মদিনার মসজিদে নববীর এক কোণে আহলুস সুফফার একটি দল বসে আছে। তাদের কাপড় মলিন, পেটে ক্ষুধার জ্বালা, তবু চোখে জ্ঞানের অদম্য তৃষ্ণা। মুহাম্মদ (সা.) নিজে তাদের কোরআন শিক্ষা দিচ্ছেন, তাদের জন্য খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছেন। এই দলের মধ্যে রয়েছেন আবু হুরায়রা (রা.), সালমান ফারসি (রা.), আবু সাঈদ খুদরি (রা.

)—যারা পরবর্তীকালে ইসলামি জ্ঞানের মহীরুহ ধারক হয়ে উঠবেন।

মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তির প্রথম দৃশ্যটি ছিল এমনই। জ্ঞান অর্জন ও প্রচারের জন্য আর্থিক ও সামাজিক সমর্থনের এই ঐতিহ্য পরবর্তী কয়েক শতকে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা ও সভ্যতার মেরুদণ্ড হয়ে ওঠে।

এই প্রবন্ধে আমরা দেখব মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তির ধর্মীয় ভিত্তি, এর প্রাথমিক রূপ এবং সামাজিক প্রভাব কেমন ছিল।

মহানবী (সা.) আহলুস সুফফার শিক্ষার্থীদের প্রতি দুজনের জন্য প্রতিদিন এক মুদ খেজুর (প্রায় আধা কিলোগ্রাম) বরাদ্দ করতেন।আল-তাবারানি, আল-মুজাম আল-আওসাত, হাদিস: ৬,৩২৫শিক্ষাবৃত্তির ধর্মীয় ভিত্তি

মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৪)। এই শিক্ষা মুসলিমদের জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করেছে এবং শিক্ষার্থীদের সহায়তা করাকে একটি পুণ্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

তিনি আহলুস সুফফাকে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য জাকাত, অন্যান্য দান ও হাদিয়া (উপহার) থেকে খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি তাদের জন্য প্রতিদিন প্রতি দুজনের জন্য এক মুদ খেজুর (প্রায় আধা কিলোগ্রাম) বরাদ্দ করতেন (আল-তাবারানি, আল-মুজাম আল-আওসাত, হাদিস: ৬,৩২৫)।

এই দৃষ্টান্ত ছিল মুসলিম সভ্যতায় শিক্ষাবৃত্তির প্রথম মডেল।

কোরআন শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে এবং জ্ঞানীদের মর্যাদা প্রদান করে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছে, তাদের মর্যাদায় উন্নীত করেন’ (সুরা আল-মুজাদালা, ৫৮:১১)।

এই শিক্ষার আলোকে মুসলিম সমাজ শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানকে একটি ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে। ফকিহরা এই দায়িত্বকে আরও সুনির্দিষ্ট করে বলেন, শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা সমাজের ওপর ফরযে কিফায়া (সামাজিক দায়িত্ব), এবং প্রয়োজনে এটি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যেমন জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে খাত নির্দিষ্ট করা হয়। (ইবনে আবিদিন, আল-উকুদ আদ-দুররিয়্যা, ২.১২৫, দামেস্ক: দারুল মুস্তফা, ১৮৩৮)।

আরও পড়ুনশরণার্থীদের জন্য মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা০৫ আগস্ট ২০২৫ফকিহগণ সুনির্দিষ্ট করে বলেন, শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা সমাজের ওপর ফরযে কিফায়া (সামাজিক দায়িত্ব) এবং প্রয়োজনে এটি বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।নববী যুগে শিক্ষাবৃত্তির প্রাথমিক রূপ

ইসলামের প্রাথমিক যুগে শিক্ষাবৃত্তি ছিল সরল কিন্তু কার্যকর। মুহাম্মদ (সা.)মক্কায় যখন নবুওয়াত লাভ করেন, তখন কুরাইশদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন লিখতে জানতেন, যেমন হারব ইবনে উমাইয়া (মৃ. ৬০৭ খ্রি.) এবং আবু সুফিয়ান (মৃ. ৬৮০ খ্রি.)। (যাহাবি, সিয়ার আলাম আল-নুবালা, ১/১২৩, বৈরুত: ১৯৮৫ মুআসসাসাত আল-রিসালা)

