মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হন। আর রাজেশ্বর বিশ্বাস শহর থেকে গ্রামমুখী হয়েছেন। তা-ও আবার শিশুদের চারুকলা শেখাতে। তাঁর বিশ্বাস, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ দূর করতে হলে শিশু-কিশোরদের চারুকলা শেখানোর বিকল্প নেই। সে জন্য তিনি সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় পৃথক দুটি চারুকলার প্রতিষ্ঠান করেছেন। সেখানে নামমাত্র টাকায় গ্রামের শিশু-কিশোরদের চারুকলার পাঠ দিচ্ছেন।

রাজেশ্বর বিশ্বাস ওরফে রাজীবের (৩৭) জন্ম সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার আলমপুর গ্রামে। বাবা নিবারণ বিশ্বাস কৃষিজীবী, মা আলতি রানী বিশ্বাস গৃহিণী। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। স্থানীয় ১ নং বাগলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মফজ্জিল আলী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি ২০০৭ সালে সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন।

শিল্পকলা একাডেমিতে দুই বছরের (বর্তমানে চার বছর) সার্টিফিকেট কোর্স শেষে রাজেশ্বর ২০০৯ সালে সিলেট নগরের উপশহর এলাকার স্কুল অব আর্টে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ২০১২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। পরে তাঁর মনে হলো, শহরের ছেলেমেয়েরা তো চারুকলা শেখার সুযোগ পাচ্ছে, কিন্তু গ্রামের শিশুরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মূলত এ চিন্তা থেকেই রাজেশ্বর ২০১২ সালে গোলাপগঞ্জে ‘দি আর্ট স্কুল’ নামে একটি চারুকলার প্রতিষ্ঠান চালু করে।

রাজেশ্বর ২০১৭ সালে পাশের উপজেলা বিয়ানীবাজারে চালু করেন ‘চারুলেখা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সিলেট নগরের উপশহরে ‘চারুগৃহ’ এবং মেজরটিলা এলাকায় ‘চিত্রকলা’ নামে আরও দুটো চারুশিক্ষার প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। 

বর্তমানে চারুলেখায় ৬৫ জন, দি আর্ট স্কুলে ২৩ জন, চারুগৃহে ১৮ জন ও চিত্রকলায় ১৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানে যেমন প্লে গ্রুপ থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা চারুকলার পাঠ নিচ্ছে, তেমনি উচ্চমাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আঁকা শিখছেন। এমনকি শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরাও চারুকলার পাঠ নিচ্ছেন। প্রতি মাসে চারুকলা শেখানো বাবদ রাজেশ্বর নিচ্ছেন জনপ্রতি পাঁচ শ টাকা করে। এ পর্যন্ত বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জে প্রায় ২ হাজার ১০০ শিক্ষার্থীকে চিত্রকলার পাঠ দিয়েছেন। 

রাজেশ্বর বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের গ্রামটি কুশিয়ারা নদীর ঠিক পাড়ে। নদী আর এলাকার সৌন্দর্য আমাকে টানত। ছোটবেলা থেকেই চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। গোলাপগঞ্জের সেই প্রত্যন্ত এলাকার একটা গ্রাম থেকে এসে সিলেট শহরে চারুকলার পাঠ নিয়েছি। পেয়েছি সিলেটের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী প্রয়াত অরবিন্দ দাসগুপ্তের সান্নিধ্য। নিজে খুব কষ্ট করে চারুকলার পাঠ নিয়েছি। একসময় উপলব্ধি হলো, গ্রামের শিশু-কিশোরদের জন্য কিছু করা দরকার। সে চিন্তা থেকেই গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে চারুকলার প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোলাপগঞ্জে এর আগে চারুকলার কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। রাজেশ্বরই সেটা প্রথম চালু করেন। শুধু প্রতিষ্ঠান করেই তিনি দায়িত্ব শেষ করেননি, বরং শিশু-কিশোরদের মধ্যে চারুকলার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে দিতে গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। এ ছাড়া স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের এক ঘণ্টার চারুকলা-বিষয়ক ক্লাস আর কর্মশালা নেন। এসব কারণে তিনি ‘আর্টের স্যার’ নামে এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন।

