বাগমারায় ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে ১৮ সমিতি উধাও, নিরুপায় দুই হাজারের বেশি গ্রাহক
Published: 19th, November 2025 GMT
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার একডালা গ্রামের খোদেজা বেগম (৫৬) বহু বছর ধরে মানুষের বাসায় কাজ করে ও হাঁস–মুরগি পালন করে চার লাখ টাকা জমিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল একটি পাকা ঘর করবেন, শেষ বয়সে শান্তিতে থাকবেন। কিন্তু চার লাখ টাকা দিয়ে ঘর হবে না, আরও কিছু লাগবে—এই ভেবে স্থানীয় একটি সমিতিতে টাকাগুলো আমানত হিসেবে রাখেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, মেয়াদ শেষে টাকাটা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু মেয়াদের আগেই ওই সমিতির লোকজন সব টাকাপয়সা নিয়ে গা ঢাকা দেন।
খোদেজা বেগমের মতো এমন আরও প্রায় ২ হাজার ৩০০ গ্রাহকের আমানতের প্রায় ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে বাগমারার ১৮টি সমিতি। মামলা, অভিযোগ, বিক্ষোভ মিছিল—সব চেষ্টা করেও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা।
শাহানাজ নামের স্থানীয় এক নারী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ও তাঁর স্বজনেরা মিলে ম্যাসেঞ্জার সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতিতে ৩৩ লাখ টাকা রেখেছিলেন। এর মধ্যে এক স্বজনের (চাচি) অবসরের টাকা আছে। আগে যে মুনাফা দিত, তা দিয়ে সংসার চলত। এখন মুনাফা বা আমানতের টাকা ফেরত না দিয়ে সমিতির কর্মকর্তারা উধাও হয়েছেন। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিলেও কাজ হয়নি।
উপজেলা সমবায় দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বাগমারায় বিভিন্ন সময় নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ৩০৩টি সমবায় সমিতিকে। কিন্তু গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফায় ৬৮টি সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০টি সমিতিকে কালোতালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
২০১৮ সালের পর থেকে সমিতির নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় এক শ্রেণির ব্যক্তি সুযোগ গ্রহণ করে আমানত সংগ্রহ করেন। উপজেলা সমবায় দপ্তরের সহকারী পরিদর্শক তাসনিমুল হক জানান, পাইলট প্রকল্প হিসেবে উপজেলা সমবায় দপ্তর থেকে ২০১৯ সালে সমিতির নিবন্ধন দেওয়া হয়। অনিয়মের অভিযোগ আসা সমিতির অধিকাংশই সে সময় নিবন্ধন পায়। তবে দুই বছর পর নিবন্ধনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ওই পাইলট প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, এসব সমিতির লোকেরা শুরুতে বেশি মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করতেন। কেউ বাৎসরিক, কেউ মাসিক, কেউ ত্রৈমাসিক মুনাফা দেওয়ার কথা বলতেন। আবার কোনো কোনো সমিতি পাঁচ বছরে দ্বিগুণ মুনাফার প্রলোভন দিত। মাসে প্রতি লাখে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা এবং বছরে প্রতি লাখে ২০ হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেকেই আমানত রাখেন। কৃষক, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, শ্রমিক—সব শ্রেণির মানুষ তাঁদের সঞ্চয় জমা দেন এসব সমিতিতে। গ্রাহকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব সমিতি ২৮ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত আমানত নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে।
গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুতে নিয়মিত মুনাফা দেওয়া হলেও চলতি বছর থেকে সমিতিগুলো টালবাহানা শুরু করে। এরপর একে একে ১৮টি সমিতির পরিচালকেরা অফিস গুটিয়ে উধাও হয়ে যান। এখনো সাইনবোর্ড ঝুললেও নেই কোনো কর্মী, নেই টাকা ফেরতের আশ্বাসও। এসব সমিতির মধ্যে আছে আত তিজারা, আলোর বাংলা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতি, আল–বায়া সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিমিটেড, তোরা ফাউন্ডেশন, মোহনা সমাজকল্যাণ সংস্থা, স্বচ্ছতা গ্রাম উন্নয়ন সমিতি, আঁত তাবারা শিক্ষক কল্যাণ সমিতি, আল আকসা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতি, আমেনা ফাউন্ডেশন, নদী সঞ্চয় ঋণদান সমিতি, চানপাড়া সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, সাফল্য গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা, সোনালী সকাল ঋণদান সমিতি, সালেমা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতি, ম্যাসেঞ্জার সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি, জনপ্রিয় সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি, গোল্ডেন স্টার সমিতি, অগ্রণী সমবায় সমিতি ও স্বনির্ভর সঞ্চয় ঋণদান সমিতি।
