তৈরি পোশাক, ট্যানারি, ওষুধসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিকাঠামো এত দিন পাঁচ বছর পরপর নির্ধারণ হতো। এখন থেকে মজুরিকাঠামো তিন বছর অন্তর পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তিন বছর পরপর বিভিন্ন শিল্প খাতের শ্রমিকের মজুরি বাড়বে। সংশোধিত শ্রম আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছে।
সংশোধিত এই আইনে, শ্রমিকের সংজ্ঞা স্পষ্ট করার পাশাপাশি মহিলা শব্দের পরিবর্তে নারী শব্দ প্রতিস্থাপন, ২০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার বিধান, প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন শ্রমিক থাকলে ভবিষ্য তহবিল বাধ্যতামূলক, মাতৃত্বকালীন ছুটি ১১২ দিন থেকে বাড়িয়ে ১২০ দিন, বার্ষিক উৎসব ছুটি ১১ দিন থেকে বাড়িয়ে ১৩ দিন করাসহ বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জাতীয় ও খাতভিত্তিক ত্রিপক্ষীয় পরিষদ গঠন, জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ছাড়া কোন কোন আচরণ যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হবে সেগুলোও আইনে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, রাজনৈতিক মতামত, জাতীয়তা, সামাজিক অবস্থান, বংশ বা প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো ব্যক্তিকে আলাদা করা, বাদ দেওয়া বা কম গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত রয়েছে আইনে।
সরকার গত সোমবার রাতে শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করেছে। গত ২৩ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই আইন সংশোধনের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। এর আগে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) সভায় কোন কোন বিষয়ে সংশোধন হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য হয়।
সংশোধিত শ্রম আইন নিয়ে শ্রমিকনেতারা সন্তোষ প্রকাশ করলেও শিল্পমালিকেরা কয়েকটি বিধান নিয়ে ক্ষুব্ধ। তাঁদের দাবি, শ্রমিকের সংজ্ঞায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে আসায় বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। ইউনিয়ন নিবন্ধনে শ্রমিকের সম্মতির সংখ্যা এবং ভবিষ্য তহবিল নিয়ে টিসিসি সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত রাখা হয়নি।
জানতে চাইলে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। আইনটি শ্রমিকবান্ধব হলেও মালিকপক্ষের শঙ্কার কোনো কারণ নেই। এটি বাস্তবায়নে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার দাবি করেছিলাম। সেটি হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতে মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো হবে।’
* ১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলেই ভবিষ্য তহবিল করা বাধ্যতামূলক।* শ্রমিকদের কালোতালিকাভুক্ত করার বিষয়টি নিষেধ করা হয়েছে।
* শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এত দিন কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগত। এখন থেকে শতকরা হারটি থাকছে না, ন্যূনতম ২০ জনের সম্মতি থাকলেই ইউনিয়ন করা যাবে। মূলত ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনে কারখানার মোট শ্রমিকসংখ্যার বিপরীতে কতজনের সম্মতি লাগবে, সেটি বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানে ২০ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক থাকলে ট্রেড ইউনিয়ন করতে ২০ জনের সম্মতি লাগবে। এ ছাড়া ৩০১ থেকে ৫০০ শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪০ জন, ৫০১ থেকে ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০০ জন, ১ হাজার ৫০১ থেকে ৩ হাজার শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩০০ জন এবং ৩ হাজার ১ থেকে এর বেশি শ্রমিক থাকলে ৪০০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যাবে। একটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পাঁচটির বেশি ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে না। এত দিন সর্বোচ্চ তিনটি করা যেত।
এত দিন শ্রম আইনে শ্রমিকদের সুবিধার জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠনের কথা বলা থাকলেও তা বাধ্যতামূলক ছিল না। তবে এবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলেই মালিকপক্ষকে কর্মীদের জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠন করতে হবে। তবে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রগতিতে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করলে ভবিষ্য তহবিল করা থেকে অব্যাহতি পাবে মালিকপক্ষ। সে ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মালিক ৫০ শতাংশ ও শ্রমিক ৫০ শতাংশ চাঁদা দেবেন।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, টিসিসির বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখান থেকে সরে গিয়ে সরকার অন্য কারও স্বার্থে বা কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শ্রম আইন সংশোধন করেছে। এতে শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শ্রমিক অসন্তোষ বাড়বে। শ্রম আইন সংশোধনে আগামী মার্চ পর্যন্ত সময় থাকলেও তড়িঘড়ি করে কেন এমন করল, সেটি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
অতীতে দেখা গেছে, মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হতেন শ্রমিকেরা। আন্দোলন ঠেকাতে শিল্পমালিকেরা অনেক সময় শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি তাঁদের কালোতালিকাভুক্ত করতেন। তখন শ্রমিকদের নতুন কারখানায় চাকরি পাওয়া কঠিন হতো। সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রমিকদের কালোতালিকাভুক্ত করার বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া মালিক বা মালিকদের সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে শ্রমিক সংগঠন গঠনে উৎসাহ দেওয়া যাবে না। পক্ষপাতমূলকভাবে বিদ্যমান ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের বরখাস্ত এবং অন্য ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করা যাবে না।
জানতে চাইলে শ্রমিকনেতা বাবুল আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম আইনের সুফল শ্রমিকের কাছে পৌঁছাতে হলে বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজ করার কারণে সামনের দিনগুলোতে ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন বাড়বে। এর জন্য শ্রম দপ্তরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ব ষয়ট দ ধ কর এত দ ন র জন য সরক র কপক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
কপ ঘিরে নানা দুর্বলতা, সংস্কারের আহ্বান
ব্রাজিলের বেলেমে এবারের কপ সম্মেলন ঘিরে মৌলিক একটি প্রশ্ন সামনে আসছে। সেটি হলো, প্রতিবছর জাতিসংঘের এই জলবায়ু সম্মেলন আসলে কী কারণে আয়োজন করা হয়?