রাজেশ্বরের বাসা সিলেট নগরের শিবগঞ্জ সেনপাড়া এলাকায়। সেখান থেকেই তিনি নিয়মিত গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে গিয়ে চারুকলার প্রতিষ্ঠান চালান। তবে সিলেট শহরেও তিনি নানাকাজে সক্রিয়। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের প্রথম বর্ণমালার মিছিলের বিভিন্ন সাজসজ্জা আর বর্ষবিদায়ের সাজসজ্জাও তিনি করেছেন। এ ছাড়া সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রংতুলি দিয়ে আঙিনাসহ আশপাশ সাজিয়ে তোলার কাজেও তিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করে সুনাম কুড়িয়েছেন।

রাজেশ্বর বিশ্বাস বলেন, ‘আমি থাকি শহরে, কিন্তু মন পড়ে থাকে গ্রামে। তাই তো সপ্তাহের বেশির ভাগ সময়ই গ্রামে ছুটে যাই। সেখানে চিত্রকলা শেখানোর পাশাপাশি কৃষিকাজও করি। জমিতে ধান, সবজি ফলাই। শিল্প আর কৃষি, দুই নিয়েই আমার জীবন কাটছে। এসবই আমার পেশা। চারুশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যে টাকা আয় হয়, সেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আমার কাছ থেকে পেনসিল স্কেচ কিংবা ওয়াটার কালারে প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নেন, সেখান থেকেও কিছু আয় হয়।’

কোনো লাভের আশায় চারুকলাকে বেছে নেননি জানিয়ে রাজেশ্বর বিশ্বাস বলেন, ‘চাইলে অন্য কিছু করে নিজের উন্নত জীবন তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু সেসবে আমার মন সায় দেয় না। আমি কেবল চাই, গ্রামের শিশু-কিশোরদের মধ্যে রুচি আর স্নিগ্ধতার বিকাশ ঘটাব। সে জন্যই সবাইকে চারুকলার পাঠ দিচ্ছি। কয়েকজন আমার কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও পড়াশোনার বিষয় হিসেবে চারুকলাকে বেছে নিয়েছে, এর চেয়ে একজন মানুষের জীবনে আনন্দের আর কী হতে পারে!

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ ল পগঞ জ ও ব য় ন ব জ র র জ শ বর ব শ ব স চ র কল র প ঠ ন র চ র কল চ ত রকল কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

গ্রামের শিশুদের পাশে ‘আর্টের স্যার’ রাজেশ্বর

মানুষ গ্রাম থেকে শহরমুখী হন। আর রাজেশ্বর বিশ্বাস শহর থেকে গ্রামমুখী হয়েছেন। তা-ও আবার শিশুদের চারুকলা শেখাতে। তাঁর বিশ্বাস, ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ দূর করতে হলে শিশু-কিশোরদের চারুকলা শেখানোর বিকল্প নেই। সে জন্য তিনি সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় পৃথক দুটি চারুকলার প্রতিষ্ঠান করেছেন। সেখানে নামমাত্র টাকায় গ্রামের শিশু-কিশোরদের চারুকলার পাঠ দিচ্ছেন।

রাজেশ্বর বিশ্বাস ওরফে রাজীবের (৩৭) জন্ম সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার আলমপুর গ্রামে। বাবা নিবারণ বিশ্বাস কৃষিজীবী, মা আলতি রানী বিশ্বাস গৃহিণী। সাত ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। স্থানীয় ১ নং বাগলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মফজ্জিল আলী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি ২০০৭ সালে সিলেট জেলা শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগে ভর্তি হন।

শিল্পকলা একাডেমিতে দুই বছরের (বর্তমানে চার বছর) সার্টিফিকেট কোর্স শেষে রাজেশ্বর ২০০৯ সালে সিলেট নগরের উপশহর এলাকার স্কুল অব আর্টে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ২০১২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। পরে তাঁর মনে হলো, শহরের ছেলেমেয়েরা তো চারুকলা শেখার সুযোগ পাচ্ছে, কিন্তু গ্রামের শিশুরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মূলত এ চিন্তা থেকেই রাজেশ্বর ২০১২ সালে গোলাপগঞ্জে ‘দি আর্ট স্কুল’ নামে একটি চারুকলার প্রতিষ্ঠান চালু করে।

রাজেশ্বর ২০১৭ সালে পাশের উপজেলা বিয়ানীবাজারে চালু করেন ‘চারুলেখা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সিলেট নগরের উপশহরে ‘চারুগৃহ’ এবং মেজরটিলা এলাকায় ‘চিত্রকলা’ নামে আরও দুটো চারুশিক্ষার প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। 

