আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে এআইয়ের অপব্যবহারও এখন চ্যালেঞ্জ
Published: 6th, October 2025 GMT
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহারকে মূল চ্যালেঞ্জ মনে করছে নির্বাচন কমিশন। সাংবিধানিক এই সংস্থা মনে করে, ইন্টারনেট বন্ধ করে কিংবা গতি কমিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। অন্যদিকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো না গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
আজ সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে পৃথক সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দুই ধাপে এই সংলাপ হয়। সকালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এবং বিকেলে প্রিন্ট মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা সংলাপে অংশ নেন। নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকেরা তাঁদের বিভিন্ন পরামর্শ ও প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনী হলফনামা, পর্যবেক্ষক সংস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে।
দুই ধাপের সংলাপের (সকালে ও বিকেলে) শুরুতে বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘আমরা একদম স্বচ্ছভাবে আয়নার মতো পরিষ্কার করে এই ইলেকশনটা করতে চাই। এ ক্ষেত্রে আপনাদের (সাংবাদিকদের) সহযোগিতাটা খুবই দরকার হবে।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ইসির কার্যক্রমকে সহজ করে, এমনটি উল্লেখ করে সিইসি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সঠিক হলে কমিশন সেই তথ্যের আলোকে পদক্ষেপ নেয়। তিনি বলেন, নির্বাচন ভালো না হওয়া ছাড়া সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও জাতির জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। সবাই মিলে নির্বাচনটা করতে হবে।
সিইসি বলেন, সম্প্রতি কানাডার হাইকমিশনারের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহারের বিষয়ে তাঁর কাছে সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কানাডার হাইকমিশনার অপারগতা প্রকাশ করে তাঁকে বলেছেন, আইন করেও তাঁরা এআইয়ের অপব্যবহার বন্ধ করতে পারেননি।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ
ইসির সঙ্গে বিকেলের সংলাপে যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার বলেন, দেশে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। এমন অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বিদ্যমান পুলিশ প্রশাসন দিয়ে কীভাবে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে একই দিনে সারা দেশে নির্বাচন পরিচালনা করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ। তিনি একাধিক দিনে নির্বাচন পরিচালনা করার পরামর্শ দেন।
একাধিক দিনে সংসদ নির্বাচন করার পরামর্শ দেন দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আযম মীর শাহীদুল আহসানও।
নির্বাচনকালীন পেশিশক্তি ও কালোটাকার প্রভাবের বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, আরপিওতে প্রার্থীর আয়করের বিষয়ে যাচাই–বাছাই করার কথা বলা থাকলেও পূর্বের কমিশনগুলো তা এড়িয়ে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সবচেয়ে খারাপ মানুষগুলো আইনপ্রণেতা হয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করে জনমত যেন প্রভাবিত করা না হয়, সে বিষয়ে ইসিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের ভোটারদের নিয়ে কী চিন্তা
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলেও তাদের সমর্থক ভোটারদের বিষয়ে ইসির ভাবনা সম্পর্কে সংলাপে প্রশ্ন ওঠে। কালের কণ্ঠ সম্পাদক হাসান হাফিজ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেটা কার্যক্রম নিষিদ্ধ আছে, সেটার ব্যাপারে আপনাদের (ইসির) বক্তব্য আমরা জানতে চাই। না হলে তো এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আওয়ামী লীগের ভোটারদেরকে তো আপনি বাদ দিতে পারবেন না। তারা তো দেশের নাগরিক। তারা যদিও অনুশোচনা করে নাই, এখন পর্যন্ত প্রায়শ্চিত্ত করে নাই, অনুতপ্ত হয় নাই। কিন্তু তারপরেও তাদেরকে বাদ দিয়ে তো নির্বাচনটা হতে পারে না।’
তবে একটি দল নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না—এমনটি মনে করেন না প্রতিদিনের বাংলাদেশ সম্পাদক মারুফ কামাল খান। তিনি বলেন, একটি দল তাদের অতীত অপকর্মের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এটা চ্যালেঞ্জ যে তাদের সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে আসবেন কি না। তবে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং মানুষকে উৎসাহিত করা গেলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে।
খবরের কাগজ সম্পাদক মোস্তফা কামাল মনে করেন, উৎসবমুখর নির্বাচনের উৎসব অর্ধেক মানুষকে বাইরে রেখে হতে পারে না। তাদেরকে কীভাবে আনা যাবে, বিচারপ্রক্রিয়া কত দ্রুত করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।
রোষানলে পড়তে হয় সাংবাদিকদের
আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা থাকলেও বিদেশে থাকা বাংলাদেশের মিশনগুলোর সক্ষমতা ও কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা কতটা আছে, তা নিয়ে সংলাপে প্রশ্ন তোলেন চ্যানেল আইয়ের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান।
একাত্তর টিভির হেড অব নিউজ শফিক আহমেদ বলেন, নির্বাচনের আগে–পরে জয়ী ও হেরে যাওয়া সব পক্ষের রোষানলে পড়তে হয় সাংবাদিকদের। তাই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইসির ভূমিকা থাকা উচিত।
যমুনা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সময় সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে, সেটা পরিষ্কার নয়। কারণ, নির্বাচনের পরে তারা আবার দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে।
ভালো নির্বাচনের জন্য
দুই ধাপের সংলাপ শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.
এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিগত নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শক্তিশালী অবস্থানে থেকে খারাপ নির্বাচনের জন্য কাজ করেছিলেন। এবার তাঁরা অতটা শক্তিশালী অবস্থানে নেই। তবে কাজ করবেন ভালো নির্বাচনের জন্য। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নির্বাচনকেন্দ্রে রোভার স্কাউটদেরও যুক্ত করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
ইসির সঙ্গে দুই ধাপের সংলাপে অংশ নেন আজকের পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কামরুল হাসান, বাসসের প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক এ এস এম জাহীদ, ইউএনবির সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, দৈনিক আমার দেশ–এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক লোটন একরাম প্রমুখ।
আরও পড়ুনকার্যক্রম নিষিদ্ধ আ.লীগের ভোটারদের নিয়ে কী ভাবছে ইসি৩ ঘণ্টা আগেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র অপব যবহ র পর স থ ত র জন য প রক শ পর চ ল
এছাড়াও পড়ুন:
এক বছরেও গ্রেপ্তার না হওয়া হতাশাজনক
গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় নেতা-কর্মীরাও হত্যাযজ্ঞে অংশ নেন। তাঁদের গুলিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের নানা জেলায় নিহত হন অনেক মানুষ। আহতের সংখ্যাও বিপুল। দুঃখজনক হচ্ছে, গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও অস্ত্রধারী দলীয় এসব সন্ত্রাসী এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। এর মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম ব্যর্থতা প্রকাশ পাচ্ছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও ফেনী জেলার সেই অধরা অস্ত্রধারীদের নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন দেশের রাজনৈতিক পটভূমি পাল্টাল, তখন ফেনী ও চট্টগ্রামের রাজপথে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের বিচার ছিল জেলা দুটির মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা। এক বছর পেরোলেও সেই প্রত্যাশা পূরণের চিত্র হতাশাজনক। ফেনীর মহিপালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গুলিতে নিহত ওয়াকিল আহমেদ শিহাবের মতো স্বপ্নবান তরুণদের পরিবারগুলো এখনো ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে। শিহাবের মা মাহফুজা আক্তারের প্রশ্ন সরল, ‘গুলি চালানো চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা কোথায়?’
ফেনীতে আন্দোলনের সময় গুলি ছুড়েছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর অনুগত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মহিপালে শিহাবসহ মোট সাতজন ছাত্র-জনতা প্রাণ হারান। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে হামলায় অংশ নেওয়া অন্তত ৩০ জনের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হলেও, নিজাম হাজারীসহ শীর্ষ নেতাদের কেউই গ্রেপ্তার হননি। একই চিত্র চট্টগ্রামেও। নগরীর মুরাদপুর, বহদ্দারহাট ও নিউমার্কেট এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি চালানো ২৭ জন চিহ্নিত অস্ত্রধারীর অধিকাংশই এখনো অধরা। তাঁরা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এবং প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
এ ঘটনার সবচেয়ে বড় রহস্য হলো ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। নিজাম হাজারীর ক্যাডারদের হাতে এম-১৬ রাইফেলের মতো যুদ্ধাস্ত্র থাকার প্রচার থাকলেও, ফেনী বা চট্টগ্রাম কোথাও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রের উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্ধার হয়নি। ফেনীর পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ‘অস্ত্র ফেনীতে আছে বলে মনে হয় না।’ এই ব্যর্থতা কেবল পুলিশি তদন্তের দুর্বলতাই নয়, বরং একটি শক্তিশালী অপরাধী নেটওয়ার্কের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়, যা প্রমাণ লোপাট করতে সক্ষম।
ফেনীর প্রধান অভিযুক্ত নিজাম উদ্দিন হাজারী বর্তমানে সাইপ্রাসে পালিয়ে গেছেন। তাঁর সহযোগী স্বপন মিয়াজিসহ অন্য শীর্ষ নেতারাও ভারত বা মধ্যপ্রাচ্যে আত্মগোপন করে আছেন। পলাতক থাকা সত্ত্বেও এই নেতারা নিষ্ক্রিয় নন; বরং তঁারা বিদেশ থেকে ভিডিও কল ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে ফেনীর রাজনীতিতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। দলীয় কর্মীদের প্রতি মাসে অর্থ অনুদান দেওয়ার খবর প্রমাণ করে যে তাঁদের অর্থ ও প্রভাবের ভিত্তি এখনো মজবুত। অন্যদিকে মামলায় নাম থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালী নেতা-কর্মীরাই গ্রেপ্তার হচ্ছেন। যঁাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, এমন তৃণমূলের কর্মীরাও একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। মামলা ছাড়া এভাবে গ্রেপ্তার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আমরা আশা করব ব্যর্থতার দাগ মুছে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সব বাহিনী দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। এটি শুধু ন্যায়বিচারের প্রশ্নই নয়, আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পলাতক অস্ত্রধারীদের যেভাবেই হোক গ্রেপ্তার করতে হবে। শীর্ষ পলাতক আসামিদের আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত গ্রেপ্তার ও প্রত্যর্পণ নিশ্চিত করতে হবে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের উৎস ও অবস্থান খুঁজে বের করে অস্ত্র উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মামলাগুলোর তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।