১৯৯৪ সালে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে একটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর ‘জনজীবনে নৈতিক মানদণ্ড’ নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করেন। লর্ড নোলানের নেতৃত্বে গঠন করা সেই কমিটি তাদের প্রথম প্রতিবেদনে ‘জনজীবনের সাতটি নীতি’ উপস্থাপন করে, যা মূলত জনসেবায় যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নৈতিক দিকনির্দেশনা হিসেবে প্রণীত।

লর্ড নোলান এই নীতিগুলোকে জনজীবনে সততা, দায়িত্ববোধ ও স্বচ্ছতার ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরেন, যাতে জনসেবার কাজে যাঁরা সম্পৃক্ত, তাঁরা নিজেদের আচরণে এসব মূল্যবোধ ধারণ করতে পারেন। এই সাত নীতি যথাক্রমে সততা, নৈতিকতা, নিরপেক্ষতা, জবাবদিহি, নিঃস্বার্থতা, স্বচ্ছতা ও নেতৃত্ব। এগুলো এখন বিশ্বের বহু দেশের প্রশাসনিক নীতিশিক্ষার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় নোলান কমিটির এই নীতিগুলো নিয়ে আলোচনা শোনা গেছে। যুক্তরাজ্যের মতো যদিও এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে এই নীতিগুলো গ্রহণ করা হয়নি। এরপরও জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, তথ্য অধিকার আইন, দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের বিভিন্ন নীতিমালায় এগুলোর প্রভাব স্পষ্ট।

এসব নীতি আমাদের প্রশাসন/আমলাতন্ত্রে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ভিত্তি গঠনে সহায়ক হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে চিত্রটি ভিন্ন। আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, দলীয় আনুগত্যভিত্তিক নিয়োগ ও নৈতিক শিথিলতা প্রশাসনিক কাঠামোকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নোলান কমিটির সাতটি নীতির আলোকে বাংলাদেশের প্রশাসন পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, কীভাবে জনসেবামুখী প্রশাসন ধীরে ধীরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও স্বার্থান্বেষী ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে।

ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ও প্রশাসনিক সংস্কৃতি

বাংলাদেশের মূল প্রশাসনিক কাঠামো বা আমলাতন্ত্র হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু এই কাঠামো কতটা জনস্বার্থে নিবেদিত? নোলান কমিটির দেওয়া সরকারি দায়িত্বে নৈতিকতার সাতটি নীতি গ্রহণ করে বিশ্বজুড়ে অপরাপর দেশসমূহ সংস্কার ও পরিবর্তনের পথে হাঁটতে পারলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই নীতিগুলোর প্রতিফলন কতটা ঘটেছে?

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের শিকড় ঔপনিবেশিক আমলে প্রোথিত। ব্রিটিশ প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের সেবা নয়; বরং শাসন ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষমতা সংরক্ষণ। পাকিস্তান আমলেও সেই কেন্দ্রীকৃত ও কর্তৃত্বমূলক প্রশাসনিক ধারা অব্যাহত থাকে।

স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় কাঠামো বদলালেও প্রশাসনের মৌলিক চরিত্রে তেমন পরিবর্তন আসেনি। শাসক পরিবর্তিত হলেও শাসনের ধরন রয়ে গেছে প্রায় একই। ফলে জনসেবার চেতনা স্থান করে নিয়েছে ক্ষমতার আনুগত্য ও প্রভাবের রাজনীতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলীয় প্রভাব, আনুগত্যের বিনিময়ে পদোন্নতির সংস্কৃতি এবং ‘ফাইলনির্ভর’ প্রশাসনিক জটিলতা।

সততা ও নৈতিকতার কাঠামোগত অবমূল্যায়ন

নোলানের প্রথম দুটি নীতি—সততা ও নৈতিকতা; জনসেবায় ন্যায্যতা, দায়বদ্ধতা ও নৈতিক সাহসের প্রতীক। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশাসনিক বাস্তবতা এ নীতিগুলোর প্রায় বিপরীত চিত্র উপস্থাপন করে।

