমন-পীড়নের সংস্কৃতি সংস্কারপ্রবণ সমাজে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে গণমানুষের অংশগ্রহণ, প্রশ্ন করার সাহস এবং নতুন এক নৈতিক বোধের উন্মেষ। শিল্প, সাহিত্য, নাটক ও সংগীতে পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা জাগছে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং মুক্তির ভাষা ফিরে আসছে কবিতায়, গান ও চিত্রকলায়। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র মানুষ এখন সংস্কৃতিকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মতপ্রকাশ ও সামষ্টিক চেতনার বাহক হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। তবে কোথাও কোথাও সংস্কৃতির চিন্তা রুদ্ধ হয়েছে। মাজার ভাঙা, সংগীত-নাটকে বাধার ঘটনাও ঘটেছে। এরকম চর্চা অনাকাঙ্ক্ষিত।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্কৃতি সবসময়ই ছিল প্রগতির বাহক, বৈচিত্র্য ও মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ধারার বিপরীতে একটি শক্তি দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থেকেছে। তাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট: সমাজকে একমাত্রিক, সংকীর্ণ ও অচল চিন্তার খাঁচায় আবদ্ধ করা, যেখানে প্রশ্ন নেই, ভিন্নমত নেই, কল্পনা বা সৃজনশীলতার জায়গা নেই। মৌলবাদের আঘাত প্রথম আসে চিন্তার ওপর। তারা সাহিত্যে ‘অশ্লীলতা’ খোঁজে, চিত্রকলায় ‘অবমাননা’ খুঁজে বেড়ায়, গানকে ‘নিষিদ্ধ’ করে, নাটককে ‘পাপ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা চায় না, মানুষ স্বতন্ত্রভাবে ভাবুক, ইতিহাস জানুক, নিজের পরিচয় ও মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলুক। এই আঘাত শুধু মননে নয়, কখনো কখনো প্রাণঘাতীও হয়েছে মঞ্চে হামলা, শিল্পীর ওপর হামলা এ সব কিছু তার প্রমাণ।

মৌলবাদী আঘাতের আরেকটি দিক হলো সংস্কৃতির বিকৃতি। তারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে এবং সেই নামে প্রচলিত লোকসংস্কৃতিকে অস্বীকার করে। বাউল, কবি, সংস্কৃতি মেলা- সবকিছুকেই তারা খারিজ করে দিতে চায়। এতে করে সংস্কৃতি শুধু সংকুচিতই হয় না, জনগণের ঐতিহ্যবাহী আত্মপরিচয়ও হারাতে বসে। তবে আশার কথা হলো, প্রতিবাদ তো হচ্ছে। প্রতিবাদী কবিতা, বিকল্প চলচ্চিত্র, তরুণদের নেতৃত্বে সংস্কৃতির নতুন জাগরণ আশাবাদী হতে শেখাচ্ছে আমাদের। সংস্কৃতি হলো মানুষের মনের আয়না, যা কখনোই একরৈখিক শাসনের কাছে পরাজিত হয় না।

এই নবজাগরণে তরুণরা পুরোনো দাসত্বমনা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে, নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। সামাজিক গণমাধ্যম, ছোট পত্রিকা, পথনাটক এবং বিকল্প সাহিত্যমাধ্যম এখন তাদের হাতিয়ার। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে; তথ্য, ইতিহাস ও স্মৃতি রচনার দায়িত্বের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বরং সংস্কৃতিতে দিয়েছে নতুন ভাষা ও মননচর্চার দিগন্ত। এখন প্রশ্ন, এই জাগরণ কতটা টিকে থাকবে এবং কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে? তবে এটুকু নিশ্চিত যে, নিপীড়ন আর আত্মবিক্রয়ের সংস্কৃতি ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে এক নতুন সাংস্কৃতিক দিগন্তের দিকে। 
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জনগণের সংস্কৃতি হবে অধিকতর সচেতন, অংশগ্রহণমূলক ও আত্মমর্যাদাশীল। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন ও ভয়ভীতির আবহে যে সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা জনগণের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভরাট হতে শুরু করেছে। মানুষ এখন আর সংস্কৃতিকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছু বলে মনে করে না, বরং তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির নির্মাতা। সবচেয়ে বড় কথা, এই নতুন জনগণের সংস্কৃতি হবে রাষ্ট্রনির্ভর নয়, বরং জনগণনির্ভর। এর উৎস থাকবে জনগণের সংগ্রামে, সাহসে, এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সংকল্পে।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কুবিতে শহীদ আব্দুল কাইয়ূমের শাহাদাত বার্ষিকী পালন
  • দায়িত্ব পালনে অনীহা বা শৈথিল্য প্রদর্শনে বিভাগীয় ব্যবস্থা, এসিল্যান্ড পদের পদায়ন নীতিমালা জারি
  • অবশেষে সংশয়ই সত্যি হলো, মাঠের বাইরে মেসি
  • জুলাই ঘোষণাপত্রে কী আছে, যা জানা গেল
  • রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান
  • জার্মানিতে বসবাসরত শাবিপ্রবি’র সাবেক শিক্ষার্থীদের পুর্নিমিলনী অনুষ্ঠিত
  • গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনীতি-সমাজ ও সংস্কৃতির আকাঙ্ক্ষা
  • গণমাধ্যমগুলোতে মব তৈরি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে: টিআইবি