আলোর বাংলা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির গ্রাহক কমিটির সভাপতি মজনুর রহমান জানান, এই সমিতির তিনটি শাখা থেকে পরিচালক ৪৫০ গ্রাহকের ২৩ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন বলে তাঁদের কাছে তথ্য আছে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা বীরেন্দ্রনাথ সরকার জানান, তিনি মোহনা নামের একটি সমিতিতে ৯ লাখ টাকা রেখেছিলেন। টাকা ফেরত না পাওয়ায় প্রায় ২০ গ্রাহক মিলে মামলা করেছেন। পরিচালক মুরাদ হোসেন গ্রেপ্তার হলেও জামিন নিয়ে পরে লাপাত্তা হয়েছেন।
আল–বায়া সমিতির আমানতকারীদের নেতা ভবানীগঞ্জের বাসিন্দা মাহাবুর রহমান বলেন, তিনিসহ ৭০ গ্রাহক প্রায় চার কোটি টাকা আমানত রেখেছিলেন। আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে তিনিসহ ২০ জন মিলে মামলা করেছেন। পুলিশ সমিতির দুই পরিচালককে গ্রেপ্তার করেছে।
অবসরপ্রাপ্ত চার চাকরিজীবী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ৭৬ লাখ টাকা আমানত আছে দুই সমিতিতে। সমিতির কর্মকর্তারা এখন গায়েব। খুবই কষ্টে আছেন বলে জানান।
রইচ উদ্দিন নামের এক দলিল লেখক বলেন, তিনি আঁত তাবারা নামের একটি সমিতিতে ১০ লাখ টাকা আমানত রেখেছিলেন। এক মাস আগে সমিতির পরিচালক তাঁরসহ ২০০ জনের আমানতের প্রায় ২৮ কোটি টাকা নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন। এর প্রতিবাদে ও টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারি কর্মচারী বলেন, তিনি আঁত তিজারা সমিতিতে ১০ লাখ টাকা আমানত রেখেছেন। এখন মুনাফা দিচ্ছে না, আমানতের টাকা চাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবার ও নিজের চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কলেজশিক্ষক বলেন, ২০ লাখ টাকা আমানত রেখে প্রতি মাসে মুনাফা নিয়ে ভালোভাবে সংসার চালাতেন। সাত মাস ধরে কোনো মুনাফা পাননি। এখন ওই সমিতির পরিচালক কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলেছেন। লোভে পড়ে সারা জীবনের সঞ্চয় সমিতিতে রেখে এখন নিঃস্ব হয়েছেন।
পালিয়ে থাকা চার পরিচালকের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তাঁরা স্বীকার করেন, আমানত নিজেদের কাছে আছে এবং ফেরত দিতে না পারার কথা জানান। আলোর বাংলা ফাউন্ডেশনের আজিজুল হক বলেন, ‘মাঠে কিছু টাকা আছে এবং সম্পদ আছে। একটু সময় দিলে ফেরত দেওয়া হবে।’ সুমন আহম্মেদ নামের আরেক পরিচালকও একই কথা বলেন। কারাবন্দী এক পরিচালক আক্কাছ আলী গ্রেপ্তারের আগে এবং আত্মগোপনে থাকা মুরাদ হোসেন নামের এক পরিচালক বলেন, গ্রাহকের টাকায় ব্যবসা করে লোকসান হয়েছে।
সমবায় দপ্তর এসব প্রতারণা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে কি না, এ প্রশ্নে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা কাউসার আলী বলেন, পরিচালকদের দেওয়া তথ্যে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি হয়। সমিতিগুলো কৌশলে একাধিক সংস্থা থেকে অনুমতি নিয়ে আমানত সংগ্রহ করেছে।
বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এসব ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে। প্রতিনিয়তই অভিযোগ আসে।
বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এসব সমিতির আমানত গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সমবায় নীতি মানা হয়নি। আইনগত বিষয় দেখে সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবসরপ র প ত গ র হকদ র কর মকর ত ন ম র এক গ র হক র ক বল ন ব গম র ত র কর উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
শততম টেস্টের মঞ্চে মুশফিকুরকে সম্মানজনক সংবর্ধনা
