ইচ্ছে ছিল তোমার নামে একটা বিড়াল পুষব। আমাকে ইলিশ মাছ ভাজতে দেখলেই যে লাফিয়ে রান্নাঘরে ঢুকবে। এরপর পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকবে, মাঝেমধ্যে ম্যা ম্যা...শব্দ করে এক টুকরা মাছের আশায় করুণ দৃষ্টিতে তাকাবে। আমি ‘ছোঁচা’ বলে সম্বোধন করে ওর নরম শরীরে পায়ের আঙুলগুলো ঢুকিয়ে দেব। ও শরীর আরও নরম করে আমার পা পেঁচিয়ে ধরতে চাইবে। আমার প্রতি ভক্তি দেখে মাছের চওড়া পেটির একটা টুকরা ছুড়ে দেব ওর দিকে। ছুড়েই দেব, খাবার ছুড়ে না দিলে প্রভুভক্তি ভাবটা ঠিকঠাক ধরে রাখা যায় না। আজাদ আমার দিকে জিনিসপত্র এমন ছুড়ে–ছুড়েই দেয়।
আজাদের জন্যই তোমার নামে একটা বিড়াল পোষা হলো না আমার। রাস্তার ছন্নছাড়া কুকুর–বিড়াল দেখলেই যে খুঁচিয়ে মারতে যায়, তার সংসারে কি আর পোষা প্রাণী রাখা যায়? তবু বাসায় ইলিশ মাছ আনলেই আমার একটা বিড়ালের জন্য আফসোস হয়। আর আফসোস হলে অনিবার্যভাবে তোমার কথা মনে পড়ে।
বাবা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে না দেওয়ার প্রথম যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছিল, যে ছেলে বিয়ের পর মাসে–দুই মাসে আমাকে ইলিশ মাছ খাওয়ানোর যোগ্যতা রাখে না, তাকে বিয়ে করা যাবে না।বাবা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে না দেওয়ার প্রথম যুক্তি হিসেবে দেখিয়েছিল, যে ছেলে বিয়ের পর মাসে–দুই মাসে আমাকে ইলিশ মাছ খাওয়ানোর যোগ্যতা রাখে না, তাকে বিয়ে করা যাবে না। আমি তখন বাবার আদুরে মেয়ে, বাসায় ইলিশ এলে দুই–তিন টুকরা মাছ একবসায়ই খেয়ে ফেলি, মাছের তিরিশ কাঁটা বাছতে বাছতে ভাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে গুনগুন করি, ‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, আবাহনী ভিক্ষা করে মোহামেডানের বাড়ি’। আমার গুনগুন শুনে ভাই তেড়ে উঠে বলে, ‘হয় নাই.
ইলিশ মাছ দূরের কথা, তখন স্ত্রীকে তেলাপিয়া, পুঁটি খাওয়ানোর সামর্থ্যও তোমার হয়নি। আমিও বিয়ে করিনি তোমাকে। আজাদকে বিয়ে করেছি এক বছর তিন মাস সাত দিন হয়ে গেল। বিয়ের পর থেকেই নিজের সংসারে ডজন ডজন ইলিশ মাছের আনাগোনা দেখছি। এই তো গেল মাসে কুয়াকাটা ‘তাজা মাছ’–এর স্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে ৩ হাজার ৫৫০ টাকা কেজি দরে ৮ হাজার ৮৫০ টাকায় আড়াই কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছ কিনেছিল আজাদ। আমি ইউটিউবে রেসিপি দেখে অনেক যত্ন করে ইলিশ–পোলাও রান্না করেছিলাম। রাজধানীতে বসে পাতে বঙ্গোপসাগরের মাছ তুলতে তুলতে ও আমাকে বলেছিল, ‘বাপের জন্মে এত বড় ইলিশ মাছ দেখেছ?’