বর্তমানে চারুলেখায় ৬৫ জন, দি আর্ট স্কুলে ২৩ জন, চারুগৃহে ১৮ জন ও চিত্রকলায় ১৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তাঁর প্রতিষ্ঠানে যেমন প্লে গ্রুপ থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা চারুকলার পাঠ নিচ্ছে, তেমনি উচ্চমাধ্যমিক থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আঁকা শিখছেন। এমনকি শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরাও চারুকলার পাঠ নিচ্ছেন। প্রতি মাসে চারুকলা শেখানো বাবদ রাজেশ্বর নিচ্ছেন জনপ্রতি পাঁচ শ টাকা করে। এ পর্যন্ত বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জে প্রায় ২ হাজার ১০০ শিক্ষার্থীকে চিত্রকলার পাঠ দিয়েছেন। 

রাজেশ্বর বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের গ্রামটি কুশিয়ারা নদীর ঠিক পাড়ে। নদী আর এলাকার সৌন্দর্য আমাকে টানত। ছোটবেলা থেকেই চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। গোলাপগঞ্জের সেই প্রত্যন্ত এলাকার একটা গ্রাম থেকে এসে সিলেট শহরে চারুকলার পাঠ নিয়েছি। পেয়েছি সিলেটের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী প্রয়াত অরবিন্দ দাসগুপ্তের সান্নিধ্য। নিজে খুব কষ্ট করে চারুকলার পাঠ নিয়েছি। একসময় উপলব্ধি হলো, গ্রামের শিশু-কিশোরদের জন্য কিছু করা দরকার। সে চিন্তা থেকেই গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে চারুকলার প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোলাপগঞ্জে এর আগে চারুকলার কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। রাজেশ্বরই সেটা প্রথম চালু করেন। শুধু প্রতিষ্ঠান করেই তিনি দায়িত্ব শেষ করেননি, বরং শিশু-কিশোরদের মধ্যে চারুকলার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে দিতে গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। এ ছাড়া স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের এক ঘণ্টার চারুকলা-বিষয়ক ক্লাস আর কর্মশালা নেন। এসব কারণে তিনি ‘আর্টের স্যার’ নামে এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন।

রাজেশ্বরের বাসা সিলেট নগরের শিবগঞ্জ সেনপাড়া এলাকায়। সেখান থেকেই তিনি নিয়মিত গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে গিয়ে চারুকলার প্রতিষ্ঠান চালান। তবে সিলেট শহরেও তিনি নানাকাজে সক্রিয়। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের প্রথম বর্ণমালার মিছিলের বিভিন্ন সাজসজ্জা আর বর্ষবিদায়ের সাজসজ্জাও তিনি করেছেন। এ ছাড়া সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রংতুলি দিয়ে আঙিনাসহ আশপাশ সাজিয়ে তোলার কাজেও তিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করে সুনাম কুড়িয়েছেন।

রাজেশ্বর বিশ্বাস বলেন, ‘আমি থাকি শহরে, কিন্তু মন পড়ে থাকে গ্রামে। তাই তো সপ্তাহের বেশির ভাগ সময়ই গ্রামে ছুটে যাই। সেখানে চিত্রকলা শেখানোর পাশাপাশি কৃষিকাজও করি। জমিতে ধান, সবজি ফলাই। শিল্প আর কৃষি, দুই নিয়েই আমার জীবন কাটছে। এসবই আমার পেশা। চারুশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যে টাকা আয় হয়, সেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতেই খরচ হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আমার কাছ থেকে পেনসিল স্কেচ কিংবা ওয়াটার কালারে প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নেন, সেখান থেকেও কিছু আয় হয়।’

কোনো লাভের আশায় চারুকলাকে বেছে নেননি জানিয়ে রাজেশ্বর বিশ্বাস বলেন, ‘চাইলে অন্য কিছু করে নিজের উন্নত জীবন তৈরি করতে পারতাম। কিন্তু সেসবে আমার মন সায় দেয় না। আমি কেবল চাই, গ্রামের শিশু-কিশোরদের মধ্যে রুচি আর স্নিগ্ধতার বিকাশ ঘটাব। সে জন্যই সবাইকে চারুকলার পাঠ দিচ্ছি। কয়েকজন আমার কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও পড়াশোনার বিষয় হিসেবে চারুকলাকে বেছে নিয়েছে, এর চেয়ে একজন মানুষের জীবনে আনন্দের আর কী হতে পারে!

সম্পর্কিত নিবন্ধ