৩০ বছর ধরে কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই সময়ে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বৈশ্বিক পদক্ষেপ কিছুটা অগ্রগতি এনেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণ হয়েছে। জলবায়ু তহবিল বেড়েছে। তবে এগুলো যথেষ্ট নয়। এত আয়োজন, এত আলাপ–আলোচনার পরও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বাড়ছে। এর জেরে স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা।
এমন পরিস্থিতিতে কপ সংস্কারের দাবি জোরালো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ৩০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কূটনৈতিক, জাতিসংঘের সাবেক মধ্যস্থতাকারী, বিভিন্ন সরকারে মন্ত্রী ও অধিকারকর্মীরা। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কপের হালনাগাদ করার প্রয়োজন রয়েছে।
যেমন পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ইউরোপীয় একজন মধ্যস্থতাকারী বলেন, কপ সম্মেলনগুলো মেলার মতো হয়ে পড়েছে। এখানে শুধু আলোচনাই হয়। এই অবস্থা থেকে সরে গিয়ে লক্ষ্য বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। ইউরোপীয় এই মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে অনেকেই একমত হলেও, সংস্কারটি কেমন হবে, তা নিয়ে অনেকের দ্বিমত রয়েছে।
কারণ, বর্তমান সময়টাকে সংস্কারের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না অনেকেই। পেরুর আবহাওয়া মন্ত্রী মানুয়েল পুলগার ভিদালের মতে, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে জলবায়ুবিরোধী রাজনীতির উত্থান হয়েছে। বিভিন্ন দেশে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন নীতি দুর্বল করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। এসব পরিস্থিতিতে কপে বড় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলে উল্টো ক্ষতি হতে পারে।
এ ছাড়া কপে যাঁরা পরিবর্তন চান, তাঁদের বড় হতাশা হলো, এই সম্মেলনে প্রায় ২০০ দেশের পূর্ণ ঐকমত্য ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রস্তাবগুলো বহুবার আটকে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে, কপ২৬-এ ‘কয়লা ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা’ নিয়ে আপত্তি তোলে ভারত। ফলে শেষ মুহূর্তে ‘পর্যায়ক্রমে কয়লার ব্যবহার কমানোর’ সিদ্ধান্ত হয়।
এ ক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে, কপে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু সেটি চালু করতেও প্রথমে সব দেশের পূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন, যা বড় একটি বাধা। কিছু সরকার প্রস্তাব করেছে, কপ যেন দুই বছর পরপর হয়। তবে ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সভাপতির বিশেষ উপদেষ্টা অবিনাশ প্রসাদ বলেন, দুই বছর পরপর কপ হলে তা গতি হারাতে পারে।
জাতিসংঘ নিজেও কপের পরিবর্তন চায়। জাতিসংঘ জলবায়ুবিষয়ক সচিবালয়ের প্রধান সাইমন স্টিয়েল একটি ১৫ সদস্যের দল গঠন করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক বিশ্বনেতা, কূটনীতিক, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও আদিবাসী প্রতিনিধিরা। তাঁরা আগামী দশকে কপকে কীভাবে আরও কার্যকর করা যায়, এ বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। স্টিয়েল বলেন, ‘নতুন যুগে আমাদের পরিবর্তিত ও উন্নত হতে হবে।’
নানা জটিলতা ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে হতাশা প্রকাশ করেছে এবারের কপ৩০–এর আয়োজন দেশ ব্রাজিলও। দেশটি বলেছে, নতুন প্রতিশ্রুতি নয়, বরং পুরোনোগুলো বাস্তবায়নে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এমন পরিস্থিতিতে এবারের কপে একটি প্রস্তাব করা হয়েছে। তা হলো, বিশ্বের জলবায়ু কূটনীতি যেন আলোচনাকেন্দ্রিক থেকে বাস্তবায়নকেন্দ্রিক করা যায়। এখন দেখার পালা, এই প্রস্তাব কতটা সফল হয়।