আমাকে দেখাতেই অত বড় ইলিশ মাছ ঘরে এনেছে আজাদ। স্বামী সৌভাগ্যে গরবিনী আমি বাপের জন্মে সত্যি এত বড় মাছ দেখিনি। আমার স্বামীর জন্মে দেখা ইলিশেরা হরিণের সঙ্গে দৌড়ে বিজয়ী হওয়া ইলিশ, এরা বনেদি ঘরানার। এদের দেহ পুরুষদেহের মতো সুগঠিত, মজবুত। আর বাপের জন্মে দেখা ইলিশেরা ছিল নারীদেহের মতো নরম, কোমল, আবেদনময়ী। বৃষ্টির দিনে এই ইলিশের রূপ আরও খুলত।
বাবা বলত, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির দিনে সবচেয়ে রূপবতী ইলিশ ধরা পড়ে। এমন বৃষ্টির দিনে বাবা জোড়া ইলিশ এনে হইচই জুড়ে দিত, বলত, ‘পেটির টুকরাটা চওড়া করে কাটবে, ওইটা আমার শশী মা খাবে।’ বাজার থেকে কখনো ইলিশ মাছ কেটে আনত না বাবা। মা বলত, কার হাতে ইলিশ মাছ পড়েছে, কার হাতে মাছ টুকরা টুকরা হচ্ছে, তার দক্ষতার ওপর ইলিশের স্বাদ, রূপ দুই–ই নির্ভর করে।
এই তো গেল মাসে কুয়াকাটা ‘তাজা মাছ’–এর স্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে ৩ হাজার ৫৫০ টাকা কেজি দরে ৮ হাজার ৮৫০ টাকায় আড়াই কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছ কিনেছিল আজাদ।বাবা, মা আমাকে খুব ভালোবাসত। তাই মাসে–দুই মাসে যে আমাকে ইলিশ মাছ খাওয়ানোর যোগ্যতা রাখে না, তার সঙ্গে আমার বিয়ে দেয়নি। আজাদ আমার যোগ্য বর। আমাকে ও অঢেল দিয়েছে। পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে হীরার নাকফুল, আংটি, আসবাবপত্র—কোনো কিছু কিনে দিতেই আজাদ কার্পণ্য করে না। সপ্তাহের সাত দিনই টেবিলে মাছ-মাংস রাখার সামর্থ্য ওর আছে। আর ইলিশ নিয়ে যত রকম আভিজাত্য দেখানো যায়, সব রকমই ও দেখাতে পারে।
আজাদ বলে, ‘ইলিশ খানদানি মাছ। ফকিন্নিরা এই মাছ পাতে তোলার সামর্থ্য রাখে না।’ ফকিন্নি শব্দটা বলতে বলতে ও এমনভাবে আমার দিকে তাকায় যেন আমি হ্যাংলা, হাভাতে, দশ বাড়ি ঘুরে এসে দুটো ভাত-ডালের আশায় ওর দরজায় দাঁড়িয়ে ঠকঠকাচ্ছি। হাভাতে আমার দিকে না তাকিয়ে আজাদ পেটির টুকরা দুই আঙুলের মাঝখানে ফেলে নদীর ইলিশের স্বাদ বর্ণনা করে। এই যেমন, সমুদ্রের নোনাপানির ইলিশের স্বাদ কম। পদ্মা, মেঘনার ইলিশ স্বাদে অনন্য। নদীর ইলিশ চেনার কায়দাও আলাদা, ফকির-ফাকরা লোকেরা এসব চেনে না। এই ইলিশ চ্যাপটা আর গোলাকৃতির, গায়ের রং লালচে। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে নদীর ইলিশ পাতে তুলতে পারলে তো কথাই নেই...স্বাদ আর স্বাদ।
ওর কথা শুনতে শুনতে মনে হয়, কোনো ঠিকাদার না, মাছের একজন আড়তদার আমার সামনে বসে আছে। আচমকা নাকে আঁশটে গন্ধ লাগে। ঘরদোরও পলকে পাল্টে যায়, নিলামের হাঁকডাক, চাঙারির ওঠা-নামা, ব্যাপারীদের পান চিবানো ঠোঁটের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে আসা হায়-আফসোস, জেলেদের মাছের চোখের মতো ঘোলাটে দৃষ্টি—সব মিলিয়ে মাথাটা ঘুরে ওঠে।