যেমন পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি কর্মজীবনে একাধিক রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও পদোন্নতি পেয়েছেন। সরকারি দায়িত্বে থেকে ব্যবসায়িক প্রভাব বিস্তার ও অবৈধ সম্পদ গঠনের অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও প্রশাসন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ২০২০-২১ সালে সততাসহ নানা গুণের কারণে তিনি রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পান।

অপর দিকে দুদকের কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করায় তাঁকে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। সম্প্রতি আদালত অবশ্য চাকরিচ্যুতি বেআইনি ঘোষণা করে তাঁকে পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এটি আমাদের প্রশাসনে সৎ কর্মকর্তাদের পরিণতির বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

এই দুই বিপরীত ঘটনা দেখায়, বাংলাদেশে সততা ও নৈতিকতা শুধু উপেক্ষিত নয়; বরং কাঠামোগতভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। দুর্নীতিবাজেরা পুরস্কৃত হন আর নৈতিক সাহস দেখানো কর্মকর্তারা শাস্তি পান। ফলে প্রশাসনে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে সততার চেয়ে আনুগত্য ও আপসকেই নিরাপদ পথ হিসেবে দেখা হয়।

নিরপেক্ষতার সংকট অথবা দলীয় আনুগত্যে পেশাদারত্বের অবক্ষয়

নোলানের তৃতীয় নীতি হলো নিরপেক্ষতা। অর্থাৎ দল–মতনির্বিশেষে যোগ্যতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া, যা বাংলাদেশের প্রশাসনিক বাস্তবতায় আজ বিলুপ্তপ্রায়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রশাসন ক্রমে একদলীয় আনুগত্যভিত্তিক কাঠামোয় পরিণত হয়, যেখানে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও সুবিধা নির্ধারিত হতো তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে।

বিশেষ করে ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনে অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করেছেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রার্থীদের সহায়তা দিয়েছেন—এমন অভিযোগ একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে। অন্যদিকে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী বা নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা বঞ্চনা, বদলি, এমনকি প্রশাসনিক নিপীড়নের মুখে পড়েছেন।

ফলে প্রশাসন ধীরে ধীরে একটি দলীয় আনুগত্যনির্ভর কাঠামোতে পরিণত হয়েছে, যেখানে পেশাগত দক্ষতা নয়; বরং রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতাই সাফল্যের পূর্বশর্তে পরিণত হয়েছে, যা নোলানের নিরপেক্ষতার নীতির পরিপন্থী।

জবাবদিহির ভাঙা কাঠামো ও সামষ্টিক বিপর্যয়

নোলানের চতুর্থ নীতি জবাবদিহি আজ বাংলাদেশের প্রশাসনিক বাস্তবতায় প্রায় অকার্যকর। অধিকাংশ তদারকি প্রতিষ্ঠানই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটে আবদ্ধ। ফলে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির ব্যবস্থা দিয়ে অসৎ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাহ্যিক তদারকি সংস্থা যেমন দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।

অপেক্ষাকৃত দুর্বল কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি বা মহলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। অন্যদিকে ন্যায়পালসহ স্বাধীন জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুপস্থিতি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতে আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতাকে আরও প্রকট করেছে। ফলে প্রশাসনে দায়বোধের পরিবর্তে বাধাহীন দুর্নীতির সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়েছে।

জনস্বার্থ নয়, ব্যক্তিস্বার্থই মুখ্য

নোলানের নীতিসমূহের অন্যতম নীতি হলো নিঃস্বার্থতা, অর্থাৎ সরকারি দায়িত্ব পালনে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থ যেন প্রভাব ফেলতে না পারে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশাসনে এই নীতি প্রায় অনুপস্থিত।

২০২৫ সালের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার ৫৫০ কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত বা ‘সুপারনিউমারারি’ পদে পদোন্নতি দেয়, যা অনুমোদিত শূন্য পদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। বিশ্লেষকদের মতে, এসব পদোন্নতির পেছনে যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক বড় ভূমিকা রেখেছে।

