দস্যুজীবনে আর ফিরবেন না আলম সরদার
Published: 4th, October 2025 GMT
মুন্সিগঞ্জ বাজারে আলম সরদারের সঙ্গে দেখা। ফরসা চেহারা, মুখে দাড়ি, পরনে পোলো শার্ট আর ট্রাউজার। ইজিবাইকের চালকের আসনে বসা মানুষটাকে দেখে কে বলবে, একসময় দস্যুতা করতেন। পাশের চুনা নদীর ওপারে সুন্দরবন, যেখানে জীবনের অন্ধকার একটা অধ্যায় কেটেছে। সেই জীবন ছেড়ে এখন তিনি সংসার চালাচ্ছেন এই ইজিবাইক চালিয়ে।
৪৪ বছর বয়সের আলম সরদার বললেন, ‘পরিচিত অনেক আত্মসমর্পণকারীই আবার দস্যুতায় ফিরে গেছে। বারবার ফোন করে আমাকে দলে টানতে চায় তারা। কিন্তু আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, ওই পথে আর ফিরব না। এই ইজিবাইক চালিয়েই এখন তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ভালোভাবে সংসার চলছে, এতেই শান্তি।’
তারপর অতীতে ডুব দিলেন আলম সরদার। বলতে থাকলেন, ‘জীবনের শুরুটাই দুঃখকষ্টে ভরা। জন্মের তিন মাস পর মা-বাবা আলাদা হয়ে গেল। বড় হয়েছি নানির কাছে। ছোট থেকেই মামার সঙ্গে সুন্দরবনে যেতাম। মাছ আর কাঁকড়া শিকার করতাম। লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ১৭ বছর বয়সে মামা মারা গেল। তখন নানির অনুরোধে বিয়েও করতে হলো। দুবেলা খাওয়ার জোগাড় করাও কষ্টের ছিল।’
সেই সময় এলাকার যাঁরা ডাকাতি করতেন, তাঁরা আলমকে লোভ দেখাতেন। বলত, ‘চল, অনেক টাকা হবে।’
অভাব ঘোচাতে ২০০৮ সালে ডাকাত দলে যোগ দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য বুঝলেন, এই কাজ তাঁর না। এলাকায় পরিচিত জেলেদের জিম্মি করে টাকা আদায় করতে হয়। এই কাজ করতে খুব কষ্ট লাগে। বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যুঝুঁকি, এক ঘণ্টাও শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। তত দিনে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ‘ডাকাত’। বাড়ি ফেরার পথও বন্ধ। মাস ছয়েক পর সুন্দরবন ছেড়ে যশোরের বেনাপোলে চলে গেলেন। বাসা ভাড়া নিলেন। তুলা কেনাবেচার কাজ নিলেন। সিম পাল্টে ফেলে নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে চাইলেন।
সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ খুলনার এক অস্ত্র কারবারির ফোন। আলম বলেন, ‘গালকাটা মাসুদ ফোন দিয়ে আবার সুন্দরবনে ফিরতে চাপ দিল। কিন্তু রাজি হলাম না। সেদিনই র্যাব আমাকে ধরে ফেলল। অস্ত্রের খোঁজ জানতে চাইল। পরে মামলা দিয়ে জেলে পাঠাল। ১১ মাস জেল খেটে বের হলাম অসুস্থ শরীরে। পেটে অপারেশনও করতে হলো, ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারতাম না।’
এরই মধ্যে খবর এল সুন্দরবনে আলিফ বাহিনী আর মোক্তারুল বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে পড়ে এক জেলে মারা গেছেন। সেই হত্যা মামলায় আলম সরদারের নামও আসামির তালিকায় ঢুকে গেল। তিনি বলেন, ‘অথচ আমি তখন লোকালয়ে অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলাম! উপায়ান্তর না দেখে আবারও সুন্দরবনে পালাতে হলো।’
আরও পড়ুনসুন্দরবন ভ্রমণে যাওয়ার আগে এই ১০টি তথ্য জেনে রাখুন০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩মুন্সিগঞ্জ থেকে নওয়াবেঁকী, কখনো বুড়িগোয়ালিনী কিংবা শ্যামনগর পর্যন্ত ইজিবাইক চালান আলম সরদার.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সুন্দরবনের দস্যু বনাম সংসদের দস্যু
আজ ৩ অক্টোবর। ইতিহাসের পাতায় দিনটি এক অমানবিক ঘটনার জন্য কালো অক্ষরে লেখা। ১৫০২ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা ভারতের কালিকটের রাজার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে ১৫টি জাহাজ আর ৮০০ লোক নিয়ে রওনা দেন।
পথে তিনি আটক করেন মিরি নামে একটি জাহাজ, যেখানে মক্কা থেকে ফেরা ৪০০ হজযাত্রী ছিলেন, এর মধ্যে প্রায় ৫০ জন নারীও ছিলেন। যাত্রীদের মুক্তিপণের প্রস্তাব উপেক্ষা করে দা গামা তাদের জাহাজ জ্বালিয়ে দেন এবং পরে একে একে পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করেন।
এটি ছিল নিছক দস্যুতা, যার উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্ক সৃষ্টি, শোষণকে বৈধ করা এবং বাণিজ্যের নামে লুণ্ঠন। ইতিহাসবিদেরা একে মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভাস্কো দা গামা ও তাঁর উত্তরসূরিরা সমুদ্রপথে শুধু পণ্য নয়, সভ্যতার মর্যাদাকেও রক্তাক্ত করেছিলেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ৫০০ বছর পেরিয়েও আমরা সেই একই জলদস্যুতার চিহ্ন দেখতে পাই। কখনো তা সুন্দরবনের অন্ধকার গহিনে, কখনো তা সংসদের গম্বুজ তলায়।
সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (আত্মসমর্পণকারীরা বন দস্যুতায় ফিরছে, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫) পড়ে আমি স্তম্ভিত হই। সেখানে বলা হয়েছে, সুন্দরবনে আবারও সক্রিয় হয়েছে বনদস্যুরা। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণকারী ৩২টি বাহিনীর বহু সদস্য পুনরায় অস্ত্র হাতে ফিরেছে।
‘দুলাভাই বাহিনী’সহ অন্তত ১৪টি নতুন-পুরোনো দল জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালিদের জিম্মি করছে, মুক্তিপণ দাবি করছে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। একজন জেলে বলছিলেন, মহাজনের কাছ থেকে আগে থেকে টাকা দিয়ে কার্ড (টোকেন) কিনতে হয়। কার্ড থাকলে দস্যুরা ছাড় দেয়, না থাকলে জিম্মি ও মারধর অবধারিত।
এই কার্ড আসলে আজকের যুগের নতুন কার্তাজ, যেমন একসময় পর্তুগিজরা সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচলের অনুমতিপত্র চালু করেছিল। আমি নৌবাহিনীর মানুষ। সমুদ্রপথের ইতিহাস জানি। ভাস্কো দা গামার পর্তুগিজরা যেভাবে কর ও পাসের (টোকেন) নামে লুটপাট চালাত, সুন্দরবনের বর্তমান দস্যুরা আজ সেই একই কৌশল ব্যবহার করছে। আর দুঃখজনকভাবে, আমাদের রাজনীতিবিদদের চরিত্রও অনেকাংশে এই জলদস্যুদের সঙ্গে মিলে যায়।
শিল্পীর তুলিতে ভাস্কো দা গামা