আজাদকে কিছু বুঝতে না দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করি। খাওয়া শেষ করে আজাদ মিনিট পনেরো বারান্দায় সিগারেট হাতে পায়চারি করে। এরপর ঘরে ঢোকে। বিছানায় বসামাত্র ওকে জানাই, আমি গর্ভধারণ করেছি, আড়াই–তিন মাস হবে ভ্রূণের বয়স। এ সময় শরীরী বিষয় থেকে দূরে থাকা ভালো। ‘তুমি কি ডাক্তার’ বলে আমার উন্মুক্ত পেটে হাত রেখে আমার ভাঁজ খুলতে থাকে আজাদ। বিয়ের রাতেই ও আমাকে এভাবে ভাঁজে–ভাঁজে খুলেছিল। আমার আপত্তি কানে তোলার মতো অবস্থায় ছিল না, লোভনীয় ইলিশের টুকরা পাতে তুললে ওর চোখ জোড়া যেমন জ্বলজ্বল করতে দেখি, তেমন জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, ‘শশী... তোমার পেট ইলিশের মতো মসৃণ।’
লোভনীয় ইলিশের টুকরা পাতে তুললে ওর চোখ জোড়া যেমন জ্বলজ্বল করতে দেখি, তেমন জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, ‘শশী... তোমার পেট ইলিশের মতো মসৃণ।’আমার মসৃণ পেটে হাত রেখে প্রথম রাতের মতোই অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে সামনে–পিছনে এগিয়ে যায় আজাদ। সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার মানুষটার মুখ-চোয়াল এত কাছ থেকে এত দিন ধরে দেখেও অচেনা লাগে। ওর মুখে, শরীরে ইলিশ মাছের গন্ধ পাই। শরীর তোলপাড় করে আমার ইলিশপেটির ভেতরে থাকা সবকিছু বেরিয়ে আসতে চায়।
সব অস্বস্তি উপেক্ষা করে আজাদ আমাকে জালে জড়াতে থাকে। আমি আপাদমস্তক আটকে গেলে ও জাল টানতে টানতে আমাকে মাছের মতো ডাঙায় তোলে। তারপর গুনে গুনে তিরিশ কাঁটা বিদ্ধ করে। আমি নিচের ঠোঁট দাঁতে চেপে গুনগুন করি, ‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, মোহামেডান ভিক্ষা করে আবাহনীর বাড়ি...’
রাত গভীর হলে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে চোখে ঘুম নামে, ঘুম নামলে স্বপ্ন নামে। আজকাল ঘুম না, একটু তন্দ্রামতো হলেও ইলিশের স্বপ্ন চোখে জাঁকিয়ে বসে। রাতের ঘুম হলে তো কথাই নেই, চোখের গহ্বরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ লাফিয়ে পড়ে, যেন অঢেল জোছনা নেমেছে। এই গহ্বর পানিতে টইটম্বুর। স্বাদুপানি থেকে নোনাপানিতে একমুখী হয়ে সাঁতার কাটতে থাকা ইলিশ দেখতে দেখতে নাকে যখন আঁশটে গন্ধ ঝাপটা মারে, তখনই কারও ঝাঁঝালো কণ্ঠ শোনা যায়, ‘সকাল হয়ে গেছে তো!’ চোখ খুলতেই টের পাই, আঁশহীন শরীরজুড়ে লালচে ক্ষত ছড়িয়ে আছে। কোনোরকমে নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বাথরুমের দিকে ছুটি। একটু পর রান্নাঘরে ছুটতে হবে। বেশি কিছু রান্না করব না আজ। আজাদ বলেছে, বৃষ্টির দিনে শর্ষে ইলিশ আর ঝরঝরে খিচুড়ি হলে জমবে ভালো। ফ্রিজ থেকে নদীর চ্যাপটা, গোলাকৃতির একটা ইলিশ মাছ বের করে সিংকের মুখ বন্ধ করে পানিতে ডুবিয়ে রাখি। ডুবন্ত মাছটা ঘোলাটে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার গা গুলিয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায়, এক বছর তিন মাস সাত দিন হয়ে গেল আমি ইলিশ মাছ খাই না।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র দ ক র জন ম র ট কর র একট
এছাড়াও পড়ুন:
না না, আমি টিশার্ট পরি না
আগের পর্ব