২৬০৭ তম টেস্ট চলছে মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশের ১৫৬তম। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বয়স ২৫ পেরিয়েছে। লম্বা পথ পেরোনোর পর বাংলাদেশ পেল টেস্ট ক্রিকেটের একশতম খেলোয়াড়। মুশফিকুর রহিম প্রথম বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে পেলেন হানড্রেড টেস্ট খেলার সুযোগ। যে সুযোগটি তিনি পেয়েছেন অজস্র পরিশ্রম, নিবেদন, তাড়না দেখিয়ে। ২২ গজে পরিশ্রমের ফুল ফুটিয়ে, সততা ও নিষ্ঠার আলো ছড়িয়ে নিজেকে পাহাড়শৃঙ্গের শেপরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তার মাইলফলক ছোঁয়া দিনটি রাঙিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সম্মানজনক সংবর্ধনায় তাকে দিয়েছে বিরাট সম্মান। বিরাট এই দিনে মুশফিকুর পাশে পেয়েছেন তার বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানদের। ছুটে এসেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। এছাড়া বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, তার প্রথম টেস্ট অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন, ২০০৫ সালে প্রথম টেস্টের সতীর্থরা ছিলেন মাঠে।
আরো পড়ুন:
মুশফিকুরের ‘সেঞ্চুরির’ রঙে রাঙানো ক্যানভাস
মুশফিকুরের শততম টেস্ট: যেসব আয়োজন রেখেছে বিসিবি
শুরুতে তাকে বিশেষ টেস্ট ক্যাপ তুলে দেন হাবিবুল বাশার। যিনি ২০০৫ সালে লর্ডসে মুশফিকের হাতে প্রথম টেস্ট ক্যাপ তুলে দিয়েছিলেন। এরপর ক্যাপের বিশেষ কেসকেট প্রদান করেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার আকরাম খান। এরপর বিশেষ ক্রেস্ট তুলে দেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান ও বর্তমান বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সঙ্গে ছিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।
এরপর হাবিবুল বাশার এবং বর্তমান অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর অটোগ্রাফ দেওয়া জার্সি পেয়েছেন মুশফিকুর। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে নাজমুল বলেছেন, ‘‘আপনার মতো খেলতে চেয়েছি, ছোটবেলা থেকে আপনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। আশা করি আপনি এভাবেই খেলে যাবেন। যেভাবে আপনি মাঠে ও মাঠের বাইরে সবসময় পরিশ্রম করেন। সবাই আপনার পরিশ্রম ও পাগলামির কথা বলে। কিন্তু আপনি সবসময় দলের জন্য খেলেন, দলের কথা ভাবেন- নিজের ক্রিকেট খেলেন না। এটা আমাদের জন্য সবসময় অনুপ্রাণার, বিশেষত যাঁরা তরুণ ক্রিকেটার টেস্ট খেলতে চায়, তাঁদের জন্য। আমাদের সঙ্গে খেলায় আপনাকে ধন্যবাদ, আমি আশা করি আপনি খেলা চালিয়ে যাবেন।’’
মুশফিকুর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়েছিলেন মেয়েকে কোলে নিয়ে। মুখে চওড়া হাসি, বুক ভরা গর্ব নিয়ে মুশফিকুর বলেছেন, ‘‘আল্লাহকে ধন্যবাদ এমন দারুণ একটা সুযোগের জন্য। যাঁরা উপস্থিত আছেন আপনাদের সবাইকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমার পরিবারের সব সদস্য, বাবা–মাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। বিশেষত আমার স্ত্রীকে, যে অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আমার সতীর্থ, কোচ, বন্ধু ও সব ভক্তদেরও ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা জানাই। আমিও বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য একশ ভাগ দেব, যেমনটা সবসময় চেষ্টা করি। আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট দলকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই এখানে আসার জন্য।’’
এরপর ফটোসেশনে অংশ নেন সবাই। ২০০৫ সালে লর্ডস টেস্টে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে থাকা হাবিবুল, আনোয়ার হোসেন মনির, মোহাম্মদ রফিক, নাফিস ইকবাল, মোহাম্মদ আশরাফুল, খালেদ মাসুদ উপস্থিত ছিলেন মুশফিকুরের ঐতিহাসিক মঞ্চে। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে থাকা সমর্থকদের সঙ্গেও ছবি তোলেন। মুশফিকুরের এই মুহুর্তটা গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডে থেকে উপভোগ করেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের ক্রিকেটাররা।
ঢাকা/ইয়াসিন/আমিনুল