শিক্ষার প্রাথমিক খরচ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য কম, তবে বদরের যুদ্ধে (৬২৪ খ্রি.) অধিকৃত বন্দীদের মুক্তির ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ পাওয়া যায়। মুহাম্মদ (সা.) কিছু বন্দীকে মুক্তির বিনিময়ে আনসারদের ছেলেদের লেখাপড়া শেখানোর শর্ত দেন। এই শিক্ষার মূল্য ছিল প্রায় ৪০০ দিরহাম, যা বর্তমানে প্রায় ৮০০ মার্কিন ডলার। (যাদ আল-মাআদ, ৩/১৫৬, দামেস্ক: দারুল ফিকর, ১ত৩৫০)

আহলুস সুফফা ছিল নববী যুগের শিক্ষাবৃত্তির প্রথম সুসংগঠিত উদাহরণ। এই দরিদ্র শিক্ষার্থীরা মসজিদে নববীর একটি বিশেষ স্থানে বসবাস করতেন এবং মুহাম্মদ (সা.) তাদের শিক্ষা ও জীবিকার দায়িত্ব নিতেন। আবু নুয়াইম আল-ইসফাহানি (মৃ. ১০৪০ খ্রি.) বলেন, ‘তাদের প্রধান কাজ ছিল কোরআন বোঝা ও শেখা’ (হিলিয়াত আল-আওলিয়া, ১/৩৪৫, বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৭)।

এই দলের সংখ্যা ছিল প্রায় সত্তর জন, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে ফিকহ ও হাদিসের মহান আলেম হয়ে ওঠেন। (আল-যাহাবি, সিয়ার, ২/৮৯)

মুহাম্মদ (সা.) শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ তোমাদের অনুসারী এবং তোমাদের কাছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা দ্বীন শিখতে আসবে। যখন তারা আসবে, তাদের প্রতি সদাচরণ করো’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৬৫০)

এই শিক্ষা সাহাবিদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগিয়েছিল, যা পরবর্তী কয়েক শতকে শিক্ষাবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গ্রহণ করে।

সাহাবি ও তাবিঈ যুগে

নববী যুগের পর শিক্ষাবৃত্তির ঐতিহ্য দ্রুত প্রসার লাভ করে। সাহাবি ও তাবিঈদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রতি আর্থিক ও সামাজিক সহায়তার প্রথা গড়ে ওঠে। ইবনে আব্বাস (মৃ. ৬৮৯ খ্রি.) তার ফারসি ভাষাভাষী শিক্ষার্থী আবু জুমরা নাসর ইবনে ইমরান আয-যুবাই (মৃ. ৭৪৬ খ্রি.)-কে তার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন এবং তার জন্য আর্থিক ভাতা বরাদ্দ করেন।

ইবনে আব্বাস আমাকে তার সাথে তার বিছানায় বসতে দিতেন এবং বলতেন, ‘আমার কাছে থাকো, আমি তোমাকে আমার সম্পদের একটি অংশ দেব।আবু জুমরা বলেন, আল-যাহাবি, সিয়ার, ৫/২৩৪

আবু জুমরা বলেন, ‘ইবনে আব্বাস আমাকে তার সাথে তার বিছানায় বসতে দিতেন এবং বলতেন, ‘আমার কাছে থাকো, আমি তোমাকে আমার সম্পদের একটি অংশ দেব।’’ (আল-যাহাবি, সিয়ার, ৫/২৩৪)

এই সহায়তার ফলে আবু জুমরা ইবনে আব্বাসের জ্ঞানসভায় ফারসি ভাষাভাষীদের জন্য তাৎক্ষণিক অনুবাদক হিসেবে কাজ করতে পারেন।

আরও পড়ুনমুসলিম সভ্যতায় রসায়নের সোনালি যুগ৩ ঘণ্টা আগে

ইমাম আবু হানিফা (মৃ. ৭৬৮ খ্রি.) তার শিক্ষার্থী আবু ইউসুফ (মৃ. ৭৯৮ খ্রি.)-কে আর্থিক সহায়তা প্রদানের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। আবু ইউসুফ দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছিলেন এবং তার বাবার ক্ষুদ্র দোকান তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারত না। আর্থিক সংকটের কারণে তিনি আবু হানিফার হালাকা (পাঠচক্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আবু হানিফা তার অবস্থা জেনে তাকে এক ব্যাগে ১০০ দিরহাম দেন এবং বলেন, ‘হালাকায় নিয়মিত আসো। এই টাকা শেষ হলে আমাকে জানিও’ (আল-যাহাবি, সিয়ার, ৮/৫৬)

এইভাবে আবু হানিফা আবু ইউসুফকে বারবার আর্থিক সহায়তা দিয়ে শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে সক্ষম করেন। ফলস্বরূপ, আবু ইউসুফ হানাফি মাযহাবের প্রধান পণ্ডিত এবং ইসলামী ইতিহাসে প্রথম কাযী আল-কুযাত (প্রধান বিচারপতি) হয়ে ওঠেন।