এতে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে এবং প্রশাসনিক দক্ষতা ও ন্যায্যতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায় নিজের অবস্থান রক্ষা, জনস্বার্থ নয়।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার জালে স্বচ্ছতা ও নেতৃত্বের সংকট

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে স্বচ্ছতা ও নেতৃত্ব—নোলান নীতির এই দুটি মৌলিক মূল্যবোধ এখন মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে। স্বচ্ছতার অর্থ হলো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত যেন খোলামেলা প্রক্রিয়ায়, জবাবদিহির মাধ্যমে গৃহীত হয় এবং জনস্বার্থে পরিচালিত হয়।

কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠপোষকতা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে অস্বচ্ছ করে তুলছে। ২০২৪ সালে কক্সবাজারের ভূমি অধিগ্রহণ দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত এক কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক হিসেবে নিয়োগের উদ্যোগ তার স্পষ্ট উদাহরণ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ ঘটনাকে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও নৈতিক নেতৃত্বের পরিপন্থী হিসেবে আখ্যা দেয়।

যখন অভিযোগে জড়িত ব্যক্তিরাও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন নেতৃত্বের নৈতিক মানদণ্ড ভেঙে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব মানে দায়িত্ব ও সততার প্রতীক হওয়ার পরিবর্তে ক্ষমতাবানদের আনুগত্য প্রদর্শনের উপায়ে পরিণত হয়। ফলে প্রশাসনে স্বচ্ছতা দুর্বল হয় এবং প্রকৃত নেতৃত্বের বদলে গোষ্ঠীনির্ভর আনুগত্যের সংস্কৃতি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন নাগরিকদের প্রশাসনিক তথ্য জানার সাংবিধানিক অধিকার দিলেও বেশির ভাগ দপ্তর এখনো গোপনীয়তাকে একটি ‘প্রতিরক্ষামূলক দেয়াল’ হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে দেখা যায়, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও খরচের স্বচ্ছতা যেখানে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হওয়া উচিত, সেখানে ‘গোপনীয়তা’ নীতিকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক স্বার্থরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

কীভাবে পরিবর্তন সম্ভব

বাংলাদেশের প্রশাসনে নৈতিকতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে শুধু আইন বা নির্দেশনা নয়, প্রয়োজন বাস্তব ও কাঠামোগত পরিবর্তন।

প্রথমত, নৈতিকতা ও জনসেবা মনোভাবকে প্রশাসনিক প্রশিক্ষণের মূল ভিত্তি করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি) ও পাবলিক সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণগুলোতে আইন, নীতি ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেওয়া হলেও নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের চর্চা প্রায় অনুপস্থিত।

যুক্তরাজ্যে সিভিল সার্ভিসের প্রশিক্ষণে ‘এথিক্যাল লিডারশিপ’ বা নৈতিক নেতৃত্ব মডিউল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেখানে কর্মকর্তারা বাস্তব জীবনের নৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করেন। যেমন রাজনৈতিক চাপ এলে কীভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত বজায় রেখে তা থেকে উত্তরণ করা যায়। অনুরূপভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার অ্যান্টি করাপশন অ্যান্ড সিভিল রাইটস কমিশন (এসিআরসি) কর্মকর্তাদের জন্য নৈতিকতার ওপর নিয়মিত কর্মশালা আয়োজন করে সেখানে ব্যক্তিগত সততা, জনস্বার্থ রক্ষা ও নৈতিক নেতৃত্বকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখানো হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রবর্তন করা গেলে কর্মকর্তাদের মানসিকতা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করবে।

দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে। পদোন্নতি, বদলি ও মূল্যায়নে রাজনৈতিক প্রভাব দূর করে সততা, কর্মদক্ষতা ও নাগরিক সেবার মানদণ্ডে কর্মকর্তাদের বিচার করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুরের সিভিল সার্ভিসকে নেওয়া যেতে পারে। সেখানে কর্মকর্তাদের বেতন উচ্চ হলেও প্রতিটি সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়।