ইমাম শাফিঈ (মৃ. ৮২০ খ্রি.)-এর জীবনেও শিক্ষাবৃত্তির গুরুত্ব ফুটে ওঠে। তিনি শৈশবে দরিদ্র ছিলেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার ফি দিতে পারতেন না। তার শিক্ষক তাকে শিক্ষার বিনিময়ে শ্রেণিতে শিশুদের সাহায্য করার দায়িত্ব দেন, যা এক ধরনের শিক্ষাবৃত্তি ছিল। (আল-বায়হাকি, আহকাম আল-কোরআন, ২/১৮৯, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯০)

পরবর্তীকালে বাগদাদে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শাইবানি (মৃ. ৮০৫ খ্রি.) তরুণ শাফিঈর প্রতিভা লক্ষ্য করে তাকে আর্থিক সহায়তা দেন। শাফিঈ বলেন, ‘আমি তার কাছ থেকে একটি পুরুষ উটের বোঝা পরিমাণ জ্ঞান লিখেছি।’ (আল-সাইমারি, আখবার আবি হানিফা, পৃ. ১২৩, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৮৫)

এই সহায়তা শাফিঈকে হানাফি ও মালিকি ফিকহের গভীর জ্ঞান অর্জনে সক্ষম করে, যা পরবর্তীতে শাফিঈ মাযহাব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে।

ইমাম আবু ইউসুফ আর্থিক সংকটের কারণে আবু হানিফার হালাকা (পাঠচক্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আবু হানিফা তাকে ১০০ দিরহাম দেন এবং বলেন, ‘হালাকায় নিয়মিত আসো। এই টাকা শেষ হলে আমাকে জানিও।’শিক্ষাবৃত্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার

ইসলামী শিক্ষাবৃত্তি শুধু জ্ঞান প্রচারের মাধ্যম ছিল না, বরং এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি হাতিয়ার ছিল। শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সমাজের উচ্চ স্তরে উঠে আসতে পারত। যাকাত, ওয়াকফ এবং ধনী ব্যক্তিদের দান থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হতো, যা তাদের শিক্ষার খরচ, বই, কলম, কাগজ এবং জীবিকার ব্যয় মেটাতে ব্যবহৃত হতো। ফকিহরা বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য বই ও শিক্ষা সামগ্রী কেনা যাকাতের একটি বৈধ খাত। (আল-বুহুতি, কাশশাফ আল-কিনা, ২/২৮৭, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৮৩)।

শিক্ষাবৃত্তি সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য দূর করত। আবু ইউসুফের মতো দরিদ্র শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে সমাজের শীর্ষে পৌঁছেছেন। এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করত যে প্রতিভা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যে কেউ শিক্ষা লাভ করতে পারে, সম্পদ বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে। এটি ইসলামী সমাজের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, যা আধুনিক বিশ্বের শিক্ষাবৃত্তি ব্যবস্থার পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

আরও পড়ুনমুসলিম জীবনে হিজরি সালের গুরুত্ব৩০ আগস্ট ২০১৯

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র থ দ র জন য এই শ ক ষ ম হ ম মদ আর থ ক স আল য হ ব ব যবস থ পরবর ত দর দ র প রথম র একট করত ন ক রআন ইসল ম ইউস ফ

এছাড়াও পড়ুন:

সোভিয়েত–পরবর্তী দুনিয়ায় জেমস বন্ডের অভিযোজন

ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্ট জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিংয়ের (১৯০৮-৬৪) বহুদিন থেকেই একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখার শখ। সময়, সুযোগ বা উদ্যমের অভাবে যা এত দিন হয়ে ওঠেনি, তাই তিনি করতে পারলেন ১৯৫২ সালে। কিছুটা বাধ্য হয়েই বলা যায়। প্রেমিকা এয়ান কার্টেরিস তখন গর্ভবতী। এরই মধ্যে চলছে তাঁদের বিয়ের আয়োজন। এত শোরগোল ভালো লাগছিল না আর। তিক্তবিরক্ত হয়ে সমস্ত কিছু থেকে দূরে গিয়ে লিখতে বসে গেলেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত সেই ডিটেকটিভ উপন্যাস। প্রথম দিনেই লিখে ফেললেন দুই হাজার শব্দ। সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেল এক মাসে। নাম দিলেন ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’।

জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং (১৯০৮-৬৪)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সোভিয়েত–পরবর্তী দুনিয়ায় জেমস বন্ডের অভিযোজন