‘হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা আইন’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের নিরাপদভাবে অনিয়ম প্রকাশে উৎসাহিত করা যেতে পারে। যেমনটি হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। একই সঙ্গে ই-গভর্ন্যান্স ও ওপেন ডেটা প্ল্যাটফর্ম চালুর মাধ্যমে নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। ভারতের ‘আরটিআই অনলাইন’ বা এস্তোনিয়ার ই–গভর্নমেন্ট মডেল এর সফল উদাহরণ।

পরিশেষে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যদি নিজেদের আচরণে স্বচ্ছতা ও নৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তবে সেটি নিচের স্তরের কর্মচারীদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে। নৈতিক সংস্কৃতির এ রূপান্তর সময়সাপেক্ষ, কিন্তু এটি ছাড়া প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতার পুনর্গঠন সম্ভব নয়।

নৈতিকতার পথে ফেরা

বাংলাদেশের প্রশাসন ‘দক্ষ’, কিন্তু এই দক্ষতার প্রায় সবটুকু জনসেবার চেয়ে নির্দেশ পালনে বেশি ব্যবহৃত হয়। নোলানের সাতটি নীতি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জনসেবা মানে কেবল নির্দেশ মানা নয়; বরং বিবেকবান হওয়া। যদি ব্রিটিশ প্রশাসন নোলানের নীতিসমূহের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নিজেদের পুনর্গঠিত করতে পারে, তবে বাংলাদেশও পারবে। এ জন্য দরকার নৈতিক প্রশাসনিক কাঠামো। যেখানে ক্ষমতার চেয়ে সততা, আনুগত্যের চেয়ে দায়িত্ব এবং ভয়ের চেয়ে ন্যায়ের মূল্য বেশি হবে।

আমলাতন্ত্রকে জনসেবায় ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের কাগুজে নীতির চেয়ে বাস্তব আচরণ ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। নৈতিকতা আইন দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এটি গড়ে তুলতে হয় নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত, নাগরিকের দাবি ও প্রশাসনের আন্তরিকতার মাধ্যমে।

নুরুল হুদা সাকিব অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান স্বাধীন গবেষক ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

*মতামত লেখকদের নিজস্ব

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর মকর ত দ র কর মকর ত র এই ন ত গ ল র জন ত ক প জনস ব র থ ন ত কত র ক র যকর ব যবস থ ব স তবত ম নদণ ড য ক তর শ সন র আম দ র পর চ ল সরক র গ রহণ আমল ত ক ষমত র আমল

এছাড়াও পড়ুন:

নিজ দেশে ভ্রমণের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের আইন কী বলে

প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারো মানুষ রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এই আবেদন মঞ্জুর হলে সরকার প্রথমে পাঁচ বছরের জন্য সুরক্ষাভিত্তিক থাকার অনুমতি দেয়। এই মেয়াদ পূর্ণ হলে দেওয়া হয় ‘ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন (আইএলআর)’ বা স্থায়ী বসবাসের সুযোগ। এর অন্তত ১২ মাস পর যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। এখানে উতরে গেলে পাওয়া যায় ব্রিটিশ পাসপোর্ট। তখন ইচ্ছেমতো বিদেশ ভ্রমণ ও যুক্তরাজ্যে ফেরার অধিকার পান আশ্রয়প্রার্থী ওই ব্যক্তি।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক–এগারোর পটপরিবর্তনের পর গ্রেপ্তার হন এবং ২০০৮ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য সপরিবার যুক্তরাজ্যে যান। এর পর থেকে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন। তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পর রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন বলে জানা গেছে। তবে বর্তমানে তিনি কোন মর্যাদায় আছেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। তবে তিনি কোন প্রক্রিয়ায় ফিরবেন, সেটা জানা যায়নি।

যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া ব্যক্তি তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী বা ইচ্ছেমতো নিজ দেশে ফিরতে পারেন কি না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল ইংল্যান্ডের অভিবাসন ও মানবাধিকার আইনে বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া মানে আশ্রয়দাতা দেশে নিরাপত্তাহীনতা থেকে সুরক্ষা পাওয়া। তাই আইএলআর তথা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পরেও নিজ দেশে ফিরে গেলে যুক্তরাজ্য সরকার কর্তৃপক্ষ তথা হোম অফিস ধারণা করতে পারে যে নিজ দেশে ওই ব্যক্তির আর কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। এতে তার রিফিউজি স্ট্যাটাস ও আইএলআর দুটোই ঝুঁকিতে পড়ে।’

সাধারণ অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি (আইএলআর) পাওয়ার পর অন্য দেশে যাওয়া এবং আবার ফিরে আসার আইনগত অধিকার থাকে। তবে যুক্তরাজ্যের বাইরে টানা দুই বছরের বেশি অবস্থান করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইএলআর বাতিল হতে পারে। তখন আবার আসতে চাইলে পুনরায় ভিসা (রিটার্নিং রেসিডেন্ট) লাগে।

তবে আশ্রয়প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে এটা আরও বড় ঝুঁকি তৈরি করে বলে জানান লন্ডনে আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘নিজ দেশে ভ্রমণই আশ্রয়দাবির বিরোধী। কারণ, যে নিপীড়নের ভয় দেখিয়ে আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল, সেই দেশে যেতে পারলে যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্তৃপক্ষ মনে করতে পারে আশ্রয়ের প্রকৃত কারণ আর নেই। এতে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি (আইএলআর) বাতিলের পথও খুলে যায়। যদি ব্যক্তি যুক্তরাজ্যে থাকাকালে এটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়, তবে আপিলের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাইরে অবস্থানকালে বাতিল হলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। তখন যুক্তরাজ্যে ফিরে আসা সম্ভব না–ও হতে পারে।’

যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য হোম অফিস একটি বিশেষ ‘রিফিউজি ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ দেয়। এই নথি ব্যবহার করে আশ্রয়প্রাপ্তরা নিজ দেশ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশে ভ্রমণ করতে পারেন। তবে যে দেশে নির্যাতনের আশঙ্কার কথা বলে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, সেই দেশে এই ভ্রমণ নথি ব্যবহার করা যায় না।

যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রাপ্ত কোনো বাংলাদেশি যদি স্বদেশে যেতে চান, তাহলে তাঁকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বা বাংলাদেশ সরকারের ইস্যু করা ভ্রমণ পারমিট ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এতে গুরুতর আইনি ঝুঁকি তৈরি হয়। যুক্তরাজ্যের হোম অফিস এটি ধরে নিতে পারে যে আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আর নেই এবং সেই দেশে আর কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। এর ফল হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির রিফিউজি স্ট্যাটাস বা মানবিক সুরক্ষার মর্যাদা বাতিল হতে পারে। একই সঙ্গে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি হারানোর ঝুঁকিও দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি যুক্তরাজ্যে ফিরে আসতে না–ও পারেন এবং ফিরতে চাইলে নতুন ভিসা বা অন্যান্য আইনগত প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

নাগরিকত্ব ত্যাগের বিধান কী

যদি কোনো ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চান, তাহলে হোম অফিস বরাবর একটি আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে হয়। এই প্রক্রিয়া শেষ হতে সাধারণত দুই থেকে তিন মাস (৮–১২ সপ্তাহ) সময় লাগে। আবেদন মঞ্জুর হলে হোম অফিস একটি প্রমাণপত্র জারি করবে এবং ওই তারিখ থেকেই এটি কার্যকর হবে। নাগরিকত্ব ত্যাগের পর যুক্তরাজ্যে থাকতে চাইলেও বসবাসের অধিকার আর থাকবে না। এ ক্ষেত্রে নতুন ভিসা বা অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